নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার প্যারালাল পৃথিবী

আমি বড়ই ভীতু মানুষ ।

আধার আলো

আধার আলো › বিস্তারিত পোস্টঃ

শেষের পাতা - ১৩

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৪২

[খুব দুঃখিত, অসুস্থতার জন্য অনেকদিন লিখতে পারিনি। আশা করি একটু ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]



ভোরের সজীব আলোয় শিশির ভেজা ঘাসের উপর খালি পায়ে দৌড়ে গেলাম শিউলি তলায়। আপুকে বললাম, “আপু তাড়াতাড়ি কর” আপু ওর ফ্রকের কোঁচাটা মেলে ধরলো। আঁজলা ভরা শিউলিগুলো ওতে ঢেলে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে আবার কুড়োতে লাগলাম। ছোট হাতে একবারে তিন চারটার বেশি ধরে না। আপুও কুড়োচ্ছে। হঠাৎ দেখি আব্বা এগিয়ে আসছেন। আমি ভয়ে থরথর করে কাপতে কাঁপতে আপুর পিছনে গিয়ে লুকালাম। উকি দিয়ে দেখি আব্বা একদম আমার কাছে এসে পড়েছেন। আপুর ফ্রকটা ভয়ে শক্ত করে ধরে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললাম। হঠাৎ শুনি আম্মা বলছে, “সোনা আমার, ওখানে লুকিয়ে আছিস কেন? আমার কাছে আয় মা” চোখ খুলে দেখি, আরে এটা তো আম্মা, আব্বা না। খুশির চোটে দৌড়ে গিয়ে আম্মার কোলে ঝাপিয়ে পড়লাম। কতদিন পর আম্মার সেই পরিচিত ঘ্রানটা নাকে এল। সত্যিই তো আম্মা! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। একটু অবাক হয়ে আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আম্মা তুমি না মরে গেছ?” আম্মা স্নেহ ভরে হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।



স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল। দুচোখ আমার তখনো বোজা, প্রাণপণে চেষ্টা করলাম স্বপ্নটা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু কিছুতেই আর ঘুম এল না। মাথায় কেউ একজন আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জানতে ইচ্ছা করল না কে। আম্মা যে আবার হারিয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই ধরে রাখতে পারছি না! চোখের সামনে আম্মার ছবিটা ফিকে হয়ে আসছে। লাল সাদা পাট ভাঙ্গা শাড়ীটা ধোয়াসে ধূসর, আম্মার মুখটাও একদম ঝাপসা। যেন অঝোর বর্ষায় দূর কোনো মুছে যাওয়া অবয়ব। আম্মা একেবারে মুছে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।



জলে ভেজা বোজা দুচোখ পাশে বসা মানুষটি থেকে আড়াল করতে পাশ ফিরে শুলাম। হাতের প্রচন্ড ব্যথায় সমস্ত শরীর কেপে উঠলো। জ্বরটাও তেমন ছাড়েনি, গা’টা পুড়ে যাচ্ছে। চোখদুটো খুলে দেখি বেয়ারা জলের স্রোতে দৃষ্টি ঝাপসা।

“সোহানা তুমি কাঁদছ মা?” জিন্তু কাকির গলা। “শরীর খুব বেশি খারাপ লাগছে? এই তো সাগর ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে এখনই এসে পড়বে। সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কর না” ঢ্যাঙ্গার বাবা, ডাক্তার কাকুকে আমাদের আব্বা আম্মা স্থানীয়রা সবাই ডাক্তার সাহেব বলে ডাকতেন। বুঝলাম কাকুকে ডেকে আনতে গেছে আটিস। কাকু খুব অসাধারণ ডাক্তার। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি উনার হাতে রুগী পড়লে রোগ নাকি বলে বাপ বাপ করে পালায়। কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। মনে হল মনের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি না পেলেও অন্ততপক্ষে শরীরটা তো যন্ত্রনাভোগ থেকে রেহাই পাবে। শরীরের টান টান ভাবটা কিছুটা শিথিল হয়ে এলেও জ্বরের দাপট আর হাতের ব্যথাটা বড্ড কাহিল করে ফেলেছে।

