নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শ্রাবণ আহমেদ (নিরব)\nট্রেইনার অব \"উই আর স্টুডেন্টস\" ঢাকা।

শ্রাবণ আহমেদ

শ্রাবণ আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আনিকা তুমি এমন কেন

০৯ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৮

আনিকা তুমি এমন কেন
পর্ব-২ (শেষ পর্ব)
লেখক: Srabon Ahmed (অদৃশ্য ছায়া)
.
খানিকপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তার রুম থেকে বের হয়ে এলাম। দেখলাম বাইরে রুমকি দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাকে দেখে বললো, ভাইয়া অয়ন কোথায়?
আমি তাকে একদিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে নিজের রুমে চলে এলাম। কখনো আনিকাকে হারানোর কথা কল্পনাতেও ভাবিনি। শুধু ভেবেছি সে আমার মামাতো বোন। আম্মুকে কিংবা মামাকে যেমন করেই হোক ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু আজ আমার কাছে সবকিছু বিবর্ণ মনে হচ্ছে। আমি ইচ্ছে করলেই আম্মুকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলতে পারছি না। তারা কত হাসিখুশি রয়েছে। এর মধ্যে যদি আমি আনিকা আর আমার সম্পর্কের কথা বলি। তবে নির্ঘাত তাদের মনটা খারাপ হয়ে যাবে। সাথে দারুণ একটা কেলেংকারি হয়ে যেতে পারে।

রুমের সাথে বারান্দা নেই। এত রাতে ছাঁদে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। স্বাধীন ভাই বলেছিলেন স্মোক করলে কষ্ট কমে। স্বাধীন ভাই হলেন মেসের পাশের রুমের বড় ভাই। বর্তমানে আনোয়ার ইস্পাতে আছেন। মাস ছয়েক হলো বিয়ে করেছেন। প্রেমের বিয়ে। ফেসবুক প্রেম। কী অদ্ভুত তার প্রেমের কাহিনী! একদিন কী কারণে যেন তিনি আমাকে তার প্রেমের কাহিনীগুলো বলেছিলেন। তাকে কখনো সিগারেট খেতে দেখিনি। কিন্তু সেদিন দেখেছিলাম। প্রথম টান দিতেই প্রচুর কাঁশি হচ্ছিলো তার। হাজার ঝড় হয়ে গেলেও আমার সিগারেট খাওয়ার প্রতি কোনো ইচ্ছে নেই।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছাঁদে গেলাম। বেশ খানিকটা সময় রাতের অন্ধকারে সাথে আলাপ করলাম। আকাশে জ্যোৎস্না নেই। তারারাও লুকিয়ে ফেলেছে নিজেদের। নাকি তারা উঠেইনি আজ? ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। একটা সময় এই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে আনিকা আমাকে বলতো, শ্রাবণ ঝিঁঝিঁ পোকার এই ডাকগুলো দারুণ না?
উত্তরে আমি বলতাম, আমার এই ঝিঁঝিঁটার 'কথার' চেয়ে বেশি না।
মেয়েটা লজ্জা পেয়ে লাল বর্ণ ধারণ করতো। আমি অনিমেষ নেত্রে তার পানে চেয়ে থাকতাম। কিন্তু আজ! আজ আমি একলা একা ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছি। একা একা ঝিঁঝিঁর ডাক শুনছি। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমার আনিকা ছাঁদে আসবে। এসে বলবে, শ্রাবণ ঝিঁঝি পোকার ডাকগুলো সুন্দর না?
কিন্তু সে আসলো না। রাত গভীর হলে নিচে নেমে এলাম। রুমে ঢুকতে যাবো, ঠিক সেই সময় পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে ডাক দিলো। পেছনে ঘুরে দেখলাম আম্মু।
- কিরে এত রাতে ছাঁদে কী করছিলি?
- অনেকদিন গ্রামের এই রাতের পরিবেশটার সাথে আলাপ করা হয় না।
- তাই বলে এতরাতে?
- হুম।
- যা, ঘুমাতে যা।
- হুম।

