![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ রাতে আমার কথা শুনতে অনেক শিক্ষার্থী এখানে এসেছেন। তাঁদের দেখে নিজের শৈশবের কথা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। আজ আমি কোনো প্রস্তুতি নিয়ে এখানে বক্তৃতা করতে আসিনি। কারণ, একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাকে জানানো হয়েছে যে আমাকে কিছু বলতে হবে। তাই শুরু করতে চাই একটি প্রশ্ন দিয়ে। বেশ কয়েক বছর আগে একজন সাংবাদিক আমাকে প্রশ্নটি করেছিলেন এবং সত্যি বলতে, তখন আমার কাছে প্রশ্নটির উত্তর ছিল না। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কেন সিনেমা নিয়ে কাজ করো?’ তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি বলেছিলাম, আমি আসলে বেঁচে থাকার জন্য স্বপ্ন দেখি, সিনেমা নিয়ে কাজ করি। আমি জানি না, কেন কথাটি বলেছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর পর আবিষ্কার করলাম, আমি আসলেই বেঁচে থাকার জন্য স্বপ্ন দেখি। এ কাজটিই সারা জীবন করে এসেছি এবং সামনের দিনগুলোতেও এটিই করতে চাই।
সবারই জীবন নিয়ে কোনো না কোনো পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু ক্যারিয়ার নিয়ে আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের একটি মূল বিষয় বেছে নিয়ে পড়ালেখা করতে হয়। কিন্তু আমার সময়ে আমি যে বিষয়ে পড়তে চাইতাম, সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান হতো না। ফিল্ম ও টেলিভিশন ছিল আমার প্রিয় বিষয়। আমার বাবা আমাকে বলেছেন, যদি আমার সিনেমা বানানোর প্ল্যান কাজ না করে, তাহলে আমাকে অন্য কোনো পেশায় কাজ করতে হবে। তিনি বললেন ইংরেজি নিয়ে পড়তে। কারণ, তাহলে আমি শিক্ষক হতে পারব। শিক্ষকতা পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পেশা। আর শিক্ষকেরা হলেন নায়ক; যাঁরা পৃথিবীতে জ্ঞান বিতরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন।
কিন্তু আমার ভাবনার জগৎজুড়ে ছিল শুধুই সিনেমা বানানোর স্বপ্ন এবং এর শুরুটা হয়েছিল নিতান্তই দুর্ঘটনাক্রমে। আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয় বছর। একদিন আমার বাবা বললেন, ‘তোমাকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর জিনিসটি দেখাতে নিয়ে যাব।’ আমি খুবই আগ্রহী ছিলাম জিনিসটি দেখতে। কারণ, বাবা বলেছেন, সেখানে বাঘ, সার্কাস, ক্লাউন—সবকিছুই থাকবে। পুরো এক সপ্তাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করলাম। তারপর সপ্তাহের শেষে আমরা নিউ জার্সি থেকে গাড়ি চালিয়ে ফিলাডেলফিয়া গেলাম।
আমার এখনো মনে আছে, সে সময়টা ছিল শীতকাল এবং দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আমরা একটা প্রায় অন্ধকার রুমে ঢুকলাম। ধোঁয়াটে, মৃদু আলোকিত, গম্বুজাকার একটি রুম। আমাদের সামনে লাল রঙের একটা পর্দা টানানো ছিল। যখন সেই পর্দাটা উঠে গেল, আমি বুঝতে পারলাম যে বাবা আমাকে মিথ্যা বলেছেন। তিনি সার্কাসে নয়, আমাকে সার্কাস নিয়ে বানানো একটি সিনেমা দেখাতে নিয়ে এসেছেন। এটাই ছিল চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমার বাবা ছিলেন একজন তড়িৎ প্রকৌশলী। অবসর সময়ে তিনি পুরোনো টিভি সেট নিয়ে কাজ করতেন। তাই এর আগে আমি প্রচুর টিভি সেট দেখেছি, কিন্তু আগে কখনো সিনেমা দেখা হয়নি। মিথ্যা বলায় আমি বাবার ওপর রাগ করেছিলাম। কিন্তু সেই রাগ টিকে ছিল মাত্র ১০ মিনিট। এরপর আমিও সিনেমা নামের সেই ভয়ানক নেশার শিকারে পরিণত হলাম। আলো, শব্দ, প্রতিধ্বনি আর চলমান ছবির সেই মোহনীয় জগতে আমি হারিয়ে গেলাম। আর এভাবেই সিনেমার সঙ্গে আমার জীবন জড়িয়ে গেল, অনেক মানুষের জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম।
সেই সিনেমার কাহিনিতে একটা ভয়াবহ ট্রেন-দুর্ঘটনার অংশ ছিল। লাইন বেয়ে এগিয়ে আসা একটি ট্রেন একটি কারের মুখোমুখি সংঘর্ষের দৃশ্য সেখানে চিত্রিত ছিল। আমি পরে জেনেছিলাম যে এটা ছিল স্পেশাল ইফেক্টের কাজ আর ট্রেনটি ছিল একটি ছোট খেলনা ট্রেন। কিন্তু সেই দৃশ্যটি ছিল আমার দেখা সবচেয়ে বাস্তব দৃশ্য। এরপর শুধু সিনেমার প্রতি আমার আগ্রহই জন্মাল না, বাবাকে বললাম আমাকে একটা ট্রেন কিনে দিতে। কিছুদিন পরেই আমার প্রথম ইলেকট্রিক ট্রেনটি হাতে পেলাম। তারও কিছুদিন পরে বাবার কাছে আবারও ট্রেন চাইলাম, যাতে আমার কাছে দুটি ট্রেন থাকতে পারে। এভাবে প্রতিবছরই আমি ট্রেন-কার প্রভৃতি জমাতে লাগলাম। এর মধ্যে আমরা নিউ জার্সি থেকে অ্যারিজোনার ফিনিক্সে চলে এলাম। ফিনিক্সে আমার আসলে করার মতো কিছুই ছিল না। হাতে ছিল অঢেল সময়। এই সময়ে আমি চাইলাম আমার দেখা প্রথম সিনেমার সেই দুর্ঘটনার দৃশ্যটিকে আবার বানাতে। দুটি ট্রেনকে মুখোমুখি ছেড়ে দিলাম এবং সেগুলো ভেঙে গেল। এগুলোকে বাবার কাছে নিয়ে গেলাম, বাবা ঠিক করে দিলেন। পরবর্তী সপ্তাহে আবার ট্রেন দুটো ভেঙে ফেললাম। এবার বাবা বললেন, ‘তুমি যদি আবার ট্রেন ভেঙে ফেলো, তাহলে আমি তোমার কাছ থেকে সব ট্রেন নিয়ে নেব।’ সিনেমায় দেখা সেই ট্রেন-দুর্ঘটনার দৃশটি ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য, যেটা আমি বারবার দেখতে চাইতাম। আবার আমি ট্রেনগুলোকেও হারাতে চাইতাম না।
আমার বাবার কাছে কোডাকের ৮ মিমি একটি মুভি ক্যামেরা ছিল, যেটা নিয়ে কখনো আমার মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু চাইলাম ট্রেন-দুর্ঘটনার দৃশ্যটাকে সেই ক্যামেরায় তুলে রাখতে, যাতে বারবার সেই দৃশ্য দেখতে পারি। এভাবেই আমি প্রথম সিনেমা বানালাম। দুটি ট্রেন দুই দিক থেকে এগিয়ে আসছে, আলাদা করে তাদের ভিডিও করলাম। এরপর যখন ঠিক মাঝামাঝিতে ক্যামেরা ধরলাম, পেয়ে গেলাম আমার কাঙ্ক্ষিত সেই দুর্ঘটনার দৃশ্য। ভাগ্য ভালো, এবার ট্রেন আর ভাঙেনি। তখন ভাবলাম, এই ক্যামেরা দিয়ে আর কী করতে পারি। সেই ভাবনা থেকেই সিনেমার ডিরেক্টর হলাম।
আমি যখন বয় স্কাউটে যোগ দিলাম, সেখানে একটি পরীক্ষা ছিল—স্থিরচিত্র দেখিয়ে কোনো একটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া। কিন্তু আমার কাছে কোনো স্থির ক্যামেরা ছিল না। আমি প্রশিক্ষককে বললাম, কোনো সিনে ক্যামেরার মাধ্যমে আমার গল্পটি বলতে পারব কি না। তিনি রাজি হলেন। এরপর সব মেধা খরচ করে একটি ওয়েস্টার্ন সিনেমা বনালাম। আমার বোন, বন্ধু, প্রতিবেশী ও কয়েকজন স্কাউটকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমাটি শেষ করলাম। অ্যারিজোনায় সবার কাছেই কাউবয় স্যুট থাকে, তাই ওয়েস্টার্ন সিনেমা বানাতে আমার খুব কষ্ট হয়নি। এক মিটিংয়ে আমি সব স্কাউটের সামনে আমার সিনেমাটি দেখালাম এবং তারা খুব হাসল, চিৎকার করল ও হাততালি দিল। এটি ছিল দর্শকদের কাছ থেকে পাওয়া আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়া আমাকে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহী করল এবং সারা জীবনে আর সিনেমা বানানো ছাড়া আর কোনো কিছুই করতে চাইলাম না।
