নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

নেপালের পথে পথে -- কাঠমুন্ডু টু পোকারা এবং আমার হিমালয় দেখা।

০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১৯





২৬ নভেম্বর, ২০১৩ তারিখ। কাঠমুন্ডু শহরের জরাজীর্ণ কাঠিন্যতা পেছন ফেলে আমার বাস এগিয়ে চলছে পোকারার দিকে। একটু এগোতেই চারপাশে সীমাহীন সবুজের দেখা পেলাম আমি। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। একপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি, অন্যপাশে গভীর খাদ, পাহাড়ী ঘুরপথে এগিয়ে চলছে বাস। আমি তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম বাইরে, উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। দেখলাম কোথাও কোথাও রাস্তা থেকে অনেক নীচূ ভূমিতে মানুষ চাষ-আবাদ করে বসতি গড়েছে। আবার কোথাও বা কুলুকুলু স্রোতে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির ধারা। আবার কোথাওবা পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের আলোর স্পর্শে কেটে যেতে শুরু করেছে ঘন জমাট কুয়াশা। কত দেখব আমি ! এখানে সুন্দরের শেষ নেই।



কাঠমুন্ডু টু পোকারা দীর্ঘ ছয় ঘন্টার বাস ভ্রমণ, প্রায় পুরোটা জুড়েই এমন পাহাড়ী প্রকৃতির সুন্দরের জাল বিছানো। সেই সাথে ঘন কুয়াশার সাথে নরম সোনালী সূর্যালোকের লুকোচুরি খেলা। কোথাও পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের আলো হুটোপুটিতে চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে আছে, কোথাওবা জমাট কুয়াশার আড়ালে সূর্য নিজেই ঢাকা পড়ে আছে। বাস এগোচ্ছে, ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। আবার কিছুক্ষণ পরই অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর হাতছানি যেন আমাদেরকে কাছে ডাকছে। এভাবে পাহাড়ের গা ঘেঁসে এগিয়ে চলছে আমাদের বাস। আর আমার মনে হচ্ছে ইস্একটিবার যদি হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারতাম নীরব অভিমানে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজের চাদর গায়ে ঐ পাহাড়কে।



এর কিছুক্ষণ পরই বাস থেমে গেল এক জায়গায়। হেলপার জানাল আধা ঘন্টা সময় দেয়া হলো সবাইকে প্রাতঃক্রিযা সারার জন্য। ততক্ষণে আরও অনেক ট্যুরিষ্ট বাস সেখানে যাত্রা বিরতি করেছে। জায়গাটা মূল রাস্তা ছেড়ে একটু ডানদিকের সমতলে। আমি নেমে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেল আমার। বিস্ময়ে হতবাক হবার জোগাড় আমার। প্রকৃতি যেন এখানে নিপুণ কারিগর। তার ঠাস বুননে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পাহাড়। সবগুলো পাহাড়ের চূড়া ঢেকে আছে শুভ্র ঘন কুয়াশায়। সত্যি এমন সুন্দরের তুলনা মেলেনা সহসা। আমি একটি লোকের হাতে আমার ক্যামেরাটি দিয়ে অনুরোধ করলাম আমার কিছু ছবি তুলে দিতে। ততক্ষণে সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। লোকটি সানন্দে আমার কয়েকটা ছবি তুলে দিল। কিন্তু প্রকৃতির এমন সুন্দরের আবাহনকে ক্যামেরায় কতটুকুই বা ধরে রাখা সম্ভব ?



আবার চলতে শুরু করল বাস। আমি টের পেলাম আমার মনে কবিতার খেলা শুরু হয়ে গেছে। দূরে ঐ আকাশনীলে/পাহাড় ডাকে ঝরণাতলে/কানে কানে কথা কয় দু’জনে মিলে। ওদের কথা বলার মাঝে আবার আমাদের যাত্রা বিরতি নাস্তার জন্য। সেই একই সৌন্দর্যের জাল বিছানো চারপাশ। তবে এবার তার সাথে যোগ হয়েছে সূর্যের আলো। অর্থাৎ এই জায়গাটা সূর্যের আলোয় পুরোপুরি উদ্ভাসিত। সবার সাথে বাস থেকে নেমে আমি শুধু এক কাপ লাল চা খেলাম ৫০ রূপীতে। ভাবলাম এতে যদি গলার একটু উপকার হয়। সারা বাসজুড়ে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে খুক খুক করে কাশছি।



