গুরু তোমাকে সালাম..

০৬ ই জুন, ২০১১ রাত ২:৪৮

সময়টা তখন ৯১ বা ৯২ হবে। ঠিক মনে নেই। বিজ্ঞান কলেজ। ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি। হয়তো সেভেনই হবে। আমার স্কুলের বন্ধুরা হয়তো মনে করতে পারবে। সেদিন অন্যসব দিনের আগেই ক্লাস ছুটি হয়ে গিয়েছিল। কী কারন তা আর আমার মনে নেই। কিন্তু স্কুল নির্ধারিত সময়ের আগেই ছুটি হবার আনন্দটা কেমন ছিল সেটা এখনও অনুভব করি। তাই সেদিনটার কিছুটা স্মৃতি আজও রয়ে গেছে। আজ এত দিন পর সেদিনটার কথা আমার আবার মনে পরলো...







ছুটির আনন্দে যখন বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আমার কোন এক ক্লাস মেট, হয়তো তৌহিদ বা ইরান, বললো যে স্কুলের মাঠে কনসার্ট হবে। সবাই যাচ্ছে। আমার নিজেকে তখনও পুরোপুরি আবিষ্কার করা হয়নি। গান, কনসার্ট এগুলো তখনও আমার কাছে খুব একটা আনন্দের বিষয় নয়। কিন্তু যতদূর মনে পরে ইরানের প্ররোচনায় আমি আমাদের কলেজের পিছনের বড় মাঠটাতে গিয়েছিলাম। অনেক লোকের সমাগম। কনসার্ট হবে সেখানে। কারা করবে তাও জানি না, কী গান গাবে তাও না। কিন্তু সবার মাঝেই অনেক উৎচ্ছ্বাস...







কিছুক্ষনের মাঝেই গান শুরু হল। না, কোন বড় বা নামীদামি বা তৎকালীন সময়ের কোন তারকা সমৃদ্ধ দলের কনসার্ট সেটা ছিলনা।কাদের ছিল তাও মনে নেই; নেই মনে প্রথম গানটা কী ছিল তাও। কিন্তু আজও একটা গান আমার মনে পরে... "রেল লাইনের ওই বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে, মা তার কাঁদে; ছেলেটি মরে গেছে..."











সেই প্রথম আমার আজম খানের কোন গান শোনা...প্রচন্ডভাবে সেদিন ওই গানটা আমকে নাড়া দিয়েছিল। যদিও কোন অখ্যাত গায়কের গলায় সেদিন গানটা শুনেছিলাম, তবুও সেটা আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল গভীর ভাবে। কনসার্টের মাঝেই কেউ আমাকে বলেছিল যে গানটা যে গাইছে সে সঠিক সুরে পারছে না গাইতে, তাও সেটা আমার মনে গেঁথে গেল। তখনই কাউকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটার মূল গায়ক কে? আজম খানের নাম আমার সেদিনই প্রথম শোনা...







তখনকার দিনগুলোর সাথে বর্তমানের দিনগুলোর পার্থক্য আকাশ পাতাল। যাদের জন্ম ৯০ এর পর তারা তা কল্পনাও করতে পারবে না। ডিশ নেই, হাজারটা চ্যানেল নেই, মোবাইল নেই, এফ এম রেডিও নেই, ইন্টারনেটের কথা দূরে থাক কম্পিউটারের নামই শুনেছি আরও ৩/৪ বছর পর। তখন যুগ বিটিভি আর ভিসিআর এর। তথ্য পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম পেপার পত্রিকা। তাও আমার বাসায় রাখে না। এখনকার মত সবকিছুতেও 'গুগল' করার কথা তখন ছিল কল্পনার চরম সীমা থেকেও শতকোটি আলোক বর্ষদূরের ব্যপার। তাই আজম খানের নাম শুনলেও তাঁর সম্পর্কে জানার ও তাঁর অন্যান্য গানগুলো শোনার কোন উপায়ই আমার ছিলনা...







আজম খান সম্পর্কে পরবর্তীতে কিছুটা জানতে পারি ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তখনও মনে হয় বিটিভিই একমাত্র ভরসা। আরও কিছু গানের কথা ইতিমধ্যে ইরান ও আমার এক কাকার মাধ্যমে আমি জানতে পারি, যেমনঃ অভিমানি, চুপি চুপি, আলাল ও দুলাল... কিন্তু সবগুলো শোনার সৌভাগ্য আমার তখন হয়ে উঠেনি...







ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে দিন পরিবর্তিত হলেও ও তথ্য পাওয়া আরও সহজ হয়ে উঠলেও আমাদের দেশের নিজেদের খবর পাওয়া তখনও অনেক কষ্টসাধ্য ছিল। আমার বাসায় তখনও পেপার রাখেনা। তাই আমি রাস্তায় দেয়ালে লাগানো পেপার পরতাম। প্রতিদিন। তখন কলেজে পড়ি...এরই মাঝে কোন একদিন আবিষ্কার করি আজম খান শুধুই একজন জনপ্রিয় গায়ক নন, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা...একজন গেরিলা...











