নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প -- ইচ্ছেবলী

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:০২

ইচ্ছেবলী

প্রকৃতির উপচে পড়া সবজ সৌন্দর্যের দিগন্ত ছুঁয়ে নেমে আসা বিশাল আকাশ, তার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি বৃক্ষরাজির অনবরত পিছু ছুটে চলার দৃশ্য দেখতে দেখতে এমদাদের ভ্রমণের ক্লান্তি কখন কেটে গেছে টেরও পায়নি। দু’পাশে সবুজের বিস্তৃত প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সামনের দিকে ছুটে চলছে ময়মনসিংহ-ঢাকাগামী বাসটি। একই গতিতে পিছু ছুটে চলছে দূরের বৃক্ষরাজি, গ্রাম, পুকুর, বাঁশঝাড়গুলো। তন্ময় হয়ে প্রকৃতির এই লুকোচুরি খেলার দৃশ্য দেখছিল এমদাদ। আর ভাবছিল প্রকৃতির এই যে বিশাল সৌন্দর্য ভান্ডার, যা দেখে আমরা নয়ন-মন সার্থক করি তার বেশীটাই বৃক্ষরাজিকে ঘিরে। অথচ কি নিষ্ঠুর আমরা! প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, ব্যক্তিস্বার্থে অহরহ উজাড় করে চলেছি এই বৃক্ষ সম্পদ।

মনটা খারাপ হয়ে যায় এমদাদের। ভালো লাগার অনাবিল যে সুখটা এতক্ষণ তার মধ্যে খেলা করছিল তা নিমিষে হারিয়ে যায়। সামনে এসে দাঁড়ায় একটি ঘটনা। এই তো সেদিন। পত্রিকার পাতায় খবর বেরিয়েছে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে উসমানী উদ্যানের বেশ কিছু গাছ কেটে নিয়ে গেছে। আর তার স্কুল শিক্ষক বাবা তাকে ডাক্তার বানাতে গিয়ে জমি-জিরাত সব শেষ করে এখন হাত বাড়িয়েছে বৃক্ষ নিধনের দিকে। প্রেক্ষাপট যদিও ভিন্ন। তার বাবাকে একাজ করতে হয়েছে নিরূপায় হয়ে, সন্তানের শিক্ষার পথকে গতিশীল রাখতে। তবুও এমদাদের মনে হয় ঘটনা তো একই। সেই বৃক্ষ নিধন, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের অঙ্গহানী। যার জন্য দায়ী সে নিজেও।

মেডিকেলে সবে চতুর্থ বর্ষে পা দিয়েছে এমদাদ। তার বাবার শিক্ষকতার বেতনের সামান্য ক’টি টাকায় তাদের সংসারের টানাপোড়েনের খবর সে জানে। বাবা যখন যা পারে দেয়। তবে নির্ভর করার মতো নয়। তাই দু’টো টিউশনী করে এমদাদ। নিজের খরচটা কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নেয়। বাবার জন্য এটাই তার সাহায্য। তার বাবা ইসহাক মাস্টারও বুঝে সেটা। ছেলের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসায় মনটা ভরে উঠে তার। এমদাদ জানে তার বাবার এই স্নেহ-ভালোবাসা তার প্রতি কৃতজ্ঞতার নামান্তর। কারণ বাবার কাছে মাসে মাসে টাকার জন্য হাত না পেতেও সে চালিয়ে যাচ্ছে তার পড়াশুনার খরচ।

ক্লাস টেনে পড়া ছোটবোন তনিমা আর তার মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে তার বাবার সংসার চলে টেনে-হিঁচড়ে। মেধার জোড়ে বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছে তনিমা। আর মাত্র একটি বছর। এরপর স্কুলের পাঠ চুকে যাবে তনিমার। কি হবে এরপর কেউ জানেনা। ভাবতে পারেনা ইসহাক মাস্টার নিজেও। তার বড় স্বপ্ন এমদাদকে নিয়ে। ছেলে তার ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে আসবে একদিন। গ্রামের দুঃখী মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবে, তাদের মুখে হাসি ফুটাবে। বিনিময়ে তার শরীরের রক্তক্ষণিকাগুলো না হয় একটু একটু করে পানি হয়ে যাবে। ক্ষতি কি তাতে?

