নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

বালাই ষাট্------- গ্রাম বাংলার অপলৌকিকতা।

১১ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৪০

বালাই ষাট্ --------- গ্রাম বাংলার অপলৌকিকতা



বাঙালীর জীবন-যাপন প্রণালীর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ তাদের গ্রামীণ জন-জীবন। আর গ্রামীণ জীবন সংস্কৃতির সাথে এক সূত্রে গেঁথে আছে গ্রামীণ লোক-লৌকিকতা বা আচার অনুষ্ঠান। এসব লোক-লৌকিকতা গ্রামীণ কৃষ্টিকে একদিকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তেমনি অন্যদিকে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের কোপানলে ফেলে গ্রামীণ জীবন সংস্কৃতিকে করে রেখেছে পশ্চাৎমুখী। এসব আচার-অনুষ্ঠান বা লৌকিকতা, যার বেশীর ভাগই অপলৌকিকতার অংশ - তার উৎস কোথায় ? উত্তর একটাই। প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা নিয়ম বা প্রথা। যুক্তির ব্যাখ্যায় এসবের কোনটাই ধোপে ঠিকবেনা সত্যি। কিন্তু আমাদের অর্ধ-শিক্ষিত বা অশিক্ষিত গ্রামীণ সমাজে এদের অবস্থান এতই পোক্ত যে সহজ-সরল মানুষগুলোকে এসবের বাইরে টেনে আনা রীতিমত দুঃসাধ্য। শুধুমাত্র অর্ধ-শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষের উপর দোষ চাপানোটা বোধহয় ন্যায় বিচারের ধোপে ঠিকবেনা। বহু শিক্ষিত আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত শহুরে মানুষের মাঝে কুসংস্কারের সাক্ষাত উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়।



অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থায় এসব অপসংস্কৃতি বা কুসংস্কারে ভিন্নতা দেখা যেতে পারে। আমি গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত সমস্ত লৌকিকতাকে অপলৌকিকতা বা অপসংস্কৃতি বলছিনা। আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ঐশ্বর্যমন্ডিত ভান্ডার। শুধুমাত্র এর যে অংশটুকু অশিক্ষা আর অজ্ঞতার অন্ধকুঠুরী থেকে উঠে এসে আমাদের অগ্রসরমান জীবনযাত্রাকে পশ্চাৎমুখে টেনে ধরে আছে তাকে আমি বলছি অপলৌকিকতা বা অপসংস্কৃতি। অজ্ঞতা আর অন্ধবিশ্বাসই এর ভিত্তি। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় এর কোন অস্তিত্বের স্বীকৃতি মিবেলনা। তবে যাই হোক। লৌকিকতা বা অপলৌকিকতা যাই বলি না কেন এগুলো স¤পর্কে জানতে হলে পৌঁছুতে হবে গ্রামীন জীবন প্রণালীর একদম গভীরে। শহুরে অতি আধুনিকতার পোশাকটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলে মিশে যেতে হবে গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থার প্রাত্যাহিকতার সাথে।



আগেই বলেছি বাংলাদেশের এক এলাকার লৌকিকতা বা আচার-অনুষ্ঠান অন্য এলাকার সাথে হুবহু মিলবে না। তবে একেবারে ভিন্ন বা মিল নেই একথা বলা যাবেনা। কাজেই বাংলাদেশের লোক-লৌকিকতা বা আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে লিখতে হলে চষে বেড়াতে হবে গোটা গ্রামীণ জনপদ। সে সুযোগ আমার পুরোপুরি না হলেও আংশিক হয়েছে। সেই সুবাদে আমার চেতনার রাজ্যে দাগ কেটে আছে কাছ থেকে দেখা এমন কতকগুলো অপলৌকিকতার আদ্যোপান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমার এ লেখায়।





ভূতে ধরা



গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত অতি পরিচিত একটা শব্দ। আমি বলব রোগ। ছোটকাল থেকে আমার নানাবাড়ি (ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল থানা) বা এর আশেপাশে দেখে এসেছি বহু ভূতে ধরা মানুষ। আমার অতি কাছের দু‘একজনকে দেখেছি এ অবস্থায়। কিছুদিন পর পর তাদের ভূতে ধরত। সেই সময়টাতে তারা পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে একাকী সময় কাটাত। সময়মত খাওয়-দাওয়া-গোসল-নামাজ পড়া কোনটাই তারা করতনা। নিজের মনের খেয়াল-খুশীমত চলত। যাকে ইচেছ গালাগাল দিত। হাতের কাছে মারধরও করত। সেই সময়টাতে গায়ের শক্তিতে নাকি তার সাথে কেউ পেরে উঠতনা। যার কারণে সবাই একটা নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলত ভূতে ধরা মানুষটার কাছ থেকে। আমরা ছোটরা মনে মনে প্রচন্ড একটা ভয় নিয়ে চলাফেরা করতাম। মা-বাবা বা বড় শ্রেণীর কারও সাথ ছাড়া ঘরের বাহির হতামনা।



কোন কোন সময় দুই-চারদিন থাকার পর ভূত এমনিতেই চলে যেত। নাহ’লে খনকা ডেকে আনা হত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল ভূতে ধরা রোগীকে নাম জিজ্ঞেস করলেই হিন্দু নাম বলত। গ্রমাঞ্চলে এর পেছনে প্রচলিত ব্যাখ্যাট এরকম --- ভুত হল হিন্দুদের আত্মা। হিন্দু মানুষকে মরার পর আগুনে পুরানো হয় বলে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত এই আত্মাগুলো খোদার আরশের নীচে ঠাঁই না পেয়ে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় আর প্রতিহিংসাবশত মানুষের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে। তারই একটা প্রক্রিয়া হল মানুষের উপর ভর করা। যাকে গ্রামের মানুষ বলে ভুতে ধরা।

এই ভূতে ধরা নিয়ে আরও একটা অন্ধ বিশ্বাস মানুষের মধ্যে আছে। তাদের মতে মহিলাকে ধরে পুরুষ ভূতে আর পুরুষকে ধরে মহিলা ভূতে। আমার মনে হয় আজ পর্যন্ত আমি যত ভূতে ধরা রোগী দেখেছি তার মধ্যে মহিলাই বেশী। নাম জিজ্ঞাসা করলেই হিন্দু পুরুষের নাম বলত। তবে কি হিন্দু পুরুষ আত্মাগুলোই বেশী পরিমাণে খোদার আরশের ছায়া থেকে বঞ্চিত ? এর কোন সদুত্তর কারও কাছ থেকে পাইনি।



সে যাক। খনকা এসে ভূতে ধরা রোগীকে উঠোনে বসিয়ে ডালপাতা (কি গাছের ডাল তা এই মুহূর্তে ঠিক মনে করতে পারছিনা) ইত্যাদি দিয়ে প্রচন্ডভাবে পেটাত। এক সময় জিজ্ঞেস করত - কি পেলে চলে যাবি বল ? উত্তর কি আসত জানিনা। খনকা রোগীর পরিবারকে বলত পাঁচসের চাল, পাঁচটা ডিম বা কিছু নির্দিষ্ট টাকা দিতে। তাহলেই ভূত চলে যাবে। তার কাছে নাকি চেয়েছে। এগুলো দেয়ার পর দেখতাম খনকা কালো কাপড়ের শতরঞ্জিতে বেঁধে নিয়ে চলে যেত। বলত অমাবশ্যার রাতে তেরাস্তার মাথায় এগুলো রেখে আসতে হবে। আপনারা পারবেননা। আমিই রেখে আসব। সাথে তার নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক তো নিতই। কোনদিনও এগুলো তেরাস্তার মাথায় রাখা হয়েছে এমন কোন প্রমান পাওয়া যায়নি।



খনকা মাঝে মাঝে ভূতকে এও জিজ্ঞাসা করত - কেন ধরেছিস ? উত্তর আসত খনকার মুখ দিয়ে একই প্রক্রিয়ায়। ভর দুপুরে সে অমুক গাছের তলায় বসেছিল। রোগী তার গায়ে পা দিয়েছিল অথবা তার চুল মাড়িয়ে গিয়েছিল। ভূতে ধরার এই সমস্ত কারণের জন্যে যুবতী মেয়ে বা নতুন বৌদের উপর ভর দুপুরে কিংবা ভর সন্ধ্যায় যত্রতত্র চলাফেরা করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকেন গুরুজনেরা। শুধু তাই নয়। ভূতে ধরা ব্যক্তিকে ছেড়ে যাওয়ার সময় আর একজনের উপর ভর করে যায়। যেহেতু সুন্দরী যুবতী মেয়ে বা নতুন বৌদের উপর ভূতদের নজর বেশী সেহেতু ভূত তাড়ানোর সময় এদেরকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখা হত।

ভূত তো চলে গেল। এরপর ভূতে ধরা মানুষটার অবস্থা কি দাঁড়ায় ? প্রচন্ড গা ব্যাথা, জ্বর জ্বর ভাব ইত্যাদি ইত্যাদি। এর পেছনের ব্যাখ্যাও সেই কুসংস্কারের পাদ-প্রদীপে ঢাকা। এবার প্রচন্ড রেগেছিল ভূত। তাই কষ্ট দিয়ে গেছে আগের চেয়ে বেশী। কারও সাধ্য নেই আসল সত্যটা এখানে দাঁড় করানোর যে খনকার মারধরের কারণেই রোগীর এই অবস্থা। ছোটকালে বুদ্ধি-বিবেচনার ধারেকাছেও না ঘেষে প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করতাম এর সবকিছু। কিন্তু আস্তে আস্তে সময়ের সাথে শিক্ষার প্রবাহমানতায় এই বিশ্বাসের খুঁটিটা নড়বড়ে হয়েছে অনেকখানি। বিবেক-বুদ্ধির ব্যাখ্যায় এর স্বপক্ষে কোন যুক্তিই দাঁড় করাতে পারিনা এখন পর্যন্ত। মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে অবৈজ্ঞানীক রোগের নাম হল ‘ভূতে ধরা‘। যার বৈজ্ঞানীক নাম হতে পারে হিষ্টিরিয়া বা বিকার গ্রস্থতা। অথচ অতি আধুনিকতার এই সময়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও নিজের মন থেকে ভূতে ধরার ব্যাপারটাকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। ভূত নামক শব্দটার সাথে মনের এক কোণে ভয় নামক অনুভূতির অস্তিত্ব এখনও টের পাই।



বান মারা বা বেদ মারা



আমি চিকিৎসক হলে এক্ষেত্রে খুব ভাল হত। অথবা কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা শুধুমাত্র গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত এই জাতীয় রোগের চিকিৎসা করাতে পারলে ভাল হত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা আপাতত দূরে থাক। আমার এই সাধারণ চোখে ও চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় যা জানতে পেরেছি তা হল এই যে, কোন ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হয়ে দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থাকলে এবং সাধারণ ঝাড়-ফোঁকে সুস্থ হওয়ার লক্ষণ দেখা না গেলে ধরে নেয়া হয় যে ঐ ব্যক্তিকে কেউ শত্রুতাবশত বান মেরেছে বা বেদ মেরেছে। অর্থাৎ তাকে কুফুরি কালাম দিয়ে যাদু টোনা করেছে। একমাত্র ঐ যাদু টোনাকারী ছাড়া কেউ তাকে ভাল করে তুলতে পারবেনা। কারণ সুস্থ করে তুলতে হলে ঠিক উল্টো বান রোগীকে মারতে হবে। একমাত্র যে বান বা বেদ মারে সেই জানে উল্টো বেদ মারতে।



গ্রামীণ বিশেষজ্ঞ কবিরাজরা যাদেরকে বান মারা বা বেদ মারা রোগী বলে সনাক্ত করে থাকেন তাদের দু’একজনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থেকে আমার প্রতিবেশী এক তরতাজা যুবক হাড্ডিসাড়ে পরিণত হয়ে মারা গেছে। আমার মনে হয়েছে সে জন্ডিস বা হেপাটইিটিস ভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি কারণ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার এক ঘনিষ্টজন ঢাকায় এক ক্লিনিকে মারা গেছে। প্রায় প্রতিদিন তাকে দেখতে যেতাম। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দেবার পরও তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কি প্রাণপন চেষ্টাটাই না করেছিল তার স্ত্রী ! যাক্। যে কথা বলছিলাম। আমার মনে হয়েছে এই সমস্ত বান মারা বা বেদ মারা রোগীদেরকে উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে পারলে তাদের শেষ দিনগুলোর বেঁচে থাকাকে আর একটু আরামদায়ক করা যেত।



নাগে প্যাঁচা



আগে যে দু’টো রোগ নামক অন্ধবিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে সেগুলোর উপস্থিতি এখনও গ্রামাঞ্চলে দেখা গেলেও নাগে প্যাঁচা রোগটা কি জানি কেন আগের মত দেখা যাচ্ছেনা। তখন আমি ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি। আমার পিঠাপিঠি ছোট ভাইটার শরীর এক রাতে ভরে গেল বড় বড় চাকায়। সেই সাথে প্রচন্ড চুলকানি। সবাই বলল নাগে প্যাঁচছে। অর্থাৎ কোন জাত সাপের শ্বাস লেগেছে। কবিরাজ এনে ঝাড়-ফোঁক দিলেই সেরে যাবে। একজন বেড়িয়ে গেল কবিরাজ আনতে। পায়ে হেঁটে বেচারাকে যেতে হবে পাঁচ পাঁচটি মাইল। ততক্ষণে রোগীকে ভাল করে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হল। যার কারণে তার শরীরের চাকাগুলি আরও বড় হয়ে ফুলে উঠল।



কবিরাজ এল। বৈঠক ঘরের সামনে জলচৌকির উপর সম্পূর্ণ উলংগ করে রোগীকে বসানো হল। চারিদিকে উৎসাহী দর্শনার্থীদের ভীর জমে গেল। বেচারা ভাইটির আমার সেই কি অবস্থা ! লজ্জা ঢাকার কি প্রাণান্তকর চেষ্টা ! কিন্তু কবিরাজের ধমকে সেটি হবার নয়। তার কথামত কেউ একজন নতুন কাসার বদনায় করে এক নিঃশ্বাসে এক বদনা পানি পুকুর থেকে তুলে আনল। কবিরাজ কি গাছের যেন (আজ আর নাম মনে করতে পারছিনা) কয়টা ছোট পাতাসমেত ডাল নিয়ে সেগুলো পানিতে ভিজিয়ে নিল। তারে আগে কিসব মন্ত্র পড়ে পানিতে ফুঁ দিল। তারপর সেই ভেজা ডাল থেকে পানি ছিটিয়ে দিল ওর গায়ে। কোন রকম তেল সাবান গায়ে ব্যবহার করা যাবেনা। কোন আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়া যাবেনা। এভাবে চলতে হবে সাতদিন। তবেই সুস্থ হয়ে উঠবে রোগী। ইত্যাদি উপদেশ দিয়ে পকেটে কবিরাজী ফি টা নিয়ে চলে গেল কবিরাজ। আমার এখনও ¯পষ্ট মনে আছে। সাতদিন তো লাগেইনি। গায়ে আলো-বাতাস লাগার পর থেকেই ওর চাকাগুলো মিলিয়ে আসছিল এবং সন্ধ্যে নাগাদ একদম স্বাভাবিক হয়ে আসছিল ওর শরীর। অথচ টানা সাতটা দিন কবিরাজের নির্দেশ তাকে মেনে চলতে হয়েছে।