সকল মা-ই তার সন্তানদের মনের কথা বোঝে। তাহলে আমার আম্মু কেন আমার মনের কথা বোঝে না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে? রুমে এসে আনিকার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোর কথা ভাবতে থাকলাম। যত ভাবছি, ততই চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আচ্ছা এই ভাবার সাথে চোখের জলের সম্পর্ক কী? নাকি তারা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারে না? হবে হয়তো! এই মুহুর্তে আনিকার সাথে কথা বলতে বড্ড ইচ্ছে করছে। তার ফোন নাম্বারও চেন্জ। ইচ্ছে করলেই কল করতে পারছি না। সামনের রুমেই রয়েছে সে। অথচ মনে হচ্ছে সে আমার থেকে লক্ষ যোজন দূরে।

সকাল হয়ে গিয়েছে। সারারাত ঘুম হয়নি। ভোর রাতেও ঘুম আসেনি। জেগেই আছি। উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। গতকালের মতো আজও চোখ দু'টো লাল হয়ে আছে। রুমেই বসে আছি। হঠাৎই আম্মু রুমের দরজায় নক করে বললো, নিরব উঠেছিস?
আম্মু আমাকে নিরব ডাকে। বাড়ির সবাই নিরব ডাকে। বড় মামা, বড় মামি, সবাই ডাকে। শুধু আনিকা শ্রাবণ ডাকে। তার নাকি শ্রাবণ নামটা বেশ ভালো লাগে।
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বললাম, হুম। কিছু বলবে?
- ছেলেপক্ষ জানিয়েছে করোনা না কী জানি এক রোগ বের হয়েছে। সেই জন্য তারা অল্পলোক আসবে।
- তো আমাকে বলছো কেন? আর বিয়ে তো আজ না।
- তোকে বলছি কারণ, বিয়ের সকল কাজ তোকে করতে হবে। তাদের আপ্যায়ন থেকে শুরে করে সব।
- পারবো না। আর অল্পলোককে তো তোমরাই খাওয়াতে পারো।
- রাতে ঘুমাসনি?
- কেন?
- চোখ লাল হয়ে আছে?
- ঘুমিয়েছি। সকালে হঠাৎ করেই চোখে কী যেন পড়লো!
- দুই চোখেই পড়েছে?
- হুম।
- মিথ্যেটাও গুছিয়ে বলতে পারিস না। আর কবে পারবি বল?
শুধু মিথ্যে নয় আম্মু। নিজের পছন্দের কথাগুলোও তোমাকে গুছিয়ে বলতে পারি না। অথচ দেখো, আব্বার চেয়ে তোমার সাথেই আমি বেশি ফ্রী।
- কিরে, কী ভাবিস?
- না, কিছু না।
- আনিকার জন্য শপিংয়ে যেতে হবে।
- যাও।
- তুইও যাবি।
- আমি কেন?
- তোর কিছু লাগলে নিবি।
- আমার কিছুই লাগবে না।
- না লাগলেও যেতে হবে। শহর বাজারে মেয়ে মানুষ একলা যায় নাকি? তুই সাথে থাকলে ভালো হবে।
- অয়নকে নিয়ে যেও।
- ও ছোট মানুষ। ও যেতে পারবে না।
- পারবো না আমি।
- রেডি হয়ে নে। খানিকপর বের হতে হবে।

আমি ড্রাইভারের পাশে বসেছি। ভেতরে আম্মু, আনিকা, মামি, অয়ন আর রুমকি। গাড়িতে উঠার সময় আনিকার চোখের দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিলো না। পরনে শাড়ি, কাজল নেই চোখে। তবুও কেমন যেন ঘোর লাগানো একটা চাহনি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি তাকিয়ে থাকতে পারিনি