জিন্তু কাকির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না, চুপ করেই থাকলাম। আম্মার ঘ্রাণটা এখনো নাকে লেগে আছে। কিন্তু চেহারাটা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। ভাল লাগছিল না কিছু। মাথাটা দপ দপ করছিল। কথা বলতেও মনে হচ্ছিল অনেক কষ্ট। শুয়ে শুয়েই কেমন মাথা ঘুরছে। চুপচাপ পড়ে থাকলাম। জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন আর বাস্তব কেমন ঘোলাটে। কপালে আলতো হাতের ছোয়া অনুভব করলাম। শুনলাম কাকি হঠাৎ “নাহ” বলে উঠে গেলেন। সব কেমন আরো ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। শব্দগুলো দূরে দূরে। একটু পরে মাথায় ঠান্ডা এক টুকরো কাপড়ের স্পর্শে আবার চোখে ঘুম চলে এল। কলিং বেলটা বোধহয় বাজলো। দূরে কারো কথাবার্তার আওয়াজ। অস্পষ্ট হয়ে এল। আবার কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম।



আম্মার কোলে ছোট্ট একটা বাবু। কি সুন্দর ঘুমিয়ে রয়েছে। চেহারার মাঝে কি প্রশান্তি। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আম্মা এই বাবুটা কে? কোথায় পেলে?” আম্মা হেসে বলল, “এদিকে আয়, ধর” বলে আমি কাছে আসতেই আমার কোলে বাবুটাকে দিয়ে আদর করে আমার নাকটা ছুয়ে বলল, “বোকা মেয়ে নিজের বাচ্চাকেও চিনে না” আমি চমকে বাবুটার দিকে তাকালাম। কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। আমার বাবু অথচ আমার কিছুই মনে পড়ছে না। কি অদ্ভুত কান্ড! একবার মনে হল আমার তো বিয়েই হয়নি, আবার পরমুহূর্তে রাজিবের কথা মনে পড়ে গেল। আতকে উঠে বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালাম। নাহ! রাজিবের কোনো আদল নাই। হওয়ারও তো কথা না! তাও কেমন সন্দেহ হল। বাচ্চাটা আস্তে করে চোখ দুটো খুলে আমার দিকে তাকিয়ে দুহাত আমার মুখের দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি মুখটা নিচু করতেই ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলগুলো আমাকে ছুয়ে দিল। কি যে মজা লাগছিল। হঠাৎ ছোট্টবাবুটার চোখদুটোয় আমার দৃষ্টি আটকে গেল। ঐ চোখদুটো আমি চিনি। চমকে ভয়ে মুখ সরিয়ে নিলাম। এ কি করে সম্ভব!



ঘুমটা আবার ভেঙ্গে গেল। বিকালের লালচে আলোটা ফিকে হয়ে ঘরের আধারকে কেমন ঘোলাটে করে তুলেছে। ঘরের বাতিটা এখনো জ্বালানো হয়নি। চারদিকে থমথমে একটা ভাব, গুমোট একটা আবহাওয়া। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। মাথার উপর হাল্কা করে পাখাটা ছাড়া। কেমন বিচ্ছিরি একটা শব্দ করে ঘুরছে, বাতাস পাচ্ছি না, শুধু শুধু বিরক্তিকর একটি শব্দ, গরম লাগছে। বুঝতে পারলাম ঘাম দিয়ে জ্বরটা সম্পূর্ণ সেরে গেছে। জামাটা পিঠের সাথে লেপ্টে রয়েছে, খুব অস্বস্তি লাগছিল। বিছানায় উঠে বসতে গিয়ে দেখি হাতের ব্যাথাটাও অনেক কম। হঠাৎ চমকে উঠলাম। আগে খেয়াল করিনি, কে জানি চেয়ারে বসে টেবিলে দুহাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। মনে হল আটিসই হবে। তাইই হবে। ও’ ছাড়া কে আর আমার জন্য এভাবে বসে থাকবে। উঠে বাতিটা জ্বালালাম। এবার চিনতে আর অসুবিধা হলনা। অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে, সন্ধের বাতিটাও জ্বালানোর আর হুঁশ হয়নি। সারাদিন ওর উপর খুব ধকল গেছে নাকি কে জানে।

