নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

যে মুখ দেখি ঝরা পাতায় -- ১ম পর্ব

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:১৬

যে মুখ দেখি ঝরা পাতায়



স্কুলে যাবার পথে সুচিকে প্রতিদিন উত্যক্ত করত ওরা। ওরা মানে রোমেলের নেতৃত্বে একদল বখাটে। একই গ্রামের ছেলে ওরা, পাড়াত সম্পর্কে চাচাত ভাই-বোন হয়। রোমেল তার বখাটে দল নিয়ে প্রতিদিন অপেক্ষা করত সুচি কখন স্কুলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। তারপর সুচির পিছু পিছু প্রায় স্কুল অবধি যেত। কিন্তু কখনও স্কুলের গেটের কাছে যেতনা রোমেল। কারণ, স্কুলের দফতরীসহ অনেক শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী রোমেলকে চিনে। স্কুলে বখাটেপনার কারণে সপ্তম শ্রেণীর গন্ডি পার হতে পারেনি সে। কর্তৃপক্ষ দুই বছর আগে তাকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে। এরপর রোমেলের বখাটেপনা আরও বেড়ে যায়। গড়ে উঠে ওর নেতৃত্বে একটি ছোটখাট বখাটে দল। অনেক মেয়ের পেছন থেকে সরে এসে রোমেলের বখাটেপনা কেন্দ্রীভূত হয় সুচিকে ঘিরে।



সুন্দরের সবগুলো উপকরণের সমন্বয় ঘটিয়ে বিধাতা সুচিকে গড়ে তুলেছেন একথা সুচিকে একবার দেখলে যে কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। কিন্তু সুচির মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের কাছে এটাই একমাত্র চিন্তার কারণ। রোমেলের আচরণ তাদের রাতের ঘুম পর্যন্ত কেড়ে নেয়। পারবে তো তারা শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে রক্ষা করতে ? কিন্তু সুচি সাহস হারায়না। ছোট ভাই বা অন্য কেউ ওকে স্কুল অবধি পৌঁছে দিয়ে আসে, আবার নিয়ে আসে রোমেলের ভয়ে। স্কুলের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সুচি। স্কুলটাকে তার কাছে একটা নিরাপদ আশ্রয় মনে হয়। কিন্তু স্কুল ছুটির ঘন্টা বাজলে বুকের ভিতরটা খচ খচ করতে থাকে সুচির। আবারও সেই রোমেল আর তার দলবল ! মাঝে মাঝে এমনসব বাক্য ছুঁড়ে দেয় ওরা যে, সংগে কেউ থাকলে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে সুচির। এভাবেই সপ্তম-অষ্টম শ্রেণী শেষ করে নবম শ্রেণীতে উঠে সুচি। এবার নতুন উদ্যমে পড়াশুনা শুরু করে সে। লক্ষ্য একটাই। এসএসসিতে ভাল ফল করা। স্কুলের শিক্ষকরাও তাকে নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। তানাহলে এমন পরিস্থিতিতে বাবা-মা কবেই সুচির স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিত।



সুচি মনের ভিতরের সমস্ত ভয়-ভীতিকে কাটিয়ে উঠে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এখন আর কাউকে সংগে নিয়ে স্কুলে যেতে হয়না ওকে। কারণ, আশ্চর্যরকমভাবে রোমেল বেশ বদলে গেছে। আগের মতো দলবল নিয়ে স্কুলে যাবার পথে সুচিকে উত্যক্ত করেনা, খিস্তি-খেউর করেনা। সবাই ভাবে, আল্লাহ তায়ালা সুচির দিকে মুখ তোলে চেয়েছেন। নিশ্চিন্ত হয় সবাই। পড়াশুনায় মনযোগী হয় সুচি সমস্ত দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে। তারপরও কোথায় যেন একটা কিন্তু থেকেই যায়। মাঝে মধ্যেই স্কুলে যাবার পথে রোমেলের দেখা পায় সুচি। রোমেল আর আগের মতো নেই। কেমন যেন শান্ত, ভদ্র ছেলেটি হয়ে গেছে রোমেল। সেই রোমেলের সাথে তুলনা চলেনা এই রোমেলের। নিশ্চিন্তে পথ চলে সুচি। একদিন সুচিকে একা পেয়ে পথ আগলে দাঁড়ায় রোমেল। কোন ভণিতা না করেই বলে , আমি তোমাকে ভালবাসি সুচি। খুব ভালবাসি বিশ্বাস করো। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবনা।



