![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।
ঘটনাটিকে দুর্ভাগ্য বলব নাকি আমার সৌভাগ্য বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমার অতি নিকট জনের একটি পারিবারিক সমস্যা সমাধান করতে হয়েছে আমাকে। বলা যায় ভাঙনের মুখ থেকে ওদের সংসারটাকে বাঁচাতে হয়েছে। মীমাংসার জন্য উভয় পক্ষের পারিবারিক বৈঠক আমার বাসায় করতে হয়েছিল। ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দু’জনকে আবার সংসারে প্রবেশ করানোর কৃতিত্ব শুধু আমার একার নয়। মেয়ের বাবা, আমি, আমার স্বামী আর অন্যপক্ষে মেয়েটির স্বামী, স্বামীর বড় ভাই ও ওদের বিয়ের ঘটক উপস্থিত ছিল সেই বৈঠকে।
মেয়েটির সাথে আমার নাড়ির সম্পর্ক নেই। কিন্তু আত্মার যে সম্পর্ক তার দৃঢ়তা এমনই মজবুত যে বিপদ-আপদে মা-বাবার আগে সে আমাকে স্মরণ করে। আমার কাছ থেকে পরামর্শ নেয় যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য। আমিও ওর যে কোন সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ি সবার আগে, বুক পেতে ওকে আগলে রাখতে চেষ্টা করি সকল ঝড়-ঝঞ্জা থেকে। আর এখন তো ও একা নয়। ওর কোল জুড়ে এসেছে তুলতুলে পাখির ছানার মতো শশী। আমি আমার কল্পনায়-চিন্তায়-বাস্তবে সব সময় শশীকে আমার বুকের ওমে জড়িয়ে রাখি। দুই বছরের শশী অধিক মাত্রায় চঞ্চলতা আর দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখে সবাইকে। আমার বাসায় যখন থাকে তখন নানা-নানু বলতে একেবার অজ্ঞান। সেই শশীর মা অর্থাৎ আমার আত্মার কোটরে লালিত মেয়েটির দাম্পত্য জীবনে যখন ঝড় উঠল তখন সাথে সাথে আমার স্বাভাবিক জীবনাচারের ভিতটাও নড়ে উঠল। ছুটে গেলাম আমি শশীর মায়ের কাছে। শুনলাম অনেক কিছু। মূল সমস্যা ওর স্বামীর পরকীয়া প্রেম। প্রায় এক বছর ধরে এক হিন্দু মেয়ের সাথে সম্পর্ক ওর স্বামীর। শশীর মা টের পেয়েছে পাঁচ/ছয় মাস আগে। তখন ওর স্বামী শশীর মাথায় হাত রেখে প্রতীজ্ঞা করেছিল যে আর কোন সম্পর্ক রাখবে না ঐ মেয়ের সাথে। শশীর মা যেন সব ভুলে যায়।
হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিল শশীর মা সবকিছু। কিন্তু বিগত দুই/তিন মাস ধরে আবারও ঐ মেয়ের সাথে তার স্বামীর যোগাযোগ দেখে সে প্রতিবাদ করে। স্বামী জানায় মেয়েটির বিয়ে ঠিক করেছে ওর বাবা-মা তাই ওকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছে মেয়েটি। এরপর আমি হলফ করে বলতে পারি কোন স্ত্রী তার স্বামীর এই আচরণ নিরবে মেনে নিতে পারবে না বা মেনে নিবে না। কাজেই সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে ওদের মধ্যে। কথাবার্তা, স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক আচরণ সবকিছু প্রায় অস্বাভাবিক পর্যায়ে এসে ঠেকে। শশীর মা যাতে আমাদেরকে এ বিষয়ে কোন খবর জানাতে না পারে সেজন্য আমার বাসায় আসা বন্ধ করে দেয়। আমি বা শশীর নানীর বাড়ি থেকে কেউ বেড়াতে গেলে শশীর মাকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করে যাতে কিছু বলতে না পারে। অথচ শশীর মায়ের স্বাস্থ্যের ক্রম অবনতি দৃষ্টি কাড়ে সবার।
