নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার প্যারালাল পৃথিবী

আমি বড়ই ভীতু মানুষ ।

আধার আলো

আধার আলো › বিস্তারিত পোস্টঃ

শেষের পাতা - ৪

০৫ ই জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৭

রাতে যখন লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুতে গেলাম দেখি আকাশ ভরা জ্যোৎস্না । বাইরে কেমন যেন এক অপার্থিব পরিবেশ । গাছের ফাঁকগুলো থেকে মনে হল অশরীরী আত্মাগুলো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে । জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে । আজ কেন যে এত বেশি চোখের বিভ্রম হচ্ছে । শুতে যাব এমন সময় হঠাৎ করে খুব তৃষ্ণা পেল । বিছানার পাশে টেবিলের উপর রাখা জলের গ্লাসটার দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখি জলের মধ্যেও আজ জ্যোৎস্না গলন্ত রূপোর মত চকচক করছে । সব কিছুর মাঝেই জ্যোৎস্নার আলো মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে । আমার পুরো ঘরটাই হালকা স্মিত এক মায়াবী আলোয় ভরা । এমন সুন্দর একটা পরিবেশে মশারীটা বড়ই বেমানান । তাই সেটা খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম । কিন্তু ঘুম আসছিল না । আপুর কথাগুলো বার বার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল । হঠাৎ করে ফোটায় ফোটায় জ্যোৎস্না পরে আমার বালিশটা ভিজে উঠতে লাগলো ।



সারাটা রাত দুটো চোখের পাতা এক করতে পারিনি । তাই শুয়ে থেকেও শরীরটা খুব অবসন্ন লাগছিল । ভোরে দিকে বেশ মশা ছেকে ধরেছিল, টুকটাক দু চারটা কামড়ও দিয়েছে । কিন্তু আর ইচ্ছা হয়নি উঠে মশারীটা টাঙাই । অন্যদিন সকালে দু একবার ডাকলেই উঠে পড়ি । কিন্তু আপু পাঁচ সাতবার ডাকার পরও যখন আমার কোনো সারাশব্দ পেল না, তখন আমার ঘরে এসে দেখে আমি ফ্যানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ।

“ কিরে এতবার ডাকলাম জবাব দিস না কেন ?”

বিশাল এক হাই তুলে বললাম, “ এমনি ”

আপু আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, “ রাতে ঘুমাসনি ? চোখগুলো লাল কেমন গর্তে বসে গেছে ।”

“ ঘুম আসেনি ”

“ অন্য পাশ ফিরে শুয়ে বললাম, “ আজকে স্কুলে যাবনা ।”

“ কেন ? স্কুলে না গেলে তুই কি ভেবেছিস আব্বা বিয়ে করবে না ? তোকে এখন অনেক বেশি শক্ত হতে হবে । এই সমাজে বাঁচার জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে ।”

“ আপু আজকে থাক । কালকে থেকে গড়বো । এখন একটু ঘুমাই ।” আপুর এই বিপ্লবী কথাবার্তা ভাল লাগছিল না ।

একটা দীর্ঘ শ্বাসের পর আপু কিছক্ষন চুপ থেকে বলল, “ ঠিক আছে নাস্তাটা খেয়ে আবার শুয়ে পর । আমি স্কুল থেকে প্রবেশ পত্র আনতে যাচ্ছি বর্ণার সাথে ।”

আমি শুয়েই রইলাম । আপু বাইরে যাওয়ার আগে আরেকবার চিৎকার করে বলে গেল, “ সোহু আমি গেলাম । তুই নাস্তাটা খেয়ে নে ।”

দেখতে দেখতে দুপুর বারোটা বেজে গেল । ঘুম তো এলোই না বরং ক্ষুধার চোটে পেটে ছুঁচোর কিত্তন শুরু হয়ে গেল । কোনো মতে উঠে গিয়ে বসলাম খাওয়ার টেবিলে । টেবিলে কোনো খাবার না দেখে রকুর মাকে ডাকলাম, “ রকুর মা ? আমার নাস্তা কই ?”

