![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।
জংধরা লাইব্রেরী
ঢাকা শহরের অগণিত রিক্শাওয়ালাদের একটাই পরিচয়। তারা রিক্শাওয়ালা। রিক্শার ঘুর্ণায়মান চাকার সাথে পাক খায় তাদের জীবনের চাওয়া-পাওয়া। রিক্শা চালিয়ে তারা নিজের পেটের ভাত জোগায়, জোগায় পরিবার পরিজনদের মুখের গ্রাস। এদের কেউ চালায় নিজের রিক্শা, কেউ চালায় মহাজনের রিক্শা। দিনশেষে সারাদিনের অর্জিত আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ তুলে দিতে হয় মহাজনের হাতে। এক্ষেত্রে মহাজনের পাওনা অংশের কোন হেরফের হওয়ার জো নেই সারাদিনের আয়-উপার্জন যাই হোক না কেন ।
মফিজউদ্দীন এই দলেরই একজন রিক্শাওয়ালা। তবুও নিজকে এদের থেকে আলাদা করে ভাবতে ইচ্ছে করে তার। ভালও লাগে। এই ঢাকা শহরে তার মতো স্কুল পড়া, কলেজ পড়া রিক্শাওয়ালার হয়ত অভাব নেই। কিন্তু তাতে কি? রিক্শাওয়ালা হলেই সে দারিদ্র পীড়িত, বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো অবস্থা থেকে উঠে এসেছে একথা সত্যি নয়। অথচ সব রিক্শাওয়ালাকে এক পাল্লায় ওজন করে সবাই। তবুও মফিজউদ্দীন নিজকে এদের থেকে একটু আলাদা করে রাখতে চায়। ধরে রাখেতে চায় নিজের ভিতরের সভ্য শিক্ষিত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার চেতনা বোধকে।
মফিজউদ্দীন জানে তার এই ইচ্ছে শুধু ইচ্ছেই নয়। সময়ের সাথে অহরহ টিকে থাকার সংঘাত। এ সংঘাতে জয়ী হওয়ার অদম্য ইচ্ছে তাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজের ভেতরে কোথায় যেন জ্বলে উঠার অপেক্ষায় একটা দাবানলের অস্তিত্ব টের পায় মফিজউদ্দীন। সেটাকে জিইয়ে রাখার তার প্রাণপণ লড়াইটা মাঝপথে ফুটা বেলুনের মতো চুপসে যায় ময়নার কথায়।
বাবা, তুমি আবারও বই কিনেছ? ঘরে রাতে রান্নার চাল নেই। আর তুমি কিনা ---
কথা শেষ করতে পারেনা ময়না। দু’চোখ ভরে আসা উদগত অশ্রু দমন করতে সে তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরে অন্যত্র সরে যায়। নিজকে অপরাধী ভাবতে থাকে মফিজউদ্দীন। চাল কিনতে হবে ময়না সকাল বেলা বলে দিয়েছিল। মহাজনের পাওনা শোধ করে তার হাতে কিছু টাকাও ছিল। কিন্তু নীলক্ষেতের মোড়ে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে তার কি জানি কি হলো। সব ভুলে গেল। হাতের কাছেই ফুটপাতের বই এর দোকান থেকে তিরিশ টাকায় কিনে ফেলল বইটা। ফলে যা হবার তাই হলো। বাড়ি ফিরতে হলো খালি হাতে। হয়ত দুপুরেও কিছু খায়নি মেয়েটা। তাই বাপের হাতে বই দেখে নিজকে আর সামলাতে পারেনি কিছুতেই। তানাহলে সহজে অনুযোগ করার মেয়ে নয় ময়না।
