![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।
আমার শ্বশুর মশায়ের বয়স তখন একশ ছুঁই ছুঁই করছে। বয়সের ভারে স্বাভাবিক কথাবার্তা গুলিয়ে ফেলেছেন। নিজকে নিজে পাগল বলেন আবার কেউ উনাকে পাগল বললে রেগেমেগে অন্যের কাছে নালিশ করেন। গান করেন আপন মনে শব্দের পেছনে শব্দ বসিয়ে। ছন্দবদ্ধ তার গানের গানের অর্থ উদ্ধার করা দুরহ ব্যাপার।তিনি চান সবাই তার চারপাশে বসে মনযোগ দিয়ে তার গান শুনুক। কাছে কেউ না থাকলে ডেকে আনেন। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলেতে থাকেন -
ওয়ান টু থ্রি
শালায় করে গরু চুরি।
পর মুহূর্তেই ঠিকঠাক আবৃত্তি করেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদ কবিতার দুই/চারটি লাইন। খেয়ালের বশে কাছের কাউকে জিজ্ঞেস করেন পরের লাইনগুলো কি হবে ?
কিন্তু কবিতার রস আস্বাদন ভাল লাগেনা উনার বেশিক্ষণ। চলে যান প্রসঙ্গান্তরে। মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিবে চলে যান অবলীলায়। উপস্থিত সবাইকে মনযোগী শ্রোতার ভান করে উনার কাছে বসে থাকতে হয়। কারও দিক থেকে সামান্যতম অমনযোগীতার আভাষ এসেছে তো আর রক্ষে নেই। ঠিক বুঝে ফেলেন তিনি। বলেন, আমার কথা ভাল লাগেনা তোমাদের। শুধু তো একটু কথা বলি আর তো কিছুই চাইনা। এতেই বিরক্ত হয়ে যাও ! তোমাদের কাছে যখন বোঝা হয়ে গিয়েছি তখন কি আর করা ! মৃত্যু তো আসেনা। আর কতদিন অপেক্ষা করবা তোমরা ? এক কাজ করো। একটু সাদা কাপড় কিনে এনে সেটা পরিয়ে আমাকে কবরে রেখে আসো।
শত চেষ্টা করেও বুঝানো যায়না যে, উনার খাবারের সময় হয়েছে। এখন গোসল করতে হবে, খেতে হবে। পরে শুনব উনার কথা।
তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন তিনি এসব কথা শুনে। বলেন, খাবার-গোসল কিছুই আমার দরকার নেই। আমার ভাল লাগে কথা বলতে। ভাত খেলেই তো বলবা ওষুধ খেতে। আমার সন্তানরা আমার কাছে থাকেনা। তারা আমার জন্য দামী দামী ওষুধ পাঠায়। আমার কাছে ওষুধের চেয়ে সন্তান অনেক বড়। এটা কেউ বুঝতে চায়না।
কিন্তু আব্বা, আমরা সবাই তো চাকুরী করি। আপনার কাছে সব সময় এসে থাকলে চলবে কি করে ?
আমার শ্বশুড় ঝটপট উত্তর দেন, চাকুরী করা লাগবেনা। দেখনা আমি চাকুরী করিনা। আমার চলছে কি করে ?
ওরা চাকুরী না করলে আপনার ওষুধের টাকা আসবে কোত্থেকে ? আপনার একটা ট্যাবলেটের দাম আশি টাকা।
মুখ ফসকে বলে ফেলেন আমার শ্বাশুরি।
আর যায় কোথায় ? অমনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন আমার শ্বশুর। আমার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলেন,
তোমার শ্বাশুরি আমাকে টাকার খোটা দেয়। বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে। আমি তোমার শ্বাশুরির কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছি। ছোটবেলায় যখন কাঁদা পানিতে নেমে শালুক কুড়িয়ে এনে দিতাম তখন ভাল ছিলাম।
আব্বা, আপনার ছোটকালের গোপন কথা বেরিয়ে পড়ল যে।
পরিবেশটাকে একটু হালকা করার জন্য আমি বলি। আমার কথায় হেসে উঠেন আব্বা। একদম শিশুসুলভ হাসি। উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। যে লোকটা অবিভক্ত ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন ধরে বিমান সংস্থায় চাকুরী করেছে, পরবর্তীতে শিক্ষকতা করেছে প্রায় এক যুগ ধরে, আজ কি অসহায় দিন গুজরান তার ! মায়ের কোল থেকে নেমে হাঁটি হাঁটি পা পা করে যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিলেন জীবনের পথে আবার যেন ফিরে যাচ্ছেন সেই সময়ের কাছে। যেন শুরুর কাছে সমাপ্তির প্রত্যাবর্তন। বিধাতার কি খেয়াল !