আস্তে করে ডাকলাম, “আটিস” ও’ ধড়মড় করে উঠে বসলো। চুলগুলো উস্কোখুস্কো, মুখটা শুকনো। কাচা ঘুম ভাঙ্গাতে চোখগুলো ঘুমে ঢুলু ঢুলু লাল। দেখে খুব মায়া লাগছিল। কিছু খায়নি নাকি সারাদিন? চেহারার এমন অবস্থা? বসে থাকতে থাকতে কেমন ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারা।

“সোহানা তুমি ঐখানে? দাড়িয়ে আছো? দেখো, মাথা ঘুরে না যায় আবার” বলে চিন্তিত মুখে কাছে চলে এল। আমি আলনা থেকে কাপড় নিতে নিতে বললাম, “চিন্তা কর না, এখন অনেক ভাল লাগছে, জ্বরটা আর নাই, শুধু খিদায় মরে যাচ্ছি”

“দুপুরের খাবারটা তো আছে। জিন্তু কাকি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তুমি নাহয় কাপড় বদলিয়ে আসো। আমি খাবারটা রেডি করছি। দেখ, ঠিক আছে তো সব? মাথা ঘুরছে না তো?”

“না না তুমি চিন্তা কর না, মাথা ঘুরছে না” বলেই, এত ক্লান্ত শরীরেও একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারলাম না, বললাম, “এত চিন্তা করছো কেন? আমি কি খুব ভারি নাকি?” ওর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা দেখার জন্য চোখ ফিরাতেই দেখি ও’ কেমন যেন অন্যরকম করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এত আপন, এত গভীর চাহনি, নিঃশ্বাসটা এক ঝটকায় আটকে গেল। হঠাৎ বহুদিন আগের চাপা পড়া সব স্মৃতিগুলো বাঁধভাঙ্গা জলরাশির মত ছুটে বেরিয়ে আসতে লাগলো, ছোটকালের আটিস, বড়কালের আটিস, সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। স্মৃতিতে যেন আবার অনুভব করলাম ওর বুকের মাঝের ওমটুকু, কি রকম এক শান্তি, এক নিশ্চিন্ততা, এক ভাল লাগা, মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হয়েছিল আমার জীবনের সবকিছু যেন ঠিকই আছে। আবার খুব ইচ্ছা করছিল ওর বুকের মাঝে ছুটে গিয়ে মুখ গুজে থাকতে, পরম নিশ্চিন্তে চোখদুটো বুজে থাকতে। বুজে থাকা চোখগুলো আবার যখন খুলব মনে হবে যেন সব স্বপ্ন, আম্মার চলে যাওয়া, আব্বার আবার বিয়ে করা, আমার এই সাজানো নাটক, সব মিথ্যে।



চিন্তাগুলো আমার স্তরে স্তরে গুছিয়ে রাখা অনুভুতিগুলোকে ওলটপালট করে দিচ্ছিল। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না, ওর চোখের এই দৃষ্টি, এই ভাষা ন্যায় অন্যায়ের সূক্ষ্ম সীমারেখায় দিশাহারার মত দাড় করিয়ে দিল আমাকে। ওর বুকের মাঝে আশ্রয়ের জন্য তীব্র তাড়নায় চোখের ভাষায় এক বুভুক্ষের ছাপ পড়েছে আঁচ করে চোখটা নামিয়ে নিলাম। এ আমার ভুল হচ্ছে। জানি না মিথ্যচার কার সাথে করছি, তবে আমার এ চিন্তা, এ অনুভুতি খুব ভুল, খুব অন্যায়।



