নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতার প্রেমে অক্ষরের সঙ্গে শুরু হয়েছিল ঘরবসতি। এখন আমি কবিতার; কবিতা আমার। শব্দচাষে সময় কাটাই...
দুই বছর শেষ এই ট্যূশনিটার। যেদিন প্রথম এসেছিলাম; মনে হয়েছিল একমাস টিকে যদি বেতনটা নিয়ে যেতে পারি, যথেষ্ট হবে। এই পরিবারে আমার ট্যূশনি হবার কথা ছিলো না। অন্য একজন স্যার আসার কথা তিন দিন ধরে। আসছি আসছি করে আসছেন না। সবশেষে জানালেন; এতো দূরে তিনি আসতে পারবেন না। অগত্যা ভদ্র মহিলা আমাকে ডাকলেন। কারণ, তাঁর বাসার পাশেই একটা ছোট্ট কোচিংয়ে আমি ক্লাস নিই। তিনি প্রায়ই জানালা খুলে আমার ক্লাস শুনেন। সেই কোচিংয়ের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেই তিনি ডাকলেন।
মূল শহরের থেকে একটু দূরে। একটা সুন্দর বাড়ি তাদের। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। ভদ্রলোক একজন শেফ। খুব বেশি বাসায় থাকেন না। আবুদাবি আর মালয়েশিয়াতে তাঁর কাজকারবার। ভদ্র মহিলা একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান। বাড়িটাকে একটা বাগানের মতো সাজিয়েছেন। ছেলে দুইটা বেশ ভদ্র এবং মেধাবি। মেয়েটা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বড় ছেলেটা মেডিক্যাল শেষ বর্ষে পড়ছে। ছোটটা নবম শ্রেণিতে। আমার কাজ ডাক্তারকে কুরআন পড়ানো। যেহেতু আমি মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের এবং কুরআন পড়ানোটা উপভোগ করি। শহরের প্রায় অভিভাবকই ব্যাপারটা জানেন। মেঝোটার মেন্টরশিপ করা। মেয়েকে পড়ানো। মোটামুটি থ্রি ইন ওয়ান ক্যারেক্টার নিয়ে শুরু করি টিউশনি।
তবে এই মেধাবিদের পড়াশোনার চেয়ে আর যতোসব বিষয় পৃথিবীতে আছে সব কিছুতেই আগ্রহ। ভদ্র মহিলার আবার এক মিনিট বাড়তি আলাপ পছন্দ না। শুরুতেই বলে দিয়েছেন, "স্যার, পড়াতে এসে খাজুরে আলাপ পছন্দ করি না আমি। পড়ানো মানে পড়ানোই। আপনি আধা ঘণ্টা আবিদকে সময় দিয়ে নাবিদ ও ফাইজাকে সোয়া এক ঘন্টা সময় দিবেন। কখনোই দেরি করে আসতে পারবেন না। বারো মাস সেলারি পাবেন। ঈদের বন্ধ বা পরীক্ষার বন্ধ বিবেচনায় আমি দিন হিসাব করবো না। যেহেতু আমি চাকরি করি, বিষয়গুলো আমি বুঝি। তবে, ফাঁকিবাজ মানুষ একদম পছন্দ না আমার।" এই বয়ানের পর মনে হয়েছিল এখানে টিকতে পারবো না। কারণ, একজন প্রাইভেট টিউটর হিসেবে আমার মূল শক্তি মোটিভেশন আর শিক্ষার্থীর মনোজগত দখলে নেওয়া। প্রচুর কথা বলি আমি। এখন কথা বলতে না পারলে তো ব্যর্থ হবোই। তার মানে মাস শেষ না হলেই যদি বিদায় ঘন্টা বাজে!
দুই.
পড়াতে শুরু করেই ডাক্তার আবিদকে পেলাম এক আকর্ষনীয় চরিত্র হিসেবে। যে ছেলে কোন রকম আরবি হরফগুলো চিনে। সেই ছেলে প্রতিটা উচ্চারণ দুই তিনবারেই পারফেক্ট করতে পারছে। কিন্তু দশ মিনিটের বেশি তার মনযোগ থাকছে না। প্রথম দিনেই তার প্রশ্ন ছিলো; 'ইগো জিনিসটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?'
নাভিদ প্রচণ্ড অলস। কিন্তু পড়তে বসে গেলে উঠবার নাম থাকে না। পড়তে না চাইলে কোনভাবেই তাকে মেনেজ করা যায় না। বাবা মা'র প্রতি প্রচণ্ড বিরক্ত। তার চাওয়া পুরো দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো। আর কৃষিকাজ করা। ফাইজা চায় আর্কিটেকচার হবে। তবে কোনদিন বিয়ে করবে না। জানতে চাই, "এই ফাইভে পড়ার সময় বিয়ে টিয়ে নিয়ে ভাবছো কেনো?" সে উত্তর দেয়, "আম্মার বকবক আর আব্বার পণ্ডিতির ভেতর দিয়ে যদি কিছুদিন টিকে যান; তাহলে আপনিই বুঝতে পারবেন। জানেন স্যার! এই চার মাসে পাঁচজন স্যার বিদায় করেছেন এই দুইজন মিলে।" আমি আবারও শকড হই। মনে মনে ভাবি; এসে যখন পড়েছি দেখি আগে কী অপেক্ষা করছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার রাত আটটা থেকে যেহেতু পড়াই; পড়াতে পড়াতে ওদের ডাইনিং রেডি হয়ে যায়। প্রথম ক'দিন চা নাশতা দিলেও একদিন ফাইজা জিজ্ঞেস করে, "স্যার আপনি বাসায় কখন ফেরেন?"