বুকের ভিতর সেই চেনা কষ্টটা ধলা বাঁধতে থাকে মফিজউদ্দীনের। ময়নারই বা দোষ কি? এইটুকু বয়স থেকে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে তার। মুখ ফুটে সামান্য অভিযোগও করেনা কোনদিন। অথচ মফিজউদ্দীন একটু হিসেবী হলে অনায়াসে চলে যেত তাদের সংসার। ঢাকা শহরে রিক্শা চালিয়ে দু’জন মানুষের ভরণ-পোষণ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কিন্তু মফিজউদ্দীন পারেনা এতসব হিসেব করে চলতে। বই পড়ার প্রচন্ড নেশা তাকে টেনে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে। সে ভুলে যায় ঘরে তার একটা উঠতি বয়সের মেয়ে আছে। তাকে আর বেশীদিন নিজের কাছে ধরে রাখা যাবে না। সে জন্য এখন থেকে তিল তিল করে প্রস্তুতি নিতে হবে। ভুলে যায় তার মতো এক রিক্শাওয়ালার জন্য বই কিনা শুধু বিলাসীতাই নয়, তারও অতিরিক্ত কিছু। সারা জীবন ময়নার মা এ নিয়ে গজ গজ করেছে। তখন অবশ্য সংসারে কিছুটা প্রাচুর্য ছিল। এখন তো তাও নেই। একেবারে নুন আনতে পানতা ফুরানোর অবস্থা।
ভাবনা বেশীদূর এগোতে দেয়না মফিজউদ্দীন। সত্যিই সে আজ একটা বড় অন্যায় করে ফেলেছে। স্বার্থপরের মতো নিজের দিকটাই কেবল ভেবেছে। একটা কিছু না করলেই নয়। সে লুঙ্গির গিট খুলে একটা একটা করে গুণে টাকাগুলো। একটা দশ টাকার নোট, একটা পাঁচ টাকার নোট, একটা দুই টাকার নোট, আর একটা আধুলি। দুপুরে আড়াই টাকার রুটি খেয়ে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়েছিল দোকানীকে। তা থেকে ফেরত পেয়েছিল আড়াই টাকা। আর পাঁচ টাকাটা ঘর থেকে নিয়ে বেরিয়েছিল। একবারে খালি হাতে বের হলে নাকি উপার্জন ভাল হয়না। তাই ময়না এটা বের করে দিয়েছিল তার হাতে। আর বই কেনার পর বেঁচেছিল দশ টাকা। সব মিলিয়ে সাড়ে সতের টাকা।
হঠাৎ নিজের ভিতর একটা ঝাঁকুনি খায় মফিজউদ্দীন। সে তো দুপুর বেলা যা হোক একটা কিছু খেয়েছে। মেয়েটা সারাদিন না খেয়ে বসেছিল রাতে ভাত খাবার আশায়। কিন্তু এ কি করেছে সে? পেটের খাবারের জোগাড় নেই যার, সে কি না মনের খোড়াকের জন্য পয়সা খরচ করে? এ বিলাসীতা তাকে মানায় না।
স্খলিত পায়ে ঘরে ঢুকে মফিজউদ্দীন। ময়না চুপ করে বসে আছে চৌকির এক কোণে। কাছে গিয়ে মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত রাখে মফিজউদ্দীন।
আমার উপর রাগ করিস না মা। তোর এই পাগল ছেলেটাকে ক্ষমা করে দে।
বাবার কথায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ময়না।
কেন এমন হয় বাবা? তোমার বই পড়ার এত সখ আর সেই তোমাকে কি না একটা বই কেনার জন্য এক বেলা উপোষ করতে হয়?
