নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুব্রত দেব নাথ

সুব্রত দেব নাথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

লেখকের মরদেহকে অসম্মান

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১:৪৩


বহুমাত্রিক লেখক রতন তনু ঘোষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গত সোমবার, ৩ অক্টোবর বিকেলে তেজগাও শমরিতা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তারপর দিন সকালে এ্যাম্বুলেন্সে রতন তনু ঘোষের মরদেহ নেয়া হয়েছিলো বাংলা একাডেমীতে, নজরুল মঞ্চে কিছুক্ষণ রাখার জন্য। কিন্তু বাংলা একাডেমীর সচিব জনাব আনোয়ার হোসেন ওই লেখকের মরদেহ বাংলা একাডেমীতে ঢুকতে দেননি। তিনি বলেন, ‘বিশিষ্ট লেখক ছাড়া বাংলা একাডেমীতে লাশ রাখা যায় না।’ এ প্রসঙ্গে দৈনিক সমকাল যে সংবাদ পরিবেশন করেছে, তাতে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের আপত্তিতে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রয়াত লেখক-প্রাবন্ধিক রতন তনু ঘোষের মরদেহ রাখা সম্ভব হয়নি। তার শবদেহ একাডেমীর গেটে পৌছালে কর্তব্যরত গার্ডরা ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নির্দেশে এর প্রবেশ ঠেকিয়ে দেন।

এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে বলেন, একাডেমী যাদের মনে করে তাদের ডেকে এনে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থা করে।’ গত সোমবার বিকেলে ৫২ বছর বয়সে আকস্মিক ভাবে লেখক রতন তনু ঘোষের মৃত্যু হয়। তিনি বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য ছিলেন। বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের প্রথম ব্যাচের এই শিক্ষার্থীর বইও প্রকাশ করেছে। তার রচিত বহু মাত্রিক বিশ্বায়ন গ্রন্থটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা অনুষদে পড়ানো হয়। তিনি ‘বিশিষ্ট লেখক’ নন এই অৎুহাতে শ্রদ্ধা নিবেদনে অস্বীকৃতি জানায় একাডেমী।
রতন তনু ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে এসেছিলেন বিটিভির পরিচালক (বার্তা) কবি নাসির আহামেদ গবেষক ও প্রাবন্ধিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিলটন বিশ্বাস, লেখকের পরিবার পরিজন সহ অনেক লেখক, কবি ও শুভানুধায়ী সোয়া এক ঘন্টা অপেক্ষার পরও অনুমতি না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা একাডেমী থেকে রতন তনুর মরদেহ নিয়ে তার জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জের দিকে যাত্রা করেন।
বাংলা একাডেমীর সচিব মহোদয় বলেন, ‘হঠাৎ করে একজনের মরদেহ নিয়ে এলেই তো আমরা অনুমতি দিতে পারি না। তাছাড়া সব মরদেহই যদি এখানে আনা হয় তাহলে একাডেমীর স্বাভাবিক কাজকর্ম করা সম্ভব হবে না।’
সচিবের মতই কথা বলেছেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে কবি নাসির আহমেদ বলেন, ‘কে বড় লেখক, কে ছোট লেখক, তা নির্ধারণ করবে কে? শুধু পুরস্কারের মধ্য দিয়েই কি তা নির্ধারণ হয়? আমি মনে করি এটা কোনো বিবেচক সিদ্ধান্ত নয়।’ মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘বাংলা একাডেমী সব লেখকের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। এখানে সবার আসার অধিকার রয়েছে। একাডেমীর আজীবন সদস্য ও লেখক হিসেবে তাকে মূল্যায়ন করা যেত।’
রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি রতন তনু ঘোষ মুহম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে দীর্ঘ ২৫ বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭২টি। বহু মাত্রিক এই লেখকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলো হলো, ‘অগ্রসর বাংলাদেশ; ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ,’ ‘বাংলাদেশের সাহিত্য,’ ‘ভাষা আন্দোলন,’ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা’। (৫/১০/১৬)।
দৈনিক আমার সংবাদ তাদের খবরে বলেছে, ‘এ ঘটনার সমালোচনা করে কেউ কেউ বাংলা একাডেমীর কাছে ‘বিশিষ্ট’ লেখকের সংঙ্গা জানতে চেয়েছেন। প্রকাশক, লেখক ও সাংবাদিক হিরন্ময় হিমাংশু বলেন, গতকাল সকালে রতন তনুর লাশ বাংলা একাডেমীতে নেয়া হলে একাডেমীর সচিব আনোয়ার হোসেন বাধা দেন। তিনি আমাদের বলেন, বাংলা একাডেমীতে বিশিষ্ট লেখক ছাড়া কোনও লেখকের মরদেহ রাখা হয় না।
এ ব্যাপারে একাডেমীর সভাপতি ড. আনিসুজ্জামানকে ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান বিদেশে থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। রতন তনু ঘোষের মরদেহ বাংলা একাডেমীর নজরুল মঞ্চে রাখতে বাধা দেয়ার ঘটনার সমালোচনা করেছেন লেখক-কবিরা। সাখাওয়াৎ টিপু বলেন, ‘লেখক রতনের লাশ নিয়ে বাংলা একাডেমীর সংশ্লিষ্টদের অমানবিক আচরণ, এমন নির্মমতা গোটা সমাজের জন্য ভয়ানক। কী এমন ক্ষতি হোত তার লাশ বাংলা একাডেমীতে রাখলে?’ সাংবাদিক ও কবি শিমুল সালাহউদ্দিন ফেসবুকে লেখেন, ‘বাংলা একাডেমী যে একটা আস্তাবলে পরিণত হয়েছে তা আবার প্রমাণ করলো পেশায় অধ্যাপক, বহু সংখ্যক গ্রন্থের প্রণেতা, বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য ও বাংলা একডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক রতন তনু ঘোষের মরদেহকে শ্রদ্ধা অর্পণের জন্য ঢুকতে না দিয়ে। এই বাংলা একাডেমী কারা চালায়? তারা কি পশু না প্রশাসক? তাদের কি কারো কাছেই কোন জবাব দিহিতা নেই?