“ আমি তো ভাবসি আফনে নাস্তা খাইবেন না ।”

“ খাবো , নাস্তা দেও।”

“ নাস্তা তো নাই ।”

“ নাই মানে ?”

“ আমি খাইয়া ফ্যালাইসি । ভাবসি খাইবেন না ।”

“ একবার তো জিজ্ঞাসাও করনি ।” এমন জোরে কথাটা মুখ থেকে বের হল যে নিজেও ভাবতে পারিনি । রকুর মাও থমকে গেল । জীবনে এত জোরে কারো সাথে কথা বলিনি ।

“ আফা ভাত খান । বেশিক্ষণ লাগবো না । চুলা থেকে নামলেই টেবিলে দিয়া ডাকুমনি ।”

খুব খারাপ লাগছিল, তাই একটু অপরাধীর সুরেই বললাম, “ ঠিক আছে । সরি ।”

রকুর মা তার পান খাওয়া মুখে লাল লাল দাঁতগুলো বের করে হাসল । “ কিসু অইবনা আফা । বন ভাত দিতাসি । অহনই হইয়া যাইব । খালুও খাইতে চাইসে ।”

চমকে উঠলাম । “আব্বা বাসায় ?”

“ হ ” বলে রকুর মা হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ।



আব্বা তো এই সময় অফিসে থাকেন । সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে যান । দুপুরে বাইরেই খান । রাত দশটায় বাসায় ফিরেন , কখনো কখনো বারোটাও বেজে যায় । আব্বা খুব রাগী আর গম্ভীর । খুব বেশি দরকার না হলে আব্বার ছায়াও মারাই না । কিছু হলে আপুকে বলি । আপু ম্যানেজ করে । আব্বার সাথে আমার দূরত্ব অনেক ।

আব্বার ঘরের দিকে গেলাম । বাইরে দাড়িয়ে ডাকলাম, “ আব্বা ?”

“ কে ? সোহানা ? স্কুলে যাওনি ?”

“ না আব্বা ।”

“ কেন ?”

“ শরীর ভাল না ।”

“ ও আচ্ছা ।”

“ আব্বা ঘরে ঢুকবো ?”

“ ঢুকো ”

আমি আব্বার ঘরে ঢুকলাম । ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়লো, দেয়ালে টাঙানো আম্মার ছবিটা নামিয়ে ফেলা হয়েছে । আব্বা আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে বলল, “ কিছু বলবে সোহানা ?”

মন মেজাজের অবস্থা এমন ছিল যে, কোনো ভণিতা না করেই বললাম, “ জি আব্বা । আপনে বলে বিয়ে করছেন ?”

“ হু ” আব্বা চেয়ারে বসে ছিলেন । হঠাৎ সামনে টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখা বইগুলো আবার গোছাতে শুরু করলেন । সমস্ত রাগ, দুঃখ, অভিমান একটা শব্দের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এলো, “ কেন ?”

সারারাত জেগে পেটে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে অনুভূতিগুলো কেমন ভোতা হয়ে এসেছিলো । আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “ কেন বিয়ে করছেন ?”

“ তোমাদের দেখাশুনা করার জন্য একজন মানুষ দরকার ।”

“ এখন ?”

“ হ্যাঁ এখনই । মেয়েরা যখন বড় হয় তখনই মায়ের প্রয়োজন হয় বেশি ।”

“ আমার মা মারা গেছে । যাকে আপনি ভুলে গেছেন, যার ফটো আপনি নামিয়ে রেখেছেন, সেই আমার মা, আমার একমাত্র মা । আমার আর কোনো মা ছিল না হবেও না । হবে আপনার বউ ।” তারস্বরে চিৎকার করে ঘর থেকে হন হন করে বেরিয়ে গেলাম । আব্বা আমার দিকে একটিবারো চোখ তুলে তাকালেন না ।



“ রকুর মা ?” জোরে ডাকলাম

“ জ্যা আফা, দিতাসি ।”