এসব নিয়ে কথা বলে কি লাভ মা? সবই ভাগ্যের লিখন। নইলে কেন এমন হবে? তোকে জন্ম দিতে গিয়ে তোর মা মরল। নদীর ভাঙনে ঘরবাড়ি সব গেল। ভাগ্যের অন্বেষণে তোকে নিয়ে ঢাকায় এলাম। মনে বড় আশা ছিল যে ভাবেই পারি তোকে পড়াশুনা করাব। নিজে তো স্কুলের পরে আর পড়তে পারিনি। তোকে দিয়ে সেই ইচ্ছে পূরণ করব তাও হলনা। এমন হতভাগ্য বাপ আমি। তোকে সারাদিন অভূক্ত রেখে নিজের পেটের ক্ষুধা তো মিটালামই, বিলাসীতা করতেও ছাড়লাম না। আর এদিকে তুই সারাদিন না খেয়ে বসে আছিস রাতে খাবারের আশায়।
নিজকে আর সামলাতে পারেনা মফিজউদ্দীন। হু হু করে কেঁদে ফেলে সে। ময়না তার শাড়ির আঁচল দিয়ে বাপের চোখ মুছে দেয়।
বাবা, তুমি অযথা কষ্ট পেওনা। আমার একটুও কষ্ট হয়নি সারাদিন। তুমি রাতে কি খাবে? এটা ভেবেই আমার সব গুলিয়ে গেল। আসলে তোমাকে এভাবে বলাটা আমার উচিত হয়নি। দাও বাবা, বইটা আমার কাছে দাও। দেখি আজ কি বই কিনেছ।
হাত বাড়িয়ে মফিজউদ্দীনের হাত থেকে বইটা টেনে নেয় ময়না। মফিজউদ্দীন উঠে দাঁড়ায়।
আমি যাই মা। যে কয়টা টাকা আছে দেখি কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় কি না।
বেরিয়ে যায় মফিজউদ্দীন। পেছন থেকে ময়নার গলা শুনা যায়, বাবা তুমি কিন্তু দোকান থেকে আবার বাকীতে কিছু আনতে যেও না। শুনে নিজে নিজে না হেসে পারেনা
মফিজউদ্দীন। মনে মনে বলে, হায়রে আত্মসম্মানবোধ! তোকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে গরীবকে কত না যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।
বইটা কিছুক্ষণ উল্টে পাল্টে দেখে ময়না। বাবার জন্য একটা কষ্ট দানা বাঁধতে থাকে বুকের ভিতর। উঠে দাঁড়ায় সে। বই হাতে এগিয়ে যায় টিনের বাক্সটার দিকে। মফিজউদ্দীনের কাছে এ বাক্সটা শুধু একটা বাক্সই নয়, একটা মিনি লাইব্রেরী। হরেক রকমের বই এ ঠাসা। ময়না যত্ন করে তুলে রাখে বইটা। বাক্সের ডালা বন্ধ করে। ফুঁ দিয়ে অযথাই ডালার উপরের ধূলি পরিস্কার করে। ধূলিই বা আসবে কোত্থেকে জংধরা টিনের বাক্সটার উপর? প্রতিদিনই একবার করে মফিজউদ্দীনের হাত পড়ে এতে।
মফিজউদ্দীনের প্রাণ এই বাক্সটা। ময়নাও জানে সে কথা। অবসর পেলেই এটাকে ঝেড়ে ধূলো-বালি পরিস্কার করে সে। প্রতিরাতে ঘরে ফিরে ঘুমানোর আগে বাক্সটা খুলে বসে মফিজউদ্দীন। একটা একটা করে সবগুলো বই নামায়। হাত দিয়ে ঘসে পরিস্কার করে। পছন্দমতো একটা বই খুলে কিছুক্ষণ পড়ে। তারপর শুয়ে পড়ে মেঝের উপর ছাটাই বিছিয়ে। ময়না ততক্ষণে চৌকির উপর ঘুমে অচেতন।
মেয়ে বড় হয়েছে। আলাদা থাকার ব্যবস্থা করার মতো সামর্থ নেই মফিজউদ্দীনের। তাই সে মেঝের উপর নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিন রিক্শার চাকায় জীবনকে খোঁজে ফেরা, ঘরে ফিরে কিছুক্ষণ বই এর জগতে নিজকে ডুবিয়ে রাখা, তারপর গভীর প্রশান্তির নিদ্রায় নিজকে সফে দেয়া এভাবেই চলছে রিক্শাওয়ালা মফিজউদ্দীনের জীবন। তা থেকে মাঝখানের সবচেয়ে ছোট্র সময়টুকু তার বড় সুখের, বড় আকাংখার।