তনিমাকে নিয়েও স্বপ্ন দেখে ইসহাক মাস্টার। তার শরীরের রক্ত জল করা চেষ্টায় যদি মেয়েটাও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পায় তাহলে তার সংসারে একদিন সুখ উপচে পড়বে। আর তাই দেখে খুশী হবে এ গাঁয়ের অসংখ্য হাড্ডিসার মানুষ। তাদের ঘরে ঘরে কিছুটা হলেও শিক্ষার আলো জ্বলবে। উৎসাহী হয়ে তারাও তাদের সন্তানদের পড়াশনার ব্যাপারে আগ্রহী হবে।
এমদাদ জানে এসবকিছু। তার বাবার স্বপ্নগুলো তাকে তাড়িত করে। স্বপ্নগুলোকে সফলতার মুখ দেখাতেই হবে। দায়িত্বটাও তার। একটা টিউশনী চলে যাওয়াতে একমাসের জন্য অসুবিধায় পড়েছে সে। তাই নিরুপায় হয়ে বাড়ি এসেছিল কিছু টাকার জন্য। কিন্তু পারেনি সে। তার বাবার জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা, মায়ের সাবধানতার ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসা শাড়ীর ছেঁড়া অংশ, তনিমার হাজারো আকুতিভরা মলিন মুখ-- এতকিছু দেখে এমদাদ টাকার কথা মুখে আনতে পারেনি বাবার সামনে। কিন্তু ইসহাক মাস্টার সারাজীবন মানুষ নিয়ে কারবার করেছে, মুখ দেখে মনের কথা পড়েছে। আর তার কাছ থেকে নিজকে লুকিয়ে রাখবে তার সন্তান ! এও কি সম্ভব ? ছেলেকে ডেকে শুধু জেনে নিয়েছে কবে সে হলে ফিরে যাবে। ব্যস্, এইটুকুই।

বৈঠক ঘরে বসে একটা বই এর পাতা উল্টাচ্ছিল এমদাদ । ইসহাক মাস্টার তখন স্কুলে। বাইরে দু’জন অচেনা ব্যক্তির ডাকাডাকিতে বেরিয়ে আসে সে। একজনের হাতে একটি কুড়াল, আর একজনের হাতে করাত। কি ব্যাপার ? জিজ্ঞাসা করতেই একজন জবাব দেয় দিঘীর পূব পাড়ের আম গাছটা তারা গতকাল মাস্টার সাহেবের কাছ থেকে কিনেছে। আজ তা কেটে নিয়ে যেতে এসেছে। এমদাদের বুঝতে এক মুহূর্তও সময় লাগেনি কেন তার বৃক্ষপাগল বাবা একাজ করেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোক দু’টোকে তাদের কাজ করতে বলে সে চলে যায় ঘরের ভিতর।

চৌকির উপর চিৎ হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ ঘরের চালের দিকে চুপচাপ চেয়ে থাকে এমদাদ। এই তাব বাবা। দূরদর্শী অভিভাবক। সন্তানের মনের না বলা কথা বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি এতটুকু। এই তো তার সারাজীবনের সাধনার ফল। সময়ের প্রয়োজনে যে সিদ্ধান্ত নিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। সন্তান আর স্বপ্ন এ দু’য়ের যুগল উপস্থিতিতে গাছের প্রতি তার সমস্ত ভালোবাসাকে উৎসর্গ করতে বুক কাঁপেনি এতটুকু।

এমদাদের মনে হয় অপরাধী সে নিজে। একজন বৃক্ষপ্রেমিক হিসেবে তার বাবার পরিচিতি এঅঞ্চলের সকলের জানা। অনেকে তাকে ডাকে গাছপাগলা বলে। বসত বাড়ির চারপাশে সামান্য যে জায়গাটুকু আছে তা গাছে গাছে সয়লাব হয়ে গেছে। কত ধরনের গাছ যে লাগিয়েছে তার বাবা! গাছ লাগানোর মৌসুম এলেই যেখানে যে চারা পাবে এনে পুতে দিবে বাড়ির আঙিনায়। এবার বাড়ি এসে এমদাদ লক্ষ্য করেছে তার বাবার এ দৌরাত্ম উঠোনের কোণ অবধি এসে ঠেকেছে।

