নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যাহা বলিব সত্য বলিব

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

তালপাতারসেপাই

লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।

তালপাতারসেপাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাদের মোল্লার ফাঁসি হলো যে সাক্ষ্যে

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:০৫



দুবছরের ছোট ভাইকে আছড়ে মারা, দুই বোনকে জবাই, এক বোনকে ধর্ষণ, মাকে গুলি করে মারা- এতোগুলো দৃশ্য দেখে নিজে ধর্ষিত হওয়ার পর মোমেনা বেগমের স্বাভাবিক থাকাটাই হতো অস্বাভাবিক। একাত্তরে একদিনে এতোগুলো ঘটনার পর পাগলই হয়েছিলেন এই নারী। তবে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে হাজির হয়েছিলেন তিনি।



মা-ভাই-বোনদের মৃত্যু দেখলেও সেদিন ধরে নেয়ার পর বাবা হযরত আলী লস্করের কোনো খবর আর পাননি মোমেনা। তাই সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কাদের মোল্লাকে মোমেনার প্রশ্ন ছিল- আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই- আমার বাবা কোথায়? কার্যত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এই নারীর সাক্ষ্যেই জামাতে ইসলামীর নেতা যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে গত বছরের ১৭ জুলাই দেয়া মোমেনার এই সাক্ষ্য বিচার চলা অবস্থায় প্রকাশিত হয়নি। আপিল বিভাগে রায়ের পর এই সাক্ষ্যটি পাওয়া যায়। একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে তাকে মৃত্যুদ- দেন।



কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ষষ্ঠ অভিযোগে তার ফাঁসির রায় হয়, ওই অভিযোগে ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক হযরত আলীর পুরো পরিবারের ওপর নির্মম নির্যাতন। তখন তিনি আরো জোয়ান ছিলেন, অল্পবয়সী ছিলেন, কাঠগড়ায় থাকা জামাত নেতাকে শনাক্ত করেছিলেন মোমেনা। কাদের মোল্লা যে সেদিন পাঞ্জাবি পরা ছিলেন, দুঃসহ সেই দিনের স্মৃতি না চাইলেও মনে আছে ওই সময়ের কিশোরীর।



পেশায় দর্জি হযরত আলী একাত্তরের উত্তাল সময়ে আওয়ামী লীগের সব মিছিলে যেতেন। ওই সময় বিহারিদের আবাস মিরপুরে ‘৭০ এর নির্বাচনে ‘নৌকা’ মার্কার পোস্টার নিজে লাগাতেন তিনি।



স্ত্রী, চার মেয়ে, এক ছেলেকে নিয়ে হযরত আলী থাকতেন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের কালাপানি এলাকার পাঁচ নম্বর লেইনের ২১ নম্বর বাড়িতে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঙালি নিধন শুরুর পরের দিনটিতে ‘নরক’ নেমে আসে তার বাড়িতে।



মোমেনার ভাষ্য, বেলা ডোবার আগে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে হামলা হয় তাদের বাড়িতে। আব্বা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া আসে এবং বলতে থাকে- ‘কাদের মোল্লা মেরে ফেলবে’। আক্তার গু-া, বিহারিরা ও পাক বাহিনীরা দৌড়াইয়া আসছিল। আব্বা ঘরে এসে দরজার খিল লাগায়ে দেয়।



হযরত দরজা এঁটে সন্তানদের খাটের নিচে লুকাতে বলে। মোমেনার সঙ্গে তার বোন আমেনা বেগমও খাটের নিচে ঢোকে। তখন দরজায় শোনে কাদের মোল্লাসহ বিহারিদের কণ্ঠস্বর। এই হারামি বাচ্চা দরজা খোল, বোম মার দেঙ্গা।



শুরুতে দরজা না খোলায় বাড়ির দরজার সামনে একটি বোমা ফাটানো হয়। এক পর্যায়ে হযরতের স্ত্রী একটি দা হাতে নিয়ে দরজা খোলে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হয়। আব্বা তখন আম্মাকে ধরতে যায়। কাদের মোল্লা পেছন থেকে শার্টের কলার টেনে ধরে বলে, এই শুয়ারের বাচ্চা, এখন আর আওয়ামী লীগ করবি না? বঙ্গবন্ধুর সাথে যাবি না? মিছিল করবি না? জয় বাংলা বলবি না?



