নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
* সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা
* নিজের দলেও তাকে ঘিরে বিতর্ক
* মাথার ওপর ঝুলছে দুদকের মামলা-জেল
*২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার খড়গ
আবুল হারিছ চৌধুরী। চারদলীয় জোট সরকারের আমলের অন্যতম আলোচিত নাম। ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব। হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যিনি পরিণত হন অসীম ক্ষমতাশালী নেতায়। বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই পতন ঘটে হাওয়া ভবন সাম্রাজ্যের। পতন ঘটে হারিছ চৌধুরীরও। ওয়ান-ইলেভেন উদ্ভূত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাওয়া ভবন ছেড়ে নিজেই হাওয়া হয়ে যান হারিছ চৌধুরী। এরপর আর দেশমুখো হননি একসময়ের এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ।জানা গেছে, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত হারিছ চৌধুরীর শীঘ্রই দেশে আসার পরিকল্পনা নেই। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ কয়েকটি আলোচিত মামলায় নাম ওঠে আসা, সরকারের কঠোর অবস্থান, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হওয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় এই সময়ে দেশে আসার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না হারিছ চৌধুরী।২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে উঠে আসে হারিছ চৌধুরীর নাম। বর্তমান সরকারের আমলে আলোচিত এই মামলার বিচার কাজ নতুন করে শুরু করেছে। এ ছাড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারেও হারিছ চৌধুরী জড়িত থাকতে পারেন বলে মনে করে সরকারি মহলের কেউ কেউ। হারিছ চৌধুরী এ ঘটনার অনেক কিছু জানতেন বলে ধারণা তাদের। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেড হামলা ও হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যার ঘটনায়ও হারিছ চৌধুরীর সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দেশে এলে এসব মামলায় ফেঁসে যেতে পারেন বলে ধারণা হারিছ চৌধুরীর আত্মীয়স্বজনের। মামলা এড়াতে গুলশানে বরাদ্দ পাওয়া সরকারি বাড়ি ফিরিয়ে দিলেও মামলা থেকে রেহাই পাননি হারিছ। ইতিমধ্যে দুদকের একটি মামলায় তিন বছরের সাজা হয়েছে তার। জোট সরকারের অনিয়ম দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা হাওয়া ভবনের অন্যতম ক্রীড়নক ছিলেন হারিছ চৌধুরী। তাই সেই সরকারের লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অনেক তথ্যই হারিছ চৌধুরীর কাছে রয়েছে। অনেক দুর্নীতিতে হারিছ চৌধুরীর সরাসরি জড়িত ছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। দেশে এলে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারেও জেরার মুখে পড়তে হবে সিলেটী এই বিএনপি নেতাকে।চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাও কোণঠাসা ছিলেন হাওয়া ভবনের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা হারিছ চৌধুরীর কাছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে সবসময় ঘিরে রাখতেন হারিছ চৌধুরী গং। সিনিয়র নেতারা ঘেঁষতে পারতেন না নেত্রীর কাছে। অনেক সিনিয়র নেতাকে সেসময় হারিছ চৌধুরীর কাছে অপদস্তও হতে হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পরবর্তিত পরিস্থিতিতে এই সিনিয়র নেতারাই এখন বিএনপির হাল ধরেছেন। এখন হারিছ চৌধুরী দেশে ফিরে আসা ও আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ব্যাপারে মত নেই এই সিনিয়র নেতাদের। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দল ও দলীয় নেত্রীকে দুর্দিনে ফেলে রেখে তার পালিয়ে যাওয়াকেও সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না দলীয় নেতারা। এ কারণে স্বয়ং তারেক রহমানও রুষ্ট হারিছ চৌধুরীর ওপর। ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখা পাননি তিনি। আর দলের আজকের করুণ পরিণতির জন্য হারিছ চৌধুরীদের অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারই দায়ী বলে মনে করেন খালেদা জিয়া। ফলে তিনিও রুষ্ট তার একসময়ের এই রাজনৈতিক সচিবের ওপর। এ জন্য বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিলে তাকে কোনো পদেই রাখা হয়নি। ফলে হারিছ চৌধুরী এখন পড়েছেন ত্রিমুখী সংকটে। ক্ষমতায় থাকাকালে নিজের অপকর্মের বিচার হওয়া, বিশেষত বিএনপিসহ বিরোধী নেতাদের ব্যাপারে সরকারের সাম্প্রতিক কঠোর অবস্থান ও নিজের দলের মধ্যে হারিছ বিরোধী বলয় শক্তিশালী হয়ে ওঠা- এই তিন কারণ আরও দীর্ঘায়িত করেছে হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপন জীবন। দমিয়ে রাখতে হচ্ছে নিজের দেশে ফেরার ইচ্ছাকে। এসব কারণে হারিছ চৌধুরীর সন্তানরাও চায় না তিনি দেশে ফিরুন।হারিছ চৌধুরীর উত্থান : ঢাকার নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হারিছ চৌধুরী শুরুতে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে ’৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন জাগদলে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি হারিছ চৌধুরীকে। একে একে সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুবদলের সেক্রেটারি, সহ-সভাপতিসহ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হওয়ার পর তো অনেকটা আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান তিনি।