আমি সব সময় আমার দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছি। চেয়েছি, তাঁদের আমার কাজের অংশীদার করতে। এ জন্যই আমার প্রথম দিকের সব সিনেমাই দর্শকদের কথা ভেবে বানানো। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে আমি সব সময় ভাবী, কীভাবে দর্শকদের মনোযোগ কেড়ে নেওয়া যায়, তাঁদের উৎসাহী করা যায়, তাঁদের হাসানো যায়-কাঁদানো যায়, ভয়ে চিৎকার করানো যায়। দর্শকদের প্রতিক্রিয়াই আমার সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আমি জানতাম না আমার স্বপ্ন সফল হবে কি না। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাকি সবকিছুই আমি ছেড়ে দিয়েছি। স্বপ্ন সব সময় চোখের সামনে দেখা যায় না। প্রায়ই দৃশ্যমান জগতের আড়ালেই স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে। চিৎকার করে কেউ তোমাকে জানিয়ে দেবে না, তুমি ভবিষ্যতে কী হবে, কী করবে। তোমার স্বপ্ন তোমাকে ফিসফিসিয়ে জানান দিয়ে যাবে, তোমার কী করা উচিত। সব সময় আমার সন্তানদের বলি, মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নিজের মনের ইচ্ছাগুলোকে সত্যিকার অর্থে জানা। কারণ, ইচ্ছারা কানের কাছে ফিসফিস করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়, কখনো জোরে চিৎকার করে বলে না। তোমাদের প্রতিটি মুহূর্তে তৈরি থাকতে হবে, যাতে নিজের মনের সেই ফিসফিস কথাগুলো তুমি শুনতে পারো। যদি তুমি তা পারো এবং সেই কথাগুলোকে নিজের কাজে পরিণত করতে পারো; তোমার কাজে সারা পৃথিবীর কল্যাণ হবে।
তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
সূত্র: ২০০৬ সালে কেনেডি সেন্টার অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে দেওয়া স্পিলবার্গের বক্তৃতা। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর: মনীষ দাশ
পরিচিতি:
স্টিভেন স্পিলবার্গ একজন মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা, গল্পলেখক ও ব্যবসায়ী। জন্ম ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে। অনেক বিখ্যাত ছবির নির্মাতা স্পিলবার্গ সেরা নির্মাতা হিসেবে দুবার অস্কার পান শিন্ডলারস লিস্ট ও সেভিং প্রাইভেট রায়ান-এর জন্য। এ ছাড়া তাঁর ঝুলিতে আছে ইটিজ’স, ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান, জুরাসিক পার্ক, লিঙ্কন-এর মতো বক্স অফিস কাঁপানো ছবি। ড্রিম ওয়ার্কস স্টুডিওর সহপ্রতিষ্ঠাতা এই গুণী চিত্রপরিচালক ফোর্বস সাময়িকীর তালিকায় পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের অন্যতম।
©somewhere in net ltd.
১|
০৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:০২
চড়ুই বলেছেন: এইরকম উৎসাহ মূলক গল্প পরলে মনে হয় সব ছেরে এক্ষুনি কাজে নেমে পরি কিন্তু কয়েকবার ট্রাই করে না পারলে হাল ছেরে দেই।