মার্কেটি গিয়ে সবাই সবকিছু নিলো। বিপত্তি বাঁধলো আনিকার শাড়ি কিনতে গিয়ে। শেষে আম্মু আমাকে বললো, দেখতো কোন শাড়িটা নেওয়া যায়?
আমি আবার এসবে আনাড়ি। তবে মাঝে মাঝে যখন আনিকার সাথে মার্কেটে আসতাম। তখন তার জিনিসগুলো আমিই পছন্দ করে দিতাম। কিন্তু এর আগে শাড়ি কেনা হয়নি কখনো। সামনে একটা লাল শাড়ি ছিল। আমি বললাম, এটা নাও।
আম্মু দোকানদারকে শাড়িটা প্যাকেট করতে বললো। বিল দিতে গিয়ে আম্মু বললো, বিলটা দিয়ে আয়।
আমি বললাম, আমি কেন বিল দেবো?
- আসার সময় টাকা নিয়ে আসিনি।
- তাহলে মার্কেটে এসেছো কেন?
- এত কথা বাদ দিয়ে বিল দে।
- টাকা নেই আমার কাছে।
- কার্ডে আছে?
- হুম।
- তুলে দে।
অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে বিলটা দিতে হলো।

বাসায় ফিরে আনিকাকে একটু একা পেয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। বললাম, তাহলে সত্য সত্যই বিয়েটা করছো?
আনিকা অবলীলায় বলে দিলো, হুম।
- আনিকা, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
- থাকতে হবে।
- তুমি কি আদৌ আমাকে ভালোবেসেছিলে? নাকি....
- শ্রাবণ এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বাদ দও। এসব আমার একদম ভালো লাগে না।
- ও।
- আর আমার আশেপাশে বেশি ঘুরঘুর করো না। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।
- তোমার ফোন নাম্বারটা দাও।
- নাও।
- আচ্ছা আনিকা তুমি না বলেছিলে আমরা দু'জন গভীর সিন্ধু মাঝে একটি রঙিন নৌকা?
- হু।
- তুমি বলেছিলে আমি লোহা। আর তুমি কাঠ। দুইটার সংমিশ্রনে নৌকা তৈরি হয় এবং সিন্ধু মাঝে ভেসে রয়।
- এসব কথা এখন বাদ দাও। প্রেমের সময় মানুষ অনেক কিছুই বলে। বাস্তব এর বিপরীত।
- তবে কেন ভালোবেসেছিলে?
- আমি তো বাসতে চাইনি। বরং তুমি বাসতে বাধ্য করেছিলে।
- আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলে কেন?
- ভালো লাগতো তখন।
- এখন লাগে না?
- শ্রাবণ আমার মাথা ব্যথা করছে। আমাকে বিশ্রাম নিতে দাও। তুমি আসো এখন।
- এই কয়টা দিনই না হয় বিরক্ত করলাম। তারপরে আর করবো না। আর আসাও হবে এই বাড়িতে।
- কাঁদছো কেন তুমি?
আমি চোখ মুছে বললাম, কাঁদলে তোমার কী?
- আমার সামনে কাঁদবে না। নিজের রুমে গিয়ে কাঁদো। এসব আমার সহ্য হয় না।
- ভালোবাসো আমাকে?
আনিকা আর কোনো উত্তর না দিয়ে তার রুমে চলে গেল।

আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। মনে চাচ্ছে আনিকাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলি, ভালোবাসি আনিকা। তোমাকে ছাড়া আমার এক মুহুর্তও চলবে না।
এর মাঝে অয়ন এসে বললো, ভাইয়া রুমকিকে দেখেছেন?
এই পিচ্চি দুইটাও বোধ হয় একে অপরকে ভালোবাসে। না না, ভালোবাসে বললে ভুল হবে। পছন্দ করে। এরাও বোধ হয় একে অপরকে পছন্দ করে।
আমি বললাম, দেখো ছাঁদে গিয়েছে।
সে দৌঁড়ে ছাঁদে চলে গেল।
.
কাল বিয়ে। আনিকার তিনজন বান্ধবী এসেছে মাত্র। দু'জনকে চিনি। বাকি একজনকে চিনি না। ছাঁদ এখন তাদের দখলে। অবশ্য আমি তেমন একটা ছাঁদে যাইও না। আর গেলেও অল্প কিছুক্ষণ থাকি। কিন্তু এখন আর সেটাও হবে না। রুম থেকে বের হয়ে আম্মুর কাছে যাচ্ছিলাম। এর মাঝে অর্পা আর জান্নাতের মুখোমুখি হতেই তারা হেসে বললো, ভাইয়া কেমন আছেন?
আমি "ভালো" বললাম। তারা আর কিছু বললো না। অপরিচিত বান্ধবীটা বললো, ভাইয়া আজ রাতে ছাঁদে আইসেন। একসাথে আড্ডা দেওয়া যাবে।
মেয়েটা দেখতে সুন্দর। কথাও বলে সুন্দর করে। নাহ, তার কথার দিকে নজর দিলে আনিকার কথা মনে পড়বে। তখন আনিকার সাথে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করবে।