যেভাবে পালিয়ে যান : সেনাসমর্থিত সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ঝটিকা অভিযান শুরু করলে আত্মগোপনে চলে যান হারিছ চৌধুরী। প্রথমে কিছুদিন হবিগঞ্জে আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর আসেন সিলেটে। সে সময় দুদকের শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় ওঠে আসে হারিসের নাম। তখনই দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০০৭ সালে ২৯ জানুয়ারি সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে নানারবাড়ি ভারতের করিমগঞ্জে পাড়ি জমান। এর কয়েকদিন পর তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, বস্তায় করে টাকা উত্তরকূল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়। ভারত থেকে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। এরপর সেখান থেকে ইরানে তার ভাই আবদুল মুকিত চৌধুরীর কাছে যান হারিছ। আবদুল মুকিত সেখানকার একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। এরপর মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র হয়ে আবার ফিরে যান যুক্তরাজ্যে।স্ত্রী-সন্তান নিয়ে লন্ডনে : স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থান করছেন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হারিছ চৌধুরী। শারীরিক অবস্থান অবনতি ঘটায় ও দেশের পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় পরিবারের সদস্যরাও চায় না তিনি দেশে ফিরে আসুক। হারিছ চৌধুরীর এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে ব্যারিস্টার ও ছেলে নরওয়ে ভিত্তিক একটি তেল কোম্পানিতে কর্মরত। সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের আগে স্ত্রী-সন্তানরা দেশে এসেছিলেন। এরপর আর তারাও দেশে আসেননি। তবে দেশে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে এখন স্ত্রী-সন্তানরাই যোগাযোগ রাখেন। ঈদ ও বিভিন্ন ধর্মীয় দিবসে বাবার পক্ষ থেকে সিলেটের গ্রামের বাড়িতে শিরনি, মিলাদ ও কোরআন খতম ও দানখয়রাত করে হারিছ চৌধুরীর সন্তানরা। এমন তথ্য পাওয়া গেছে হারিছ চৌধুরীর কয়েকজন আত্মীয়স্বজন ও রাজনৈতিক অনুসারীর সঙ্গে আলাপ করে।একাধিকবার দেশে ফেরার পরিকল্পনা : ২০১০ সালের ঈদুল আজহার পর দেশে ফিরে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী। আত্মসমর্পণের জন্য দেশের শীর্ষ এক আইনজীবীর সঙ্গে তিনি যোগাযোগও করেন। ওই আইনজীবী তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলায় জামিন হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেন। এরপর হারিছ চৌধুরীর সম্মতিতে ওই আইনজীবী সব কাগজপত্র প্রস্তুত করেন। কিন্তু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সম্পূরক চার্জশিটে তাকে আসামি করায় হারিছ চৌধুরী দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। গত নির্বাচনের আগে সিলেট-১ আসনে হারিছ চৌধুরীকে প্রার্থী করার দাবি জানিয়ে পোস্টারিংও করা হয়। ইচ্ছা ছিল নির্বাচন হলে দেশে এসে প্রার্থী হবেন। তবে সে নির্বাচনে বিএনপি অংশই নেয়নি। ফলে দেশে আসাও হয়নি হারিছ চৌধুরীর। হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজনরা জানান, আগেও একাধিকবার দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু দেশ থেকে গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া, নতুন নতুন মামলায় জড়ানো ও পরিবারের সদস্যদের আপত্তির কারণে আর দেশে ফিরেননি হারিছ চৌধুরী। ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর হারিছ চৌধুরীর আরেক ছোট ভাই সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা আবুল হাসনাত চৌধুরী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার দাফন সম্পন্ন হয় গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগর গ্রামে। লাশ গ্রামের বাড়ি আসার পর থেকে দাফন পর্যন্ত হারিছ চৌধুরী ও আবদুল মুকিত চৌধুরী ইরান থেকে ফোনের মাধ্যমে কথা বলেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। এ সময় ফোনে হারিছ চৌধুরী খুব বেশি কান্নাকাটিও করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ডা. আবদুল মুকিত চৌধুরী দেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু হারিছ চৌধুরীর কারণে ইরান ফিরে যেতে সমস্যায় পড়তে পারেন এমন আশঙ্কায় তিনি দেশে আসা থেকে বিরত থাকেন।নিস্তব্ধ ‘সিলেটের হাওয়া ভবন’ : চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হারিছ চৌধুরী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সিলেটের কানাইঘাট নিজ বাড়িতে ডাকঘর, স্কুল, পুলিশ ক্যাম্প ও ব্যাংকের শাখা বসিয়েছিলেন। বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন মিনি চিড়িয়াখানা। সিলেটের ‘হাওয়া ভবন’ হিসেবেই পরিচিত ছিল তার বাড়ি। জরুরি অবস্থার পর তার বাড়ি থেকে ৫টি বন্য হরিণ উদ্ধার করে বনবিভাগ। বর্তমানে প্রায় জনশূন্য এ বাড়িটি খাঁখাঁ করছে। বাড়িতে থাকেন হারিছ চৌধুরীর সর্বকনিষ্ঠ ভাই কামাল আহমদ। হারিছ চৌধুরীর বর্তমান অবস্থান প্রসঙ্গে তার চাচাতো ভাই ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে মাঝে মধ্যে তার ছেলে-মেয়েরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হারিছ চৌধুরী কোথায় আছেন তা তার জানা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
সুত্র
©somewhere in net ltd.