![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
শনিবার সকালবেলা। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। অবরোধের সঙ্গে জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোট যোগ করেছে হরতাল। বোঝা দায় কোনটা কী? হরতাল বড় না অবরোধ বড়। হরতালেও বাস পোড়ানো হয়, বোমা মারা হয়, অবরোধেও তাই। এরই মধ্যে হরতালেও কম-বেশি বাস-সিএনজি চলে, রিকশা তো চলেই। আবার অবরোধেও তাই। অফিস-আদালত ও ব্যাংকে অফিসার-কর্মীর উপস্থিতির কোনো কমতি নেই। তারপরও দিনের পর দিন অবরোধ-হরতাল। শনিবার সকালে যখন গুলশান রওনা দিই তখনও অবরোধ-হরতাল। যাব কীভাবে? কোনো অসুবিধা নেই। মিনিটে মিনিটে অটো পাওয়া যাচ্ছে। আগে তা অসম্ভব ছিল। আঠারো দলীয় অবরোধের পূর্বে ঢাকার রাস্তায় একটা সিএনজি পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব কল্পনা। এখন দরে সস্তা, সহজে লভ্য। শান্তিনগর মোড় থেকে গুলশান দুই নম্বরে আজাদ মসজিদের পিছনে ‘লেক শোর’ হোটেলে যেতে ভাড়া কত? ২৫০ টাকা, স্যার। একটু চড়া গলায় বললাম ১০০ টাকা। সিএনজিওয়ালা থামল। স্যার, আর কিছু দেন। না শেষ পর্যন্ত ১২০ টাকায় রফা। ভাবা যায় কত সস্তা সিএনজি ভাড়া। ড্রাইভার তার গাড়িতে বসিয়েই বলল, স্যার আমাদের মেরে ফেলেন। আমাদের রোজগার এখন অর্ধেকও না। খাই-খরচা তো কম নয়। এভাবে চলে না, স্যার। আমি শুনছি তার অভাব-অভিযোগের কথা। বাড়ি তার বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়ার বৃহত্তর নোয়াখালীতে। আমি ঠিক করেছি তার কথা শুনব, কিছু বলব না। সে এক পর্যায়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করল। এসব শুনতে শুনতে যাচ্ছি ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির’ গোলটেবিল বৈঠকে। বিষয়বস্তু জানি না। পরের দিন অর্থাত্ ৫ জানুয়ারি নির্বাচন। কয়েকদিন আগে বিদেশি অর্থ ও সাহায্যপুষ্ট কিছু এনজিও ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটা গোলটেবিল করে চর্বিতচর্বণ করে— নির্বাচন স্থগিত করা হোক। সংবিধান বড় নয়, মানুষ বড়। আরও কত কথা। তারা জোর দিয়ে বললেন না সন্ত্রাস বন্ধ করতে, জঙ্গিবাদ বন্ধ করতে। চাচা মজীনা যা বলেন আকারে-ইঙ্গিতে তারা তাই বললেন। ক্ষোভ নিয়ে যাচ্ছি গোলটেবিলে। গিয়ে দেখি গোলটেবিলের বিষয়বস্তু: সন্ত্রাসী রাজনীতি, ফল ও ভবিষ্যত্ কর্মপন্থা। উপস্থিত অনেককেই চিনলাম, বেশির ভাগের সঙ্গেই পরিচয় নেই। ‘সমঝোতা’, নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, জামায়াতে ইসলামী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দুর্নীতিসহ অনেক বিষয়েই কথা হলো। সবই বহুল আলোচিত বিষয়, নিত্যদিন আমরা এসব চর্চা করছি। বুঝলাম বর্তমান আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বুঝলাম আন্দোলনের উদ্দেশ্য। নির্বাচন নয়— যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো। এক কথায় ১৯৭১ সাল। একদিকে উদার সমাজের আর্তি, আরেক দিকে ১৯৪৭-পূর্ব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান চেষ্টা। এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শক্তি, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী আমাদের সবকিছুকে তছনছ করে দিচ্ছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের বিকৃতি শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যা কিছু আমাদের অর্জন তাকে চেষ্টা করা হয় বিতর্কিত করতে। ইতিহাস বিকৃত করা হয়। ‘পাকিস্তান ভেঙেছে কে? শেখ মুজিবুর রহমান।’ ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে কে? জেনারেল জিয়াউর রহমান।’ পতাকা, জাতীয় সংগীত, সংবিধান, নির্বাচন, নির্বাচন পদ্ধতি, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন সবকিছুকে বিতর্কিত করা হয়, দলীয়করণ করা হয়। নতুন উদ্যমে হিন্দুশূন্য বাংলাদেশ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এবার শুরু হয়েছে অর্থনীতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। অর্থনীতিকে দুর্বল করতে পারলে বাংলাদেশকে পদানত করতে সুবিধে হয়। কথাটা পাকাপোক্ত করা যায় যে পাকিস্তান ভাঙার কারণেই আমাদের এই অবস্থা। এই অবস্থার সুযোগ নিতে চায় পাকিস্তান, যারা প্রকাশ্যে তাদের দোসর যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে। লজ্জার মাথা খেয়ে, কূটনীতির মাথা খেয়ে তারা তা করেছে তাদের জাতীয় পরিষদে। অথচ কে না জানে আমাদের ডলারের দাম কত। ৮০ টাকা দিয়ে আজ আমরা একটা ডলার কিনি, আজকের পাকিস্তান কেনে ১০০ টাকার ওপর দিয়ে। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, দারিদ্র্য, সাক্ষরতা, অপুষ্টি ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ পাকিস্তান কেন, অনেক ক্ষেত্রে ভারতেরও ওপরে। ত্রিশ-চল্লিশ লাখ নারীকর্মী পোশাক কারখানায় নিয়োজিত। ‘গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট’ ‘জিডিপি’র আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কৃষির অবদান ৭০ শতাংশের জায়গায় ২৫ শতাংশ। শিল্পের অবদান ২০ শতাংশ। সেবা খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত। পোশাক খাত দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি আয়ের খাত। খাদ্যে, বিশেষ করে চালে আমরা আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। মঙ্গা নির্বাসিত। যে উত্তরবঙ্গে প্রতিবছর ‘মঙ্গার’ কারণে লোক মারা যেত, উপোস থাকত আজ সেই শব্দটি আমাদের বাস্তব অভিধান থেকে নির্বাসিত। সবাই খেয়ে-পরে আছে। গ্রামে কোনো ভিক্ষুক নেই। শহরে ভিক্ষুক দেখা যায় না। মানুষের পায়ে জুতো আছে, পরনে জামা আছে। শাক-সবজি প্রচুর চাষ হচ্ছে। দুধের উত্পাদন বেড়েছে, মাছের উত্পাদন বেড়েছে। আমরা অন্ধকার থেকে আলোতে এসেছি। পাঁচ বছর আগে ফ্ল্যাট বাড়িতে ‘লিফট’ চলত, পানীয় জল কলসি করে ওপরে তুলতে হতো। নতুন করে হারিকেন কিনতে হয়েছে। অফিসে আমরা থাকতাম ঘর্মাক্ত। আজ বিদ্যুতের অভাব নেই। গ্যাসের সংযোগও এসেছে। বছরের প্রথম দিনে শিশুদের হাতে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে যাচ্ছে। মাছের উত্পাদন বাড়ছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকের সংখ্যা এখন মাত্র মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। খাদ্যশস্য উত্পাদন ৪২ বছরে সাড়ে তিনগুণ বেড়েছে। এসব পারফরমেন্স কি ছোট পারফরমেন্স? বিশাল হয়েছে বাজেটের আকার। উন্নয়ন বাজেটের আকার হয়েছে ৫ বছরে তিনগুণ। এসব কিসের কথা বলে? বাংলাদেশ আজ অবাক বিস্ময়ের দেশ। কার কাছে? নরপিশাচ হেনরি কিসিঞ্জারের দেশের লোক মজীনার কাছেও। তিনিও দেখা যাচ্ছে অর্থনৈতিক পারফরমেন্সের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিদেশিরা তো বটেই। অর্থনীতির নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বাঙালি অর্থনীতিবিদদের ড. অমর্ত্য সেনও একই কথা বলছেন। সারাবিশ্ব যখন আমাদের অসীম সম্ভাবনার কথা অকপটে স্বীকার করছে তখন দেশের কিছু কুষ্মাণ্ড আমাদের সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতি সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী যা করেনি তাই তারা করছে। হাজার হাজার বৃক্ষ তারা নিধন করছে। রেল তুলে ফেলছে। বাস-অটোতে আগুন লাগিয়ে মানুষ মারছে। পাকিস্তানি বর্বররা কি এসব করেছে! না, তারা অন্তত গাছ কাটেনি, রেললাইন উপড়ে ফেলেনি। এখন দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্বাচনের নামে এসব করছে। তাদের দেশবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে এই প্রথম আমাদের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে। বহু কষ্টের অর্জন। তিলে তিলে অর্জিত প্রবৃদ্ধির হার। জঙ্গিবাদীরা, মৌলবাদীরা, সংবিধানবিরোধী, জাতীয় পতাকা ও সংগীতবিরোধী শক্তি কৃষিতে আগুন লাগিয়েছে। এবার কৃষক তার পণ্যের মূল্য পায়নি। অবরোধের কারণে তার পণ্য কেনার কোনো লোক নেই। হাজার হাজার টন দুধ বিনষ্ট হচ্ছে একদিনে অথচ আমাদের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। পরিবহন বিপর্যয়ে রফতানি আক্রান্ত। এই প্রথম ২০১৩ সালে রফতানি প্রবৃদ্ধির হার কম হবে। রেমিট্যান্স ইতিমধ্যেই কমেছে। রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’। যেখানে আগের বছর রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় ১৭ শতাংশ, সেখানে ২০১৩ সালে তা হ্রাস পেয়েছে প্রায় আড়াই শতাংশ। আয়কর থেকে সরকারের রাজস্ব হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকগুলোর কোনো বিনিয়োগ নেই। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানি শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস পেয়েছে। মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে শুরু হয়েছে খেলাপি আতঙ্ক। তারা ব্যাংকের দেনা শোধ করতে পারছেন না। খেলাপি হয়ে যাবেন। পরিবহন মালিক, হোটেল মালিকরা খেলাপি হচ্ছেন। পোশাক খাত ইতিমধ্যেই ৫০০০ কোটি টাকা নিজের পকেট থেকে খরচ করেছে বিমানে মাল পাঠাতে গিয়ে। আর কত বলব আর লিখব। রাজনীতি তছনছ হওয়ার পর, অর্থনীতি তছনছ হচ্ছে। পাকিস্তানিদের কাছে আমাদের হাস্যাস্পদ করার জন্যই কি এসব? তাই মনে হয়। আগেই বলেছি অর্থনীতি ধ্বংস না করতে পারলে বাঙালিকে দমন করা সম্ভব নয়। এই কাজটিই হাতে নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে পারলেই স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের তাদের বিদেশি প্রভুদের কাছে মাথা নত করাতে পারবে— এই বোধ হয় তাদের পরিকল্পনা। কিন্তু এটা হওয়ার নয়। এটা ২০১৪ সালের বাংলাদেশ। সুত্র
©somewhere in net ltd.