রাতে ছাঁদে যাওয়ার আগে অর্পা, জান্নাত আর ঐ অপরিচিত মেয়েটা বললো, ভাইয়া ছাঁদে যাচ্ছি। আসতে পারেন।
আমি বললাম, তোমরা যাও।
তারা চলে গেল। আনিকার রুমের দিকে উঁকি দিতেই বড় মামি ডেকে বললেন, নিরব বাবা একটু এদিকে আসো তো!
আমি কাছে যেতেই তিনি বললেন, বাবা আমার একটা মাত্র মেয়ে। তুমি কাল বিয়ের সময়টাতে একটু সাহায্য করবে। দেখছোই তো বাড়িতে বড় ছেলে বলতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়েটার বিয়ে নিয়ে তোমার মামার খুব চিন্তা ছিল। ভালো মতো বিয়েটা হয়ে গেলেই হয়। তুমি একটু খেয়াল রেখো সবকিছু।
- জ্বী মামি।
- খাবার খেয়েছো?
- জ্বী।

আমি রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ফোন বের করে আনিকাকে কল করলাম। রিং হচ্ছে রিসিভ হচ্ছে না। এই বিয়েতে যদি তার অমত থাকতো। তবুও আমরা পালিয়ে যেতে পারতাম না। মামি ঠিকই বলেছেন, অত্র বাড়িতে সকল কাজের জন্য আমি ছাড়া আর কোনো ছেলে নেই। বেশ কয়েকবার কল করলাম। সে রিসিভ করলো না। রাতটা পেরোলেই তার বিয়ে। কালকের মধ্যেই সে অন্যের হয়ে যাবে। নাহ, তার বিয়ের সময়টাতে আমি থাকতে পারবো না। থাকলে আমি তার বিয়েটা মেনে নিতে পারবো না। সহ্য হবে না আমার। আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি মারা যাবো। ও প্রেম, প্রেম গো, তুমি এমন কেন গো প্রেম? তোমাতে এত জ্বালা কেন প্রেম? যদি আগে জানতাম, তবে তোমাতে মিশতাম না গো প্রেম। তুমি সুখের তরীতে ভাসিয়ে নিয়ে দুখের কূলে নাও বাও। তুমি বড্ড চতুর গো প্রেম, বড্ড চতুর।

সকাল হতেই বাড়ির ভেতরটা সাজানো থেকে শুরু করে সকল কাজকর্ম আমাকেই করতে হচ্ছে। দুঃখ কষ্ট সকল চেপে রেখে আমি নিঃশব্দে সবকিছু করে যাচ্ছি। কেউ কিছু বললে শুধু হ্যাঁ হু উত্তর করছি। আনিকার সাথে দুইবার দেখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল বলতে আমি তাকে দেখেছিলাম। সে আমাকে দেখেনি। তাকেও কেমন যেন বিষন্ন দেখাচ্ছিল। হয়তো এই বিয়েতে তারও মত নেই। কিন্তু মামা মামির কথা চিন্তা করে সে তাদের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না।