কিন্তু উপরওয়ালার ইচ্ছে যদি হয় অন্যরকম তাহলে সেটাকে সামলে রাখে কার সাধ্য ? তিনিই সুযোগ করে দেন সবকিছু প্রকাশের। আমি ২২-১১-১৩ তারিখে আমি ওদের বাসায় যাই। সেদিন শশীর বাবা গিয়েছিল গ্রামের বাড়িতে শশীর দাদার অসুস্থতার কারণে। এই সুযোগে আমি যা শুনলাম তাতে প্রথমে শশীর মায়ের উপরই আমার রাগটা গিয়ে পড়ে। কেন এতদিন ধরে এতবড় ঘটনা আমাদের কাছ থেকে গোপন রাখল সে কারণে। যা শুনলাম তাতে আমার নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। যাকে কখনও জামাই হিসেবে দেখিনি, দেখেছি নিজের ছেলে হিসেবে, যে কারও চোখে চোখ তুলে কথাটি পর্যন্ত বলেনা তার ভিতরটা কি না এত কুৎসিত ! একটা বাইরের মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য নিজের স্ত্রীকে বলেছে মেয়েকে রেখে চলে যেতে। শশীর মা একদিন শশীকে রেখে বাইরে বেরিয়েও গিয়েছিল। এক ঘন্টা সময় ধরে রাস্তার এদিক-ওদিক ঘুরেছে। এরমধ্যে ওর স্বামী একবারের জন্যেও খোঁজ করেনি তার বউটি কোথায় গেল। সম্পর্কের চরম টানাপোড়েনে দুইদিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল শশীর মা। তবু ডাক্তার ডাকেনি ওর স্বামী। কারণ, তাহলে জানাজানি হয়ে যাবে ওর কুকীর্তির কথা।
আমি শশীর মায়ের মুখ থেকে একটি একটি করে কথা শুনি আর টের পাই আমার বুকের প্রকোষ্টের এক একটি পাঁজর নড়েচড়ে উঠছে। যখন শুনলাম আমাদের ফুলের মতো মেয়েটির গায়ে সে হাত তুলেছে তখন নিমিষেই আমার পৃথিবীটা দুলে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। তারপর যখন শুনলাম বিয়ের আগেও ওর আরও দুটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল তখন নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম ‘ওর বাহিরটা যতটা কুৎসিত ভিতরটা তার চেয়েও কুৎসিত।’ অথচ পাশাপাশি গ্রামের ছেলেমেয়ে ওরা দু’জন, পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে ওদের। এলাকার সবাই বিয়ের আগে ছেলে অত্যন্ত সৎ ও চরিত্রবান হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছিল। বিয়ের পর গত পাঁচ বছরে ওর আচার-ব্যবহারে কোন অসদাচরণ আমাদের চোখে পড়েনি। সেই ছেলে কি-না এই !
বিশ্বাসের ভিতটা দুলে উঠারই কথা। আমি সেই মুহূর্তে একটি চিন্তাই করলাম যে ওদের সম্পর্কের এখন যে অবস্থা তাতে যে কোন সময় একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সবার আগে বাঁচাতে হবে আমার আত্মার কুটরটিাকে। আমি শশীর মাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বলো এখন তুমি কি করতে চাও। তুমি একটা শিক্ষিত চাকুরিজীবী মেয়ে। স্বামীর এই আচরণ ভাগ্য বলে মেনে নিয়ে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়া তোমার কাজ নয়। শশীর মা জবাব দেয়, খালাম্মা আমার খুব ভয় করছে। ঐ মেয়ের কথায় ও যদি আমাকে কিছু খাইয়ে মেরে ফেলে ?