আব্বা হাত জোড় করে বলে, কাদের ভাই, আমাকে ছেড়ে দাও। আক্তার গু-াকে বললো, আক্তার ভাই, আমাকে ছেড়ে দাও। তবে না ছেড়ে হযরত আলীকে টেনেহিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় বিহারিরা।



সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এরপর কাঁদতে কাঁদতে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হত্যাকা-ের বিবরণ দেন মোমেনা।



দাও দিয়ে আমার মাকে তারা জবাই করে। চাপাতি দিয়ে খোদেজাকে (বোন) জবাই করে। তাসলিমাকেও (বোন) জবাই করে। আমার একটি ভাই ছিল বাবু, বয়স ছিল দুবছর, তাকে আছড়িয়ে মারে। বাবু মা মা করে চিৎকার করছিল, বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদেন মোমেনা।



বাবুর চিৎকার শুনে খাটের তলায় লুকানো আমেনা চিৎকার দিলে তার অবস্থান জেনে যায় হামলাকারীরা। মোমেনা বলেন, আমেনাকে তারা টেনে বের করে, সব কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলে। এরপর তাকে নির্যাতন করতে থাকে। আমেনা অনেক চিৎকার করছিল, এক সময় চিৎকার থেমে যায়।



কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অজ্ঞান মোমেনা এরপর শোনান নিজের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা। তখন পর্যন্ত মোমেনা খাটের নিচেই লুকিয়ে ছিলেন। সন্ধ্যা হলে হামলাকারীরা যাওয়ার সময় ঘরের বিভিন্ন জায়গায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিল, আর কেউ আছে কিনা। একটি খোঁচা মোমেনার পায়ে লাগলে মুখ দিয়ে বের হওয়া শব্দ তার অবস্থান জানিয়ে দেয়। এরপর তার ওপরও চলে নির্যাতন, জ্ঞান হারান তিনি। রাতে জ্ঞান ফিরলে কোনো রকমে পাশের ফকির বাড়িতে যান মোমেনা। সেখানে তারা তাকে আশ্রয় দেন। তাদের মাধ্যমে শ্বশুরবাড়িতে খবর পাঠানো হলে মোমেনাকে নিয়ে যান তারা।



স্বাধীনতার পর মিরপুরে লাশ খুঁজতে যেতেন মোমেনা। কিন্তু বাড়িতে কাউকে পাননি তিনি, পাননি বাবার খোঁজও।



কামাল খান নামে একটা লোক ছিল, সে মুক্তিযোদ্ধাদের চা বানিয়ে খাওয়াত। সে আমাকে বলতো, কাদের মোল্লা তোর বাবা-মাকে মেরে ফেলছে। আক্কাস মোল্লা আমার উকিল বাবা ছিলেন, তিনিও একই কথা বলতেন।



পরিবারের সবাইকে হারিয়ে প্রায় তিন বছর মোমেনা বেগম মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। পরে চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। হত্যা করার সেই দৃশ্য আজও ভুলতে পারি না। সেজন্যই আমি পাগলপ্রায় ছিলাম। আমি বেঁচে থেকেও মরে আছি, শুধু বিচার চাই।



৪২ বছর পর বিচার পেয়েছেন মোমেনা। হযরত আলীর পরিবারকে হত্যাকা-ের জন্য কাদের মোল্লাকে দোষীসাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদ- দিলে ফুঁসে উঠেছিলেন সবাই।



আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসির আদেশ হলে সেই ক্ষোভের প্রশমন ঘটে; মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ বলেন, এবার যথার্থ রায় হয়েছে।

সুত্র

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.