- এই তো বারোটা সাড়ে বারোটায়! কেনো?
- ঠাণ্ডা খাবার খেলে অসুখ করে না! মেসের খাবার! তাও ঠাণ্ডা। খেতে পারেন?
আমার ভেতরে একটা হাহাকার ঢেউ খেলে যায়। মনে হয় ফাইজার ভেতরে আমার মা কথা বলে উঠছেন! কিছুটা আনমনা হয়ে বলি, 'বাদ দাও এসব। ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।' আজকে তাহলে যাই।
এমন সময় ভদ্র মহিলা এসে বলেন, স্যার টিউশনি করা হলো দুনিয়ার সবচেয়ে জটিল মানসিক কষ্টের কাজ। রাতে মেসের মিল বন্ধ করে দিবেন। আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে খেয়ে যাবেন। এইটা বোন হিসেবে আমার আবদার।
আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম।
তিন.
আজ আবিদের ইন্টার্নি শেষ। ওদিকে পবিত্র কুরআনুল কারীমেরও শেষ সব পড়বে। প্রায় ত্রিশটা সুরা মুখস্ত তার। বাড়িতে বেশ ভালো একটা আয়োজন। আমারও দুই বছর পূর্তি এই পরিবারে। ইতোমধ্যেই আমি আবিদের আম্মা ঝর্ণা আপার কাছে স্যার, ভাই হয়ে হুজুর হয়ে গেছি। আর আবিদের আব্বার কাছে স্যার থেকে জামিল হয়ে গেছি। যদিও গত দুই বছরে তিনি বাসায় এসেছেন সাকূল্যে পাঁচবার। কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলেছেন মনে হয় পাঁচ বছর! আমার সঙ্গে আলাপ শুরু হলে আর থামতেই চায় না ভদ্রলোকের। যেনো তার ভেতরে অগণিত কথার পাহাড়। সেসব বের করতে না পারলে পেট ফেঁটে যাবে।
আবিদের বন্ধুরা আড় চোখে আমাকে দেখছে। নাভিদের বন্ধুরা আসছে গল্প করছে। ফাইজার বান্ধবিরা খাতা নিয়ে এসেছে হাতের লেখা নিতে। মাঝেমধ্যেই এদের খাতায় এক দুই লাইন লিখছি। গল্প করছি। ছড়া কবিতা শুনছি। এভাবেই রাত একটা বেজে গেছে। খাবার-দাবার ও অনুষ্ঠান শেষে আবিদ তেলাওয়াত করলো। উপস্থিত সবাই ডাক্তার ক্বারী বলে অভিনন্দন জানালো। কেউ কেউ আমাকে পড়ানোর অফারও করে বসল।
রাত বেশি হওয়ায় আবিদ বাইক নিয়ে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল।
চার.
বাসায় পৌঁছেই মাথায় একটা গোলমাল শুরু হলো। আজকের এতো বড় একটা অনুষ্ঠানে আবিদের আব্বা ও আম্মাকে কখনোই একসঙ্গে দেখিনি। সবসময়ই দুইজন দুইবারে দুই জায়গায় থেকেছেন। পরস্পরে কোন আলাপ করতে দেখিনি। স্মৃতি হাতড়াতে লাগলাম। দেখলাম গত দুই বছরে এই দম্পতিকে একসঙ্গে কখনোই আমার সঙ্গে বসে কথা বলতে দেখিনি। দুইজনকে কোনদিন খাবার টেবিলে আলাপ করতেও দেখিনি। যতোবার ভদ্রলোক ফোন দিতেন ঝর্ণা আপা হাক ছাড়তেন ফাইজাআআ বলে।
ব্যাপারগুলো মাথায় তোলপাড় করতে শুরু করে। একটা রহস্য আমার ভেতরে দানা বেঁধে উঠে। মনে মনে ভাবতে থাকি আসল ব্যাপারটা জানতেই হবে। যদিও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এইসব পাত্তাই দিতাম না। কিন্তু এই দুই বছরে এই পরিবারটি আমাকে নিজেদের পরিবারের সদস্য করে নিয়েছে। বাড়তি ট্যূশনির চাপ থেকে বাঁচিয়েছে। রাতের খাবারের সংকট থেকে রক্ষা করেছে। আট চল্লিশ কেজি থেকে আমি এখন আদর্শ ওজন আটাত্তর কেজিতে এসেছি। গ্যাসট্রিকের সমস্যা নেই বললেই চলে। আর সেইখানে এমন একটা দুঃখজনক ব্যাপার আমি অনুভব করছি। তা তো একটু হয়রানিরই।
এইসব ভাবতে ভাবতেই রাতে শেষ। ফজরের আজান হয়ে গেল। নামায শেষে একটু ঘুম দিতে গিয়ে ক্লাস মিস করে ফেললাম একটা। বারোটায় কলেজে ঢুকলাম।
পাঁচ.