ওর কথা শুনে আমি কেঁপে উঠলাম। আশংকাটা অবাস্তব নয়, অহরহই ঘটছে ঠিক এই কারণেই। আমি আমার সিদ্ধান্ত ঠিক করে ফেললাম। ওকে তৈরী হয়ে থাকতে বলে বাসায় আসলাম আমি। আমার স্বামীকে সব খুলে বললাম। সে আমাকে পরামর্শ দিল গ্রামে ওর বাবাকে এক্ষুণি সব জানাতে। সাথে সাথে আমি ফোন করলাম ওর বাবাকে। সব শুনে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, আমার মেয়েটাকে তুমি বাঁচাও। ওকে তোমার কাছে এনে রাখ।
কিন্তু কাজটা করতে হবে পরদিন শশীর বাবা ঢাকায় ফেরার পর। কারণ, ওর অনুপস্থিতিতে ওর বউ-বাচ্চাকে নিয়ে আসলে অন্যরকম একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলবে সে। সে সুযোগ আমি তাকে দিবনা। আমার একজন আইনজীবী বন্ধুর সাথে পরামর্শ করলাম এ নিয়ে। সেও আমাদের পদক্ষেপকে সমর্থন জানাল। আমি শশীর মাকে সেই অনুসারে তৈরী থাকতে বললাম। পরদিন ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যার পর শশীর বাবা বাসায় ফিরে। খবরটা দেয় শশীর মা আমাদের পূর্ব নির্দেশমতো। আমি আমার স্বামীকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গাড়িতে ফার্মগেট থেকে সিপাহীবাগ যেতে সময় লাগে চল্লিশ মিনিটের মতো। আমরা বাসায় ঢুকার পর শশীর বাবা যথারীতি আমাদেরকে সালাম দেয়। আমি প্রতি উত্তর দিয়ে বলি, কয়েকদিন যাবৎ লিলি মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত। ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাই ওকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার বাসায় কিছুদিন থেকে আসুক। তারপর আমার স্বামীও আমার সাথে যোগ দেয়। আমরা বলি, তুমি বাসায় আসো, কথা বলি আমরা। দেখি কি হয়েছে?
শশীর বাবা এর প্রতি উত্তরে কিছু বলেনা। আমরা সবাই যখন ঘর থেকে বের হয়ে আসছি তখন শশীর বাবা শশীর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, স্কুলের কি হবে ? এখানে বলে রাখি যে, লিলি একটি স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষয়ত্রী এবং ওর স্কুলটা ওদের বাসার একদম কাছে। ওদের মেয়ে শশীকে দেখাশুনা করে রহিমা, যার বাড়িও ওদের গ্রামে। শশীর বাবার প্রশ্নের উত্তরে লিলি জবাব দেয়, রহিমা ফুফুকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
আর কোন কথা হয়না। সবার শেষে ছিলাম আমি। তিন তলা থেকে সিঁড়ির দুটো ধাপ পার না হতেই আমাদের পেছনে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেয় শশীর বাবা।
যাই হোক। চলে আসি আমরা। অনেক দিন পর শশীর চঞ্চলতা আর দুষ্টুমিতে মুখর হয়ে উঠে আমার ফ্ল্যাটটি। ওকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে আমাদের সবার। রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, অবরোধ মাথায় নিয়ে প্রতিদিন লিলি আমার বাসা থেকে ওর বাসার কাছে স্কুলে যাচ্ছে। শশীর বাবা আমার ও আমার স্বামীর ফোনে ফোন করে শশীর খোঁজ নেয়, কথা বলে শশীর সাথে। কিন্তু শশীর মায়ের ব্যাপারে কিছু বলেনা। ফোনও করেনা ওকে। শশীর নানা গ্রামের একটি হাইস্কুলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। পাশাপাশি গ্রামের মাতবর গোছের লোকও। গ্রামের বিভিন্ন সালিশ-মিটিং এ অগ্রণী ভূমিকায় উনাকে থাকতে হয়।
এদিকে আমার প্রাণহীন বাসাটাকে প্রাণের আনন্দে মাতিয়ে রাখে শশী একা। কিন্তু ওর মায়ের বুকের রক্তক্ষরণটা আমি টের পাই। মাঝে মাঝে আমাকে প্রশ্ন করে, খালাম্মা আমার কি হবে ?