তাড়াতাড়ি পরনের কাপড়গুলো নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে তাতে হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকলাম। অনুভুতিগুলো এমন নিরলজ্জভাবে আমার ভাবনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে যে নিজেকে নিজের কাছে খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে। ওভাবে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় অনুভুতিগুলো থিতিয়ে এসে মনটা নানা দ্বিধা দ্বন্দ্বময় প্রশ্নে ছেয়ে গেল। আটিসকে কেন আমি আমার অনুভূতিটা বুঝতে দেই না? নাকি বুঝতে দিতে চাই না? নাকি রাসেল ভাই যেমন বলেছিলেন, আমার সত্যিই ওর প্রতি কোনো ফিলিংস নাই? এই বিয়ে থেকে মুক্তি পাওয়ার অবলম্বন হিসাবে ওকে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম? ওর প্রতি আমার ভালবাসাটা আসলে মরীচিকামাত্র? জ্বর থেকে ভুগে ওঠা দুর্বলতায় মনটাও আসলে হয়তো দুর্বল। আর বিবাহিত একজন মানুষের পক্ষে চিন্তাগুলোও অন্যায়। যদিও নিজেকে বিবাহিত মনে হয়না, তাও এরকম করে কিভাবে থাকা সম্ভব। আটিসকে তো আমি বেধে রাখতে পারিনা। ও’ কি এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে? ওর কথা চিন্তা করলেই যে বুকটা হুহু করে ওঠে, মনটা কেমন হয়ে যায়। হায়রে মন! কিছুতেই যে মানে না, কিছুতেই না, মনে হয় সব কিছু ছেড়ে, ছুটে যাই ওর কাছে। খুব কষ্ট হচ্ছে, ভেবেছিলাম বিয়ের পর এই কষ্টটা চলে যাবে, গেল না তো। জামা পালটে হাতমুখ ধুয়ে খাওয়ার ঘরে গিয়ে দেখি আমার জন্য খাবার রেডি করে আটিস অপেক্ষা করছে। নিজেকে সামলে নিলাম। ওর সামনে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম,

“কি? এতক্ষন বাথরুমে ছিলাম, একবারও মনে হয়নি আমি মাথা ঘুরে পরে গেলাম নাকি?”



ওর মুখে কেমন মলিন ছাপ, হালকা হেসে বলল, “বাথরুমের দরজার নীচ দিয়ে তোমার পায়ের ছায়া দেখছিলাম এতক্ষণ। তারপর তোমার কলের ঐ ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শুনে বুঝলাম ঠিক আছ, এসে খাবারটা রেডি করলাম, আর একটু হলে ডাকাডাকি শুরু করতাম”

“তুমি খেয়েছো?” আটিসকে জিজ্ঞাসা করলাম। ও’ অন্যদিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বলল “খেয়েছি”

“তুমি খাওনি। যা খেয়েছ তাকে খাওয়া বলে না। আমার সাথে বস”

“থাক, তুমি আগে খেয়ে নেও”

হঠাৎ খুব রাগ হল, বললাম, “আমার সাথে খেলে কি তোমার জাঁত যাবে?” বুঝতে পারি না ও’ খেতে বসা নিয়ে এমন করে কেন আমার সাথে। আগেও দেখেছি ও’ কেন যেন আমাদের বাসায় খেতে চায় না। খাওয়ার সময় শুধু আমার বন্ধুরা না, যেই আমাদের বাসায় আসুক না কেন, থালা নিয়ে সোজা খেতে বসে যায়। যা থাকে তাই দিয়েই খেয়ে ওঠে। আম্মা বেঁচে থাকতে আমাদের বাসার এই রীতি চালু হয়েছিল, আম্মা কাউকে না খাইয়ে যেতে দিত না, আম্মা চলে গেছে, কিন্তু এই রীতিটা থেকে গেছে।

উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “খাব না” বলে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলাম। ও হঠাৎ আমার ডান হাতটা ধরে কাছে টেনে নিল। বুঝতে পারিনি ও’ এমন করবে, তাই ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গেলাম। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর মাখা কন্ঠে বলল, “আমি খাইয়ে দেই?” যেন আমি ছোট একটা বাচ্চা। বড় বড় চোখে বিস্মিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম, “তোমার কি হয়েছে আটিস? তুমি হঠাৎ এমন করছো কেন?” “আজকে তোমার শরীরটা খারাপ সোহানা, রাগ কর না, খাইয়ে দেই” আমি একটু পিছিয়ে এলাম, একা না খেতে পারার মত শরীরের অবস্থা আমার না, তাও কেন আটিস এরকম করছে? শুধু আমার মান ভাঙাবার জন্য? ও আমার হাতটা ছাড়লো না, বরং হাতটা ওর হাতের মধ্যে গোল করে ধরে বুকের মাঝে চেপে ধরলো, বলল, “সোহানা, রোহু আপু তোমাকে ছোটবেলায় কত আদর করে খাইয়ে দিত। কত্ত আদর করতো, মনে পড়ে?” অবাক হয়ে গেলাম ভাত খাওয়া নিয়ে হঠাৎ আপুর কথা কেন? তাও আবার আমার হাতটা এভাবে বুকের কাছে ধরে? কেন জানি মনে হতে লাগলো আটিস আপু সম্বন্ধে কিছু বলবে। কিন্তু এভাবে এত ভণিতা করে কেন?



খুব সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললাম, “পড়বে না কেন?” মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি দানা বাধতে শুরু করলো। প্রথমে এমন অদ্ভুত আচরণ, তারপর আপুর প্রসঙ্গ টানা। কেমন ভয় ভয়ও করতে লাগলো। আপুর সাথে সম্পর্কটা আপুর বিয়ের পর থেকে যে অদ্ভুত এক অভিমান ভরা টানাপড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তার একটা সূক্ষ্ম জের যেন রয়েই গেছে। স্বার্থপরের মত শুধু সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করেছি, কিন্তু কখনই কেমন আছে জানার জন্য ফোনের রিসিভারটা উঠাতে ইচ্ছা করেনি। তবে এক্ষেত্রে জীবনের মোড়টা এমন আকস্মিকভাবে ঘুরে যাওয়াতে সমস্ত ইচ্ছাগুলো মরে গেলেও অনিচ্ছার চেয়ে অভিমানটাই বোধ হয় বেশি কাজ করেছে। আব্বা আমাকে এই বিয়েতে দাবার চাল হিসাবে যখন ব্যবহার করছিল তখন আপুর দুর্বল প্রতিবাদটা দেখে অভিমানটা চলে যেতে যেতেও কেন জানি যায়নি। রাজিবের সাথে বিয়ের পর পর একবার আপু ফোন করেছিল জানার জন্য কেমন আছি, বলেছিলাম যে, সেটা জানার জন্য তোমার ফোন করে আমার মুখ থেকে শুনতে হবে? আপু কিছু বলেনি। মনে খুব আঘাত পেয়েছিল নিশ্চয়, বুঝতে দেয়নি, আমিও হাপিয়ে ওঠা মৃত অনুভুতি নিয়ে বুঝতে চাইনি। ওইটাই আপুর প্রথম আর শেষ ফোন। এছাড়া আমি নিজের স্বার্থে তিনবার ফোন করেছিলাম, একবারও জানতে চাইনি কেমন আছে। ব্যাস এইটুকু। কিন্তু আজকে কেন বুকটা এমন ধক করে উঠলো?