আম্মুর সাথে দেখা হলে মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু মায়ের মন! সে সবকিছুই বোঝে। দুপুরে আম্মুর মুখোমুখি হতেই আম্মু বললো, কিরে তোর যে কোনো খোঁজই নেই। কোথায় থাকিস?
বললাম, কোথায় আর থাকবো? আমার একটা মাত্র বোনের বিয়ে। তার বিয়ের সকল কাজের দায়িত্ব তো আমার, তাইনা?
- তোর মন খারাপ?
- মন খারাপ হতে যাবে কেন?
- আনিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেজন্য!
- তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এটা তো আরও খুশির খবর। এতে মন খারাপের কী আছে?
- ছেলেপক্ষের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
- হুম।
- আনিকাকে গাড়িতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত তোর কাজ। এরপরে তুই স্বাধীন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। বাড়িতে বিয়ের আয়োজন বাড়তে থাকলো। সবাই সবার নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আমি সকলের চোখ এড়িয়ে আনিকার রুমের দরজায় নক করলাম। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, দরজা খোলাই আছে। ভেতরে আয়।
সে ভেবেছে, তার বান্ধবীরা বোধ হয় দরজায় নক করেছে। আমি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আনিকা আমাকে দেখে বলে উঠলো, তুমি?
- চুপ, একদম চুপ।
- তুমি এখানে কী করছো? বের হয়ে যাও শ্রাবণ। কেউ এসে পড়লে কেলেংকারি হয়ে যাবে।
- কেউ আসবে না।
- তুমি যাও প্লিজ।
আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে বোধ হয় ভয় পাচ্ছে আমাকে। চোখ দু'টো তার সেটাই বলছে। সে বললো, কিছু করো না আমাকে। প্লিজ শ্রাবণ।
আমি খানিক হেসে বললাম, আমার প্রতি তোমার এতটুকুও বিশ্বাস নেই আনিকা? যেই আমি তোমার টোল ছাড়া ঠোঁটটা অব্দি কোনোদিন স্পর্শ করিনি। তুমি ভাবলে কী করে সেই আমি আজ তোমার সাথে!
আনিকা চুপ হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, আমি তোমায় ভালোবাসি আনিকা। আর আমি চাই না আমার ভালোবাসা কখনো কষ্ট পাক। তোমার কাছে আমি একটা শেষ অনুরোধ নিয়ে এসেছি। বলো রাখবে, বলো!
- কী?
- একটু বউয়ের সাজে সেজে আমার সামনে দাঁড়াবে? বড্ড ইচ্ছে ছিল তোমাকে বউয়ের সাজে দেখার। প্লিজ!
- কিন্তু.....
- আর তো কখনো বলবো না। প্লিজ আনিকা।

সে একটু তড়িঘড়ি করেই সেদিনের সেই লাল শাড়িটা পড়লো। তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কী অপরূপ গো আমার আনিকার মুখ! কেউ দেখলেই তার সুপ্ত মনে প্রেম জেগে উঠবে। আমি অপলক চেয়ে রইলাম তার দিকে। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে শাড়ির কুচিটাও ঠিকমতো দিতে পারেনি সে। বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিলো কুচিটা ঠিক করে দিতে। কিন্তু আমার সেই অধিকারটা নেই। আমি বললাম, আনিকা।
সে 'হু' বললো।
- একটাবার জড়িয়ে ধরতে দেবে আনিকা?
- না।
- একটাবার।
সে চুপ করে রইলো। চুপ করে থাকা সম্মতির লক্ষণ। তবে সব ক্ষেত্রেই নয়। আমি বললাম, আসি আনিকা। তোমাকে বউয়ের সাজে দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিল। দেখা হয়ে গিয়েছে। আসি এখন।
আমি দরজার দিকে পা বাড়াতেই সে বললো, ধরো।
আমি দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল পড়ছে। আনিকা আমাকে জড়িয়ে ধরেনি। শুধু আমিই ধরেছি। মনে হচ্ছে তাকে ছেড়ে দিলেই সে হারিয়ে যাবে। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। আমার চোখ দু'টো জলে ছলছল করছে। সেটা তার চক্ষু এড়ালো না। সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। আমি দরজা খুলে বাইরে বের হতেই আম্মুর সামনে পড়ে গেলাম। আমার এখন একদম ভয় করছে না। আমি চোখ দু'টো মুছে আম্মুর পাশ কাটিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে চলে এলাম।
.
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সূর্যের আলো পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি আধো ভাঙা পিচঢালা পথ ধরে গন্তব্যহীন হেঁটে চলেছি। দু'টো ছেলে আমার পিছু নিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে ছিনতাইকারী। বয়স আনুমানিক সতের কি আঠারো হবে। আমি তাদের ডাক দিলাম। তারা এগিয়ে এলো। আমি বললাম, ভাই আমার কাছে তেমন কিছু নেই। একটা মোবাইল, একটা ঘড়ি, কিছু খুচরা টাকা। আর কিছু নেই। চাইলে নিয়ে যেতে পারো। আমি হাত থেকে ঘড়িটা খুলে তাদের দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
ছেলে দু'টো অবাক হলো। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই আপনে কাঁদতেছেন ক্যান?
- আজ আমার অতি মূল্যবান জিনিসটাই ছিনতাই হয়ে যাচ্ছেরে। তার কাছে এসব কিছুই না।
ছেলে দু'টো আমার থেকে কিছু না নিয়ে প্রস্থান করলো।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। আমার ফোনটা বেজে উঠলো। আমি পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলাম আম্মু কল করেছে। রিসিভ করলাম।
- কোথায় তুই?
- জানি না।
- তোর মামার এখানে আয় তাড়াতাড়ি।
- বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
- হ্যাঁ।
আমি কল রাখলাম। ধীরে ধীরে মামার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম। পা দু'টো অবশ হয়ে আসছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ দু'টোও ঝাপসা হয়ে আসছে।