ওর ছলছল চোখের জিজ্ঞাসা আমার বুকের ভিতরটা নাড়িয়ে দিলেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি আমি। বলি, কি হবে মানে ? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি থাকতে এতটা চিন্তা কেন আসে তোমার মনে ?
বলি বটে। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থার আসল ক্ষতটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনা। যদি ওদের মধ্যে একটা ইতিবাচক মীমাংসা না-ই হয়, যদি আলাদা হয়ে যেতে হয় ওদেরকে তাহলে এই সমাজ ব্যবস্থা যে প্রথমে মেয়েটির দিকেই আঙুল তুলবে। তার উপর রয়েছে ঘর আলো করা শশী। বাবা ছাড়া বড় হতে হতে ওর মনে যে প্রশ্নগুলো জাগবে সেগুলোর উত্তর দিতে দিতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে না তো লিলি ?
লিলি আবার প্রশ্ন করে, খালাম্মা আমার ভাগ্যটা এমন হলো কেন ?
এই প্রশ্নেরও কোন উত্তর দিতে পারিনা আমি। কারণ, এই একই প্রশ্ন আমারও বিধাতার কাছে। যিনি মানুষের ভাগ্য নিয়ে অহরহ খেলায় মেতে রয়েছেন। খেলায় মেতে রয়েছেন বললাম এই কারণে যে, তা না হলে লিলির মতো একটা মেয়ের এমন জীবনসংগী কেন জুটিয়ে রাখলেন বিধাতা ? লিলি অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট একটি মেয়ে, সাতচড়ে রা’টি করেনা। দেখতে সুন্দর, জীবনের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কোন উচ্চাকাংখা নেই। পাশাপাশি ওর স্বামীটি, যাকে দেখে পছন্দ করার মতো কিছু নেই। বরং উল্টোটাই ঘটনার কথা। একটি অতি সাধারণ অশিক্ষিত ঘরের একমাত্র শিক্ষিত ছেলে। ওকে পছন্দ করার একমাত্র কারণ হলো লিলি সাধারণ মাপের তুলনায় একটু খাটো।
যাক সে কথা। শশীর নানু বাধ্য হয়ে শশীর দাদুর বাড়িতে ব্যাপারটা জানায়। জানানো হয় ওদের বিয়ের ঘটককেও। শুনে সবাই এমন অবাক হয় যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য একটি ঘটনার কথা বলছি আমরা। গ্রামের চেয়ারম্যানকেও জানানো হয় ঘটনাটি। ওরা শশীর বাবার সাথে ফোনে যোগাযোগ করলে নানা টালবাহানা করতে শুরু করে সে। প্রথমে বুঝাতে চেষ্টা করে যে তেমন কোন সম্পর্ক নেই ঐ মেয়ের সাথে। মাত্র কয়দিন ধরে ফোনে আলাপ। সেটাকেই ভুল বুঝেছে লিলি। লিলির শ্বশুর-ভাসুর গ্রামের সহজ-সরল মানুষ, তাদের ছেলের কথা মেনে নিয়ে লিলিকে বলে বাসায় চলে যেতে। কিন্তু লিলির এক কথা, এভাবে যাবার জন্য আমি আসিনি। আমার কিছু কথা আছে তা আপনাদেরকে শুনতে হবে। এরপর আমি যাব। আপনারা আসুন।
খলের ছলের অভাব হয়না-একথা আমরা সকলেই জানি। এই পন্থায় কাজ হচ্ছেনা দেখে নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয় লিলির স্বামী। সে ফোনে তার পরিবারের লোকজনকে জানায় যে লিলি বাসা থেকে সমস্ত গয়না-টাকা-পয়সা ও অন্যান্য দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে চলে এসেছে। আমি সাথে সাথে এনিয়ে আমার আইনজীবী বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করি। সে আমাকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে, মেয়ে যদি চলেই যায় তাহলে সে তার ব্যবহৃত সমস্ত কিছু সাথে নিয়ে যেতে পারে। কোন আইনে এটাকে আটকাতে পারবে না।