সাথে সাথে সুচির মনে রোমেলের প্রতি চাপা পড়ে থাকা পূর্বের ক্ষোভ জেগে উঠে। প্রচন্ড ঘৃণায় সে প্রত্যাখান করে রোমেলকে। রোমেল কোন প্রতিবাদ না করে সেখান থেকে চলে যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সুচি। কিন্তু মনের ভিতর নতুন করে দুশ্চিন্তা বাসা বাঁধতে শুরু করে ওর। এর ঠিক দুই দিন পরই হঠাৎ করে রোমেলের মা এসে উপস্থিত হয় সুচিদের বাড়ি। সুচির মায়ের সাথে আলাপের ফাঁকে সে প্রস্তাব দেয় রোমেলের সাথে সুচির বিয়ের। কথাটা শুনে প্রথমে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা সুচির মা। কিন্তু রোমেলের মা নাছোড় বান্দা। তার বখাটে ছেলে রোমেলকে সামলাবার ক্ষমতা তার নেই। এই বিয়ে না হলে সে যা ইচ্ছে তা করে বসতে পারে। সুচির মা ঝাঁঝাঁল কন্ঠে উত্তর দেয়, আপনার ছেলে যা ইচ্ছে করুক গে, মরুক গে। তাতে আমার কি ? ওর মতো একটা বেগাবন্ড ছেলের হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিয়ে আমার মেয়ের জীবনটা আমি নষ্ট করতে পারব না।



এই ঘটনার পর একমাসও পার হয়নি। সুচির যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার কথা, তখনই খবর আসে রোমেল তার দলবলসহ সুচিকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত যা হয়ে থাকে। সুচির বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন, পুলিশ-প্রশাসন সবাই খোঁজাখুঁজি করল। কোন হদিস মিলল না সুচি আর রোমেলের। আদালতে মামলা উঠল ছেলের অপরাধে বাবা-মাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে নিয়মিত। তাদের এক কথা, আমাদের ছেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আপনারা ওকে খোঁজে বের করে যা ইচ্ছে হয় করুন।



এদেশে এক বছরে কোন মামলা কতদূর এগোতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের সকলের ধারণা আছে। কিন্তু এই মামলার ক্ষেত্রে সত্যি সত্যিই একটা বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হলো। পুলিশ রোমেল আর সুচিকে খোঁজে বের করে আদালতে হাজির করল। দীর্ঘ এক বছরে পর নিজেদের তন্বী-সুন্দরী মেয়েটির কড়িকাঠের মতো শরীরের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে সুচির বাবা-মা। তাদের মনে বড় আশা। এবার মেয়েকে ফেরত পাবে তারা। কারণ, সুচি অপ্রাপ্তবয়স্কা সেটা আদালতে আগেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া সুচি কখনও রোমেলকে বিয়ে করতে চায়নি। কাজেই সুচি যদি একবার বলে যে, রোমেল তাকে জোড় করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছিল এতদিন, এখন সে তার বাবা-মায়ের কাছে ফেরত যেতে চায়, তাহলে মুহূর্তেই সব মীমাংসা হয়ে যাবে। আদালত সুচিকে তার বাবা-মায়ের জিম্মায় ফেরত দিবে।



কিন্তু ঘটনা ঘটল ঠিক তার উল্টো। সুচি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে ফেরত যাবার কথা সরাসরি অস্বীকার করল। কারণ, সে এখন মা হতে চলেছে। আদালতে উপস্থিত সুচির আত্মীয়-পরিবার-পরিজন সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায় সুচির মুখ থেকে একথা শুনে। তারা নিজ নিজ কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। এ যেন তাদের সেই আদরের সুচি নয়, কথা বলছে অন্য কেউ, যাকে তারা চিনেনা, দেখেনি কোনদিন। ঘটনার আকস্মিকতা কিছুটা সামলে উঠার পর সুচির মা এগিয়ে যায় মেয়ের দিকে। সত্যিই তো ! তার ফুলের মতো তুলতুলে মেয়েটার জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে আর একটি প্রাণ বেড়ে উঠার লক্ষণ ষ্পষ্ট। মা হয়ে মেয়ের শরীরের এই পরিবর্তন কেন চোখে পড়েনি তার ? দু’হাতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে সুচির মা।



