![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।
একজন কালো মানুষের কথা ভুলতে পারিনা।
নাম জানা হয়নি সেই কালো মানুষটির, কোন পরিচয়ও না। সেটা ২০১২ সালের হজ্ব মওসুমের কথা। আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবাণীতে ঐ বছর আমি হজ্বে গিয়েছিলাম আমার স্বামীর সাথে। আরাফাত দিবস অর্থাৎ হজ্বের পরের দিনের ঘটনা এটি। যারা টেলিভেশনে হজ্বের অনুষ্ঠান কিংবা এখন যেমন হজ্ব পূর্ববর্তী অনুষ্ঠানসমূহ পবিত্র মক্কা থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে, সেগুলো দেখেন তারা খেয়াল করবেন যে দীর্ঘদেহী কালো নারী-পুরুষেরা দল বেঁধে চলাফেরা করছে। এরা হাবসী সম্প্রদায়, হযরত বেলাল (রাঃ) এর বংশধর। ওরা বলা যায় অনেকটা বিনা খরচে হজ্ব করতে আসে। সৌদি সরকার হযরত বেলাল (রাঃ) এর প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজ খরচে এদেরকে নিয়ে আসে এবং হজ্বশেষে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। শুধু নিজেদের থাকা-খাওয়ার খরচটা ওরা বহন করে। সেটা বহন করার সুযোগও সৌদি সরকার ওদেরকে করে দেয়। যারা হজ্বে গিয়েছেন তারা ভাল জানবেন। হজ্ব মওসুমে হেরেম শরীফের আশেপাশের রাস্তায় কিংবা মদিনা মনোয়ারায় মসজিদে নববী এর চারপাশে নানা জিনিস পত্রের পসরা সাজিয়ে বসে এরা। হজ্বে এসে এই ধরনের উপার্জনশীল কাজে একমাত্র এরাই নিয়োজিত হতে পারে।
আজ এমনি একজন কালো মানুষের কথা বলব। হজ্বের পরদিন মুযদালিফা থেকে মিনার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা। এর আগের দিন আরাফার মাঠ থেকে হেঁটে মুযদালিফা এসে রাত্রি যাপন করেছি। সঠিক বলতে পারবনা, তবে সম্ভবত পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার হেঁটে রাত দশটায় মুযদালিফায় এসে পৌঁছেছিলাম। রওনা দিয়েছিলাম সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক থাকেনা এ সময়। আরাফার মাঠে দুপুরের খাবার হিসেবে খেয়েছিলাম সৌদি সকোরের দেয়া ভাত-মাংস। আর আমাদের সংগে আছে খেজুর, বিস্কুট, চিড়া ইত্যাদি। তাছাড়া আরাফার মাঠ থেকে আসার সময় পথে পথে দিয়েছিল জুস প্যাক। সেগুলো কিছু খেয়েছিলাম, কিছু সাথে রয়ে গেছে।
যাই হোক। রাত দশটায় মুযদালিফায় পৌঁছে শরীর যেন আর চলছিল না। কোনমতে একটু শোয়ার জায়গা করে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম খোলা আকাশের নিচে। কিন্তু হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে একটি হলো মুযদালিফায় এসে মাগরেব আর এশার নামাজ একসাথে পড়তে হবে। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর উঠে সেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলাম। তারপর বিস্কুট, খেজুর, জুস ইত্যাদি দিয়ে রাতের খাবার সারলাম। রাত কাটল ঘুম-অঘুমের মাঝে। ফজরের আজানের সাথে সাথে উঠে জামায়াতে নামাজ পড়ে কিছু খেজুর, বিস্কুট আর পানি খেয়ে আবার রওনা দিলাম আমরা মিনার উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে শয়তানকে পাথর মারতে হবে। আমরা দলে ছিলাম চার জন মহিলাসহ আটজন। যার যার সাথে থাকা বোতলে খাবার পানি নিয়ে নিলাম আমরা। কিন্তু কতই বা আর নেয়া যায় ? এমনিতেই ক্লান্ত শরীর। তার উপর সবার সাথে মোটামুটি ভারী একটা ব্যাগ। তবু সাধ্যমত খাবার পানি সাথে নিলাম আমরা।