এমদাদ নিজেও কি কম ভালোবাসে গাছপালা? তার বাবাই তাদের দু’ভাই-বোনকে শিখিয়েছে গাছকে ভালোবাসতে। এমদাদ যখন সেই ছোট্রটি, কেবল বই হাতে স্কুলে যাওয়া-আসা করছে তখন থেকেই ইসহাক মাস্টার তাকে শিখাত কেন গাছকে ভালোবাসতে হবে, কিভাবে ভালোবাসতে হবে। বলত, গাছ শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই নয়। একটা ভূ-খন্ড আর তার জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বৃক্ষরাজির ভূমিকার কোন বিকল্প নাই। শুধু তাই নয় আদি যুগের মানুষ ক্ষুধার্ত হয়ে গাছের ফল খেয়ে ক্ষুধা মিটাত, গাছের ছাল-বাকল আর পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করত। অসুস্থ হলে গাছপাতার রস দিয়ে চলত তাদের চিকিৎসা। আর অর্থনৈতিক প্রয়োজন তো আছেই। এমদাদ আরও অবাক হতো যখন তার বাবা বলত, গাছকে ভালোবাসলে গাছ সেটা বুঝতে পারে। ইসহাক মাস্টারের সেই শিক্ষা ভুলেনি এমদাদ। কিন্তু আজকের এই অবস্থায় এছাড়া আর কি কোন বিকল্প পথ ছিল তার জন্য? বছর বছর ফল দেয় যে গাছ তা বিক্রি করে দিয়ে সে টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছে তার বাবা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে এমদাদের বুক ছিঁড়ে। একটা প্রাণ নিধন করে হাজারো প্রাণ বাঁচানোর শিক্ষা নিতে সে হাত পেতে নিয়েছে সে টাকা। তার বাবার বুকের গভীর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে আছে এই টাকার প্রতিটি ভাঁজে। সাথে আছে বাবার স্বপ্নমোড়ানো ইচ্ছা। গ্রামের স্কুলের প্রাইমারী সেকশনের একজন শিক্ষকের সেই ইচ্ছেপাখি একদিন মুক্ত আকাশে ডানা মেলবেই। তার দায়ভার নিতে হবে এমদাদকেই।

ক্ষণে ক্ষণে বাবার মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। তার হাতে টাকাটা তুলে দেয়ার সময় যে করুণ আর্তি ফুটে উঠেছিল তার বাবার চোখেমুখে তা দৃষ্টি এড়ায়নি এমদাদের। কি বলতে চেয়েছিল তার বাবা? ‘বাবা, এই নিয়ে যা। আমি যে আর পারছি না।’ নাকি অন্যকিছু। টাকাটা নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই এমদাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল তার মায়ের ছেঁড়া শাড়ির আঁচলটা। এক হাজার টাকা বাবার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে।

‘বাবা, বাকী টাকায় আমার বেশ চলে যাবে। তুমি এই টাকাটা দিয়ে মায়ের জন্য একটা শাড়ি আর তোমার ও তনিমার জন্যে কিছু কাপড়-চোপড় কিনে নিও।’ কিন্তু সে টাকা ফেরত নেয়নি ইসহাক মাস্টার। বলেছে, ‘আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকি। যেভাবেই থাকি চলে যায়। কিন্তু তুই সেটা পারবিনা। অন্তত দু’বেলা দু’মুটো খেতে তো হবে?’

বুকের ভিতরের কান্নাটা কখন চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে টের পায়নি এমদাদ। দুই ঠোঁটের ফাঁকে নোনা জলের স্বাদে তার ভাবালুতা কেটে যায়। বাসটি ততক্ষণে গাজীপুর ছাড়িয়ে ঢাকার পথ ধরেছে। এখান থেকে মহাখালি পৌঁছুতে আরও আধাঘন্টা লেগে যাবে। আবারও নিজের ভিতর ডুবে যায় এমদাদ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের যে অঙ্গহানী আজ তার জন্য তার বাবাকে করতে হয়েছে এর ক্ষতিপূরণ তাকেই করতে হবে। অঢেল সম্পদের তার দরকার নেই। মানুষের সেবার বিনিময়ে সামান্যতম যে আয় সে করবে তা দিয়ে তার বাবার স্বপ্নগুলোকে আলোর মুখ দেখাবে সে। বাবার বুকের দীর্ঘশ্বাসকে প্রাণখোলা হাসিতে পরিণত করবে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ছায়াতলে উৎসর্গ করবে তার বাড়তি ভোগ-বিলাসকে। তবেই হবে তার বাবার আজকের এই উৎসর্গের যথাযথ প্রতিদান।









মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.