রাত ন'টা নাগাদ মামার বাড়িতে পৌঁছালাম। এর মাঝে ফোনটা অনেকবার বেজে উঠেছে। কিন্তু আমি রিসিভ করিনি। বের করে দেখিওনি কে কল করেছে। বাড়িতে পৌঁছাতেই দেখলাম সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আনিকাও দাঁড়িয়ে আছে। আনিকার চোখ দু'টো ছলছল করছে। টিপটাপ লাইটের আলোয় তার চোখের জলগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। আমাকে দেখেই মেয়েটা দৌঁড়ে এসে সকলের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে সে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

বড় মামি আম্মুর হাতে একটা শেরওয়ানি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, নিরবকে পড়ে আসতে বলো।
আম্মু আমাকে শেরওয়ানিটা দিয়ে বললো, এখন ঝটপট এটা পড়ে আয়। এই ক'টা দিন অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোকে। আরে বোকা বিয়েটা তোর সাথেই হচ্ছিলো। তোর মামা, মামি, আমি আর আনিকা যুক্তি করেই এই ক'দিন তোর সাথে এই অভিনয়টা করলাম। দেখলি না মার্কেটে গিয়ে তোর টাকাতে কেনাকাটা করলাম?
আমার চোখের সামনে সবকিছু নতুন নতুন লাগছে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এ জল যে সুখের জল। আনিকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি দ্রুত শেরওয়ানিটা নিয়ে রুমে এলাম। রাতে আনিকার খবর আছে। আমাকে কষ্ট দেওয়ার সাধটা মিটিয়ে দেবো।

সেই রাতেই আনিকাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম। বাড়িতে এসে দেখি আমাদের বাড়িটাও সাজানো হয়ে গিয়েছে। সোহান, সাকিব, রুহান সবাই বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাই আমাকে আমার নিজের বাড়িতে স্বাগতম জানালো। আর বললো, বেটা তোর বিয়ে আর তুই কিনা আমাদের দাওয়াত দিলি না। তবুও দেখ বিনা দাওয়াতেই কেমন চলে এলাম!