চা খাওয়া শেষ করে অন্যদের নাস্তা খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি হাঁটাহাঁটি করে দেখলাম চারপাশটা। সবাই উঠে এলে আমিও উঠে বসলাম বাসে। চলতে শুরু করল বাস। এবার বাসে বসেই আমি ঘুমের কোলে আশ্রয় নিলাম। যখন জাগলাম দেখি বাস এক জায়গায় থামছে। মানুষের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে জায়গাটা। তার কারণ অনেকগুলো ট্যুরিষ্ট বাস এসে থেমেছে সেখানে। কেউ খাচ্ছে, কেউ লাঞ্চ বক্স সাথে নিয়ে বাসে উঠছে। আমি নেমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। এখানেও পাহাড় আছে বটে, কিন্তু পাহাড়-মাটি আর জলস্রোত মিলে প্রকৃতির যে নিসর্গ সৌন্দর্য তা যেন ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। তার বদলে অন্য রকম কিছুর হাতছানি। মানুষের মাঝে নাগরিক ব্যস্ততার ছোঁয়া এই প্রথম দেখতে পেলাম। টের পেলাম আমাদের গন্তব্য আর বেশীদূর নয়। একজনের কাছে জানতে পারলাম আর এক ঘন্টা লাগবে পোকারা পৌঁছুতে। যেহেতু একটায় বাসটি পৌঁছার কথা তাই আমি এখান থেকে কোন খাবার নিলাম না। তাছাড়া দুপুরের খাবার খাওয়ার মতো ক্ষুধাও লাগেনি। হোটেলে পৌঁছে যা হোক একটা কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেয়া যাবে।



আবার ছেড়ে দিল বাস। আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। চারপাশের আবহ ক্রমশঃ পাল্টে যেতে শুরু করেছে। একপাশে পাহাড়ের সারি আছে বটে, অন্যপাশে রাস্তার কোল ঘেঁষে ছোট ছোট বাড়ি। সুন্দর ছিমছাম বাড়িগুলো, বাইরের দিকের প্লাস্টারে নান্দনিক সৌন্দর্য যে কারও দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম। আমি বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে গেলাম অন্য এক ভূবনে। এর আগে জাপানে এমন নান্দনিক প্যাটার্ণের বাড়ি দেখেছি আমি। তবে এগুলোর সৌন্দর্য সম্পূর্ণ আলাদা। কোন বাড়িতে কোন বাউন্ডারি দেয়াল নেই, কলাপসিবল গেটও নেই। বারান্দায় আমাদের দেশের মতো লোহার ব্যারিকেডও নেই। আমাদের দেশের বাড়িগেুলোর বারান্দায় যে লোহার গ্রীল দেয়া হয় নিরাপত্তার স্বার্থে সেগুলোকে আমি লোহার বেড়া বা ব্যারিকেড বলতে বেশী পছন্দ করি। কারণ, আমি যখন আমার বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়াই তখন মনে হয় একটা জেলখানায় আছি আমি, ইচ্ছে করলই এখান থেকে সামনের দিকে এগোতে পারবনা আমি। অন্যদিকে পোকারা শহরের এই বাড়িগুলো যেন মুক্ত বিহঙ্গ, আকাশপাণে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি বাড়ির চারপাশ খোলা, বারান্দা খোলা, বাইরের দিকের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কারুকার্যময় সৌন্দর্য। আমার কাছে মনে হলো এই বাড়িগুলো পোকারা শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি অনিবার্য উপকরণ। এরা প্রকৃতির বন্ধু বটে !