আমি বুঝতে পাচ্ছিলাম স্বামীর এই ধরনের মানসিক হীনতা দেখে লিলি ভিতরে ভিতরে কুকড়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জন গিয়ে যেখানে ওকে নিয়ে এসেছি। এরইমধ্যে আমি একদিন মন্তব্য করলাম যে, নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য সে যা করছে তাতে তার হীন মানসিকতারই প্রকাশ ঘটাচ্ছে। সাথে সাথে লিলি বলে, এ ধরনের মানুষের সাথে কিভাবে একসাথে থাকা সম্ভব ? লিলির এই প্রশ্নেরও কোন উত্তর দিতে পারিনা আমি। শুধু বলি, দেখনা কি হয় ! আল্লাহর উপর নির্ভর কর। সব মুশকিল আসান করবেন তিনি। আর আমি প্রতি ওয়াক্ত নামাজশেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকি, ইয়া আল্লাহ, তোমার ইচ্ছা ব্যতীত দুনিয়াতে গাছের একটি পাতাও নড়েনা। তুমি না চাইলে ওদের মাঝে এই সমস্যা এসে দাঁড়াতে পারত না। ছোট্ট শিশুটির কথা ভেবে এর একটা সুন্দর সমাধান তুমি করে দাও, যাতে করে শিশুটি ওর মা-বাবা দু’জনের স্নেহের ছায়াতে বড় হতে পারে। একই দোয়া করতে থাকে লিরির মা অর্থাৎ আমার বড় বোন।
জানিনা বিধাতা সেদিন আমাদের দু’বোনের ডাক শুনেছিলেন কি-না। লিলি যেদিন আর ঐ সংসারে যাবেনা বলে কান্নাকাটি করল এর দুদিন পরই খবর এলো ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন ঢাকায় আসতে রাজী হয়েছে বিষয়টি মীমাংসার জন্য। সংগে ওর বাবা তো আছেই। আর আছে ওদের বিয়ের ঘটক। ব্যাপারটা আমি লিলির বড় ভাই, যে ঢাকায় একটি ব্যাংকে চাকুরী করে, তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলাম এবং জানালাম।১৪ ডিসেম্বর ওরা আমায় বসবে তাও জানালাম। কিন্তু ওর স্ত্রী-কন্যা থাকে ময়মনসিংহে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ওদের কাছে যেতে পারছেনা দুই সপ্তাহ ধরে। এ সপ্তাহে যাওয়া দরকার। তাই ১৪ তারিখের মিটিং এ কি করে থাকবে ভাবছিল। আমি ব্যাপারটা সহজ করে দিলাম। বললাম, আমরা মুরুব্বীরাই যেহেতু বসব সেখানে তোমার না থাকলেও চলবে। তুমি ময়মনসিংহ যাও। মেয়েটা তোমার অপেক্ষায় থাকবে। আসলে সব শুনার পর ওর যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি আমি তাতে মনে মনে আমিও চাইছিলাম ও না থাকুক ঐ দিন। রাগের বশে কি বলে বসবে বলা তো যায়না।
আমি ১৪ ডিসেম্বর যথারীতি জামাই আয়োজন করলাম বাসায়। লিলির বাবা গতরাতই আমার বাসায় এসেছে। খবর পেয়েছি যে শশীর চাচা ও ঘটক লিলির সিপাহী বাগের বাসায় উঠেছে। আমি সবাইকে পরদিন অর্থাৎ ১৪ তারিখ দুপুরে আমার বাসায় খাবারের দাওয়াত দিলাম। যথাসময়ে ওরা এল। শশী তো বাবাকে পেয়ে মহাখুশী। আমরা সবাই বসলাম। প্রথমে কথা বললাম আমি।
আপনাদেরকে দেশ থেকে এতদূর ডেকে আনতে হয়েছে। কারণটা সবাই জানেন। কোন মেয়ে তার নিজহাতে গড়া সংসার ছেড়ে চলে আসতে চায়না। লিলি চলে আসতে চাইছিল তাই আমরা গিয়ে নিয়ে এসেছি ওর বাবার সম্মতিতে। এরপর আপনারা ওকে চলে যেতে বলেছেন ওর সংসারে। কিন্তু ও যায়নি। কারণ কিছু সমস্যার সুরাহা করে তবে যেতে চায় লিলি। লিলি সবার সামনে কিছু কথা বলতে চায়, যা আপনারা জানেন না। অথবা ভুল বুঝানো হয়েছে আপনাদেরকে।