হায়রে অন্ধবিশ্বাস ! তোর ক্ষমতা ব্যাখ্যা করার মত কলমের শক্তি আমার নেই। নাহলে বড় হয়ে যখন দেখলাম একটু চুলকালেই আমার ভাইটার শরীরে চাকা চাকা দেখা দেয় এবং পাউডার জাতীয় কিছু দিলেই সেগুলো সেরে যায় তখনও কেন শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি তোর বিরুদ্ধে। শুধু এই নয়। এই জাতীয় এলার্জির বাতিক রয়েছে আমার শরীরেও। হঠৎ করে চুলকানি হয়ে গায়ে ছোট ছোট চাকার মত হয়ে যায়। পাউডার দিলেই চুলকানি থেমে গিয়ে চাকাগুলো মিলিয়ে যেতে থাকে। ডাক্তারের মতে এক এক জনের শরীরে এই এলার্জির কারণ এবং প্রকাশ এক এক রকম হয়ে থাকে। তবে এর মূল কারণ হল খাবার। সব খাবারও সবার জন্য এলার্জির কারণ হয়না। যার যে খাবারে এলার্জি তার উচিত সে সব খাবার এড়িয়ে চলা।



থাপা খাওয়া



গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত মরণব্যধি। যে ব্যক্তি থাপা খায় তার একমাত্র পরিণতি মৃত্যু। পৃথিবীর কোন শক্তি নেই তাকে বাঁচিয়ে রাখার। একজন তরতাজা মানুষ, কোন রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত না হয়ে হঠাৎ মারা গেলে ধরে নেয়া হয় সে থাপা খেয়েছে। এর লক্ষণ দেখা যায় মৃত ব্যক্তির শরীরে। তবে তার মৃত্যুর পর। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দিতে গিয়ে আনেকে নাকি দেখেছে এই লক্ষণ। শরীরের যে কোন জায়গা কালসিটে হয়ে উঠা অংশে পাঁচ আঙুলের চিহ্ন। সাধারণত মহিলারা এর শিকার হয়ে থাকে বেশী। আমার দুর্ভাগ্য আমার অতি প্রিয় বড় বোনটির মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে এ রোগটিকে। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। স্বচছ কোন ধারণা ছিলনা এ রোগটি স¤পর্কে শুধুমাত্র লোমহর্ষক ভীতিকর মানসিকতা ছাড়া। আপা ছিল আমার বাবা-মার বড় সন্তান। বিয়ে হয়েছিল গোঁড়া ধর্মীয় পরিবারে। যেখানে গিয়ে আপা আমাদের আলো-বাতাস ভরা পরিবেশের বিন্দুমাত্রও পায়নি। বরং ধর্মীয় কুসংস্কারের দমবদ্ধ করা বিকৃত আয়োজনের শিকার হতে হয়েছিল আপাকে। শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে এর পদতলে সম্পূর্ণ বিনা চিকিৎসায়। ধোঁয়া তোলা হল সেই কুসংস্কার আর অপলৌকিকতার। থাপা খেয়েছে তো। বাঁচবে কি করে ?



আমার বোনের মৃত্যুর ক্ষতটা আমরা কেউই আজ পর্যন্ত কোন প্রলেপে সারিয়ে তুলতে পারিনি। যেহেতু এই লেখার একমাত্র উদাহরণ এটি সেহেতু একটু বর্ণনা না করে পারছিনা আমার বোনের মৃত্যুর ঘটনাবলী। যদিও বুকের ক্ষতটা আবার নতুনভাবে মোচড় দিয়ে উঠছে। আপা ছিল আসন্ন প্রসবা। বাল্য বিবাহের কারণে আঠার বৎসর বয়সেই সে চতুর্থ সন্তানের মা হতে যাচ্ছিল। তার প্রথম দুটি সন্তান মৃতই জন্ম নিয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। আজ যদিও আমরা বুঝি যে মা হওয়ার মত শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি তার তখনও গড়ে উঠছিলনা বলে তার সন্তান দু’টি মৃত জন্মেছিল। অথচ আপার উপর কুদৃষ্টি পড়েছে বলে কুসংস্কারের যে মিথটিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল সেদিন, তা কিন্তু আজও বহাল তবিয়তে আছে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর শিক্ষা-সংস্কৃতিকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে। যাই হোক, তৃতীয়বার মা হওয়ার সময় অনেকটা জোড়-জবরদস্তি করে আপাকে আনা হয়েছিল আব্বার কর্মস্থলে। যার ফলে ডাক্তার-নার্সদের তত্ত্বাবধানে একটি সুস্থ ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছিল আপা। আজ বিয়ে করে সংসারী সে ছেলে। অথচ আমার আপা নেই।



