নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
দেশে এখন দুটি বিরোধী দল— ঘরের বিরোধী দল ও বাইরের বিরোধী দল। প্রথমটি জাতীয় পার্টি বা জাপা। দ্বিতীয়টি বিএনপি। সংসদীয় গণতন্ত্র অনুসারে জাপাকেই এখন দেশের প্রধান বিরোধী দল বলতে হয়। কিন্তু দলটির উভচর দশা— সরকারে আছে, বিরোধী দলেও আছে। মানুষ তাই জাপাকে নয়, বিএনপিকেই বিরোধী দল ভাবছে। সংসদ কার্যক্রম শুরু হলেও এই ভাবনায় চিড় ধরবে বলে মনে হয় না। তখনও মানুষের নজর বাইরের বিরোধী দল মানে বিএনপির দিকেই থাকবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গতকালের সংবাদ সম্মেলনও এ সাক্ষ্য দেয়। গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ-সম্মেলনটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে খালেদা জিয়ার বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচারকালে মানুষকেও উত্কর্ণ থাকতে দেখা গেছে।
দুই.
বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলপ্রেমী। বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে সমর্থকরা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে উত্সবমুখর থাকে। তখন বাড়ির ছাদে-ছাদে উড়তে দেখা যায় ওই দুই দেশের পতাকা। দল দুটির কোনও একটি বাদ পড়লে ফাইনাল খেলাও আবেদন হারায়। বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো জাতীয় নির্বাচনও বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি উত্সব। এ ক্ষেত্রে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জায়গায় থাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আর দুই দেশের পতাকার জায়গাদখল করে দল দুটির নির্বাচনি প্রতীক— নৌকা ও ধানের শীষ। কথাগুলো আগেও এক গদ্যে লিখেছিলাম। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এই ছয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তিনবার করে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। ৬ষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও দলটির প্রতীক নৌকা ছিল না। তাই উত্সবও ছিল না। নির্বাচনোত্তর বিএনপি সরকার তখন ক্ষমতায় ছিল মাত্র ১১ দিন। গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনে ছিল না বিএনপি ও দলটির প্রতীক ধানের শীষ। এ নির্বাচনও উত্সবমুখর পরিবেশে হয়নি। ১৫৩ আসনে ভোটকেন্দ্রেই যেতে হয়নি ভোটারদের। পরন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ছিল নৈরাজ্য-নাশকতা। প্রাণহানিও ঘটেছে সর্বাধিক। প্রশ্ন উঠেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আসা বর্তমান সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে বা এ সরকারের কতদিন ক্ষমতায় থাকা উচিত?
তিন.
সরকারগঠনের পর-পরই একাধিক মন্ত্রীকে বলতে শোনা গেছে— এই সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন আখ্যা দিয়ে সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেছে বিএনপি। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়াও একই কথা বিশদে বলেছেন। আওয়ামী লীগকে ‘গণতন্ত্রহত্যাকারী’ বলে তিরস্কারও করেছেন তিনি। তার মতে— বর্তমান সরকার ‘বিনাভোটের সরকার’, ‘গায়ের জোরে আসা অযোগ্য সরকার’, ‘বিপজ্জনক সরকার’। লিখিত বক্তব্যে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়েও অনেক কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন ‘আওয়ামী প্রহসন’, ‘কারসাজির নির্বাচন’ ‘জালিয়াতি’ ইত্যাদি বিশেষণ। বিএনপির ভবিষ্যত্ কর্মসূচির কথাও এসেছে খালেদা জিয়ার বক্তব্যে। আরও এসেছে গ্রামীণ ব্যাংক আর নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূস প্রসঙ্গ। এত-এত প্রসঙ্গ এলেও বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যে জামায়াত-প্রাসঙ্গিক কোনও কথাই ছিল না। সাংবাদিকদের একজন এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি গত্বাঁধা পুরনো কৌশলে বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যান। জামায়াত-সঙ্গে মানুষহত্যার দায়ও সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে গণতন্ত্রের স্বার্থে সংলাপ-সমঝোতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন তিনি, যা প্রশংসার দাবি রাখে।
চার.