বাস যতই এগোচ্ছে ততই পোকারা শহরের ছিমছাম নাগরিক সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করছে। এখন আর প্রকৃতির নিসর্গ সুন্দরের জন্য পিছুটান অনুভব হচ্ছেনা আমার। এমন সময় বাস থামল এক জায়গায়। কিছু লোক নেমে গেল। ড্রাইভার আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কোন হোটেলে যাব। আমি মাউন্ট কৈলাস রিসোর্ট এর নাম বললাম। ড্রাইভার আমাকে বসে থাকতে বলল। বুঝলাম বাস আরও সামনের দিকে যাবে। আমি বসে রইলাম। বাস এগোতে লাগল মূল রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকের একটি ছিমছাম রাস্তা ধরে। রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডে সারি সারি নারকেল গাছ। দু’পাশে হোটেল আর রিসোর্ট। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। কোথাও ট্রাফিক জ্যাম নেই, নেই কোন ট্রাফিকও। এর আগে এমন সুন্দর রাস্তার দেখা পেয়েছিলাম আমি ভারতের গোয়া শহরে। গোয়াকে মনে হয়েছিল নাগরিক কাঠিন্যতা বা কৃত্রিমতা থেকে দূরে স্বর্গীয় এক শহর। আজ পোকারাকেও আমার কাছে অনেকটা সেরকম মনে হচ্ছে।



বাস এসে সর্বশেষ স্টপেজে থামল। দেখলাম নানা হোটেলের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার আমার হোটেলের নাম ধরে ডাকতে লাগল। এক লোক এগিয়ে এলো ড্রাইভারের ডাকে। দেখলাম ওর হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে আমার নাম লেখা রযেছে। আমি বাস থেকে নেমে ওর পিছু পিছু গিয়ে গাড়িতে বসলাম। এগিয়ে চলল গাড়ি। সেই সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ চারপাশে। দশ মিনিটও বোধহয় লাগেনি আমি এসে পৌঁছে গেলাম মাউন্ট কৈলাস রিসোর্টে। কিন্তু প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আবারও স্তম্ভিত হলাম আমি সুন্দরের আবাহন দেখে। হোটেলের এপাশ-ওপাশ মিলিয়ে দুটি ভবন। মাঝখানে অনেকটা জায়গাজুড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক সুন্দরের আবাহন। ইয়া বড় বড় গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা ফুল বাতাসে দুলে দুলে যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আগত অতিথিদের। আছে আরও নানা জাতের ফুল। গাঁদা ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারপাশ। এখানেই শেষ নয়। এদেরকে পরম আদরে আগলে রেখেছে একটি স্বচ্ছ জলাধার। এর পানির উৎস হচ্ছে একটি কৃত্রিম ঝরণা। জলাধারটা একেবেঁকে পুরো বাগানটাকে ঘিরে রেখেছে। এপাড় থেকে ওপাড়ে যাবার জন্য এর উপর রয়েছ দুটি ছোট্ট পুল। সব মিলিয়ে অবাক করা সুন্দরের সমাহার ঘটানো হয়েছে রিসোর্টের খোলা প্রান্তরে।



হোটেলের গেট সংলগ্ন মূল রাস্তার অপর পাড়েই লেক, এর পাশ ঘেঁষেই সারি সারি পাহাড়। জানিনা এজন্য কি-না, জায়গাটির নাম লেক সাইড। গেট পেরিয়ে হাতের বাঁদিকে প্রথম ভবনটিতেই রিসেপশন। আমি ভিতরে ঢুকে প্রয়োজনীয় কাজ সারলাম। রিসিপশনের কর্মকর্তা মেয়েটি আমার পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে একটু অবাক হলো তিনটি পাসপোর্ট একসাথে দেখে। আমি অনেকগুলো দেশ ভ্রমণ করেছি দেখে সে খুব খুশী হলো। আমার হাতে চাবি দিল, বি ব্লকের ৫০৩ নম্বর কক্ষ আমার জন্য বরাদ্দ হলো। এটা পাশের ভবনে। হোটেল স্টাফ আমার লাগেজ নিয়ে আমার সাথে সাথে এলো। আমি রুমে ঢুকেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কাঠমুন্ডুর মতো একই ভাড়া অর্থাৎ প্রতিদিন ৮০ মার্কিন ডলার করে। অথচ এখানকার ব্যবস্থা কত উন্নত। এর আগে আরও অনেক দেশে ফাইভ স্টার হোটেলে থেকেছি আমি। দেখলাম এই রুমের ব্যবস্থাপনা প্রায় সেগুলোর কাছাকাছি। রুমের সামনের ভারী পর্দা তখন গুছানো। তাই বাইরের আলো অতি সহজেই সাদা রং এর স্বচ্ছ পর্দা ভেদ করে রুমে ঢুকে পড়েছে। আমি স্বচ্ছ পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। সামনে কৃত্রিম ঝরণা, সুইমিং পুল, সারি সারি গাঁদা ফুল। এগুলোর ওপাশেই হোটেলের আরেকটি ভবন। সব দেখে আমি ভাবলাম আজকের বিকেলটা এখানে কাটানোই উত্তম হবে।