“ আমার খাবারটা আমার ঘরে দিও ।” বলে নিজের ঘরে চলে গেলাম । ঘরে গিয়ে নিজের বিছানার উপর বসে হাঁপাতে লাগলাম । বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কে যেন দুরমুস পিটাচ্ছে । ঢক ঢক করে কালকে রাতের সেই জ্যোৎস্নার পানিটা খেয়ে ফেললাম । খালি পেটে পানি খেয়ে পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা করে উঠলো , তাড়াতাড়ি তাই পেটে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম । এভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি । ঘুম ভাঙ্গল আপুর ডাকে, “ ওঠ সোহু ওঠ । তিনটা বাজে ওঠ ।”

আমি হুরমুর করে উঠে বসলাম । কেমন যেন ঘোরের মত লাগছিল । কিছুক্ষণ পর যখন সম্বিত ফিরে পেলাম দেখি ক্ষুধাটা কেমন যেন মরে গেছে । রকুর মা দুপুরের খাবারটা চাপা দিয়ে রেখে গেছে টেবিলের উপর । খেতে একদমই ইচ্ছে করলো না । “ সোহু তুই হাত মুখ ধুয়ে আয় । আমি খাবারগুলো গরম করে এনে দিচ্ছি । আয়নাতে একবার দেখেছিস নিজেকে কেমন লাগছে ? চোখ মুখের কি অবস্থা বানিয়েছিস, যা হাত মুখ ধুয়ে আয় ।” বলে আপু খাবারগুলো গরম করতে নিয়ে গেল ।



প্রায় চারটা বাজে । রকুর মায়ের রান্না এই অবেলায় খেয়ে নাড়িভুঁড়ি পাকিয়ে উঠলো । দুই লোকমা খেয়েই উঠে হাতটা ধুয়ে ফেললাম । একটু পরে গেলাম আপুর ঘরে, তা নাহলে আবার বুঝতে পারবে যে তেমন কিছু না খেয়ে উঠে পরেছি “ আপু খাওয়া শেষ ।” আপু পিছন ফিরে টেবিলের উপর কাগজপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল , বলল , “ ঠিক আছে ” একটু চুপ থেকে ইতস্তত করে আবার বললাম, “ আপু , ঢ্যাঙার অপারেশন হয়েছে । বল্টুরা তো সবাই ক্লিনিকে দেখতে যাবে ঠিক করেছে, আমিও যাই ?”

“ হু জানি । বর্ণার কাছে শুনেছি । যাবি ? আব্বাকে তো বলতে হবে।”

খুব অভিমান হল । ঠোঁট উল্টিয়ে গাল ফুলিয়ে বললাম, “ থাক তাহলে দরকার নাই।”

আপু হেসে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, “ পাগলী, এত রাগ করিস কেন ? বোকা মেয়ে কোথাকার , ঠিক আছে আমিই আব্বাকে বলে দিব নাহয় । যাওয়ার আগে জামাটা পাল্টে নিস ।“

“ থ্যাঙ্কু আপু, তুমি গ্রেট । “ বলে এক ভোঁ দৌড় ।

যেতে যেতে শুনতে পেলাম আপু চিৎকার করে বলছে, “ আরে আরে জামা ?” আর জামা, তখন লাইসেন্স পেয়ে গেছি, হাতে আর সময়ও নাই , কে অত আমার জামা দেখবে !

“ জামা লাগবেনা, সময় নাই ।” বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলাম ।

আপু তখনও চিৎকার করে বলেই যাচ্ছে, “সাবধানে যাস । গলিগুলো পার হওয়ার সময় খেয়াল রাখিস , হঠাৎ করে গাড়ি চলে আসে, হর্ন টর্ন দেয় না । ভাল করে দেখে শুনে পার হোস ...”



নিচে গিয়ে এক বিব্রতকর অবস্থা । সবাই বেশ ফিটফাট হয়ে বাইরে পড়ার কাপড় পরে এসেছে, বেশ টিপটপ লাগছে । আর আমার পড়নে বাসার পুরনো জামা , পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল ।

বল্টু বলল, “ যাবি না ?”