তারপর শশীর বাবার উদ্দেশ্যে বলি, ঘরে বউ রেখে, বাচ্চা রেখে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয় তোমাকে। লিলিকে তুমি মেয়ে রেখে চলে আসতে বলেছ। গত কয়মাস যাবৎ তোমাদের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটাকে স্বভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলা যায়না। তোমার আচরণ বুঝিয়ে দিচ্ছে ঘরের স্ত্রীর চেয়ে বাইরের সম্পর্ক তোমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এবার বল, এসব কেন ? লিলির সাথে সংসার যাপনে তোমার কি বড় ধরনের কোন সমস্যা হচ্ছে যার কারণে ঘরের শান্তি নষ্ট করেও তুমি বাইরের সম্পর্ককে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছ ? লিলির কোন সমস্যা থাকলে তা সবার সামনে বল।
আমি থামি। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে শশীর বাবা। এই ফাঁকে আমার দুলাভাই অর্থাৎ লিলির বাবা বলেন, আমার মেয়ের কোন দোষ থাকলে তুমি এখানেই বল।
তখন শশীর বাবা জবাব দেয়, ওর কোন দোষ নেই। সব অপরাধ আমার।
আমার হাজব্যান্ড তখন বলেন, মানুষ সন্তানের জন্য কত কি করে ! এমন একটা সন্তান রেখে স্ত্রী মারা গেলে এবং সেই স্বামীর চেহারা-ছবি দেখতে ভালো থাকলেও সে আর বিয়ে না করে বাকী জীবন কাটিয়ে দেয়। তোমাকে আমি আসতে বলেছিলাম কথা বলার জন্য। তুমি না এসে ফোনে শশীর খবর নাও। লিলির কোন খবর তুমি নাওনা। তুমি কত বড় হয়ে গেছ যে আমি আসতে বলা সত্ত্বেও আসনি। লিলি তোমার সন্তানের মা। তোমার জীবনে ওর কোন প্রয়োজন নেই তাহলে তুমি মেয়ে পাবে কি করে ?
এই প্রসংগে আমি বলি, তুমি তো শিক্ষিত চাকুরিজীবী ছেলে। দেশের আইন তো তোমার কিছু হলেও জানার কথা। লিলিকে যে মেয়ে রেখে চলে আসতে বললে ধওর লিলি চলে আসল মেয়ে রেখে। এরপর কি হতো ? মেয়ে তুমি রাখতে পারতে ? যদি দুইজন একসাথে না-ই থাকতে পার তাহলে সন্তানের বয়স আঠার বছর না হওয়া পর্যন্ত আইন অনুসারে সে মায়ের অধিকারে থাকত। তুমি নিজের অধিকারে সন্তানকে নিতে পারতেনা। বরং তার ভরণ-পোষণের খরচ বহন করতে হতো।
এত কথার মাঝে মিনমিন করে শশীর বাবা বলে যে আমরা কেন ঐদিন এভাবে লিলিকে নিয়ে এসেছি। এতে ওর খুব খারাপ লেগেছে।
আমি বললাম, তোমাদের মধ্যে যা চলছিল সেটাকে কি কোন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলে। তোমরা যে এরপর আরও কোন দুর্ঘটনা ঘটাতে না তার নিশ্চয়তা কি ? ওকে তো এনেছি প্রায় আধমরা অবস্থায়। আমি আবার বলি, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে বিশ্বাসের, নির্ভরতার, আস্থার। তোমার উপর থেকে তোমার স্ত্রীর বিশ্বাস, আস্থা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা নষ্ট করেছ তুমি। এখন লিলির মনে সেটা ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও তোমার। তোমার উপর আস্থা রেখে লিলি যখনই বলব তখনই ওকে পাঠিয়ে দিব।
এবার লিলি বলে, সে মেয়ের মাথায় হাত রেখে প্রতীজ্ঞা করার পরও আবার সেই মেয়ের সাথে সম্পর্ক রেখেছে। আমার গায়ে হাত তুলেছে। আবার যে সে এরকম করবে না তার নিশ্চয়তা কি ? লিলির জিজ্ঞাসা আরও আছে। সে জানতে চায়, আজ যদি আমি এরকম করতাম তাহলে সে কি করত ?