বিকেলটা আশেপাশে ঘুরে কাটিয়ে দিলাম। রাতে বিছানায় শুয়ে আগামী দিনের কথা ভাবলাম। পোকারা আসার মূল কারণই তো এটা। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘু ম ভাঙল রাত ৩টা ২০ মিনিটে। আর ঘুমানোর চেষ্টা করলাম না আমি। তার বদলে এই লেখাটা এগিয়ে নিলাম। সাড়ে চারটার দিকে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আবার লিখতে শুরু করলাম। পাঁচটায় রিসিপশন থেকে ফোন পেলাম। আমি জানালাম তৈরী হচ্ছি। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। কাজেই সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হয়েছে আমাকে। রিসিপশনে যেতেই একটি ছেলে গাড়ি দেখিয়ে দিল। আমি গাড়িতে উঠে বলসলাম। অন্ধকারের বুক ছিঁড়ে এগিয়ে চলল আমার গাড়ি। দেখলাম অসংখ্য গাড়ি ও ট্যুরিষ্ট বাস একইভাবে ছুটে চলছে। উদ্দেশ্য সবার এক, গন্তব্যও এক।

আধা ঘন্টার মধ্যে আমার এসে পৌঁছে গেলাম কাংখিত গন্তব্যে। গাড়ি পার্কিং এ দিতে হলো ৩০ রুপী। ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিয়ে বলল সে এখানেই অপেক্ষা করবে। আমি যেন গাড়ির নাম্বার দেখে চলে আসি। গাড়ির নাম্বার হচ্ছে ৩৬১। তাছাড়া গাড়ির গায়ে মাউন্ট কৈলাস রিসোর্ট লেখা রয়েছে। আমি উঠে গেলাম অসংখ্য পর্যটকদের সাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে। পাহাড়ের উপরে সমতল জায়গাটা তখন অসংখ্য পর্যটকের ভীড়ে কোলাহল মুখর। অথচ কেউ কারও মুখ দেখছে না বা দেখতে পাচ্ছেনা। সেদিকে দৃষ্টিও নেই কারও। সবার অপেক্ষা কাংখিত সূর্যোদয়ের জন্য। যে কারণে আমার মতো নিজ দেশের ভৌগলিক সীমারেখাকে পেছনে ফেলে এতদূর ছুটে এসেছে সবাই।



আকাশে তখনও চাঁদ শোভা পাচ্ছে। চাঁদের আলোতে দূরে পোকারা শহরের অস্তিত্ব বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে চাঁদের আলো উপভোগের তৃষ্ণা কারও নেই। বরং চাঁদের বিদায় যত তাড়াতাড়ি হয় সেটাই সবার কাম্য। আমি এই প্রথম এটা টের পেলাম। সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সামনের বিস্তীর্ণ পাহাড়ভূমে চাঁদের উদ্ভাসিত আলোকে উপভোগের পরিবর্তে কারও নিকট অকাম্য হতে পারে। এতেই বুঝা যায় হিমালয়ের পাদদেশে সূর্যোদয়ের যে দৃশ্য দেখার জন্য আমি এখানে ছুটে এসেছি সেটা কত উপভোগ্য ! কত গরিমাময় !

যাই হোক। ভূমি থেকে এখন আমি কতটা উপরে উঠে এসেছি সেটা ঠিক পরিমাপ করে বলতে পারবনা। তবে উঠে এসেছি অনেক উপরে এটা নিশ্চিত। কারণ, প্রথমে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়িগুলো অনেক উপরে উঠে এসেছে। তারপর যেখানে আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েছে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বেশ কয়েকটা ঘুরানো-প্যাঁচানো অমসৃণ সিঁড়ি বেয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা সবাই। উঠার সময় খেয়াল করলাম এই রাতের বেলাতেও সিঁড়ির ধাপে ধাপে দুই পাশে নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানীরা। এসব জিনিসের মধ্যে শাল এবং হাতে তৈরী বিভিন্ন সামগ্রী এবং ধাতব মূর্তিই বেশী।