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আবার আবিদের পরিবার মাথায় এসে হাজির হলো। মনে মনে ফন্দি আটলাম। নাভিদের কলেজে ভর্তির বিষয়ে পরামর্শের ছুতায় দুইজনকে নিয়ে একসঙ্গে বসব। এরপর কিছু একটা কৌশলে দুইজনের ব্যাপারটা যাচাই করার চেষ্টা করবো।
গত দুই বছরে আবিদের বাবা ও মা আমার সঙ্গে এতো এতো কথা বলেছেন; কিন্তু কখনোই নিজেদের দাম্পত্য নিয়ে কোন কথা বলেননি। যদিও আমার অভাজ্ঞতা বলে, যাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক জমেছে তাদের প্রায় সবাই নিজেদের দাম্পত্য, প্রেম ও মান-অভিমান নিয়ে আমাকে মধ্যস্থতাকারীর মতো মেনেছেন।
ঠিক সাতটা আটান্ন মিনিটি বাসার কলিং চাপলাম। দরজা খুললেন আবিদের বাবা। খুব প্রসন্ন হাসিতে বললেন, ''আসো আসো জামিল। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সকালে ফ্লাইট চলে যাবো। বিদায় নিতে বসে আছি।''
এরপর আর পড়ানো হলো না। ভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে বাসায় এসে ফাইজাকে পরের দিনের কাজ বুঝিয়ে চলে যেতে চাইতেই আবিদ বললো, "স্যার সময় থাকলে চলেন একটু নদীর পাড়ে যাই। আপনার সঙ্গে মন খুলে কিছু আলাপ করতে চাই। আপনি বাবাকে বলেছিলেন কিছু কথা জমে আছে আপনার। বলতে চান। বাবা ও আমি কিছুটা টের পেয়েছি। আম্মা ধরতে পারেননি। আপনি হয়তো কিছুটা আঁচ করেছেন।" বললাম, 'চলো'।
ব্রহ্মপুত্র নদ। শরতের পরিস্কার আকাশ। নদীর পাড়ে একটা বন্ধ চায়ে স্টলের সামনের টেবিলে বসলাম দু'জন। যেখান থেকে নদীর পানিটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারদিকে কোলাহল। এরপরেও আবিদ আর আমার ভেতরে কী যেনো এক নির্জনতা ভর করেছে। শরতের হালকা বাতাসে নদীর ঢেউগুলোও সমান্তরাল ও ছোট হয়ে উঠে আসছে। চারপাশে কোলাহলের কারণে কলতানটা এতক্ষণ টের পাইনি। এখন কিছুটা নীরব হয়েছে চারপাশ। মাঝি ডাকছে, 'আপনারা পার হবেন!' আবিদ বললো, 'না কাকা'। অমনি মাঝি বললো, "আরে ডাক্তর! আয় আয় নৌকায় বসে কথা ক। আমি একটু আইতাছি।"
রাত বারোটা বেজে গেছে। গোদারা বন্ধ। সব দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। এদিক সেদিক কিছু নিশাচর বসে গল্প করছে। এমন সময় আবিদ নীরবতা ভেঙে বললো, 'স্যার!' আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললাম, 'বলো'।
- স্যার আমাদের পরিবারটা আপনার কাছে সুখি পরিবার মনে হয় না! বললো আবিদ।
- হ্যাঁ। তোমাদের গল্প তো আমি নানা জায়গায় করি।
- স্যার আমাদের পাঁচটা মানুষ অভিনয়ে অস্কার পাওয়ার যোগ্য। প্রতিদিন আমরা সুখের অভিনয় করে যাচ্ছি। নিজেদের অশান্তি ও অস্বস্তি কী এক জটিল কৌশলে গোপন করে চলছি। আপনার কাছেও দুই বছর ধরে সবকিছুই গোপন করে চলছি।
- আরেহ! কী বলো এসব?
- জ্বী স্যার। এই দুইজন মানুষ। আমার মা বাবা। আমি যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি; সেদিন থেকে তাদেরকে পরস্পরে কথা বলতে দেখিনি। তারা দু'জন দু'জনের সঙ্গে কথা বলেন না। বাসার একটা সিক্রেট রুম আছে। ওখানে একটা ওয়াইট বোর্ড আছে। তারা সেখানে লিখে লিখে জীবন চালাচ্ছেন। অথচ এইসব কেউ জানে না। জেনে যাবে বলে, দুইজন বাসায় থাকতে দাদা-দাদু, নানা-নানু ও পরিবারের কোন আত্মীয় স্বজনকে বাসায় আসতে দেওয়া হয় না। যতদূর বুঝি এই চলছে সতেরো বছর ধরে। কিন্তু কেনো! কী কারণে তার কিছুই জানতে পারিনি। আর জানতে চাইলেন রেগে যান দু'জন। এই বিষয়ে কিছুই বলতে রাজি না তারা।
এমন একটা জটিলতার ভেতর দিয়ে অভিনয় ছাড়া সুখি হওয়া কীভাবে সম্ভব। স্যার আপনাকে আমি প্রথম দান ইগো বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। ফাইজা বিয়ে করবে না বলা আর নাভিদের কৃষক হওয়ার ইচ্ছা মূলত আম্মা আব্বার এই জটিলতার বাই প্রোডাক্ট।
ছয়.
রাতে আর কোন কথা বলতে পারিনি। মেসে চলে আসি। আবিদকে বলি, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো দুইজনের সঙ্গে কথা বলতে।
এরপর ধীরে ধীরে ঝর্ণা আপার সঙ্গে আলাপ শুরু করি। কথা চলতে থাকে। মুখোশ খুলতে থাকেন আপা। কিন্তু বিস্তারিত কিছুই বলেন না। শুধু বলেন, 'আছে একটা ব্যাপার'। 'অনেক গভীর'। 'সমাধানযোগ্য এখন আর নেই'। 'বাদ দেন'। এইসব বলে এড়িয়ে যান। মাঝেমধ্যেই আবার আমার প্রতি রেগে যান। বিরক্ত হোন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। খুব ছোট বিষয়কে বড় করে আজ এই দাশায় আটকেছেন এই দুইজন। আর বিপদে ফেলেছেন তিনটা নিষ্পাপ সন্তানকে।
সাত.