কথা ঠিক— গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে সংলাপের বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, সেই দায় কি বিএনপির ওপরও বর্তায় না? শেখ হাসিনা তো সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে ফোন করেছিলেন খালেদা জিয়াকে। তখন কেন সাড়া দেননি তিনি? সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন এ-ও বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হবে’। জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ না-করে কীভাবে তা বন্ধ করবেন, সে প্রসঙ্গে যাননি তিনি। তবে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূর-অতীতের নির্বাচনি সখ্যের কথা জানাতে ভোলেননি। সে তো সবার জানা কথা। মানুষ এ-ও জানে, ওই সখ্যের নিকুচি করেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল। মানুষ দেখেছে— সরকার যখন মিরপুরের কসাই-কুখ্যাত কাদের মোল্লাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করছে, বিএনপি তখন নির্বাচন ঠেকাতে একাত্তরের ঘাতক-সঙ্গে পেট্রলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারছে। জ্বালিয়ে দিচ্ছে শত-শত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। স্বাভাবিক কারণেই পোড়-খাওয়া মানুষের মনে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— আওয়ামী লীগের ‘গণতন্ত্রহত্যা’ বেশি ক্ষতিকর, না কি বিএনপি-জামায়াতের মানুষহত্যা?
পাঁচ.
৫ জানুয়ারি দেশে একটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন হয়েছে— এ ব্যাপারে কারুরই দ্বিমত নেই। কিন্তু খালেদা জিয়া যে বললেন, এমন কারসাজির নির্বাচন মানুষ আগে কখনও দেখেনি? ডাহা অসত্য কথা। তার সরকারই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এইরকম একটি নির্বাচন করেছিল। সেই নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিতও হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে জামায়াত-সঙ্গে প্রাণঘাতী নাশকতা চালিয়ে সেই প্রমাণ নষ্ট করেছে খালেদা জিয়ার দল বিএনপিই। সহিংসতার মাধ্যমে ওইদিন ভোটারদের গৃহবন্দি করে রাখা হয়নি, এর কোনও প্রমাণ আছে কি দলটির কাছে? নিজের নির্বাচনকালীন গৃহবন্দিত্বের কথা বলার সময় ভোটারদের গৃহবন্দিত্বের কথাও যদি ভাবতেন খালেদা জিয়া, তাকে বাহবা দেওয়া যেত। প্রাসঙ্গিক আরেকটি কথা না-বললেই নয়— অজ্ঞাতস্থানীয় ভিডিওবার্তায় ডাকা বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচন-প্রতিহতের সহিংসতায় সাধারণ মানুষেরও কোনও সায় ছিল না। সবাই তখন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। আর এ কারণেই ‘কারসাজি’র নির্বাচনে আসা ‘বিনা ভোটের সরকার’ পেয়েই মানুষ এখন স্বস্তি বোধ করছে। জামায়াত-সঙ্গে পেট্রলবোমায় মানুষহত্যা করে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে বিএনপি। দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলেও দেশে ধানের শীষের অনুরাগীর সংখ্যা এখনও অনেক। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে নির্বাচনে গেলেও দলটিকে হয়তো গত সংসদের মতো মাত্র ৩৩ আসন পেয়ে বিরোধী দলের সারিতে বসতে হত না। বিজয়ী হয়ে সরকারগঠনের সম্ভাবনাও ছিল।
পাদটীকা
গণতন্ত্র নয়— সবার উপরে মানুষ সত্য। আওয়ামী লীগের ‘গণতন্ত্রহত্যা’র আগে জামায়াত-সঙ্গে মানুষহত্যার জন্য বিএনপির বিচার হওয়া উচিত। ওই কুসঙ্গ ত্যাগ না করলে নির্বাচন নিয়ে কথা বলারই অধিকার রাখে না দলটি। যদিও বিএনপির দলকানা সুশীলরা জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগে আইন করতে বলছেন সরকারকে। কিছুদিন আগে এক গদ্যে বলেছিলাম— মুক্তিযুদ্ধের বর্জ্য জামায়াতকে ত্যাগ করতে কোনও আইনের দরকার নেই; শৌচাগারই যথেষ্ট। তার মানে এই নয়, কুসঙ্গে কুকর্ম করলেও তা আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে। সব কথার শেষ কথা এই যে— বিএনপি যদি জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ না করে, ‘কারসাজির নির্বাচনে’র মাধ্যমে আসা ‘বিনাভোটের সরকার’ পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার পাবে। সেটা বিএনপির জন্য মোটেও সুখকর হবে না। ইতোমধ্যেই দলটির কূল গেছে। তখন কিনারও থাকবে না। সুত্র
©somewhere in net ltd.