কিন্তু মফিজউদ্দীনের মন ভরে না এতে। বইগুলো তার অনেকবার পড়া হয়ে গিয়েছে। এতবার পড়েছে যে সবগুলো বই এর কাহিনী ও চরিত্রের নাম সে হুবহু বলে দিতে পারে। আরও নতুন নতুন বই পড়ার তাড়না সব সময় মফিজউদ্দীনকে ক্ষত-বিক্ষত করে। কিন্তু এ যে গরীবের ঘোড়া রোগ। কি দিয়ে কিনবে সে বই? তাই মাঝে মাঝে এমন অবিবেচকের মতো কাজ করে ফেলে সে আগপাছ না ভেবেই। ময়না বুঝে সবকিছু। তার বাবার রক্তক্ষরণের উৎসটা কোথায় সে জানে। কিন্তু কিছুই করার নেই তার। বই পড়ার আগ্রহ তারও কম নয়। বাবাকে বুঝতে দেয়না সে তার এই আগ্রহের কথা। রংচটা বাক্সের ভিতরে রাখা বইগুলো তারও পড়া হয়ে গিয়েছে। তবে মফিজউদ্দীনের অজান্তে।
মফিজউদ্দীন কোনমতে খেটে-খুটে ক্লাস নাইন অবধি পড়িয়েছিল ময়নাকে। কিন্তু আর এগোতে পারেনি। এগুতে দেয়নি ময়না নিজেই। ভেবেছে তার পড়ার খরচটা বাঁচিয়ে এ দিয়ে যদি বাবার বুকের রক্তক্ষরণ খানিকটা কমানো যায়। কি হবে বাবার রক্ত পানি করা টাকায় অত পড়াশুনা করে? কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষা তো আর কপালে জুটবে না। সেই তো বিয়ে হবে আর এক বস্তিবাসী রিক্শাওয়ালা কিংবা মুদি দোকানদারের সাথে।
ময়নার বিশ্বাস পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সে ভুল করেনি মোটেও। বই হাতে মফিজউদ্দীন যখন ময়নার সামনে এসে দাঁড়ায় তখন তার সুখ সুখ মুখটা দেখে সব কষ্ট ভুলে যায় ময়না। এ কি কম পাওয়া! ভাবে ময়না। তিল তিল করে যে মিনি লাইব্রেরী তার বাবা গড়ে তুলেছে তা কয়জনে পারে? অনেক শিক্ষিত লোকের ঘরেও এমন একটা লাইব্রেরীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সম্পদের প্রাচুর্য তাদের নেই। কিন্তু মনের প্রাচুর্যে তার রিক্শাচালক বাবা অনেক বিত্তবানদের চেয়েও বিত্তশালী। তার প্রমাণ এই জংধরা মিনি লাইব্রেরী।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫০
সুফিয়া বলেছেন: ঈদের দিন আমি কারও মন খারাপ করে দিতে চাইনি। তবে গল্পটা মনে দাগ কেটে যায় এটা ঠিক।
ধন্যবাদ আপনাকে গল্পটা পড়ার জন্য।
ঈদ মোবারক।
২| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১১:৪৫
কলমের কালি শেষ বলেছেন: হুমম ।
তিল তিল করে যে মিনি লাইব্রেরী তার বাবা গড়ে তুলেছে তা কয়জনে পারে? অনেক শিক্ষিত লোকের ঘরেও এমন একটা লাইব্রেরীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সম্পদের প্রাচুর্য তাদের নেই। কিন্তু মনের প্রাচুর্যে তার রিক্শাচালক বাবা অনেক বিত্তবানদের চেয়েও বিত্তশালী। তার প্রমাণ এই জংধরা মিনি লাইব্রেরী।
চমৎকার গল্প । ঈদ মোবারক ।
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫২
সুফিয়া বলেছেন: গল্পটা আপনার ভাল লেগেছে দেখে আমারও খুব ভাল লাগছে। ধন্যবাদ আপনাকে গল্পটা পড়ার।
সেই সাথে অনেক অনেক ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
৩| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৩
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ব্যাতিক্রমি প্লটের এই ছোটগল্পে একরাশ ভালোলাগা।
+++
ঈদের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো খুব ভালো কাটুক। ভালো থাকবেন।
১০ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১০:৩৬
সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার ঈদও আনন্দময় পরিবিশে কাটুক।
©somewhere in net ltd.
১|
০৬ ই অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:২৮
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: মন খারাপ করে দিলেন আপু ।
ঈদ মুবারক ।