পরবর্তীতে তাঁর কথা যে কতবার পড়েছি , কত বার যে তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের জীবনবাজি রাখা দিনগুলোর কথা জেনেছি তার হিসেব নেই। যখনই পড়তাম চোখের সামনে ভেসে উঠতো ২১ বছরের এক টগবগে যুবকের কথা, যে মা কে ভালবাসে,দেশকে ভালবাসে, গানকে ভালবাসে... আর এই ভালবাসার টানেই গিটার ধরে, এই ভালবাসার টানে গ্রেনেড ধরে...যে হাতে দিনে যুদ্ধ করে, সে হাতেই রাতে গিটার বাজিয়ে গান শুনায় সহযোদ্ধাদের...তাঁর কথা যতই ভাবি ততই মুগ্ধ হই...অবাক হই...নিজেকে তাঁর স্থানে রেখে ভাবতে গেলেই বুঝতে পারি যে কতটা স্বার্থপর আর ছোট মনের মানুষ আমি...তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর ভালবাসা আমার আরও বেড়ে যায়....







আজকাল একটা,দুইটা গান গেয়েই সবাই স্টার হয়ে যায়, কোটিপতি হয়ে যায়। জুটে যায় অসখ্য ভক্ত। চলে ফষ্টি-নষ্টি। চলে যায় সবার ধরা-ছোঁইয়ার বাহিরে। শুনেছি আজকাল বালামের মত গায়কও নাকি বিএমডাব্লিউ চালায়!!!







আর আজম খান?







আজম খান সারাজীবন গান গেয়েছেন আমাদের জন্য। দেশের জন্য।টাকার জন্য নয়। নয় কোন মিথ্যা তারকাখ্যাতি পাওয়ার জন্য। তাঁর জীবন যাপন ছিল সাধারণের থেকেও সাধারণ। ছিলনা তাঁর কোন অহঙ্কার, কোন গর্ব, কোন লোভ। হাসিমুখে তিনি সকলের সাথে মিশেছেন, সকলের আবদার মিটিয়েছেন। ৫০ বছর বয়সেও তিনি ছিলে তরুন... সেই বয়সেও তিনি চুটিয়ে ফুটবল, ক্রিকেট খেলেছেন এলাকার স্কুল্পড়ুয়াদের সাথে...খেলেছে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটও। ইচ্ছে ছিল তাঁর বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার।পারেন নি। ক্ষোভ ছিলোনা তাঁর সেটার জন্য। কেউ কোনদিন বলতে পারবে না তিনি তারকাখ্যাতির জন্য কারো সাথে মিশেননি,পরিচিত -অপরিচিত সকলকেই তিনি ভালবাসায় বরণ করেছেন সারাজীবন...







এইদেশকে সারাটা জীবন শুধু যিনি দিয়েই গেলেন, তাকে আমরা কী দিয়েছি?







এদেশে রাজাকাররা দেশে প্রেসিডেন্ট হয়েছে,মন্ত্রী হয়েছে...পেয়েছে ২১শে পদকও*। অন্যদের কথা আর বললাম না। কিন্তু এই মহান শিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা, গুরু আজম খান কী পেয়েছেন? তিনি যখন অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুর গেলেন কতজন তাঁর খোঁজ রেখেছেন? কতজন জানেন যে টাকার অভাবে তিনি চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই চলে এসেছিলেন দেশে... কতজন জানেন যে টাকার অভাবেই তাঁকে স্কয়ার হাসপাতাল থেকে নেয়া হয়েছিল সিএমএইচে। হায় বাঙ্গালী, হায় বাংলাদেশ!!!!







আজ টিভিতে প্রতিটা চ্যানেলে দেখি শুধুই আজম খানের সংবাদ। আমার মন খুবই বিক্ষুব্ধ, বেদনার্ত...কোথায় ছিল এরা, এই মিডিয়া যেদিন তিনি ছিলেন? কোথায়!!!??







আমি আজ কেঁদেছি... আজম খানের জন্য... অনেক দুঃখে... পারিনি কিছুই দিতে তাঁকে আজ আমরা... এই ব্যথা আমাকে সারাজীবন কাঁদাবে...







আজম খান চলে গেছেন... আর ফিরে আসবেন না... কিন্তু তিনি থেকে যাবেন আমাদের মাঝে...চিরদিন...যতদিন থাকবে এই বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা...







"হারিয়ে গেছে,



খুঁজে পাবোনা..."

গুরু তুমি সত্যিই হারিয়ে গেলে... আর খুঁজে পাবোনা তোমায়... বেদনার্ত হৃদয় আজ আমার...বলতে চাইনা বিদায় তোমায়...তুমি থাকবে আমাদের এই হৃদয়ে...তোমার গানের মাঝে...খুঁজে নেব তোমায়...

১১ টি +২/-০