লাখ লাখ মানুষের সাথে হাঁটতে লাগলাম। একটু পর পর আমার গলা শুকিয়ে আসছিল আর আমি একটু একটু করে পানি বোতল থেকে মুখে দিচ্ছিলাম। আমার হাজব্যান্ড আবার লো প্রেসারের মানুষ, প্রতিদিন সকালে একটি করে খাবার স্যালাইন খেতে হয় তাকে। ঘন্টাখানেক হাঁটার পর দেখলাম ওর শরীর কেমন যেন দুর্বল হয়ে আসছে। আমি ব্যাগ থেকে একটা স্যালাইনের প্যাকেট বের করে সেটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে আমাদের কাছে থাকা সর্বশেষ পানির বোতলে ঢেলে নেড়েচেড়ে ওকে খেতে দিলাম। আমাদের সাথের এক ভাই আবার ওর কাছ থেকে অর্ধেকটুকু চেয়ে নিয়ে খেল। স্যালাইন খেয়ে আমার স্বামী একটু সুস্থ বোধ করল। আবার হাঁটতে লাগলাম আমরা। আমার উৎসুক দৃষ্টি কেবল খুঁজে বেড়াতে লাগল দুরত্ব লেখা ডিজিটাল সাইনবোর্ড। আর কতদূর হাঁটতে হবে ? শুরু করেছিলাম যেখান থেকে সেখান থেকে ঘন্টাখানেক হেঁটে এসে বোধহয় দেখেছিলাম মিনার দূরত্ব ছয় কিলোমিটার।
খোলা আকাশের নিচে মানুষের ভীড়ে তা-ও হাঁটা যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ঢুকতে হলো একটি টানেলের ভিতর। যারা হজ্ব করে এসেছেন এবং হেঁটে মিনা অবধি গিয়েছেন, তারা জানেন যে এই টানেলের ভিতর কি অবস্থা হয় ! সীমাবদ্ধ জায়গা ধরে লাখ লাখ মানুষ হাঁটছে। হাঁটা তো নয়, একজনের ঠেলায় অন্য জন এগিয়ে যাচ্ছে। জানতে পারলাম এই টানেল গিয়ে শেষ হয়েছে মিনায়। কিন্তু টানেল যেন আর শেষ হয়না। ঠেলাঠেলিতে আমাদের দলের সবাই তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি শক্ত করে আমার স্বামীর কোমড়ের বেল্ট ধরে এগোতে লাগলাম। আর মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকতে লাগলাম।
কিন্তু খাওয়ার পানি তো নেই। ব্যাগে দুটো চকলেট ছিল, একটা একটা করে দুটোই শেষ করলাম। এতে পিপাসা না মিটলেও মুখের ভিতরটা একটু ভিজল। কিন্তু এখন সেই চকলেটও নেই। আমার স্বামী বরাবরই কষ্টসহিষ্ণু মানুষ। মুখে কিছু বলছেনা, শুধু দোয়া পড়ছে। কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, ওর অবস্থাও আমার মতো। আমার জিহবা শুকিয়ে মুখের ভিতর আটকে যাবার যোগাড় হয়েছে, ঠিকমতো কথা বলতে পাচ্ছিনা। তবু কোনমতে বললাম, একটু খাবার পানি যদি পেতাম ! আমার স্বামী বলল, আল্লাহকে ডাক, তিনি সব কষ্ট দূর করে দিবেন। আমি তো প্রথম থেকে তাই করছি। আল্লাহকে ডাকা ছাড়া এখানে তো আমাদের করার মতো আর কিছু নেই।
এভাবেই হাঁটছি মানে পেছনের দিকের ঠেলায় সামনে এগোচ্ছি। কোথাও বিরতি দিয়ে একটু বিশ্রাম নিব সেই উপায় নেই। আমি হাঁটছি আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি কারও কাছে একটু খাবার পানি পাওয়া যায় কি-না। এমন সময় দেখি আমার পাশ দিয়ে হাঁটছে দীর্ঘদেহী একজন কালো পুরুষ। হাঁটছে আর বোতল থেকে পানি পান করছে সে। আমি ওর পানির বোতলের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারলামনা। তখনও একটু পানি বোতলে রয়ে গেছে। এমন সময় লোকটির দৃষ্টি পড়ল আমার দিকে। আমার পিপাসা কাতর দৃষ্টির অর্থ সে বুঝতে পারল। ইশারায় জিজ্ঞেস করল, আমি পানি চাই কি-না। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। সে সাথে সাথে বোতলটি আমার হাতে দিয়ে দিল। বোতলের তলায় একটুখানি পানি। সেটার অর্ধেকটা আমি পান করলাম, অর্ধেকটা আমার স্বামীকে দিলাম। তারপর কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য ফিরে তাকিয়ে দেখি লোকটি আমাদেরকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে অনেকটা। (এখানে একটু বলে রাখি যে, আমরা হাঁটছিলাম টানেলের মাঝ দিয়ে। এরপর কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আমরা ডানদিকে সরে গিয়ে টানেলের পাশ ধরে হাঁটতে গিয়ে পানির ব্যবস্থা পেয়েছি, একটুখানি বসে বিশ্রামও নিতে পেরেছি। তাই মনে হয়েছে যে, প্রথম থেকে একপাশ ধরে হাঁটলে বোধহয় এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতনা)।