সেখানে উপস্থিত আমরা ছয় জনের সামনে একটি প্রশ্ন। আমার মনে হয় এ জিজ্ঞাসা গোটা সমাজের কাছে। একজন পুরুষ ঘরে স্ত্রী রেখে বাইরে অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে। তার নামের সাথে কুলটা বা চরিত্রহীন জাতীয় কোন বিশেষণ যোগ হয়না। অথচ একটা মেয়ে এপথে হাঁটলে তার কপালে কুলটা কিংবা চরিত্রহীনার কলংকতিলক পরাবার জন্য আগ্রহী লোকের অভাব হয়না এই সমাজে। লিলির এই একটি প্রশ্ন আমাদের ঘুণেধরা গোটা সমাজকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেও সমাজের তাতে কিছু যায় আসেনা। যদি কিছু যেত আসত তাহলে লিলির স্বামী এই মুহূর্তে তার স্ত্রীর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য থাকত।
অপরাধীর মতো মুখ করে লিলির স্বামী তখন বলে, আমি সবার সামনে কথা দিচ্ছি আমার দ্বারা এমন কাজ আর হবেনা। আপনারা সবাই আগে যেভাবে আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন ভবিষ্যতেও সেরকম পাবেন।
তারপর প্রসংগ উঠে টাকা-পয়সা-গয়না নিয়ে আসা প্রসংগে। শশীর চাচা বলে, একথা কে বলেছে ? আমি তো জানিনা ?
দুলাভাই বলেন, সাক্ষী তো সামনেই হাজির। ঘটককে বলেছে। ঘটক সাথে সাথে বলে, হ্যাঁ, বলেছিল। পরে অবশ্য নিজের ভুল স্বীকার করেছে।
শশীর চাচা সাথে সাথে তার ভাইকে বলে, যত দোষ তোর। সবার কাছে ক্ষমা চা।
এরপর ক্ষমা চাওয়ার ভিত্তিতে সেদিনই লিলি ওর স্বামীর সাথে নিজের সংসারে ফিরে যায়। কিন্তু আমার মনের ভিতর একটা খচখচানি থেকেই যায়। ভবিষ্যতে ঠিক থাকবে তো ওদের সংসার ? আমরা বড় কিছু হারাব না তো এরপর ?
প্রশ্নগুলো ভবিষ্যতের কাছেই ছুড়ে দিলাম আমি।
২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩০
সুফিয়া বলেছেন: আপনার কথাগুলো একদম ঠিক। যেমন একবাক্যে আমরা ওকে বলে দিয়েছি যে মনে রেখো, তোমার স্বামীর এটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কাজেই সবকিছুর পরও বাড়তি একটা চোখ খোলা রাখতে হবে।
ওদের জন্য দোয়া করবেন।
ধন্যবাদ আপনাকে।
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:০১
ফিলিংস বলেছেন: দোয়া করি ভালো থাকুক ওরা।
লিলি কে চোখ কান খোলা রাখ তে বলবেন। ছেলেটা নতুন কৈাশল ধরতে পারে। গত বার যে কারনে লিলির কাছে ধরা খেয়েছিল সেগুলো এবার এড়িয়ে চলতে পারে।লিলি কে স্বামীর কর্ম ক্ষেত্রর কারো সাহায্য নিতে বলেন যেমন উনি কখন যায় আসে ইত্যদি।স্বামীর প্রতি বারতি সন্দেহ হিতে বিপরিত হতে পারে।
পরকীয়া শরীর সরবস্য সম্পর্ক তাই এটা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন।