নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প --- বুকের ভিতর সন্ধ্যা

০২ রা আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৮

বুকের ভিতর সন্ধ্যা



হাইনজা অইয়া গেছে অহনও ঘর বাতি দেস নাই। কি করছস অতক্ষণ ?

অহনই দিতাছি।

অহনই দিতাছি মাইনি ? তুই দেহি অহনও হারিকেলই সাফ করছ নাই। সাফ করবি, তেল ভরবি, হের বাদে না জ্বালাইবি। এইহান দিয়ে যে হাইনজা গুজুইরা গেছে গা ?

হারিকেল সাফ করতে আর কতক্ষণ লাগব ? এই ত অইয়া গেল বইলা। তুমি একটু খাড়াওনা উডানে।

খাড়াইয়াই ত রইছি। এইডা ছাড়া আমার আর অহন করনের কি আছে ? সময়মতো ঘরে হাইনজা বাতি দিবি- এই কামডাও অওনের জোগাড় নাই। তর মতো গায়ে-গতরে তরতাজা একটা বউ ঘরে থাকতে এই কামডাও যদি ঠিকমতো না অয় তাইলে আর কি করা ? আমি বাইরের কাইজ-কাম ছাইড়া দিয়া ঘরে বইয়া থাহি।



ততক্ষণে হারিকেন পরিস্কার করা হয়ে গেছে লতিফার। তেলের বোতলটা উপুর করে যেটুকু কেরোসিন ছিল সবটুকু ঢেলে দেয় হারিকেনের পেটে। তারপর হারিকেন হাতে উঠে দাঁড়ায় সে। ঘরে ম্যাচ নেই, সারাদিন চুলা জ্বলেনি যে চুলা থেকে আগুন নিয়ে হারিকেন জ্বালাবে। পাশের উঠোনে ময়না রাতের রান্না চাপিয়েছে। লতিফা হারিকেন হাতে সেদিকে পা বাড়ায়। সাথে সাথে প্রায় গর্জে উঠে মবিন।



এই ভর হাইনজা বেলা কই যাইতাছস ?

হারিকেলডা ধরাইয়া আনি। ঘরে ত ম্যাচ নাই।

উত্তর দেয় লতিফা। মবিন আবার বলে

ম্যাচ নাই ত কি অইছে ? খালি ম্যাচ থাকলেই অগুন জ্বলে ? আর না অইলে জ্বলেনা ? চুলা কই ? চুলায় আগুন নাই ? খালি এইবাড়ি ঐবাড়ি করন। উছিলা একটা পাইলেই অইল। স্বামীডা আজ কয়দিন বাদে ঘরে ফিরছে হেইদিকে হের খেয়াল নাই। হারিকেল জ্বালানের উছিলায় হে আবারও যাইতাছে পাড়া বেড়াইতে।



মবিনের এত কথার কোন উত্তর দেয়না লতিফা। সে দ্রুতপায়ে হারিকেন হাতে চলে যায় সেখান থেকে পাশের উঠোনে। ময়না তখন চুলোয় তরকারী চাপিয়েছে। লতিফা কোন কথা না বলে ময়নার চুলার পাশে বসে পড়ে। হাত বাড়িয়ে এক টুকরো পাটশুলা নিয়ে চুলা থেকে সেটাতে আগুন ধরায়। তারপর জ্বলন্ত পাটশুলাটা হারিকেনের সলতের মাথায় ধরতেই সেটা দপ করে জ্বলে উঠে। এরপর হারিকেনের চিমনিটা ভাল করে বসায় লতিফা।



অন্যদিন হলে এতক্ষণ দুই জায়ের মধ্যে দুই/একটা কথা বিনিময় হতো। কিন্তু আজ লতিফা একদম চুপ। ওর নিশ্চুপ মুখের দিকে ময়নাও চুপচাপ তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ লতিফার হারিকেন জ্বালানো শেষ না হয়। তারপর লতিফা যখন কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করে তখন ময়না বলে



আইছে মনে অয় ? আইয়াই ত হম্বিতম্বি শুরু কইরা দিছে। তুই যে দুই দিন পেরায় না খাইয়া আছস হেই খোঁজ নিছে ? ঘরে বাতি জ্বালানের তেলডা পর্যন্ত নাই। হে আবার হম্বিতম্বি করে ! কামাই করনের নাম কইরা দিনের পর দিন কই গিয়া থাহে হেইডা বেবাকতে জানে।

থাক্ ময়না বু ঐসব কথা। আমি অহন যাই। দেরী অইলে হিবার ------



কথা শেষ করেনা লতিফা। উঠে দাঁড়ায় সে। ময়না সাথে সাথে বলে

তর এই চুপ কইরা থাহনের ফল তুই একদিন পাইবি লতি। তহন কাইন্দাও কুল পাইবিনা এই আমি কইয়া দিলাম।



ততক্ষণে লতিফা সেখান থেকে চলে গেছে। ময়না চুলায় আর কয়টা লাকড়ি গুজে দিতে দিতে নিজ মনে বলে

বছরও গড়ায় নাই বিয়া অইছে। অহনই স্বামী ঘরে থাহেনা। বাইরের মাইয়া মানুষের লগে ফূর্তি করবার যায়। নিজের স্বামীরে ঘরে আটকাইয়া রাখতে পারেনা এ কেমুন মাইয়া মানুষ ?



লতিফা হারিকেন নিয়ে ফিরে এসে দেখে মবিন তখনও উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। হারিকেনটা ঘরের ভিতর রেখে লতিফা স্বামীকে ডাক দেয়, ঘরে আহ।

মবিন গজরাতে গজরাতে ঘরে ঢুকে। সময়মতো ঘরে বাতি দেসনা, চুলা জ্বালাসনা , তর অইছে কি ?

চুলা জ্বালানের মতো ঘরে চাইল-ডাইল কিছু নাই হের লাইগা চুলা জ্বালাই নাই। কেরাসিন আছে একটুখানি। তুমি কবে আহ, না আহ, হের লাইগা দরকার না পড়লে হারিকেল জ্বালাই না।



বউ এর কথায় মবিনের মন একটু নরম হয়েছে কি-না সেটা বুঝা যায়না। হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে কলপাড়ের দিকে। হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এসে বলে

ব্যাগডা খুলে দেখ। চাইল-ডাইল কিছু আছে। চড়াইযা দে। আমি যাইতাছি কেরাসিন তেল লইয়া আই। আর কি লাগব ক। আনাজপাতি কিছু লাগব ?

লতিফা আস্তে করে বলে, ঘরে ত কিছুই নাই। ভাত খাইবা কি দিয়া ? নুন লাগব, আনাজপাতিও লাগব।

আচ্ছা দেহি। বলে ঘর থেকে বেরিযে যায় মবিন।



গ্রামাঞ্চলের হাট সন্ধ্যার পর বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সাথে সাথে হাটুরেরা কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে শুরু করে। এরপর উঠে যায় দোকানীরা। মবিন যখন হাটে পৌঁছে তখন হাট ভাঙতে শুরু করেছে। সে দ্রুততার সাথে কাজ সারতে শুরু করে। কেরোসিন তেলটা সবচেয়ে বেশী জরুরী। নইলে অন্ধকারে রাত কাটাতে হবে। লতিফা পরিস্কার করে কিছু না বললেও মবিন বেশ বুঝতে পেরেছে যে, হারিকেনটাও বেশীক্ষণ জ্বলবেনা। এতক্ষণে বোধহয় নিভেই গেছে, অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে লতিফা।



চাচা, এক বোতল কেরাসিন দেন দেহি।

এই দোকান থেকে বরাবর সওদা করে মবিন। দোকানদার রমজান মিয়া তার পাড়া সম্পর্কে চাচা হয়। রমজান মিয়া মবিনের হাত থেকে বোতলটি নিয়ে তাতে কেরোসিন ঢালতে ঢালতে বলে

আইলা তাইলে ?

হ চাচা। জবাব দেয় মবিন।

এইবার একটু তাড়াতাড়ি আইলা মনে অয় ? তা রোজগারপাতি কেমন অইল ? বউডারে একলা ঘরে ফালাইয়া যাও বাবা -----।

কি আর করমু চাচা কন ? দেশ-গেরামে কাজ-কামের যা অবস্থা তাতে ত পেটে-পিঠে চলা দায় ।



ততক্ষণে বোতলে তেল ঢালা শেষ রমজান মিয়ার। মবিনের দিকে তেলের বোতলটা এগিয়ে ধরে বলে

জানিনা বাজান, কোনডা হাছা। গেরামের মানুষ ত অন্য কথা কয়।



দোকানের সামনে বেঞ্চির উপর বসে ছিল মোতালিব, মবিনের প্রতিবেশী, সম্পর্কে ভাই হয়। রমজান মিয়ার কথাটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে সে বলে উঠে

পাড়ার লোকে যেডা কয় হাছাই কয় চাচা। মবিন কামাই করতে যায় ঠিহই। কিন্তুক হেই কামাইয়ের পইসা সবডা ঘরে আনেনা। ফূর্তি কইরা উড়াইয়া আসে। কিছু যদি বাঁচে হেইডা লইয়া বাড়িতে আসে। নাইলে আফনেই কন চাচা, এলাকার হগল মানুষের কাম জুডে গেরামে, হের বেলায় জুডেনা ক্যান ? হের আসল টান ত ----



কথা শেষ করেনা মোতালিব। রহস্যপূর্ণ হাসিতে তাকায় মবিনের মুখের দিকে। মবিনের ভিতর তখন অন্য এক মবিন গজরাতে শুরু করেছে। কিন্তু হাটে অত মানুষের সামনে সে সেটাকে প্রকাশ করতে চায়না। কারণ, এখন মোতালিবের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালে হাটের আরও দশজনে দশটি কথা বলবে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে রাগটা হজম করে মবিন। মোতালিবের দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে দুপদাপ পা ফেলে সেখান থেকে চলে যায়।



বাড়ি ফিরে দেখে যা ভেবেছে ঠিক তাই। হারিকেনটা নিভে গেছে অনেক আগেই। লতিফা অন্ধকারে বসে আছে মবিনের অপেক্ষায়। ভাত রান্না ওর হয়ে গেছে। মবিন তেল নিয়ে আসলে হারিকেন জ্বেলে যা হোক একটা কিছু করে খেতে দিবে। নিজেও খাবে। সেই অপেক্ষাতেই বসে আছে লতিফা।



একদিকে পেটের ভিতর একটি বাড়ন্ত দেহ, খাবার চায় সব সময়। তার উপর আজ দুই দিন প্রায় উপবাসই বলতে হবে। গরম ভাতের ঘ্রাণে তাই লতিফার দুই দিনের উপবাসী শরীর চনমনিয়ে উঠে। পেটের ভিতর নাড়িভুড়ি মোচর দিতে শুরু করে। লতিফার ইচ্ছে করে এখনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে। কিন্তু তা কি করে হয় ? স্বামী গেছে হাটে। তাকে আগে না খাইয়ে সে কি করে খায় ? তাই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে লতিফা। মবিন ঘরে ঢুকে অনেকটা ছুঁড়ে ফেলার মতো ব্যাগটা এগিয়ে দেয় লতিফার দিকে। লতিফা তাড়াতাড়ি কেরোসিনের বোতলটা নিয়ে হারিকেনে তেল ঢালে। তারপর চুলা থেকে পাটশুলা দিয়ে আগুন এনে হারিকেন জ্বালায়। মবিনের মেজাজ বুঝার সময় এখন ওর নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শাক-পাতা যা হোক কিছু একটা রান্না করে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে সেদিকে মনযোগী হয়।



মবিন থুম মেরে বসে থাকে অন্ধকার ঘরের চৌকির এক কোণে। লতিফা তরকারী রান্না শেষ করে ঘরে এসে খেতে দেয় মবিনকে। তেমন কিছু নয়। ডাল তো মবিন নিয়েই এসেছিল। আর বাজার থেকে এনেছে কলমী শাক। ঘরে থাকার মধ্যে গোটা কয়েক শুটকি মাছ পড়েছিল মাটির হাড়ির তলায়। সেই দিয়ে কলমী শাক আর ডাল। ভাপ উঠা ভাত আর ডাল-তরকারী স্বামীর সামনে বেড়ে দিয়ে নিজেও একটি থালা নিয়ে বসে লতিফা। এক লহমা ভাত মুখে দিতে যাবে অমনি মবিন বলে



তরে আমি কোন দিক দিয়া কম দিছি ? তুই জনে জনে কইয়া ফিরস আমি নাহি আর এক মেয়ে মানুষ লইয়া থাহি ? হের লাইগা ট্যাহা উড়াই ? যদি থাহিও আর এক জনের লগে তাইলে তর কি ? তর অত হিংসা অয় কেন ?



লতিফার দুই দিনের উপবাসী শরীর ভাত দেখে যেমন চনমনিয়ে উঠেছিল তেমনি মনের উপর কুড়ালের এক ঘা পড়তেই সেটা মরে যায়। হাত থেকে ভাত আলগোছে থালায় পড়ে যায়। হা করে কতক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে লতিফা। এই মানুষটার জন্য সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে ! কত জনে কত কথা বলে ওর কাছে মবিন সম্পর্কে। কিন্তু সে কারও কথায় কান দেয়না মোটেও। বরং অদেখা সময়টায় স্বামীর তৃষ্ণায় ওর মন-প্রাণ উন্মুখ হয়ে থাকে। আজ যখন স্বামীকে কাছে পেয়ে সেই বাসনার পরিতৃপ্তি চাইছে ওর দেহ-মন, তখন স্বামীর কাছ থেকে এই ধরনের কথা শুনে মনটা ভীষণভাবে দমে যায় লতিফার। সে আস্তে করে বলে

এমুন কথা তুমি কি কইরা কইলা ? স্বামীর নামে বদনাম করুম আমি ? আমার দেহে প্রাণ থাকতে যেন এমনডা না অয়।

তুই যদি কিছু না কইবি তাইলে হাডের বেবাক মানুষ আমারে অত কথা কয় কেমনে ? তর চিন্তায় দেহি হেগর পেডের ভাত অজম হয়না।

হাডের মাইনষের কথা আমি কয়াম কেমনে ? আমি কি হেরার লগে দেহা করবার যাই কোন সময় ? একলা নিঝঝুম বাড়িতে পইরা থাহি। হের লাইগা মাঝে-মধ্যে একটু ময়না ভাবির কাছে যাই দুইডা কথা কইতে।

তর ঐ ময়না ভাবিই অইছে যত নষ্টের গোড়া। পাড়া জুইড়া হে-ই ছড়াইছে যে তরে আমি একলা ফালাইয়া গিয়া অন্য মাইয়া মানুষের লগে থাহি।

আমি কি করুম তুমি কও। ময়না ভাবি ত এইসব কথা আমারেও কয়। আমি এক কান দিয়া হুইনা আর এক কান দিয়া বার কইরা দেই।

আমি কইলাম ঐ ময়না ভাবিই অইতাছে যত নষ্টের গোড়া। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ফ্যাসাদ লাগানের ধান্ধায় থাহে সব সময়।

তুমি অমন কইরা কইওনা গো। ময়না ভাবি অতডা খারাপ মানুষ না। তোমার-আমার ভালাই চায় হে। হের লাইগা মাঝে -মধ্যে দুই/চাইরডা কথা কয়।

কি ভালাডা চায় হেইডা আমার দেহা অইয়া গেছে।

ঝংকার দিয়ে উঠে মবিন। লতিফা তেমনি বলে

হেইডা তুমি বুঝবা কেমনে ? একলা ঘরে খাইয়া না খাইয়া পইড়া থাহি ত আমি, আমিই বুঝি ময়না ভাবি কেমুন। তুমি দুই/তিন দিনের কথা কইয়া চইলা যাও, ফির আট/দশ দিন পর। কোন কোন বার পনর দিনও অইয়া যায়। ঘরে ত খোড়াক রাইখা যাও মাত্র দুই/তিন দিনের। তা ও চাইল থাহে ত নুন থাহেনা, নুন থাহে ত তেল থাহেনা এমুন অবস্থা। তহন আমার দিনগুলা চলে কি কইরা কোনদিন ভাইবা দেখছ ? ময়না ভাবী না থাকলে ত বাকী দিনগুলি উবাসই থাহন লাগত।

এটুকু বলে জোড়ে একটা শ্বাস নেয় লতিফা। মবিনের মুখের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখে। তারপর নিজের ভাতের দিকে মাথাটা নিচু করে আঙুল দিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করে কিছুক্ষণ। মবিন ততক্ষণে একটিও কথা বলেনা। এই সুযোগে লতিফা আবার বলে

তাছাড়া শরীরের এই অবস্থায় অহন ত আর আগের মতো উবাস করতে পারিনা। খুব কষ্ট অয়, পেটের ভিতর খালি গুলায়।



মবিন তখন ভাত চিবাইতে চিবাইতে আর এক লোকমা মুখে দিচ্ছিল। লতিফার কথায় মাঝপথেই থেমে যায় ওর হাত। হাতের লোকমাটা থালার উপর ফেলে দিয়ে বলে উঠে

এই অবস্থা ? এই অবস্থা মানে কি অবস্থা ? কি অইছে তর ?



লতিফার তখন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। খাওয়া বন্ধ করে মাথাটা আরও নিচের দিকে গুজে দেয় সে। মবিন তাকে আবারও তাড়া দেয়। লতিফা বুঝতে পারেনা মবিনের এই উদগ্রীব জিজ্ঞাসা তার প্রতি রাগের না ভালবাসার। কিন্তু সে যেটা বলে ফেলেছে সেটা তে আর ফিরিয়ে নিতে পারবেনা। নিজের মুখ ফোটে যেহেতু বলেই ফেলেছে বাকীটাও তাকেই বলতে হবে। যে নাছোড়বান্দা মবিন, না শুনে ছাড়বেনা যা জানতে চাইছে। লতিফা গলার স্বর আরও নিচু করে বলে

তুমি ত বাড়িত বেশী দিন থাহনা। থাকলে নিজেই বুঝতা। তুমি বাপ অইবা।



এক নিঃশ্বাসে কথা ক’টি বলে সেখান থেকে দ্রুত উঠে যায় লতিফা। ঝুটা ভাতের থালা অমনি পড়ে থাকে। মবিনের কিছুক্ষণ সময় লাগে বুঝতে কি বলল লতিফা। মনে মনে লতিফার কথার পুণরাবৃত্তি করে সে। ঠিক তখনি তার উপলব্ধির রুদ্ধ দুয়ার খুলে যায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্তের একটা শিহরণ অনুভব করে সে। সে বাবা হবে ! বাবা ! একটি ছেলের বাবা। একটি ছেলে সন্তান তার চাই-ই চাই।



বউ, তুই এতবড় একটা খবর দিলি আমারে ? -- বলে তাকিয়ে দেখে লতিফা সেখানে নেই। গলার স্বর উঁচু করে ডাকতে থাকে সে লতিফাকে। বউ ! বউ ! কই গেলি তুই ?



লতিফা ঘরের বাইরে অন্ধকার উঠোন কোণে দাঁড়িয়ে মবিনের ডাক শুনে। কিন্তু সাড়া দেয়না। সে বুঝতে পারেনা এই মুহূর্তে স্বামীকে যে খবরটা দিল সেটা তার স্বামী কিভাবে গ্রহণ করেছে, দুঃসংবাদ না সুসংবাদ হিসেবে ছোটকাল থেকে দেখে এসেছে এই ধরনের বর্হিমুখী পুরুষেরা বাবা হবার খবরে আনন্দ তো করেই না, বরং স্ত্রীর উপর চড়াও হয়, নিজের পিতৃত্বকে অস্বীকার করে স্ত্রীকে দেয় অসতীর কলংক। তাই মবিনের ডাক কানে যাবার সাথে সাথে ভয়ে কেঁপে উঠে লতিফা। না জানি কি ভবিষ্যত লেখা আছে তার কপালে ! পরক্ষণে আবার মনে হয়, দাদীর মুখে শুনেছে এই ধরনের কোন কোন পুরুষেরা সংসারে সন্তান আসলে ঘরমুখো হয়, স্ত্রীর কাছে ফেরত আসে। ইয়া আল্লাহ, তাই যেন হয়।



মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানায় লতিফা। এমন সময় মবিন হারিকেন হাতে সেখানে আসে।

কিরে আন্ধারে খাড়াইয়া রইলি যে ? ভাতটিও ত শেষ করলি না ? আয়, ঘরে আয়।



বলে লতিফার একটি হাত ধরে টেনে ওকে ঘরে নিয়ে যায়। কেঁপে উঠে লতিফা। এটা তার স্বামীর ভালবাসার স্পর্শ না হয়েই পারেনা। সে মবিনের পায়ে পায়ে হেঁটে ঘরে আসে। মবিন তাকে আবার খাওয়ায় বসায়। নিজেও বসে থাকে লতিফার সামনে। বলে



তর অহন খাওন-দাওনের অবহেলা করন যাইবনা। ঠিকমতো খাওয়া খাইবি। আমাদের সন্তান আসতাছে না, হের লাইগা। আমি আর তরে ছাইরা যামুনা। গেরামেই কাম করুম। হগলের খাওন জুডলে এইহানে আমরার খাওনও জুডব।

আমি হেই কথাই ত কইতে চাই তোমারে। আমরা দুই জনের খাওন এই গেরামেই জুডব। তোমার আর কামের খোঁজে গেরাম ছাড়নের দরকার নাইগা।

তুই ত অত ভালা খবরডা আমারে আগে দেস নাই। দিলে কি আমি তরে ফালাইয়া যাইতাম ? জানস লতি ? আমি যেন দেখতাম পারতাছি আমার একটা পোলা অইছে। আচ্ছা, তুই ক ত পোলাডার কি নাম রাহন যায় ?

লতিফার ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। মবিনের শেষ কথায় ওর মুখের দিকে ফিরে তাকায় সে। বলে

আচ্ছা, পোলাই যে অইব হেইডা তুমি জানলা কি কইরা ?

মবিন দৃঢ়তার সাথে উত্তর দেয়, তুই দেহিস আমার পোলাই অইব। আমি যে পোলা চাই। নে উঠ এবার। চল, হাত ধুইয়া আয় হুইয়া পড়ি।



বিছানায় শুয়ে লতিফাকে বুকের কাছে টেনে নেয় মবিন। আদরে আদরে ভরে দেয় ওকে। বহুদিন পর এমনভাবে স্বামীকে কাছে পেয়েছে লতিফা। মনটা ওর পাওয়ার আস্বাদনে ভরে উঠতে গিয়েও থেমে যায়। একটা কথা মনের ভিতর খচখচ করতে থাকে। ভাবে, এই মুহূর্তে মবিনের ভাল স্বামী হয়ে উঠার পেছনে রয়েছে একটি ছেলে সন্তানের আকাংখা। কিন্তু যদি ছেলে সন্তান জন্ম দিতে না পারে সে তাহলে ?



কথাটা মনে হবার সাথে সাথে বুকটা কেঁপে উঠে লতিফার। সে স্বামীর বুকে মুখটা গুজে দিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে

আচ্ছা, আমার যদি মাইয়া অয় তহন তুমি কি করবা ?

সাথে সাথে বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো ছিটকে উঠে মবিন। নিজকে ছাড়িয়ে নেয় লতিফার হাতের বন্ধন থেকে।

এই কথা আর মুখে আনবিনা কইলাম। তাইলে খুব খারাপ অইব। মনে রাখিস, আমার পোলা চাই, পোলা।



বলে পাশ ফিরে শোয় মবিন। লতিফাও উল্টোদিকে পাশ ফিরে। দাদীর মুখ থেকে শুনা কথাটি ওর মনে পড়ে যায়। ওর দাদী বলছিল, সংসারে সন্তান আগমনের খবরে বাহিরমুখো পুরুষেরা ঘরমুখো হয়, সংসারী হয়।



কিন্তু হেইখানে যে পোলা-মাইয়ার ভেদ আছে হেইডা ত দাদী কয় নাই ? ভাবে লতিফা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.