ছেলের বয়স তখন দুই কি আড়াই বৎসর। চতুর্থবার মা হতে যাচ্ছে আপা। ডাক্তারদের কাছে নিলে ধর্মীয় বিধি-নিষেধের বরখেলাপ হয় -- এই অজুহাতে আপাকে ওরা গ্রামেই রেখে দেয়। আমরা যখন খবর পেলাম তখন ওর প্রসব বেদনার তৃতীয় দিন। আব্বা গিয়েই ওকে নিয়ে গেল থানা হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে একটি প্রাণ তো গেছেই আপার প্রাণও যায় যায় করছে। বাচ্চাটি পেটের ভিতর মরে ফুলে উঠার উপক্রম হয়েছে। তাড়াতাড়ি অপারেশন করে বাচ্চাটিকে কেটে চার টুকরা করে বের করে ডাক্তাররা। কিন্তু বাঁচানো গেলনা আপাকে। হয়ত ওর অপুষ্ঠ শরীরে বারবার মা হওয়ার কষ্ট বিধাতারও সহ্য হয়নি। তাই আপাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে গেছে।



আপার এই আকস্মিক মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় আমাদের সবাইকে। কিন্তু আমরা আরও বেশী নাড়াটা খেলাম যখন ওদের পক্ষ থেকে বলা হল যে, ডাক্তারের কাছে আগে নিলেও কোন লাভ হতনা। গোসল দেয়ার সময় শরীরে থাপা খাওয়ার চিহ্ন দেখা গেছে। ওকে বাঁচায় সাধ্য কার। শুধু তাই নয়। তাদের বক্তব্য আরও সুদুরপ্রসারী। আপার উপর কুদৃষ্টি পড়েছিল সেই প্রথম থেকেই। শেষ পর্যন্ত নিয়েই গেল। অথচ আপাকে গোসল দেয়ার সময় আম্মা নিজেও উপস্থিত ছিলেন। আমরা আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওর শরীরে কোন চিহ্ন দেখেছে কিনা। শোকে কাতর ছিলেন বলে আম্মার উত্তর আমরা মেনে নিয়েছি যে, ওনার তখন এসব কিছু দেখার হুশ ছিলনা। কিন্তু কুসংস্কারের বলিদান হয়ে আমার বোনটার অকালে ঝড়ে যাওয়াকে আমরা আজও মেনে নিতে পারিনি। বুকের ক্ষতটা তাই আজীবন ধিক ধিক করে জ্বলবেই।





মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৯

মুদ্‌দাকির বলেছেন: পড়ব

২০ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৭:৪১

সুফিয়া বলেছেন: ঠিক আছে। পড়ার পর আপনার মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।

২| ১৮ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ৯:১৭

হিমেল হাসান কাগজের খেয়া বলেছেন: প্রথম দুইটা জান্তাম। ন্যাগে প্যাঁচা। থাপে খাওয়া নতুন শুনলাম। কবে যে আমরা কুসংস্কার থেকে বের হতে পারব। আপনার লেখাটা সুন্দর লাগলো।

২০ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৭:৪০

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে এতবড় লেখাটা পড়ার জন্য। সত্যি কথা বলছেন কবে যে আমরা এই কুসংস্কার থেকে মুক্তি পাব জানিনা। একমাত্র শিক্ষাই দিতে পারে আমাদেরকে এই মুক্তির সন্ধান।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.