এমন কি নিজের বিবেকের কাছেও? (আমার সংবাদ- ৫/১০/১৬) আর নিজেকে লেখক পরিচয় দিতে অভিরুচি হয় না- লেখা-লেখি করি দীর্ঘদিন। রতন তনু ঘোষ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তার লেখারও অনুরাগী আমি। মাত্র ৫২ বছর বয়সে যিনি ৭২টি বই লিখেছেন, এবং মৃত্যুর পূর্বেও যিনি লেখা ত্যাগ করেননি, লিখেছেন বিবেকের তাড়নায়, মনের তাগিদে, তিনি এই প্রতিদান পেলেন একটি জাতীয় মননশীল প্রতিষ্ঠান থেকে। কত লেখক, কবি সাহিত্যিকদের ওপর লিখেছেন রতন তনু ঘোষ। কত লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। এই-ই তার প্রতিদান পেলেন।
আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে রাজনীতিবিদদের মন্দ বলা। বাংলা একাডেমীর মত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সচিব ‘বিশিষ্ট লেখক’-এর যে সংঙ্গা দিলেন তাতে বাংলাদেশের লেখকদেরই ছোট করা হয়েছে। সচিব সাহেবের প্রতিটি কথা অবজ্ঞা সূচক। আমরা জানি আহমদ ছফার মতো অত্যন্ত শক্তিশালী, চিন্তাশীল লেখককে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেয়নি। অত্যন্ত পাওয়ারফুল গবেষক তিতাশ চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, গবেষক, বিশিষ্ট গদ্যশিল্পী আবু জাফরকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেয়নি। তারাও বোধ করি বিশিষ্ট লেখক নন। বিশিষ্ট লেখকের সার্টিফিকেট দেন যদি একজন আমলা, তা হলে বলবো, বাংলাদেশের লেখকদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মনে প্রশ্ন জেগেছে, মোনায়েম খানের আমল ফিরে এলো কিনা।
পাকিস্তান আমলে স্বরাষ্ট মন্ত্রনালয়ে আবুল ফজলের ‘রাঙ্গা প্রভাত’ উপন্যাসের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন এক পাকিস্তানি লেখক। এটি নাকি ইসলাম বিরোধী উপন্যাস। বঙ্গবিবেক আবুল ফজল এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তার ‘মানবতন্ত্র’ গ্রন্থে। বলেছেন ‘সাহিত্য বিচারের ভার যদি স্বরাষ্ট বিভাগের ওপর পড়ে, তাহলে সাহিত্যিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে পারি না।’
আমরাও আবুল ফজলের মতো শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। বাংলা একাডেমীর সচিবের ‘বিশিষ্ট লেখক’ কথাটি শুনে। মনীষী মোতাহের হোসেন চেšধুরী, ‘ব্যর্থতা জিন্দাবাদ’ নামে অসামান্য একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। যেখানে বলেছেন, ‘সাধনা বাইরের দিকে ব্যর্থ হলেও ভেতরের দিকে কোনো দিন ব্যর্থ হয় না।’ আরো বলেছেন, ‘বলেছি যে সমাজে যত ব্যর্থ লোকের বাস, সে সমাজ তত ধনী। যে বনে যত বেশি ঝরা ফুল, সে বনে তত বেশী বসন্ত এসেছে মনে করতে হবে।’