তখনও পূব আকাশে আলোর রেখা ফুটেনি। সূয্যি মামার দেখা পাওয়া তো দূরের কথা। কেবল পূব দিগন্তে রক্তিম আভার দেখা মিলছে। এতেই চোখে পড়ছে সারি সারি পাহাড়ের অস্তিত্ব। এতক্ষণ অন্ধকারে কোনটা পাহাড়, কোনটা গহবর ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না। এখন পূব আকাশে আলোর রেখা যত ষ্পষ্ট হচ্ছে ততই পাহাড় আর খাদের অস্তিত্ব পরিস্কার হচ্ছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার ঠিক সামনেই গভীর একটা খাদ, তারপর সারি সারি পাহাড়। আমরা দাঁড়িয়েছি পূব দিকে মুখ করে। সারি সারি পাহাড়ের মায়াজাল ভেদ করে সূর্য উঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে সেদিকে। আর আমাদের হাতের বাঁদিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে বিস্তীর্ণ পাহাড়রাশির ওপাড়ে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়া ক্রমশ শুভ্র সতেজ আলোয় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। অবাক হবার মতো ব্যাপার। সূর্যের দেখা তখনও মেলেনি। অথচ পাহাড়ের চূড়াটি ক্রমশঃ শুভ্র থেকে শুভ্রতর হয়ে বড় আকার ধারণ করছে। এখান থেকে দেখা যায় বরফে ঢাকা গ্রেট হিমালয়ের অন্নপূর্ণা ও ধূলগিরি চূড়া। কি অদ্ভূত মিতালী সূর্যের সাথে বরফাচ্ছিত এই পাহাড় চূড়ার ! হিমালয় যেন নিজ থেকে সূর্যের সাথে এই মিতালী স্থাপন করেছে নিজের অস্তিত্বকে আরও বেশী জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলার জন্য। সময়ের প্রতিটি পলক এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সময় যতই এগোচ্ছে গ্রেট হিমালয় তার মহামহিম শুভ্রতার অবগুন্ঠনে নিজকে প্রকাশ করছে বিস্তৃত আকারে।



অবশেষে পূব আকাশে পাহাড়ের অপর পাশে সূর্যের মুখ দেখতে পেলাম আমরা। লাল টকটকে সূর্যরাজ ক্রমেই নিজের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব ঘোষণা করতে লাগল। এ যেন আকাশে সূর্য উঠা নয়, সূর্য উঠছে পাহাড়রাশির আদুরে বন্ধন ছুঁয়ে ওপাড় থেকে। সবার ক্যামেরা সচল হয়ে গেছে অনেক আগেই। একবার পূব আকাশের সূর্যের ছবি তুলছি আমরা, তার পর মুহূর্তেই উত্তর দিকে বরফাচ্ছাদিত হিমালয়ের চোখ ধাঁধানো রূপের। কোনটা ছেড়ে কোনটার ছবি তুলব ! আমি এসেছি একা। একে-তাকে অনুরোধ করে নিজের ছবি তুলতে হচ্ছে। এক সময় সূর্যের দিক থেকে সবার মনযোগ গিয়ে নিবিষ্ট হলো শুভ্র গরিমায় প্রস্ফুটিত গ্রেট হিমালয়ের উপর। তখন সাদা বরফের উপর সূর্যের আলো পূর্ণরূপে পড়ছে। প্রেমিকের অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকার মতো হিমালয় বুঝি রূপকা রানী সেজে এতক্ষণ এর অপেক্ষাতেই ছিল। তাই সূর্যের আলোর পরিপূর্ণ অবয়বে নিজকে ঢেকে সে প্রকাশ করছে তার মোহময়ী রূপের সবটুকু। সত্যি এ সৌন্দর্যের তুলনা মেলেনা পৃথিবীর কোথাও ! কোন ভাষার কোন সমৃদ্ধ অভিধানেও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবেনা এই সৌন্দর্যকে উপযুক্তরূপে বর্ণনা করার মতো কোন শব্দ। পৃথিবী বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের কল্পনা বিলাসও বোধহয় এখানে এসে হার মানতে বাধ্য হবে। আমি শুধু ভাবছি মানুষের মনকে মোহিত করার জন্য বিধাতার সে কি অপরূপ সৃষ্টি ! প্রকৃতিকে সাজিয়ে রেখেছে সৌন্দর্যের সবটুকু নির্যাস দিয়ে। একমাত্র চোখে দেখে হৃদয়ে ধারণ করা ছাড়া কার সাধ্য আছে ভাষার ফ্রেমে সুন্দরের এই আবাহনকে প্রকাশ করতে পারে ?