“কি হয়েছে আটিস? বলনা কি হয়েছে?” অসহায় ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম। “কি হবে? কিছু হয়নি” অন্য দিকে তাকিয়ে কেমন যেন দুর্বল স্বরে বলল ও’। আমার মাথায় হঠাৎ রক্ত চড়ে গেল। ওর শার্টটা দুহাতে খামচে ধরে রাগে দুঃখে, জ্বরে ভুগে ওঠা শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “আটিস তুমি বল, আপুর কিছু একটা হয়েছে, তাই না? বল তাই না?” উত্তেজনায় হাতের কথা মনে ছিল না, শার্টটা ওভাবে ধরতেই বাঁ হাতটা আবার ব্যাথায় টন টন করে উঠলো আর সেই সাথে ওর শার্টের কলারের নিচের দ্বিতীয় বোতামটা ছিড়ে গড়াতে গড়াতে খাওয়ার টেবিলের নিচে চলে গেল। দুজনে কিছুক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে থাকলাম। হাতদুটো আলগা হয়ে আসতে শার্টের ছেড়া বোতামের স্থানটির দিকে চোখ পড়লো। হাতের ব্যাথাতে উত্তেজনাটাও একেবারে থিতিয়ে এসে চোখদুটো জলে ভরে উঠলো, অপরাধীর মত বললাম, “সরি”

“ব্যাথা পেলে তো? দেখি হাতটা”

আমি “না কিছু হয়নি” বলে সরে খাওয়ার টেবিলের চেয়ারটা ধরে উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলাম। চোখে চলে আসা জলটুকু গাল বেয়ে পড়ার আগে আড়াল করতে চেয়েছিলাম।

আটিস ঠিক আমার সামনে এসে দাড়াল, আলতো করে ওর ডান হাতটা দিয়ে আমার গালে বেয়ে পড়া জলটুকু মুছে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বলল, “তুমি জানো না সোহানা? তোমার কষ্ট যে আমি সহ্য করতে পারি না? চল আমিও তোমার সাথে খাচ্ছি, খেতে খেতে সব বলছি” ওর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতে ইচ্ছা করছিল না। মনে হচ্ছিল ওভাবেই সব কথাগুলো শুনি। ও কি বুঝে না? সত্যিই বুঝে না এভাবে আমার কষ্টটা ও’ কতগুণ বাড়িয়ে দেয়। হাত ধুয়ে খেতে বসলাম, আমার পাশে আটিস।

আমি চুপচাপ খেতে খেতে মাঝে মাঝে আটিসের দিকে তাকাচ্ছিলাম। চাচ্ছিলাম ও’ নিজ থেকে কথা শুরু করুক। সব খাবার বিস্বাদ লাগছিল। কোনোমতে চার পাঁচ লোকমা খাওয়ার পর, অবশিষ্ঠ ভাতটুকু প্লেটের মধ্যে এমনি নাড়াচাড়া করছিলাম। আর খেতে ইচ্ছা করছিল না। ও’ এই জন্যই অপেক্ষা করছিল নাকি কে জানে, তবে খাওয়ার প্রতি আমার এই অনিহা দেখার পর অবশেষে বলা শুরু করলো। কিন্তু ও’ যা বলল তা শুনে ভিতরে ভিতরে আরো কুঁকড়ে গেলাম। আমি যেবার আপুকে ফোন করেছিলাম, রাসেল ভাইকে কেন পাঠালো জানার জন্য, তখন আপুর আর্লি প্রেগন্যান্সি ছিল, কিছু কমপ্লিকেশন হচ্ছিলো, সোয়েব ভাইকে সেজন্য আপুর ইন্টার্নীর ডিউটিগুলো করে দিতে হচ্ছিল। মাঝে কিছুটা ঠিক হয়ে আসলেও কিছুদিন হল আপুর একটু বেশিই অসুস্থ লাগছিল। আজকে সকাল দশটায় হঠাৎ ইমারজেন্সি ডেলিভারি করতে হয়েছে। আপুর মেয়ে হয়েছে, ভাল আছে। তবে আপুকে আই সি ইউ-তে রাখতে হয়েছিল, অবস্থা তেমন ভাল ছিল না ডেলিভারির পর পর। বিকাল চারটার দিকে একটু একটু করে ভালর দিকে যাচ্ছে, রাতে হয়তো কেবিনে নিয়ে আসবে। আমি চুপচাপ শুনছিলাম, গলা দিয়ে ভাত নামছিল না। “আটিস?” প্লেটের ভাতটা নাড়তে নাড়তে ক্ষীণ কন্ঠে ডাকলাম ওকে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো, বুকের ভিতর দলা পাকানো একটা কষ্ট। কথা সরছিল না মুখ দিয়ে। তাও কোনো মতে ওকে ডাকলাম। দৃষ্টি এখনো আমার প্লেটের দিকে, ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। নিজেকে প্রচন্ড অপরাধী মনে হচ্ছিল। চোখের কোণ দিয়ে বুঝতে পারলাম ও’ আমার দিকে তাকালো। চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, “আপুকে দেখতে যাওয়া যাবে?” কেমন যেন পর পর লাগছিল নিজেকে। কোনদিন যে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকা আপুকে দেখতে চাওয়ার অনুমতি নিতে হবে ভাবতে পারিনি। ও’ তো আমার আপু, আমি তো এক দৌরে ছুটে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরবো! অনুমতি লাগবে কেন?



“তুমি আরেকটু সুস্থ হও, তোমার হাতটা আরেকটু ঠিক হোক, এখন ঐরকম ঘা নিয়ে না যাওয়াই ভাল। একবার কোনো খারাপ ইনফেকশন হয়ে গেলে সমস্যা”

“ও আচ্ছা”

“মন খারাপ কর না সোহানা, জিন্তু কাকি এলেই খবর পাওয়া যাবে, তুমি আরো দু’একদিন পর নাহয় যেও, ততদিন আমি খবর এনে দিব তোমাকে”

“জিন্তু কাকি?”

“জিন্তু কাকি, বর্ণাপু দুজনেই রোহু আপুর কাছে গেছে”

“ও….” বুঝলাম দুনিয়ার সবাই আপুকে দেখতে যেতে পারবে, শুধু আমি ছাড়া। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আব্বা জানে?”

“ইউনুস কাকাকে দুপুরে পাঠিয়ে দিয়েছি দেশে, রাত নাগাদ খবর পেয়ে যাবে আশা করছি” ইউনুস কাকা আব্বার বহু পুরনো কর্মচারী, আব্বার ডান হাত বললেও ভুল হবে না, আমাদের পুরো পরিবারের নাড়ি নক্ষত্র সব তার জানা। বুঝলাম আব্বা ঠিকই খবর পাবে, কিন্তু তারপর আব্বার প্রতিক্রিয়াটা ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না। আব্বা আমার কাছে খুব অপরিচিত একজন মানুষ হয়ে গেছে।



আটিসের দিকে তাকিয়ে খুব আশা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপুর বাবুটা কই আটিস?”

ও’ একটু ইতস্তত করে হতাশ সুরে বলল, “হাসপাতালেই” বলেই আমার দিকে তাকাল। “আপু তো ইমপ্রুভ করছে ভালই, দু’একদিনের মধ্যে হয়তো ছেড়ে দিবে, তখন একবারে বাসায় গিয়ে দেখে আসতে পারবে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব”

“দু’একদিন পর কি আমি আর এখানে থাকবো?”

“এই হাত নিয়ে ওই বাসায় গেলে তোমাকে দেখবে কে?”

“ওখানে আমার দেখার যে আছে, সেই দেখবে” চোখটা আবার প্লেটের দিকে ফিরিয়ে নিলাম।

বেশ কিছুক্ষণ দুজন চুপচাপ বসে যে যার প্লেটের ভাতগুলো নাড়তে থাকলাম। কেউই ভাত খাচ্ছিলাম না। দুজনেই কেন যেন বসে আছি। গরম ভাতগুলো ঠান্ডা হয়ে গেছে। শরীরটাও খুব ক্লান্ত লাগছিল। হঠাৎ আটিস আমাকে ডাকল, “সোহানা”

“হুমম”

“তুমি ঐ বাসায় ফিরে যেও না”



ওর দিকে এক পলক একটু রাগ রাগ চোখে তাকিয়েই চেয়ার থেকে উঠে হাত ধুতে গেলাম। হাত ধুয়ে পিছন ফিরে দেখি ও’ আগের মতই বসে আছে, দৃষ্টিটা প্লেটের দিকে, মাথাটা একটু নোয়ানো। জ্বরটা এমন কাবু করে ফেলেছে আমাকে, চোখে বার বার জল এনে দিচ্ছে। খুব অভিমান ভরে বললাম, “কেন ফিরে যাব না? কিসের জন্য আমি থাকব এখানে?”