হয়তো রতন তনু ঘোষের মতো একজন নিষ্ঠাবান সাধক বাইরের দিকে ব্যর্থ হয়েছেন কিন্তু ভিতরের দিকে ব্যর্থ হয়নি। কেননা লিখেছেন তিনি ভেতরের তাগিদে। কোনো পুরস্কার পাননি, তবুও লেখা থামান নি। যেদিন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মার গেলেন, সেদিনও দৈনিক যায় যায় দিন পত্রিকায় লেখা জমা দিয়েছেন।
স্বাধীনতার পক্ষে, সুন্দরের পক্ষে, প্রগতির পক্ষে লিখেছেন, লিখেছেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। এই সমাজে রতন তনু ঘোষের মতো নিরলস সাহিত্য সাধক ক’জন আছে? এঁটা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছি যে, লেখালেখির জগতেও আমলাদের দৌরাত্ম্য, ধান্দাবাজি ঢুকুছে।
রতনতনু ঘোষের মরদেহ অসম্মান হওয়ার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের লেখকরা দু’ভাগ ভিবক্ত হলো, কেউ বিশিষ্ট আর কেউ অবিশিষ্ট লেখক। বাংলা একাডেমী যাদের সম্মান দেখাবে তারা বিশিষ্ট লেখক আর বাংলা একাডেমী যাদের সম্মান দেবে না তারা অবিশিষ্ট লেখক। বহুমাত্রিক লেখক রতন তনু ঘোষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গত সোমবার, ৩ অক্টোবর বিকেলে তেজগাও শমরিতা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তারপর দিন সকালে এ্যাম্বুলেন্সে রতন তনু ঘোষের মরদেহ নেয়া হয়েছিলো বাংলা একাডেমীতে, নজরুল মঞ্চে কিছুক্ষণ রাখার জন্য। কিন্তু বাংলা একাডেমীর সচিব জনাব আনোয়ার হোসেন ওই লেখকের মরদেহ বাংলা একাডেমীতে ঢুকতে দেননি। তিনি বলেন, ‘বিশিষ্ট লেখক ছাড়া বাংলা একাডেমীতে লাশ রাখা যায় না।’ এ প্রসঙ্গে দৈনিক সমকাল যে সংবাদ পরিবেশন করেছে, তাতে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের আপত্তিতে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রয়াত লেখক-প্রাবন্ধিক রতন তনু ঘোষের মরদেহ রাখা সম্ভব হয়নি। তার শবদেহ একাডেমীর গেটে পৌছালে কর্তব্যরত গার্ডরা ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নির্দেশে এর প্রবেশ ঠেকিয়ে দেন।

এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে বলেন, একাডেমী যাদের মনে করে তাদের ডেকে এনে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থা করে।’ গত সোমবার বিকেলে ৫২ বছর বয়সে আকস্মিক ভাবে লেখক রতন তনু ঘোষের মৃত্যু হয়। তিনি বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য ছিলেন। বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের প্রথম ব্যাচের এই শিক্ষার্থীর বইও প্রকাশ করেছে। তার রচিত বহু মাত্রিক বিশ্বায়ন গ্রন্থটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা অনুষদে পড়ানো হয়। তিনি ‘বিশিষ্ট লেখক’ নন এই অৎুহাতে শ্রদ্ধা নিবেদনে অস্বীকৃতি জানায় একাডেমী।
রতন তনু ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে এসেছিলেন বিটিভির পরিচালক (বার্তা) কবি নাসির আহামেদ গবেষক ও প্রাবন্ধিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিলটন বিশ্বাস, লেখকের পরিবার পরিজন সহ অনেক লেখক, কবি ও শুভানুধায়ী সোয়া এক ঘন্টা অপেক্ষার পরও অনুমতি না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা একাডেমী থেকে রতন তনুর মরদেহ নিয়ে তার জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জের দিকে যাত্রা করেন।
বাংলা একাডেমীর সচিব মহোদয় বলেন, ‘হঠাৎ করে একজনের মরদেহ নিয়ে এলেই তো আমরা অনুমতি দিতে পারি না। তাছাড়া সব মরদেহই যদি এখানে আনা হয় তাহলে একাডেমীর স্বাভাবিক কাজকর্ম করা সম্ভব হবে না।’
সচিবের মতই কথা বলেছেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে কবি নাসির আহমেদ বলেন, ‘কে বড় লেখক, কে ছোট লেখক, তা নির্ধারণ করবে কে? শুধু পুরস্কারের মধ্য দিয়েই কি তা নির্ধারণ হয়? আমি মনে করি এটা কোনো বিবেচক সিদ্ধান্ত নয়।’ মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘বাংলা একাডেমী সব লেখকের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। এখানে সবার আসার অধিকার রয়েছে। একাডেমীর আজীবন সদস্য ও লেখক হিসেবে তাকে মূল্যায়ন করা যেত।’
রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি রতন তনু ঘোষ মুহম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে দীর্ঘ ২৫ বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭২টি। বহু মাত্রিক এই লেখকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলো হলো, ‘অগ্রসর বাংলাদেশ; ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ,’ ‘বাংলাদেশের সাহিত্য,’ ‘ভাষা আন্দোলন,’ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা’। (৫/১০/১৬)।
দৈনিক আমার সংবাদ তাদের খবরে বলেছে, ‘এ ঘটনার সমালোচনা করে কেউ কেউ বাংলা একাডেমীর কাছে ‘বিশিষ্ট’ লেখকের সংঙ্গা জানতে চেয়েছেন। প্রকাশক, লেখক ও সাংবাদিক হিরন্ময় হিমাংশু বলেন, গতকাল সকালে রতন তনুর লাশ বাংলা একাডেমীতে নেয়া হলে একাডেমীর সচিব আনোয়ার হোসেন বাধা দেন। তিনি আমাদের বলেন, বাংলা একাডেমীতে বিশিষ্ট লেখক ছাড়া কোনও লেখকের মরদেহ রাখা হয় না।
এ ব্যাপারে একাডেমীর সভাপতি ড. আনিসুজ্জামানকে ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান বিদেশে থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। রতন তনু ঘোষের মরদেহ বাংলা একাডেমীর নজরুল মঞ্চে রাখতে বাধা দেয়ার ঘটনার সমালোচনা করেছেন লেখক-কবিরা। সাখাওয়াৎ টিপু বলেন, ‘লেখক রতনের লাশ নিয়ে বাংলা একাডেমীর সংশ্লিষ্টদের অমানবিক আচরণ, এমন নির্মমতা গোটা সমাজের জন্য ভয়ানক। কী এমন ক্ষতি হোত তার লাশ বাংলা একাডেমীতে রাখলে?’ সাংবাদিক ও কবি শিমুল সালাহউদ্দিন ফেসবুকে লেখেন, ‘বাংলা একাডেমী যে একটা আস্তাবলে পরিণত হয়েছে তা আবার প্রমাণ করলো পেশায় অধ্যাপক, বহু সংখ্যক গ্রন্থের প্রণেতা, বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য ও বাংলা একডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক রতন তনু ঘোষের মরদেহকে শ্রদ্ধা অর্পণের জন্য ঢুকতে না দিয়ে। এই বাংলা একাডেমী কারা চালায়? তারা কি পশু না প্রশাসক? তাদের কি কারো কাছেই কোন জবাব দিহিতা নেই?

এমন কি নিজের বিবেকের কাছেও? (আমার সংবাদ- ৫/১০/১৬) আর নিজেকে লেখক পরিচয় দিতে অভিরুচি হয় না- লেখা-লেখি করি দীর্ঘদিন। রতন তনু ঘোষ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তার লেখারও অনুরাগী আমি। মাত্র ৫২ বছর বয়সে যিনি ৭২টি বই লিখেছেন, এবং মৃত্যুর পূর্বেও যিনি লেখা ত্যাগ করেননি, লিখেছেন বিবেকের তাড়নায়, মনের তাগিদে, তিনি এই প্রতিদান পেলেন একটি জাতীয় মননশীল প্রতিষ্ঠান থেকে। কত লেখক, কবি সাহিত্যিকদের ওপর লিখেছেন রতন তনু ঘোষ। কত লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। এই-ই তার প্রতিদান পেলেন।
আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে রাজনীতিবিদদের মন্দ বলা। বাংলা একাডেমীর মত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সচিব ‘বিশিষ্ট লেখক’-এর যে সংঙ্গা দিলেন তাতে বাংলাদেশের লেখকদেরই ছোট করা হয়েছে। সচিব সাহেবের প্রতিটি কথা অবজ্ঞা সূচক। আমরা জানি আহমদ ছফার মতো অত্যন্ত শক্তিশালী, চিন্তাশীল লেখককে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেয়নি। অত্যন্ত পাওয়ারফুল গবেষক তিতাশ চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, গবেষক, বিশিষ্ট গদ্যশিল্পী আবু জাফরকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেয়নি। তারাও বোধ করি বিশিষ্ট লেখক নন। বিশিষ্ট লেখকের সার্টিফিকেট দেন যদি একজন আমলা, তা হলে বলবো, বাংলাদেশের লেখকদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মনে প্রশ্ন জেগেছে, মোনায়েম খানের আমল ফিরে এলো কিনা।
পাকিস্তান আমলে স্বরাষ্ট মন্ত্রনালয়ে আবুল ফজলের ‘রাঙ্গা প্রভাত’ উপন্যাসের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন এক পাকিস্তানি লেখক। এটি নাকি ইসলাম বিরোধী উপন্যাস। বঙ্গবিবেক আবুল ফজল এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তার ‘মানবতন্ত্র’ গ্রন্থে। বলেছেন ‘সাহিত্য বিচারের ভার যদি স্বরাষ্ট বিভাগের ওপর পড়ে, তাহলে সাহিত্যিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে পারি না।’
আমরাও আবুল ফজলের মতো শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। বাংলা একাডেমীর সচিবের ‘বিশিষ্ট লেখক’ কথাটি শুনে। মনীষী মোতাহের হোসেন চেšধুরী, ‘ব্যর্থতা জিন্দাবাদ’ নামে অসামান্য একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। যেখানে বলেছেন, ‘সাধনা বাইরের দিকে ব্যর্থ হলেও ভেতরের দিকে কোনো দিন ব্যর্থ হয় না।’ আরো বলেছেন, ‘বলেছি যে সমাজে যত ব্যর্থ লোকের বাস, সে সমাজ তত ধনী। যে বনে যত বেশি ঝরা ফুল, সে বনে তত বেশী বসন্ত এসেছে মনে করতে হবে।’

হয়তো রতন তনু ঘোষের মতো একজন নিষ্ঠাবান সাধক বাইরের দিকে ব্যর্থ হয়েছেন কিন্তু ভিতরের দিকে ব্যর্থ হয়নি। কেননা লিখেছেন তিনি ভেতরের তাগিদে। কোনো পুরস্কার পাননি, তবুও লেখা থামান নি। যেদিন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মার গেলেন, সেদিনও দৈনিক যায় যায় দিন পত্রিকায় লেখা জমা দিয়েছেন।
স্বাধীনতার পক্ষে, সুন্দরের পক্ষে, প্রগতির পক্ষে লিখেছেন, লিখেছেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। এই সমাজে রতন তনু ঘোষের মতো নিরলস সাহিত্য সাধক ক’জন আছে? এঁটা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছি যে, লেখালেখির জগতেও আমলাদের দৌরাত্ম্য, ধান্দাবাজি ঢুকুছে।
রতনতনু ঘোষের মরদেহ অসম্মান হওয়ার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের লেখকরা দু’ভাগ ভিবক্ত হলো, কেউ বিশিষ্ট আর কেউ অবিশিষ্ট লেখক। বাংলা একাডেমী যাদের সম্মান দেখাবে তারা বিশিষ্ট লেখক আর বাংলা একাডেমী যাদের সম্মান দেবে না তারা অবিশিষ্ট লেখক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.