রাত একটা বাজে। আমি আর আনিকা বাসর ঘরে বসে আছি। সে হাসছে। তার হাসি যেন থামছেই না। আমি বললাম, হাসছো কেন?
সে বললো, আমি সরি শ্রাবণ। দেখো, বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু কী করবো বলো? ফুফু আমাকে এই অভিনয়টা করতে বললো।
- সরি বলছো। আবার হাসছো। এটা কী ধরনের সরি?
সে হাসতে হাসতেই বললো, জানি না। তবে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।
- কেন?
- জানি না।
- তাহলে জানোটা কী?
- তাও জানি না।
- ঐ ছবিটা কার ছিল?
- জানি না। ফুফু ছবিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল যদি তুমি কখনো ছেলের ছবি দেখতে চাও। তবে যেন তোমাকে ঐ ছবিটা দেখাই।
আমি চুপ করে আছি। আমার ভেতরে সুখের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার সুখ।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আনিকা বললো, এখন দেখো আমাকে। যত খুশি মন ভরে দেখো। আর এই দেখো শাড়ির কুচিটা ইচ্ছে করেই এমন করে পড়েছি। নাও, ঠিক করে দাও।
- ওটা আর ঠিক করতে হবে না।
- কেন?
- আচ্ছা তুমি এমন কেন বলো তো?
- কেমন?
- এইযে এত সুন্দর!
সে হেসে বললো, আজও কি আমার টোল পড়া জায়গাতে চুমু খাবে? নাকি ঠোঁটে?
- এই দাঁড়াও, একটু দাঁড়াও। নাঈম ভাইকে কল করে নেই।
- নাঈম ভাই কে?
- আমার রুমমেট। তিনি বলেছিলেন, শ্রাবণ তুমি একদম চিন্তা করো না। বিয়েটা তোমার সাথেই হবে।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১৯

চাঁদগাজী বলেছেন:


গল্প, নাকি আপনার জীবন কাহিনী?

০৯ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:১৩

শ্রাবণ আহমেদ বলেছেন: এটা কেবলই গল্প মাত্র। শুধু বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ধন্যবাদ

২| ০৯ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৮

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
বাহ শেষ চমকটা ভালেই গল। মিলন। মহামিলন।

শ্রাবন মেঘের দিন..........গল্পর মত সুন্দর নাম।

০৯ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:১৩

শ্রাবণ আহমেদ বলেছেন: ধন্যবাদ প্রিয়। ভালোবাসা অবিরাম

৩| ০৯ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:২৯

নেওয়াজ আলি বলেছেন: সৃজনশীল লেখা।

১০ ই জুন, ২০২০ ভোর ৬:২৪

শ্রাবণ আহমেদ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইজান। দোয়া করবেন যেন সামনে আরও ভালো কিছু দিতে পারি।

৪| ০৯ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:৩৪

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লিখেছেন। গড়গড় করে লিখে গেছেন।

১০ ই জুন, ২০২০ ভোর ৬:২৫

শ্রাবণ আহমেদ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইজান। সবই আপনাদের অনুপ্রেরণার ফল। ভালোবাসা রইলো ভাইজান।

৫| ০৯ ই জুন, ২০২০ রাত ৯:০৫

চাঁদগাজী বলেছেন:


লেখক বলেছেন, " এটা কেবলই গল্প মাত্র। শুধু বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ধন্যবাদ।"

-গল্পে নিজের নিক ইত্যাদি ব্যবহার রলে পাঠক কনফিউড হয়।

১০ ই জুন, ২০২০ ভোর ৬:২৪

শ্রাবণ আহমেদ বলেছেন: একদম সঠিক বলেছেন ভাইজান। তবে বাস্তব হিসেবে পড়লেই বা দোষ কোথায়? আপনি পড়ার সময় চোখের সামনে ঘটনাগুলো ভাসতে থাকলেই একজন লেখক তার লেখার সার্থকতা খুঁজে পায় উক্ত লেখার মধ্য দিয়ে।

৬| ১০ ই জুন, ২০২০ দুপুর ১২:২৮

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: -জীবন এমন কিললাই ?? - প্রেমে এত সুখ কেরে?

একখান প্রেম করতে - শুধু মুনচায় মুনচায়।

চমৎকার গল্প এবং হৃদয় ছোঁয়া সমাপ্তির জন্য অনেক ধন্যবাদ।

১০ ই জুন, ২০২০ দুপুর ১:৩০

শ্রাবণ আহমেদ বলেছেন: ভালোবাসা ভাইজান এত কষ্ট করে গল্পটা পড়ার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.