মসজিদে ইমামতি করতেন আমার শ্বশুর অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত। অথচ এখন নামাজের কথা তাকে মনে করিয়ে দিতে হয়। তাও ইচ্ছে হলে কখনও নামাজ পড়েন, কখনও পড়েন না। কখনও বা হেঁটে হেঁটে চলে যান মসজিদে। তখন উনার সাথে সাথে যেতক হয় কাউকে। মসজিদের উল্টোদিকে বাড়ির পশ্চিম পাশটা ঘেঁষে চলে গেছে ঝিলাম নদী। বড় ভয় এই নদীটাকে নিয়ে।
এ ধরনের মানুষের কোন বোধবুদ্ধি থাকেনা। কিন্তু আমার শ্বশুরের সেটা আছে বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে একজন জ্ঞানী বিবেকবান লোকের মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলেন। আবার মাঝে মাঝে সেই বোধবুদ্ধি কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তখন কাউকে চিনেত পারেন না। তবে উনার শৈশব-কৈশোরের কথা উনি কখনও ভুলেন না। বারোয়ারি কথার মাঝে সব সময় স্থান করে নেয় উনার শৈশব-কৈশোর ও বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ। কখনও বা কেঁদে ফেলেন উনার বাবা-মায়ের কথা মনে করে। নিজের সন্তানদের বাবা-মা ডেকে কাছে পেতে চান সব সময়।
আব্বার চিকিৎসায় উনার সন্তানদের কোনরকম গাফিলতি নেই। বাংলাদেশের বিখ্যাত নিউরো সার্জনের অধীনে উনার চিকিৎসা চলছে। কিন্তু যে রোগের যে উপসর্গ ! তাকে ঠেকায় কে ? ডাক্তার সাহেব আমাদেরকে সব পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন। বয়সের ভারে মস্তিস্কের কোষ শুকিয়ে গেছে আব্বার। কখনও সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়না এ রোগ। কেবল ওষুধ দিয়ে খানিকটা দমিয়ে রাখা যায় এ রোগের প্রভাব। কিন্তু এক সময় ওষুধের কার্যক্ষমতাও কমে আসে।
আমরা অসহায়ভাবে চেয়ে থাকি ডাক্তার সাহেবের মুখের দিকে। যদি আর কোন প্রতিকার থাকে তার জানামতে তিনি যেন সেটা প্রয়োগ করেন। এক্ষেত্রে টাকা-পয়সা কোন সমস্যা নয়। শেষ বয়সে একজন ভাল মানুষের অগৌরবের মৃত্যু হোক এটা আমরা কেউ-ই চাইনা। ডাক্তার তার কর্তব্য করেন যথারীতি। আমাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেন।
দেখুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রিগান স্বয়ং এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। নিজের অতি প্রিয় সাদা ঘোড়াটা ছাড়া আর কাউকে উনি চিনতে পারতেন না। এমনকি নিজের স্ত্রীকেও না। যদি কোন চিকিৎসা থাকত এ রোগের তাহলে প্রেসিডেন্ট রিগানকে এভাবে ফেলে রাখা হতনা। তাদের তো টাকা-পয়সা কিংবা সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিলনা।
আমরা প্রকৃতিস্থ হই। সমর্পিত হই ভাগ্য-বিধাতার কাছে। রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করি। কান পেতে থাকি বাড়ির খবরের জন্য। খাবার আসে আব্বার পাগলামো আরও বেড়েছে। আমার শ্বাশুরি মাকেও আর সহ্য করতে পারেন না। মাঝে মাঝে অন্য কেউ ভেবে বসেন আমার শ্বাশুরিকে।
শেষ ভরসাও বুঝি গেল ! আশার সম্বল ছিল একটাই। নিজের স্ত্রীকে চিনতেন, উনার উপর নির্ভর করতেন, উনার কথা শুনতেন। এখন আর এসবের তোয়াক্কা করেন না। ওষুধ খেতে চাননা একদম। ওষুধ খেতে দিলে অগোচের ফেলে দেন। ডাক্তারের কথা মনে পড়ে। এক সময় ওষুধ কাজ করবেনা। ঐ পর্যায়ে যাওয়ার আগে যদি সেরে উঠেন তো ভাল। তানাহলে আর কোন পথ খোলা নে্।ি এক সময় ওষুধ আর খেতে চাইবেন না।
হতাশার আঁধার ঘনিয়ে আসে আমাদের চারপাশে। বাবার শিশুসুলভ হাসিমাখা অসহায় মুখটা ভেসে উঠে চোখের সামনে। তবে কি সেদিনটা ঘনিয়ে আসছে ? যেদিন চিরতরে মুছে যাবে আব্বার এই হাসি। কি করব আমরা তখন ? আব্বা কি জানেন জাগতিন জ্ঞান-বুদ্ধি হারিয়েও তিনি এখনও আমাদের মাথার উপর নির্ভরতার ছায়া হয়ে আছেন সায়াহ্নের সূর্যের মতো ? এর দীপ্তি যতই তেজহীন হোক এরও প্রয়োজন রয়েছে আমাদের। হয়তো এর অভাবে আমাদের পথচলা থেমে থাকবে না, কিন্তু নতুন উদ্যমে পথ চলার সাহস যুগিয়ে নেবার বিড়ম্বনা তো থেকেই যাবে।
তবু এই তেজহীন সূর্যটা একদিন মিলিয়ে গেল দিগন্তের ওপাড়ে।অসহায় আমরা সমর্পিত হলাম ভাগ্য-বিধাতার কাছে।
(লেখাটা লিখেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে আমার শ্বশুরের মৃতু্যর পর পর। আজ কেন জানিনা, উনার কথা খুব মনে পড়ছে। তাই শেয়ার করলাম এই ব্লগে।)
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৩১
সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ ইমতিয়াজ। অাপনার বাবা অনেক অনেক ভাল থাকুক এই দুয়া করি।
২| ১৪ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৮
ঢাকাবাসী বলেছেন: খুব ভাল লাগল অন্তর দিয়ে লেখা একজন চিরতরে হারিয়ে যাওয়া মানুষের বিষয়ে ক'টি কথা। আমিও চলে যাবো। ধন্যবাদ।
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৩৪
সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ অাপনাকে লেখাটা পড়ার জন্য এবঙ মন্তব্য করার জন্য।
৩| ১৪ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:১৪
আজমান আন্দালিব বলেছেন: হৃদয় ছুঁয়ে গেল...