ততক্ষণে সূর্যের আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। মহামতি হিমালয়ের রূপে ভুলে গিয়ে এতক্ষণ ঠান্ডার অস্তিত্ব যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। মোহাচ্ছন্ন ভাব একটু শিথিল হতেই টের পাচ্ছি কনকনে ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে গায়ে। অনেকে ফেরার পথ ধরেছে। কেউ কেউ ছবি তুলছে তখনও। আমিও তাদের মধ্যে রয়েছি। ঐতিহাসিক এই সময়কে যতক্ষণ পারা যায় উপভোগ করার জন্য। এমন সময় পরিচয় হলো এক বাংলাদেশী দম্পতির সাথে। তাদের বাসা তেজগাঁও এ, সাত রাস্তার মোড়ে ওয়াপদা কলোনীতে। এবার আমার ছবি তোলার সুবিধা হলো। আমার অনুরোধে ভদ্রলোক আমার ছবি তুলে দিলেন। উনার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সাথেও ছবি তুললাম আমি। তারপর উনাদের যুগল ছবি তুলে দিলাম। এরপর আলাপচারিতার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে উনারা গতকালও এখানে এসেছিলেন। কিন্তু দেখতে পারেননি কিছুই। কারণ, গতকাল এই সময়ে আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, হিমালয় ছিল মেঘে ঢাকা। একথা শুনে আমি মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ জানালাম আজকে অমনটি না করার জন্য। কারণ, আমার হাতে সময় শুধু আজকের দিনটিই। আজকে মিস হলে এযাত্রা আর দেখার সুযোগ হতনা হিমালয়ের এই অনিন্দ সুন্দর রূপ ! আগামীকাল সকালেই আমাকে চলে যেতে হবে, টিকেট ওভাবেই কাটা আছে।



যাক্। কথা বলতে বলতে নেমে এলাম আমরা গাড়ি পার্কিং এ। এরপর সেই আঁকাবাঁকা পথ বেযে রিসোর্টে ফেরা। আসার পথে বেশ কিছুক্ষণ চোখে পড়ছিল শুভ্র সোন্দর্যমন্ডিত হিমালয়ের চূড়াটি। তারপর এক সময় সে হারিয়ে গেল আমার দৃষ্টির সম্মুখ থেকে। ঠিক তখনি আমি আমার মধ্যে এখানকার প্রকৃতির মায়াবী হাতছানি টের পেলাম। সেই হাতছানি যতটা না এখানকার আকাশ কিংবা সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির, তারচেযে বেশী হিমালয়ের। সবকিছু মিলিয়ে বুকের ভিতর একটা সূক্ষ্ণ পিছুটান টের পেলাম।





পরের পর্ব নগরকোর্ট এর পথে পথে।

মন্তব্য ২০ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (২০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৮

বর্ণিল হেয়ালী বলেছেন: ঘুড়ে এলাম আপনার লিখায় :) অসাধারণ

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৩৬

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। আজ আমার লেখায় ঘুরেছেন। কামনা করি যেন একদিন সত্যি সত্যিই ঘূরে আসতে পারেন এই জায়গাটা।

২| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫

পরিবেশ বন্ধু বলেছেন: সুন্দর ভ্রমন কথা । এক কথায় অপূর্ব ।

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৩৮

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। এই ভ্রমণ কাহিনীটা বই আকারে বের করার ইচ্ছে আছে অগামী বই মেলায়। আশা করছি আপনাদের সহযোগীতা পাব।

৩| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৪৯

সকাল রয় বলেছেন:

কাঠমুন্ডু নামটা শুনলেই সত্যজিত রায়ের কথা মনে পড়ে। আপনার কথায় ঘুড়ে এলাম খানিকটা।



একদিন সত্যি যাবো
তারপর ফিরে এসে সব রহস্য গল্প লিখব।

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৪০

সুফিয়া বলেছেন: অনেক ভাল হবে। এ ব্যাপারে আরও কিছু পড়তেপারব। তার আগে আপনার ইচ্ছে পূর্ণ হোক সেটা কামনা করছি।