আজ প্রায় তিন মাস। আবিদের বাবা ফের বাসায় আসলেন। রাতে তাকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে সেই নৌকায় গিয়ে বসলাম। বললাম আজকে পেন্ডোরার বাক্স খুলতেই হবে। বলতেই হবে ঘটনা আসলে কী!
জামিল, দেখো গত কয়েক মাস ধরেই তোমার কাছে বলতে চাইছিলাম। মনে মনে ধারণা হচ্ছিল তুমি কিছু একটা করতে পারবে। কিন্তু ইগো ও লজ্জা আমাকে মুখ খুলতে দিচ্ছিলো না। আসলে হলো কি! আমি নখ কাটি খুব যত্ন করে। নখ কাটার পর খুব যত্ন করে নদের ধারগুলো ঘষে ঘষে স্মুদ করি। বারবার গালে আঁচর দিয়ে দেখি; নখগুলোর ধার মজেছে নাকি। কারণ এই ধারালো নখ আমাকে প্রচণ্ড বিরক্ত করে। ওদিকে ঝর্ণা খুব অবহেলায় নখ কাটে। প্রায়ই আমার পা হাত তার নখের আঁচড়ে কেটে যায়। আর নখের কাটা বলে ইনফেকশন হয়। কষ্ট হয়। আমি প্রায়ই শেখাতে চেষ্টা করি। নিজেই মাঝে মাঝে তার নখগুলোর ধার ঘষে ঘষে শেষ করে দিই।
একদিন রাতে তার পায়ের নখ লেগে আমার পা থেকে ব্লিডিং হচ্ছিল। আমি মেজাজ হারালাম। বকাবকি করে বাসা থেকে বলে হয়ে গেলাম রাতেই। সেই ক্ষত শুকাতে টানা সাতদিন এনাটিবায়োটিক খেলাম। কিন্তু ঝর্ণা দিব্যি স্কুলে যাচ্ছে। একটি বারের জন্য 'স্যরি' বলেনি। অপরাধবোধে ভূগেনি। আমি কলেজের চাকরি ছেড়ে দুবাই চলে যাই রাগে। গিয়ে রান্না শিখি। অনেকগুলো কোর্স করি। অনেকগুলো চিঠি লিখি। যেনো সে একবার 'স্যরি' বলে। কিন্তু সে বলে গালি দিয়েছো তুমি স্যরি বলবো আমি!
আমারও জেদ বাড়তে থাকে। তাকে বলি গত দশ বছরে কোনদিন কি তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছো! কোনদিন কি নিজ থেকে অভিমান ভাঙিয়েছো! প্রতিবার তো আমিই নিজ থেকে স্যরি বলি। তোমার অভিমান ভাঙাই। এবার আর আমি স্যরি বলছি না।
এই একটা স্যরির জন্য আজ সতেরো বছর। ওয়াইটবোর্ডে চলছে আমাদের সংসার।
কথা বলতে বলতে রাত তিনটা হয়ে গেলো।
নয়.
হঠাৎ করেই কারো আসার আওয়াজ পাই। ভাবি সকালের বাজার ধরতে কাঁচা বাজারিরা হয়তো নদী পাড় হতে এসে জমছে। না! ভুল ভাঙল আবিদের ডাকে। আমরা দেখলাম আবিদ চলে যাচ্ছে। ঝর্ণা আপা নৌকায় উঠছেন কাঁদতে কাঁদতে।
দুইজন বসে আছেন। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ মাত্রই হাজিরা দিয়েছে। আমি স্পষ্ট দেখছি নৌকার দুই পাশে দুইজন চোখের পানি ফেলছেন। আমি কিছু বলতে যাবো এমন সময় দেখি দুইজন একই সময়ে একই ফ্রিকোয়েন্সিতে বলে উঠছেন 'স্যরি'।
***
[ডিসক্লেইমার: বহুদিন পর ছোটগল্প লিখলাম। বহুদিন ধরেই গল্পটা জমা ছিলো মাথায়। ভদ্রলোক ঘটনা প্রকাশের অনুমতি দিচ্ছিলেন না। কয়েকমাস আগে তিনি ওয়াটসএপে মেসেজে জানালেন, "সাইফ, তোমার লেখা পড়ে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়। আমাদের ঘটনাটা তুমি লিখতে পারো। কারও যদি উপকার হয়।"
আমি ঘটনা হিসেবে না দেখে একটা ছোটগল্পই বানিয়ে দিলাম। শুধু জায়গা আর নামগুলো বদলে দিলাম।]
দুই বছর শেষ এই ট্যূশনিটার। যেদিন প্রথম এসেছিলাম; মনে হয়েছিল একমাস টিকে যদি বেতনটা নিয়ে যেতে পারি, যথেষ্ট হবে। এই পরিবারে আমার ট্যূশনি হবার কথা ছিলো না। অন্য একজন স্যার আসার কথা তিন দিন ধরে। আসছি আসছি করে আসছেন না। সবশেষে জানালেন; এতো দূরে তিনি আসতে পারবেন না। অগত্যা ভদ্র মহিলা আমাকে ডাকলেন। কারণ, তাঁর বাসার পাশেই একটা ছোট্ট কোচিংয়ে আমি ক্লাস নিই। তিনি প্রায়ই জানালা খুলে আমার ক্লাস শুনেন। সেই কোচিংয়ের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেই তিনি ডাকলেন।