আমরা জানি যে, হজ্বের আর এক অর্থ হচ্ছে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ মুসলিম উম্মাহর মিলন। হজ্বে যাবার প্রথম দিন থেকে সেটা আমরা দেখে থাকি এবং উপলব্ধিও থাকি। কিন্তু পিপাসার চরম মুহূর্তে সেই কালো মানুষটি তার পান করা পানির খানিকটা আমাদেরকে দিয়ে যে উপকার করেছিল তা বলে বুঝানোর মতো নয়। ভুক্তভোগী ছাড়া এর সত্যিকার মমার্থ হৃদয়ঙ্গম করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণভাবে মনে হতে পারে একটু খাবার পানি দিয়ে সে এমন কি করেছে ? কিন্তু সেই মুহূর্তে পারিপার্শ্বিকতার বিচারে সেই একটু পানি আমার কাছে শুধু একটু পানিই ছিলনা, এর মূল্য ছিল অন্যরকম, টাকা-কড়ির মূল্য মানের উর্ধ্বে। একথা বলতে আজ আমার দ্বিধা নেই যে, এমনিতে অর্থাৎ সাধারণ অবস্থায় একজন কালো মানুষের পান করা পানির বাকী অংশ একই বোতল থেকে আমি হয়তো কখনই পান করতাম না। কিন্তু সেদিন যে সহমর্মিতা দেখিয়েছে আমাকে ঐ কালো মানুষটি, সেটা আমি যতদিন বেঁচে থাকব কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব। আর মনপ্রাণ দিয়ে ঐ কালো মানুষটির মঙ্গল কামনা করে যাব।
২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:১৯
সুফিয়া বলেছেন: আপনি যেহেতু উনাদের ভাল এর প্রসঙ্গ টানলেন তাহলে আর এক্তা ঘটনা বলি। সেটা মদিনাতে। মসজিদে নববির যে পাশে জান্নাতুল বাকি অবস্থিত সেখানে এক কালো মহিলার কাছ থেকে মাথায় পরার রুমাল কিনলাম ৪টি। প্রতিটির দাম ২ রিয়াল। আমি দাম দিতে গেলে মহিলা আর একটি রুমাল হাতে দিয়ে বলল, লও। মদিনা কা তোফা। আমি রুমালটি হাতে নিয়ে মহিলাকে শুকরিয়া জানালাম।
এবার বুঝুন ওদের উদারতা কোন পর্যায়ের! এই ব্যবসা ওদের জীবিকার উৎস। অথচ কি উদারচিত্তে তোফা বা উপহার দিল আমাকে ?
ধন্যবাদ আপনাকে।
২| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:০৩
কলমের কালি শেষ বলেছেন: পড়ে ভাল লাগলো । কিন্তু আমি সাদা
।
২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২০
সুফিয়া বলেছেন: কলমের কালি সাদা হলে চলবে কি করে ?
ধন্যবাদ আপনাকে।
৩| ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ২:০৮
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: আল্লাহ্তায়ালা ঐ কালো মানুষটির মঙ্গল করুন। শুভকামনা রইল আপনার প্রতিও।
২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২৩
সুফিয়া বলেছেন: আপনার জন্যও শুভকামনা রইল।
ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ।
৪| ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৫
আদম_ বলেছেন: যে কোন হজ্বের গল্প আমি এতো মনযোগ দিয়ে পড়ি যে আর কোন কিছুই আমার মনযোগকে এভাবে আকর্ষণ করেনা। খুব ভালো লাগলো। কত মানুষের হজ্বের কাহিনি শুনেছি আর পড়েছি তার ঠিক নেই, তবু আমি এখনো এতটাই তৃষ্ণার্ত যে মনে হয়ে প্রথমবার কোন হজ্বের কাহিনে শুনছি।
২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:৫৪
সুফিয়া বলেছেন: এটা আমার বেলায়ও হচ্ছে। আমি নিজে ঈদ হজ্ব করে এসেছি। তাও
আপনার মত বার বার হজ্ব ফেরত মানুষের মুখ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে ইচ্ছে করে।
ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকবেন।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:০৯
মুদ্দাকির বলেছেন:
পড়লাম ভালো লাগল। হজ্জ ফেরত অনেক মানুষের কাছেই শুধু কালোদের প্রশংসা শুনি। উনারা আসলেই হয়ত অনেক ভালো !!