“ যাব তো ”

“ যাবি তো জামা বদলাসনি কেন ?”

আমি মুখটা কাচুমাচু করে বললাম, “ এমনি ”

বিবিসি আঁতকে উঠে বলল, “ তোকে দেখে তো কাকতারুয়ার মত লাগছে!!! ”

সবাই আবার জামা বদলাতে চাপাচাপি শুরু না করে, একদম ইচ্ছা করছিলনা জামা পাল্টাতে । বললাম, “ থাক বাদ দে । জামা বদলানোর আর টাইম নাই ।“

আটিস বলল, “ থাক কিছু হবে না । সুন্দর লাগছে । ন্যাচারাল ন্যাচারাল ।“

টর্চ হঠাৎ খুব বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, “ তুমি তো আর্টিস্ট মানুষ , তোমার তো গোবর দেখলেও সুন্দর লাগে । এরকম অবস্থায় বাইরে যাওয়া যায় ?”

টর্চ তার ন্যাচারাল সৌন্দর্যটার উপর হালকা গোলাপি লিপস্টিক আর কাজলের ছোঁয়া লাগিয়ে এসেছিল বলে বোধ হয় আঁতে ঘা লেগেছিল ।

বল্টু সবাইকে তারা দিল, “ চল চল, বিকাল বিকাল আবার ফিরে আসতে হবে ।”

আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম । রাস্তার নেরি কুকুরটার মাথায় কি যে খেলল, আমাদের দেখে লেজ নাড়াতে নাড়াতে সঙ্গ নিল।



মাস্টারনী বলল, “ রুগি দেখতে যাচ্ছি খালি হাতে যাব ?”

সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাড়িয়ে পড়লাম , সত্যিই তো এখন উপায় ? আটিস হঠাৎ খুব উৎসাহ সহকারে বলল, “ ঢ্যাঙার ঐখানে অনেকগুলো হরলিক্সের বোতল ছিল ।এতগুলো কে খাবে দেখে ডাক্তার অ্যান্টি আমাকে একটা দিয়ে দিয়েছিলেন । সেটাই খবরের কাগজে মুরিয়ে দিয়ে দেই ।”

মহা এক উৎকণ্ঠা দূর হল । বল্টু বলল, “ হ্যাঁ নিয়ে আসো । খুলে খাওনি তো আবার ?”

“ না না আমি হরলিক্স খাই না ।” বলে আটিস দৌড় দিয়ে বাসা থেকে খবরের কাগজে মুড়িয়ে হরলিক্সের বোতলটা নিয়ে এলো।



আমরা আবার চলতে লাগলাম । নেরি কুকুরটা মাঝে মাঝেই নাক বাড়িয়ে হরলিক্সের বোতলটা শুকার চেষ্টা করছিল । বল্টুর হাতে থাকলে এতক্ষণে নির্ঘাত নাগাল পেয়েও যেত । আটিসের হাতে ছিল বলে রক্ষা । আটিস অবশ্য আমাদের চেয়ে দুই ক্লাস উপরে পড়ত দেখে সবার চেয়ে লম্বা, ঢ্যাঙার সমান ।

আমরা সেদিন ঢ্যাঙাকে দেখে এসেছিলাম । আমাদের কচি মনে সেদিনটা ছিল এক দারুন অ্যাডভেঞ্চার । আমার ছোটবেলা এই বল্টু বাহিনীর জন্য অসাধারন সব স্মৃতিতে ভরা । কিন্তু ধিরে ধিরে সবার বয়সটা যখন বাড়তে বাড়তে এমন এক সময় এসে ঠেকলো যে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড (অথবা অপকর্মকাণ্ড) বারবার ‘বয়সের দোষ’ নামক এই দুটো শব্দেরই আখ্যা পায় ---- তখনি ঘটতে শুরু করলো নানা রকম বিপত্তি ।

.........চলবে

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.