আদালতের মীমাংসা এখানেই শেষ। এই মুহূর্তে সুচির শরীরের দিকে তাকালে যে কারও প্রথমেই মনে পড়বে ওর প্রচুর পরিমাণে যতœ দরকার, বিশ্রাম দরকার। এতদিন পুলিশের হয়রানির কারণে কোথায় কোথায় ছুটে বেরিয়েছে কে জানে ? এমন অবস্থায় সুচির বাবা প্রস্তা দেয় মেয়েকে নিজের বাড়িতে নিয়ে রাখতে, যাতে ওর শরীরটা একটু সুস্থ হয়। কিন্তু না ! যেমনি মত রোমেলের তেমনি তার মা-বাবার। সুচিকে এখন কিছুতেই বাপের বাড়িতে যেতে দেয়া যাবেনা। এই মেয়ের জন্য অনেক ঝামেলা তারা পোহায়েছে। এরপর বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে মত বদলিয়ে তাদের ছেলেকে আবার ফাঁসিয়ে দিবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে ? এই পরিস্থিতিতে সুচির মনের ইচ্ছে জানার প্রয়োজন কেউ বোধ করেনি। চলে যায় সুচি শ্বশুর বাড়ি। এক মেধাবী স্কুল ছাত্রী মা হবার প্রহর গুণতে থাকে ধুকে ধুকে।



যে অনাগত মাতৃত্বের টানে সুচি বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে অস্বীকার করেছে সেই মাতৃত্বের টানেই সুচির মা মেয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় এলাকার মাতবরদের মধ্যস্থতায় সুচিকে মায়ের কাছে আসতে দেয়া হয় এক দিনের জন্য। কিন্তু সামান্য ক্ষণের প্রশান্তি কি আর মাতৃত্বের এতবড় আঘাতকে প্রশমিত করতে পারে ? তাই অন্তত মেয়ের খোঁজ-খবর যেন নিতে পারে সুচির পরিবার সেই সমঝোতা হয়।



কিন্তু বোধহয় এই সমঝোতাটা না হলেই ভাল হতো। সুচির উপর ওর শ্বাশুড়ির নির্যাতনের খবর এখন আর গোপন থাকেনা ওর বাপের বাড়িতে। সুচির শ্বশুর অসুস্থ। নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হয় তাকে। সুচির বেকার স্বামী রোমেলই পরিবারের বড় সন্তান। একমাত্র ছোট ভাই স্কুলে পড়ে। আয়-রোজগারের উৎস একমাত্র কিছু ধানী জমি। কিন্তু সেগুলোর দেখাশুনা করে কে ? এক সময়ের বখাটে রোমেল এখন একজন স্বামী ও হবু বাবা হলেও এসবের কোন দায় যেন ওর কাঁধে বর্তায়না। উঠতে-বসতে তাই সারাক্ষণ শ্বাশুড়ির কটু কথা শুনতে হয় সুচিকে। নিজে কামলার মতো খেটে সবাইকে বসিয়ে খাওয়াতে সে পারবেনা। এমন কি লাট সাহেবের মেয়ে ঘরে এসেছে যে গৃহস্থলীর কাজে হাত লাগাতে পারবে না ?



এটা ঠিক। সুচি গৃহস্থ ঘরের কাজ কখনও করেনি। স্কুল শিক্ষক বাবাবর যেটুকু জমিজমা আছে তা ভাগে চাষ হয়। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের সংসার তাতেই চলে যায়। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে, বড়জনের স্বামী চাকুরীজীবি আর ছোটজনের স্বামী ব্যবসায়ী । ঐ দুই বোন নিজেরাও প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করছে। বোনদেন মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও মেধাবী সুচি যেন ছিল সকলের চোখের মণি। কিন্তু তাতে কি ? স্বামীর সংসারের গৃহস্থলীর কাজ সে করতেই পারে। কিন্তু শরীর যে সায় দেয়না কিছুতেই। নিজের অপুষ্ট শরীরে বেড়ে উঠা আর একটি শরীর যেন তাকে শুষে খাচ্ছে। ওর- ই বা দোষ কি ? ওকে তো পরিপুষ্ট হয়ে সময়মতো পৃথিবীর আলো দেখতে হবে।



সুচি শ্বাশুড়ির কটুবাক্য গায়ে মাখতে চায় না। কিন্তু বড় কষ্ট পায় যখন রোমেলও মাঝে মাঝে তার মাকে সমর্থন করে সুচিকে কথা শুনায়। রোমেল যেন এখন আর আগের মতো নেই, বদলে গেছে অনেকটা। যে ভালবাসার প্রচন্ড উন্মাদনা রোমেল সুচিকে অপহরণ করে বিয়ে করার মতো দুঃসাহসী কাজ করেছিল, সেটা আদৌ ভালবাসা ছিল কি-না আজকাল এ নিয়ে সুচির মনে প্রায়ই সন্দেহ জাগে। মাঝে মাঝে ওর প্রতি রোমেলের ব্যবহার প্রচন্ড আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। সুচি ভয় পেয়ে যায় তখন। কিন্তু করার কিছু নেই তার। এসবকিছু মাকে জানিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা আর বাড়াতে চায় না সে।



মাঝে মাঝে মেজাজ বুঝে রোমেলকে বুঝাতে চেষ্টা করে সুচি। যা হবার হয়েছে। আমরা তো আর আগের মতো নেই। আমাদের সন্তান আসছে। তোমার বাবা অসুস্থ মানুষ, বেশী কাজকর্ম করতে পারেনা। কাজল পড়াশুনা করছে। মা তো ঠিকই বলেন। একাহাতে কতদিক সামলাবেন ? তুমি পড়াশুনা করতে পারনি তো কি হয়েছে ? তোমার বাবার ফসলী জমি আছে। সেগুলোর দেখাশুনা করো। মায়েরও সাহায্য হবে।



বাকীটা আর বলেনা সুচি। রোমেল কখনও হয়তো চুপ করে শুনে স্ত্রীর কথা। কখনও চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে। কিন্তু তবু হাল ছাড়েনা সুচি। ওর অনবরত তাগিদেই হোক, কিংবা নিজের অনাগত সন্তানের কথা ভেবেই হোক, আজকাল মায়ের সাথে কখনও- সখনও কাজে হাত লাগায় রোমেল। কিন্তু কেন যেন কুলিয়ে উঠতে পারেনা। একটুতেই হাঁফিয়ে উঠে। শরীরে জ্বর জ্বর লাগে। আবার সেরেও যায় সেই জ্বর। কখনও ঔষধ খেতে হয়, কখনও বা এমনিতেই ছেড়ে যায় জ্বর। এরইমধ্যে সুচির প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসে। সুচির বাবা-মা মেয়েকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখতে চায়। এবার আর সুচির শ্বাশুরি বাধা দেয়না। এমনকি রোমেলও না। হয়তো সুচির সন্তান প্রসবের ঝামেলার চাপটা ওরা বহন করতে চাই না, তাই।

সুচি চলে এলো বাপের বাড়ি। দীর্ঘদিন পর একটা লম্বা সময় ধরে থাকতে পারবে বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে। এই খুশীতে সুচির শরীর-মন এমনিতেই চাঙ্গা হয়ে উঠে। কিন্তু রোমেল আসেনা সুচিকে দেখতে কিংবা খোঁজ নিতে। এ নিয়ে অবশ্য সুচির বাড়ির কারও মধ্যে কোন তাগিদ দেখা যায়না। তবু লোক মারফত সুচি খোঁজ-খবর করে। ইদানীং রোমেলের শরীর প্রায়ই খারাপ হচ্ছে, জ্বর ছাড়ছেই না বলা যায়।



এরই মধ্যে সুচি একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়। মেয়ের মুখ দেখে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা ভুলে যায় সুচি। সুচির মেয়ের নাম রাখা হয় মুক্তি। মুক্তির জন্মাবার খবর ওর বাবার বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয় লোক মারফত। কিন্তু কেউ আসেনা সুচি কিংবা তার মেয়ে মুক্তিকে দেখতে। শুধু লোক মারফত একদিন খবর আসে যে রোমেলের শরীর খুব অসুস্থ। তাই ওবাড়ি থেকে কেউ আসতে পারবে না। সুচি যেন মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। তখনও মুক্তির বয়স এক মাস পেরোয়নি। সুচির বাবা-মা এ অবস্থায় কিছুতেই মেয়েকে ছাড়তে নারাজ। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই সুচির শ্বাশুড়ি আসে সুচিকে বাড়ি নিয়ে যেতে। তার বক্তব্য, রোমেল খুব অসুস্থ। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে। এদিকে তার বাবাও অসুস্থ। ঘর-গৃহস্থলীর সব কাজ একা হাতে সামলিয়ে দুইজন রুগীর সেবা করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। সুচি যেন গিয়ে তার স্বামীর দেখাশুনার দায়িত্ব নেয়।



এবার সুচিকে আর কেউ আটকিয়ে রাখতে পারেনি। শ্বাশুড়ির সাথে চলে যায় সে। এই কয়দিনে রোমেল সত্যিই বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দেখে ভয় পেয়ে যায় সুচি। পাড়ার ডাক্তার ডেকে আনে সে। ডাক্তার ঔষধ দেয় বটে। কিন্তু বলে যায় যে, অবস্থা মোটেও ভাল নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় নিতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু শ্বাশুড়ির এক কথা। এই ছন্নছাড়া ছেলের চিকিৎসার জন্য সে টাকা খরচ করতে পারবে না। যার স্বামী সে এই ব্যবস্থা। এমনকি সেদিন থেকে রোমেল ও সুচিকে পৃথকান্ন করে দেয় সুচির শ্বাশুড়ি। অসুস্থ স্বামী, দুগ্ধপোষ্য শিশু, ঘরে এক মুঠো অন্নের জোগাড় নেই, স্বামীর চিকিৎসার টাকা - এতগুলো পাহাড়সম সমস্যা নিয়ে সুচি বাবার বাড়িতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মেয়ে ও তার দুগ্ধপোষ্য শিশুর কথা ভেবে সুচির বাবা-মা রোমেলকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। রোমেলের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। নানা উৎস থেকে টাকা সংগ্রহ করে সুচির পরিবার ছয় মাসের মতো রোমেলের চিকিৎসা চালিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এই সময়ের মধ্যে রোমেলের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ এক দিনের জন্য রোমেলের খবর নিতে আসেনি। অবশেষে ডাক্তার যখন শেষ কথা বলে রোমেলকে বিদায় দিয়ে দেয় তখন মায়াকান্না শুরু করে দেয় রোমেলের মা। রোমেলকে নিয়ে যাওয়া হয় নিজ বাড়িতে। ছোট বাচ্চা নিয়ে সুচি কিভাবে মরণাপন্ন রোমেলকে নিয়ে দিন যাপন করবে ? তাই সুচির মা থেকে যায় মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু সুচি ও তার মায়ের প্রতি বেলার খাবার আসে সুচির বাবার বাড়ি থেকে। তা সত্ত্বেও সুচির শ্বাশুড়ি কথা শুনাতে ছাড়েনা সুচির মাকে।



অচিরেই এসবের সমাধান করে দেন বিধাতা। রোমেল ইহলোক ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে যাবার অল্প কয়দিনের মধ্যেই। যে মেয়েটির মনজুড়ে স্বপ্ন বুনে লম্বা চুলে বেণী দুলিয়ে কিশোরী চপলতায় চারপাশকে রাঙিয়ে কলেজে যাবার কথা ছিল, সেই মেয়েটি আট মাসের শিশু সন্তান নিয়ে বিধাব হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে এলো।