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৩৬
সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
৪| ১৪ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:১৭
জাহিদ হাসান হামিদপুরী বলেছেন: শ্বশুরকে কে নিয়ে আবেগজড়িত ভাষায় লেখা পোষ্টটি পড়ে খুবই ভাল লাগল। শ্বশুরের প্রতি আপনার ভালবাসা সত্যি অবাক করার মত। এ যুগে এতোটা আশাই করা যায়না।
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৫৬
সুফিয়া বলেছেন: ধন্যআদ অাসার লেখাটি পড়ার জন্য এবঙ মন্তব্য করার জন্য।
৫| ১৪ ই মে, ২০১৫ রাত ৯:৪৬
ওয়াছেকুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন: আপনার লেখা পড়ে চোখে জল এসে গেল। তবে আপনার মত ছেলের বৌ পাওয়া হয়তো ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। এখনকার বৌ’রা এসব বুড়ো বুড়ি পছন্দ করে না। শুধু টুনা আর টুনি।
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৪১
সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ অাপনাকে। ভাল থাকুন সব ।
৬| ১৪ ই মে, ২০১৫ রাত ১১:০৪
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: চোখে জল আনা হৃদয়স্পর্শী লেখা। বয়স বড়ই নির্মম। নিজেকে ঐ বয়সে কল্পনা করে কষ্টগুলো অনুধাবন করি। আল্লাহ উনাকে বেহেশত নসীব করুন। আমাদের সবাইকে বৃদ্ধাবস্থায় সুন্দর একটা জীবন দান করুন আল্লাহ তা'য়ালা।
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৪৭
সুফিয়া বলেছেন: অাপনার সাথে একমত অামি। একই দোয়া করি। ধন্যবাদ অাপনাকে।
৭| ১৫ ই মে, ২০১৫ দুপুর ২:৫৩
শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: এইসব লিখেন ক্যান? পড়লে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই এমন কিছু লিখেন। বুক ভার করা লেখা চাইনা।
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৫১
সুফিয়া বলেছেন: অাপনাকে ধন্যবাদ অামার লেখাটা পড়ার জন্য।
৮| ১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৫০
দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: আবেগ ছুঁয়ে গেল। কিছু মন খারাপ করা লেখায় ও তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন এটি।
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৫৫
সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ রাজপুত্র অামার লেখাটা পড়ার জন্য। ভাল থাকুন।
৯| ১৭ ই মে, ২০১৫ রাত ১২:২৬
প্রকাশক পপি চৌধুরী বলেছেন: মন কেমন করা একটি চমৎকার লেখা। ধন্যবাদ সুফিয়া আপা এমন সুন্দর যুগোপযোগী লেখাটির জন্য। এটি পড়ে এ যুগের অনেক পুত্রবধূরা উপকৃত হবে। শ্বশুর-শাশুড়ির বৃদ্ধ বয়সের ছেলেমানুষির বিরক্তি অসহনীয় মনে হবে না।
১৭ ই মে, ২০১৫ সকাল ৯:৩৫
সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ পপি আপা আপনাকে লেখাটি পড়ার জন্য ও সুন্দর করে মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকুন সব সময়।
১০| ১৭ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৫
মোঃমোজাম হক বলেছেন: বাবা এবং শশুরকে হারিয়েছি অনেকদিন,তাদের কথা মনে করিয়ে দিলেন ভাই
১৭ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪
সুফিয়া বলেছেন: অামরা কি অাসলেই ভুলতে পারি উনাদের কথা ? ধন্যবাদ অাপনাকে লেখাটা টড়্র জন্য।
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৮
ইমতিয়াজ ১৩ বলেছেন: খুব আবেগী লেখা। আমার বাবার অবস্থাও একই রকম, প্রতিদিন আমাদের অল্প অল্প করে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, মনের অজান্তের চোখের কোণে পানি জমে যায় বাবা তাকিয়ে বালেন বাস্তবতাটা মেনে নিতে শিখ। আমি বলি ..........
আপনার শশুড় জান্নাতবাসী হোক।
দোয়া করবেন আমার আব্বার জন্য।