ধন্যবাদ আপনাকে।

৪| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৯:৩১

সেলিম আনোয়ার বলেছেন: চমৎকার ছবি আর বর্ণনা ।সব মিলিয়ে খুব ভাল লেগেছে ।নিজে ছবি তোলার অনেক শখ দেখা যাচ্ছে। :P

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৪৩

সুফিয়া বলেছেন: লেখালেখি আর ছবি তোলা এই দুটিা সখ আমার সমান্তরলে চলে। হিমালয়কে কেন্দ্র করে অনেকছবি তুলেছি। কিন্তু সবছবি এখানে দেয়া সম্ভবনয়। মূল কারণ। ছবিগুলোর সাইজ। কিভাবে ছবি রিসাইজ অর্থাৎ ছোট করা যায় সেই কৌশলটা জানিনা।

ধন্যবাদ আপনাকে আমার ব্লগে সময় দেয়ার জন্য।

৫| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৫৮

লিখেছেন বলেছেন: excellent travel blog

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৪৪

সুফিয়া বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকবেন।

৬| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৯:৪১

ইচ্ছের ঘুড়ি বলেছেন: আরও কয়েকটা ছবি দিলে আরও বেশি ভালো লাগতো...... সুন্দর বর্ণনা......

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৪৭

সুফিয়া বলেছেন: খেয়াল করেছেন বোধহয় আমার হিমালয় দেখার আরও একটা পর্ব আছে। সেটা নাগরকোর্টে। সেখান থেকে হিমালয়ের পাদদেশে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।

কিছু ছবি ওখানে দিব।

ধন্যবাদ আপনাকে।

৭| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৫৫

সুমন কর বলেছেন: দেখে গেলাম।

১০ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৫৩

সুফিয়া বলেছেন: দেখেই চরে গেলেন। কিছু তো বললেন না। তবু ধন্যবাদ দেখার জন্য।

৮| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৩

রানা বলেছেন: আপনি তো অনেক জায়গা ঘুরেছেন..... সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি সংকলন বের করলে কেমন হয় বলুন তো ?

১০ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:০৫

সুফিয়া বলেছেন: রানা ভাই। আপনার প্রস্তাবটা কিন্তু মন্দ নয়। এর আগে আমারও মনে হয়েছে। কিন্তু আমার ব্যাপারে বলতে পারি কোনটা রেখে কোনটা লিখব সেটা নির্বাচন করা আমার জন্য কঠিন হবে। কারণ, এ পর্যন্ত আমি ভ্রমণ করেছি দশটা দেশ। এরমধ্যে শুধু জাপানকে নিয়ে আমার একটা ভ্রমণ কাহিনী বের হয়েছে। তাছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতের গোয়া ভ্রমণের উপরও আমার একটা ভ্রমণ কাহিনী বাজারে আছে। আশা করছি ২০১৫ এ বই মেলায় নেপাল ভ্রমণের উপর লেখা বইটি বের হবে। তাছাড়া বাংলােদশের অনেক ঐতিহাসিক জায়গা আমি ঘুরেছি। সেগুলোও লিখে রেখেছি বই আকারে বের করব বলে। এখন আপনিই বলুন আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কোথা থেকে শুরু করব এবং কোথায় নিয়ে শেষ করব।

সুযোগ বুঝে নিজের অনেক সাফাই গেয়ে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। ব্লগে যেহেতু এসেছেন তাই আমাদের ঈদ সংকলনটা একটু ঘুরে দেখার অনুরোধ করছি।

অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

৯| ১১ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:১১

জাফরুল মবীন বলেছেন: ভ্রমন কথাশিল্পীকে ধন্যবাদ চমৎকার পোস্টটির জন্য।

১১ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৮:৪৫

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ এবং পরের পর্বে আমন্ত্রণ।

১০| ১১ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৮:৫১

লেখোয়াড় বলেছেন:
অসাম।
++++++++++++++

১১ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৯:২১

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ। দ্বিতীয় পর্ব কাঠমুন্ডু টু নগরকোর্ট এবং হিমালয়ের চূড়ায় সূর্যাস্তের দৃশ্য এর উপর আর একটি পোস্ট দিয়েছি। আশা করছি আপনাদের ভাল লাগবে।

ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.