[সম্মানিত পাঠক, গল্পের এ পর্যায়ে এসে আপনাদের কাছে এই কাহিনীটাকে কল্পনাপ্রসূত মনে হয়েছে কি-না আমি জানিনা। কিন্তু এই কাহিনী পুরোপুরি সত্যি এবং আমার অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা। এমনকি সুচিকে অপহরণের পর ঢাকায় ডিবি অফিসেও ধর্ণা দিয়েছিলাম আমি আর আমার স্বামী। কারণ, সুচি আমার কাছের আত্মীয়। তবে সুচি এবং তার স্বামীর প্রকৃত নাম এখানে প্রকাশ করা হয়নি।]



যাক গে। যে কথা বলছিলাম। এই গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত কিংবা আমি শেষ করে দিতে পারতাম। কিন্তু সেটা করলে অবিচার করা হবে সুচির প্রতি এবং অন্য আর একজন মহান ব্যক্তির প্রতি। পাঠকদের নিকট অজানা থেকে যাবে ভাগ্যের কাছে হার না মেনে শূন্য থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো একটি মেয়ের গল্প। সেই গল্পই এখন বলব।



সেই সুচি এখন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা, একজন সুগৃহিনীও বটে। তার চেয়েও বড় খবর হলো সুচি এখন তার মুক্তাসহ দুই সন্তানের জননী এবং তৃতীয়বার মা হবার জন্য আসন্ন প্রসবা।



সুচির ভাগ্য পরিবর্তনের এই গল্পটাই বলব পরবর্তী পর্বে।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:২৮

নুরএমডিচৌধূরী বলেছেন: খুব ভাল হয়েছে

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:১৩

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

২| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৩৮

ডি মুন বলেছেন: সুচি শ্বাশুড়ির কটুবাক্য গায়ে মাখতে চায় না। কিন্তু বড় কষ্ট পায় যখন রোমেলও মাঝে মাঝে তার মাকে সমর্থন করে সুচিকে কথা শুনায়। রোমেল যেন এখন আর আগের মতো নেই, বদলে গেছে অনেকটা। যে ভালবাসার প্রচন্ড উন্মাদনা রোমেল সুচিকে অপহরণ করে বিয়ে করার মতো দুঃসাহসী কাজ করেছিল, সেটা আদৌ ভালবাসা ছিল কি-না আজকাল এ নিয়ে সুচির মনে প্রায়ই সন্দেহ জাগে। মাঝে মাঝে ওর প্রতি রোমেলের ব্যবহার প্রচন্ড আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। সুচি ভয় পেয়ে যায় তখন। কিন্তু করার কিছু নেই তার। এসবকিছু মাকে জানিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা আর বাড়াতে চায় না সে।

এটা খুবই কমন একটা চিত্র আমাদের দেশে।

আর আপনার গল্পটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। যদিও এখন সুচি ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন শেষে। তবুও তাকে কিরকম কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি।

যাহোক, এমন ঘটনা সমাজে আর না ঘটুক - এটাই প্রত্যাশা।

শুভকামনা রইলো।

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:১৫

সুফিয়া বলেছেন: আপনার মতো এই প্রত্যাশা আমারও। স্বামী-সন্তানসহ সুচিকে সুখে থাকতে দেখে আমার খুব ভাল লেেগছে। কামনা করি ওর এই সুখের নিরবচ্ছিন্নতা যেন বজায় থাকে।

ধন্যবাদ আপনাকে। এতবড় লেখাটা পড়ার জন্য।

৩| ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:০৮

দৃষ্টিসীমানা বলেছেন: বেদনাময় কাহিনী , আপনার নিখুঁত বর্ণনা প্রশংসনীয় । ভাল লাগা রইল ।

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:১৮

সুফিয়া বলেছেন: এসব কাহিনী এতদিন গল্পে পড়েছি। কিংবা নাটক-সিনেমায় দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে এমনটি দেখে মানুষের ভাগ্য নিয়ে বিধাতার খেলাকে কেমন যেন বড় নিষ্ঠুর মনে হয়। এরপরও বিধাতা সুচির জন্য সুখময় একটা জীবন তৈরী করে দিয়েছেন। সেজন্য বিধাতাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.