মূল শহরের থেকে একটু দূরে। একটা সুন্দর বাড়ি তাদের। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। ভদ্রলোক একজন শেফ। খুব বেশি বাসায় থাকেন না। আবুদাবি আর মালয়েশিয়াতে তাঁর কাজকারবার। ভদ্র মহিলা একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান। বাড়িটাকে একটা বাগানের মতো সাজিয়েছেন। ছেলে দুইটা বেশ ভদ্র এবং মেধাবি। মেয়েটা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বড় ছেলেটা মেডিক্যাল শেষ বর্ষে পড়ছে। ছোটটা নবম শ্রেণিতে। আমার কাজ ডাক্তারকে কুরআন পড়ানো। যেহেতু আমি মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের এবং কুরআন পড়ানোটা উপভোগ করি। শহরের প্রায় অভিভাবকই ব্যাপারটা জানেন। মেঝোটার মেন্টরশিপ করা। মেয়েকে পড়ানো। মোটামুটি থ্রি ইন ওয়ান ক্যারেক্টার নিয়ে শুরু করি টিউশনি।
তবে এই মেধাবিদের পড়াশোনার চেয়ে আর যতোসব বিষয় পৃথিবীতে আছে সব কিছুতেই আগ্রহ। ভদ্র মহিলার আবার এক মিনিট বাড়তি আলাপ পছন্দ না। শুরুতেই বলে দিয়েছেন, "স্যার, পড়াতে এসে খাজুরে আলাপ পছন্দ করি না আমি। পড়ানো মানে পড়ানোই। আপনি আধা ঘণ্টা আবিদকে সময় দিয়ে নাবিদ ও ফাইজাকে সোয়া এক ঘন্টা সময় দিবেন। কখনোই দেরি করে আসতে পারবেন না। বারো মাস সেলারি পাবেন। ঈদের বন্ধ বা পরীক্ষার বন্ধ বিবেচনায় আমি দিন হিসাব করবো না। যেহেতু আমি চাকরি করি, বিষয়গুলো আমি বুঝি। তবে, ফাঁকিবাজ মানুষ একদম পছন্দ না আমার।" এই বয়ানের পর মনে হয়েছিল এখানে টিকতে পারবো না। কারণ, একজন প্রাইভেট টিউটর হিসেবে আমার মূল শক্তি মোটিভেশন আর শিক্ষার্থীর মনোজগত দখলে নেওয়া। প্রচুর কথা বলি আমি। এখন কথা বলতে না পারলে তো ব্যর্থ হবোই। তার মানে মাস শেষ না হলেই যদি বিদায় ঘন্টা বাজে!
দুই.
পড়াতে শুরু করেই ডাক্তার আবিদকে পেলাম এক আকর্ষনীয় চরিত্র হিসেবে। যে ছেলে কোন রকম আরবি হরফগুলো চিনে। সেই ছেলে প্রতিটা উচ্চারণ দুই তিনবারেই পারফেক্ট করতে পারছে। কিন্তু দশ মিনিটের বেশি তার মনযোগ থাকছে না। প্রথম দিনেই তার প্রশ্ন ছিলো; 'ইগো জিনিসটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?'
নাভিদ প্রচণ্ড অলস। কিন্তু পড়তে বসে গেলে উঠবার নাম থাকে না। পড়তে না চাইলে কোনভাবেই তাকে মেনেজ করা যায় না। বাবা মা'র প্রতি প্রচণ্ড বিরক্ত। তার চাওয়া পুরো দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো। আর কৃষিকাজ করা। ফাইজা চায় আর্কিটেকচার হবে। তবে কোনদিন বিয়ে করবে না। জানতে চাই, "এই ফাইভে পড়ার সময় বিয়ে টিয়ে নিয়ে ভাবছো কেনো?" সে উত্তর দেয়, "আম্মার বকবক আর আব্বার পণ্ডিতির ভেতর দিয়ে যদি কিছুদিন টিকে যান; তাহলে আপনিই বুঝতে পারবেন। জানেন স্যার! এই চার মাসে পাঁচজন স্যার বিদায় করেছেন এই দুইজন মিলে।" আমি আবারও শকড হই। মনে মনে ভাবি; এসে যখন পড়েছি দেখি আগে কী অপেক্ষা করছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার রাত আটটা থেকে যেহেতু পড়াই; পড়াতে পড়াতে ওদের ডাইনিং রেডি হয়ে যায়। প্রথম ক'দিন চা নাশতা দিলেও একদিন ফাইজা জিজ্ঞেস করে, "স্যার আপনি বাসায় কখন ফেরেন?"
- এই তো বারোটা সাড়ে বারোটায়! কেনো?
- ঠাণ্ডা খাবার খেলে অসুখ করে না! মেসের খাবার! তাও ঠাণ্ডা। খেতে পারেন?
আমার ভেতরে একটা হাহাকার ঢেউ খেলে যায়। মনে হয় ফাইজার ভেতরে আমার মা কথা বলে উঠছেন! কিছুটা আনমনা হয়ে বলি, 'বাদ দাও এসব। ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।' আজকে তাহলে যাই।
এমন সময় ভদ্র মহিলা এসে বলেন, স্যার টিউশনি করা হলো দুনিয়ার সবচেয়ে জটিল মানসিক কষ্টের কাজ। রাতে মেসের মিল বন্ধ করে দিবেন। আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে খেয়ে যাবেন। এইটা বোন হিসেবে আমার আবদার।
আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম।
তিন.