আটিস মাথা নিচু করেই আস্তে করে বলল, “আমার জন্য, সোহানা”

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ঘুম থেকে উঠার পর সারাক্ষণই কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে। ডান হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেদে ফেললাম। আটিস এমন করছে কেন আমার সাথে?

ও’ চেয়ার থেকে উঠে আমার একদম কাছে চলে এল। বলল, “আমি তোমাকে আর যেতে দিব না। সারাজীবনের জন্য আমার কাছে রেখে দিব। তোমাকে ছাড়া আর এক মুহূর্তও থাকতে পারব না, সোহানা”

ওর দিকে রাগ অভিমান ভরা চোখে তাকিয়ে ধরা গলায় বললাম, “তুমি আমাকে এত কষ্ট দেও কেন? যেটা অসম্ভব……” কথা শেষ করতে দিল না ও’, বলল, “সম্ভব, আমি সম্ভব করে নিব, সোয়েব ভাইয়ের সাথে…………”

হঠাৎ বাইরের কলিং বেলটা বাজলো।

......চলবে





১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব ৮ম পর্ব ৯ম পর্ব ১০ম পর্ব ১১তম পর্ব শেষের পাতা - ১২

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৮

অর্ধমানব ও অর্ধযন্র বলেছেন: রোহু আপু কি চলেই গেল? কেমন কেমন জানি মনে হচ্ছে।

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:২৩

আধার আলো বলেছেন: ভাইয়া পুরাটা পরেননি তাই না? :D আপনাকে আর কি বলবো আমার নিজের লেখা নিজেরই পড়তে ইচ্ছা করে না। :( আপু রিকভার করিতেছে এবং সুস্থ শরীরেই আগামী পর্বে উপস্থিত হবে। আপনে ভাল থাকিবেন।

২| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:০৭

স্বপনচারিণী বলেছেন: ভাল লাগলো। কিন্তু সেই টান টান সুতোটা ছিঁড়ে গেছে। দেখি জোড়া লাগে কিনা।

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:৩৬

আধার আলো বলেছেন: সুতোটা যে ছিঁড়ে গেছে আমি নিজেই অনুভব করেছি, কিন্তু জোড়া লাগানোর ক্ষমতাটাও কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি। পরবর্তী পর্বটা ইতিমধ্যে কতবার যে লিখতে শুরু করেছি আর মুছে ফেলেছি তার ইয়োত্তা নেই। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ল্যাপটপটা ছুঁড়ে ফেলে দেই। কি আর করব। :( আপনে ভাল থেকেন।

৩| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪৪

ইকরাম বাপ্পী বলেছেন: লেখিকাও কি সোহানার মতন অসুখ হল নাকি? এটা ঠিক......... পড়ার টানটা কেমন যেন কমে গেছে...... পারবেননা আবার কয়েকটা পর্ব একই সাথে বা খুব কম সময়ের ব্যবধানে দিয়ে আবার সেই টান ফিরিয়ে আনবেন...... তবে তার সাথে সাথে শরীরের যত্ন নেবেন...... আবার অসুস্থ হয়ে যান না যেন...... ভালো থাকবেন......

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:০৩

আধার আলো বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া। দেখি টান ফেরে কিনা। না ফিরলে আর কি করবো। টান ছাড়াই লিখতে হবে। :( বুড়ী হয়ে গেছি তাই এট্টু আট্টু অসুখ লেগেই থাকে। ভাল থাকবেন ভাইয়া।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.