আজ আবিদের ইন্টার্নি শেষ। ওদিকে পবিত্র কুরআনুল কারীমেরও শেষ সব পড়বে। প্রায় ত্রিশটা সুরা মুখস্ত তার। বাড়িতে বেশ ভালো একটা আয়োজন। আমারও দুই বছর পূর্তি এই পরিবারে। ইতোমধ্যেই আমি আবিদের আম্মা ঝর্ণা আপার কাছে স্যার, ভাই হয়ে হুজুর হয়ে গেছি। আর আবিদের আব্বার কাছে স্যার থেকে জামিল হয়ে গেছি। যদিও গত দুই বছরে তিনি বাসায় এসেছেন সাকূল্যে পাঁচবার। কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলেছেন মনে হয় পাঁচ বছর! আমার সঙ্গে আলাপ শুরু হলে আর থামতেই চায় না ভদ্রলোকের। যেনো তার ভেতরে অগণিত কথার পাহাড়। সেসব বের করতে না পারলে পেট ফেঁটে যাবে।
আবিদের বন্ধুরা আড় চোখে আমাকে দেখছে। নাভিদের বন্ধুরা আসছে গল্প করছে। ফাইজার বান্ধবিরা খাতা নিয়ে এসেছে হাতের লেখা নিতে। মাঝেমধ্যেই এদের খাতায় এক দুই লাইন লিখছি। গল্প করছি। ছড়া কবিতা শুনছি। এভাবেই রাত একটা বেজে গেছে। খাবার-দাবার ও অনুষ্ঠান শেষে আবিদ তেলাওয়াত করলো। উপস্থিত সবাই ডাক্তার ক্বারী বলে অভিনন্দন জানালো। কেউ কেউ আমাকে পড়ানোর অফারও করে বসল।
রাত বেশি হওয়ায় আবিদ বাইক নিয়ে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল।
চার.
বাসায় পৌঁছেই মাথায় একটা গোলমাল শুরু হলো। আজকের এতো বড় একটা অনুষ্ঠানে আবিদের আব্বা ও আম্মাকে কখনোই একসঙ্গে দেখিনি। সবসময়ই দুইজন দুইবারে দুই জায়গায় থেকেছেন। পরস্পরে কোন আলাপ করতে দেখিনি। স্মৃতি হাতড়াতে লাগলাম। দেখলাম গত দুই বছরে এই দম্পতিকে একসঙ্গে কখনোই আমার সঙ্গে বসে কথা বলতে দেখিনি। দুইজনকে কোনদিন খাবার টেবিলে আলাপ করতেও দেখিনি। যতোবার ভদ্রলোক ফোন দিতেন ঝর্ণা আপা হাক ছাড়তেন ফাইজাআআ বলে।
ব্যাপারগুলো মাথায় তোলপাড় করতে শুরু করে। একটা রহস্য আমার ভেতরে দানা বেঁধে উঠে। মনে মনে ভাবতে থাকি আসল ব্যাপারটা জানতেই হবে। যদিও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এইসব পাত্তাই দিতাম না। কিন্তু এই দুই বছরে এই পরিবারটি আমাকে নিজেদের পরিবারের সদস্য করে নিয়েছে। বাড়তি ট্যূশনির চাপ থেকে বাঁচিয়েছে। রাতের খাবারের সংকট থেকে রক্ষা করেছে। আট চল্লিশ কেজি থেকে আমি এখন আদর্শ ওজন আটাত্তর কেজিতে এসেছি। গ্যাসট্রিকের সমস্যা নেই বললেই চলে। আর সেইখানে এমন একটা দুঃখজনক ব্যাপার আমি অনুভব করছি। তা তো একটু হয়রানিরই।
এইসব ভাবতে ভাবতেই রাতে শেষ। ফজরের আজান হয়ে গেল। নামায শেষে একটু ঘুম দিতে গিয়ে ক্লাস মিস করে ফেললাম একটা। বারোটায় কলেজে ঢুকলাম।
পাঁচ.
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আবার আবিদের পরিবার মাথায় এসে হাজির হলো। মনে মনে ফন্দি আটলাম। নাভিদের কলেজে ভর্তির বিষয়ে পরামর্শের ছুতায় দুইজনকে নিয়ে একসঙ্গে বসব। এরপর কিছু একটা কৌশলে দুইজনের ব্যাপারটা যাচাই করার চেষ্টা করবো।
গত দুই বছরে আবিদের বাবা ও মা আমার সঙ্গে এতো এতো কথা বলেছেন; কিন্তু কখনোই নিজেদের দাম্পত্য নিয়ে কোন কথা বলেননি। যদিও আমার অভাজ্ঞতা বলে, যাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক জমেছে তাদের প্রায় সবাই নিজেদের দাম্পত্য, প্রেম ও মান-অভিমান নিয়ে আমাকে মধ্যস্থতাকারীর মতো মেনেছেন।
ঠিক সাতটা আটান্ন মিনিটি বাসার কলিং চাপলাম। দরজা খুললেন আবিদের বাবা। খুব প্রসন্ন হাসিতে বললেন, ''আসো আসো জামিল। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সকালে ফ্লাইট চলে যাবো। বিদায় নিতে বসে আছি।''
এরপর আর পড়ানো হলো না। ভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে বাসায় এসে ফাইজাকে পরের দিনের কাজ বুঝিয়ে চলে যেতে চাইতেই আবিদ বললো, "স্যার সময় থাকলে চলেন একটু নদীর পাড়ে যাই। আপনার সঙ্গে মন খুলে কিছু আলাপ করতে চাই। আপনি বাবাকে বলেছিলেন কিছু কথা জমে আছে আপনার। বলতে চান। বাবা ও আমি কিছুটা টের পেয়েছি। আম্মা ধরতে পারেননি। আপনি হয়তো কিছুটা আঁচ করেছেন।" বললাম, 'চলো'।
ব্রহ্মপুত্র নদ। শরতের পরিস্কার আকাশ। নদীর পাড়ে একটা বন্ধ চায়ে স্টলের সামনের টেবিলে বসলাম দু'জন। যেখান থেকে নদীর পানিটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারদিকে কোলাহল। এরপরেও আবিদ আর আমার ভেতরে কী যেনো এক নির্জনতা ভর করেছে। শরতের হালকা বাতাসে নদীর ঢেউগুলোও সমান্তরাল ও ছোট হয়ে উঠে আসছে। চারপাশে কোলাহলের কারণে কলতানটা এতক্ষণ টের পাইনি। এখন কিছুটা নীরব হয়েছে চারপাশ। মাঝি ডাকছে, 'আপনারা পার হবেন!' আবিদ বললো, 'না কাকা'। অমনি মাঝি বললো, "আরে ডাক্তর! আয় আয় নৌকায় বসে কথা ক। আমি একটু আইতাছি।"
রাত বারোটা বেজে গেছে। গোদারা বন্ধ। সব দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। এদিক সেদিক কিছু নিশাচর বসে গল্প করছে। এমন সময় আবিদ নীরবতা ভেঙে বললো, 'স্যার!' আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললাম, 'বলো'।
- স্যার আমাদের পরিবারটা আপনার কাছে সুখি পরিবার মনে হয় না! বললো আবিদ।
- হ্যাঁ। তোমাদের গল্প তো আমি নানা জায়গায় করি।
- স্যার আমাদের পাঁচটা মানুষ অভিনয়ে অস্কার পাওয়ার যোগ্য। প্রতিদিন আমরা সুখের অভিনয় করে যাচ্ছি। নিজেদের অশান্তি ও অস্বস্তি কী এক জটিল কৌশলে গোপন করে চলছি। আপনার কাছেও দুই বছর ধরে সবকিছুই গোপন করে চলছি।
- আরেহ! কী বলো এসব?
- জ্বী স্যার। এই দুইজন মানুষ। আমার মা বাবা। আমি যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি; সেদিন থেকে তাদেরকে পরস্পরে কথা বলতে দেখিনি। তারা দু'জন দু'জনের সঙ্গে কথা বলেন না। বাসার একটা সিক্রেট রুম আছে। ওখানে একটা ওয়াইট বোর্ড আছে। তারা সেখানে লিখে লিখে জীবন চালাচ্ছেন। অথচ এইসব কেউ জানে না। জেনে যাবে বলে, দুইজন বাসায় থাকতে দাদা-দাদু, নানা-নানু ও পরিবারের কোন আত্মীয় স্বজনকে বাসায় আসতে দেওয়া হয় না। যতদূর বুঝি এই চলছে সতেরো বছর ধরে। কিন্তু কেনো! কী কারণে তার কিছুই জানতে পারিনি। আর জানতে চাইলেন রেগে যান দু'জন। এই বিষয়ে কিছুই বলতে রাজি না তারা।
এমন একটা জটিলতার ভেতর দিয়ে অভিনয় ছাড়া সুখি হওয়া কীভাবে সম্ভব। স্যার আপনাকে আমি প্রথম দান ইগো বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। ফাইজা বিয়ে করবে না বলা আর নাভিদের কৃষক হওয়ার ইচ্ছা মূলত আম্মা আব্বার এই জটিলতার বাই প্রোডাক্ট।
ছয়.
রাতে আর কোন কথা বলতে পারিনি। মেসে চলে আসি। আবিদকে বলি, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো দুইজনের সঙ্গে কথা বলতে।
এরপর ধীরে ধীরে ঝর্ণা আপার সঙ্গে আলাপ শুরু করি। কথা চলতে থাকে। মুখোশ খুলতে থাকেন আপা। কিন্তু বিস্তারিত কিছুই বলেন না। শুধু বলেন, 'আছে একটা ব্যাপার'। 'অনেক গভীর'। 'সমাধানযোগ্য এখন আর নেই'। 'বাদ দেন'। এইসব বলে এড়িয়ে যান। মাঝেমধ্যেই আবার আমার প্রতি রেগে যান। বিরক্ত হোন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। খুব ছোট বিষয়কে বড় করে আজ এই দাশায় আটকেছেন এই দুইজন। আর বিপদে ফেলেছেন তিনটা নিষ্পাপ সন্তানকে।
সাত.
আজ প্রায় তিন মাস। আবিদের বাবা ফের বাসায় আসলেন। রাতে তাকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে সেই নৌকায় গিয়ে বসলাম। বললাম আজকে পেন্ডোরার বাক্স খুলতেই হবে। বলতেই হবে ঘটনা আসলে কী!
জামিল, দেখো গত কয়েক মাস ধরেই তোমার কাছে বলতে চাইছিলাম। মনে মনে ধারণা হচ্ছিল তুমি কিছু একটা করতে পারবে। কিন্তু ইগো ও লজ্জা আমাকে মুখ খুলতে দিচ্ছিলো না। আসলে হলো কি! আমি নখ কাটি খুব যত্ন করে। নখ কাটার পর খুব যত্ন করে নদের ধারগুলো ঘষে ঘষে স্মুদ করি। বারবার গালে আঁচর দিয়ে দেখি; নখগুলোর ধার মজেছে নাকি। কারণ এই ধারালো নখ আমাকে প্রচণ্ড বিরক্ত করে। ওদিকে ঝর্ণা খুব অবহেলায় নখ কাটে। প্রায়ই আমার পা হাত তার নখের আঁচড়ে কেটে যায়। আর নখের কাটা বলে ইনফেকশন হয়। কষ্ট হয়। আমি প্রায়ই শেখাতে চেষ্টা করি। নিজেই মাঝে মাঝে তার নখগুলোর ধার ঘষে ঘষে শেষ করে দিই।
একদিন রাতে তার পায়ের নখ লেগে আমার পা থেকে ব্লিডিং হচ্ছিল। আমি মেজাজ হারালাম। বকাবকি করে বাসা থেকে বলে হয়ে গেলাম রাতেই। সেই ক্ষত শুকাতে টানা সাতদিন এনাটিবায়োটিক খেলাম। কিন্তু ঝর্ণা দিব্যি স্কুলে যাচ্ছে। একটি বারের জন্য 'স্যরি' বলেনি। অপরাধবোধে ভূগেনি। আমি কলেজের চাকরি ছেড়ে দুবাই চলে যাই রাগে। গিয়ে রান্না শিখি। অনেকগুলো কোর্স করি। অনেকগুলো চিঠি লিখি। যেনো সে একবার 'স্যরি' বলে। কিন্তু সে বলে গালি দিয়েছো তুমি স্যরি বলবো আমি!
আমারও জেদ বাড়তে থাকে। তাকে বলি গত দশ বছরে কোনদিন কি তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছো! কোনদিন কি নিজ থেকে অভিমান ভাঙিয়েছো! প্রতিবার তো আমিই নিজ থেকে স্যরি বলি। তোমার অভিমান ভাঙাই। এবার আর আমি স্যরি বলছি না।
এই একটা স্যরির জন্য আজ সতেরো বছর। ওয়াইটবোর্ডে চলছে আমাদের সংসার।
কথা বলতে বলতে রাত তিনটা হয়ে গেলো।
নয়.
হঠাৎ করেই কারো আসার আওয়াজ পাই। ভাবি সকালের বাজার ধরতে কাঁচা বাজারিরা হয়তো নদী পাড় হতে এসে জমছে। না! ভুল ভাঙল আবিদের ডাকে। আমরা দেখলাম আবিদ চলে যাচ্ছে। ঝর্ণা আপা নৌকায় উঠছেন কাঁদতে কাঁদতে।
দুইজন বসে আছেন। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ মাত্রই হাজিরা দিয়েছে। আমি স্পষ্ট দেখছি নৌকার দুই পাশে দুইজন চোখের পানি ফেলছেন। আমি কিছু বলতে যাবো এমন সময় দেখি দুইজন একই সময়ে একই ফ্রিকোয়েন্সিতে বলে উঠছেন 'স্যরি'।
***
[ডিসক্লেইমার: বহুদিন পর ছোটগল্প লিখলাম। বহুদিন ধরেই গল্পটা জমা ছিলো মাথায়। ভদ্রলোক ঘটনা প্রকাশের অনুমতি দিচ্ছিলেন না। কয়েকমাস আগে তিনি ওয়াটসএপে মেসেজে জানালেন, "সাইফ, তোমার লেখা পড়ে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়। আমাদের ঘটনাটা তুমি লিখতে পারো। কারও যদি উপকার হয়।"
আমি ঘটনা হিসেবে না দেখে একটা ছোটগল্পই বানিয়ে দিলাম। শুধু জায়গা আর নামগুলো বদলে দিলাম।]
২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৮
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন। স্যরি আসলেই খুব জরুরী এক শব্দ।
২| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:১৮
KrypticDen বলেছেন: থ্রিলার গল্প লিখতে পছন্দ করি চাইলে পড়ে দেখতে পারেন আমার ব্লগে।মন্তব্যের মাধ্যমে আমার ভুলক্রুটি জানালে পররবর্তীতে ভালো লিখতে পারব বোধহয়
২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪০
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। নানাবিধ ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে হঠাত উদিত হই। সময় পেলে আপনার গল্প পড়ার চেষ্টা করবো।
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: চমতকার এবং শিক্ষণীয় গল্পের জন্য ভাললাগার সাথে সাথে ধন্যবাদও রইলো আপনার প্রতি।
আসলেই ভাই, শুধু ইগো'র কারনে মানুষের একজীবনে কত যে সম্পর্কের অপমৃত্যু হয় কিংবা না চাইতেও কত যে জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় , তা বলার নয়।
আবার ছোট একটা শব্দ '' সরি '' যে কত বড় বড় সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে তাও বলার নয়। আবার একটি '' সরি '' না বলার কারনে ফেরাউনের সাম্রাজ্যের ও পতন হয়। তার নজির আমাদের দেশেই শেখ সালাতানাতের পতনের শুরু এক '' সরি '' না বলাতেই। যদি শেখের বেটির হাজারো-লাখো বড় বড় অপরাধ ছিল । তারপরও এই এক না বলা '' সরি '' ই তাকে দেশ-ক্ষমতা হারা করেছে।
'' সরি '' - আসলেই এক বিশেষ কিছু(ভালো-খারাপ দু ভাবেই)।