![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দিহানের সমস্ত শরীর খুব দ্রুত নিস্তেজ হয়ে আসছে। খুব কষ্ট করে বাঁ হাতটা উঠাতে চেষ্টা করলো। কাপা হাতটা বিছানা থেকে দু ইঞ্চির মতো উপরে উঠেই আবার ধপ করে পরে গেল। চোখের পেশীগুলো এখনো তাও কিছুটা কাজ করছে। মাথাটা স্থির। অনেক আগেই গলার বাইরের মাংসপেশিগুলো অবশ হয়ে গেছে, মাথাটা কিছুতেই ঘুরিয়ে দেখতে পারছে না, মিলি কি করছে। সকালে চা’টা দিয়ে মিলি ব্রেকফাস্ট বানাতে যায়। দিহানের অভ্যাস ঘুম থেকে উঠেই রোজ সকালে বাসিমুখে এক কাপ চা খাওয়া। আজ সকালের চায়ে চুমুক দিয়ে অন্যরকম কিছু মনে হয়নি। রোজদিনকার মতই সেই চেনেশুনা চা। অবশ্য বুঝার কথাও না। সি এফ-ওয়ান টোয়েন্টি একেবারেই বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদহীন চিনি সদৃশ একধরনের ক্রিস্টাল। যে কোন খাদ্যের সাথেই মেশানো হোক না কেন মুহূর্তের মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে সেটা আলাদাভাবে সনাক্ত করা একদম অসম্ভব হয়ে পরে। এটা একধরনের বিষ যা সাধারন হাসপাতালগুলোর টক্সিকোলজি বিভাগে নির্ণয় করা যায়না। আমেরিকার আর্মফোর্সেসের বাইয়োটেকনোলজি উইং-এর রিসার্চ ডিভিশনের অধীনে লেভেল ফোর ক্লিয়ারেন্সের প্রোটকল বি-নাইন্টিনের একটা প্রজেক্ট-এর ফল এই সি এফ-ওয়ান টোয়েন্টি। আর তাই এর সনাক্তকরণ কিট ও অ্যান্টিডোটটাও শুধুমাত্র এখানেই রয়েছে। প্রোজেক্ট ডাইরেক্টর ডঃ মিনহাজুর রহমান দিহান। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভারসিটি স্কুল অভ মেডিসিনে থাকতে বাইয়োমলেকুলার সাইয়েন্সের সাথে ন্যানোটেকনলজি প্রয়োগে তার ‘ইন্ট্রাসেলুলার আনডিটেক্টেবল ডেলিভারি ডিভাইস’ ছিল মেডিক্যাল সাইয়েন্সে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি নামকরা পত্রিকায় প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে ছবি সহ ছাপা হয়েছিল তার এই অসামান্য কৃতিত্বের কথা। এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। একদিন বিকালে ইভনিং ওয়াকের সময় মুখে ভদ্রতার কলুপ আঁটা দুজন সাধারন পোশাকধারী ব্যাক্তি দিহানকে বাধ্য করল তাদের পাশে রাখা গাড়িটিতে উঠতে। চোখ বাধা অবস্থায় দিহানকে শেষমেশ একটি ঘরে এনে উপস্থিত করে চোখের বাধন খুলে দিয়ে দুজন চলে গেল। চোখ খুলেই প্রথম সে দেখতে পেল তার সামনে দণ্ডায়মান প্রায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার এক ব্যাক্তি। যার তুলনায় দিহানের নিজেকে মনে হল অতি ক্ষুদ্রকায় একটি পিপড়া ছাড়া কিছু নয়। আর্মি ছাটের কাঁচাপাকা ছোট ছোট চুল আর সুঠাম দেহের ক্লিন সেভ করা এই ভদ্রলোকের বয়স আনুমানিক পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে কোথাও হবে। নিজের পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক, আর্মি বাইয়োটেকনিকাল অপারেশনসের ডাইরেক্টর জেনেরাল ডঃ হামফ্রি ডেইলহাম। এই ভদ্রলোকেরই বাসার ড্রয়িং রুমে দিহান দাড়িয়ে। সোফায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে খুব অমায়িকভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেয়ার ফর সাম টি ডঃ মিনয়্যাজ?” দিহান মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাল। এখানে তাকে এভাবে নিয়ে আসার কি অর্থ, সেটা না জানা পর্যন্ত তার পুরো বাপারটাই খুব অসস্তি লাগছিল। আর তা ছাড়া বাঙালিদের চা আর বিদেশিদের চা আকাশ পাতাল পার্থক্য। খেলে বমি আসে। ডঃ হামফ্রি দিহানের হাতে তিন দিনের পুরনো একটি খবরের কাগজ হাতে ধরিয়ে দিলেন। ‘গ্রাউন্ড ব্রেইকিং ব্রেইক থ্রু ইন মেডিক্যাল সাইয়েন্স’ হেডিংটার দিকে আঙুলটা নির্দেশ করে ইংরেজিতে বললেন, “আপনার সাহায্য আমাদের খুবই দরকার, প্লিজ” দিহানের মনে অনেকগুলো চিন্তা একসাথে খেলে গেল। ডাঃ হামফ্রির সাহায্য চাওয়ার ধরনে এত গোপনীয়তা নির্দেশ করে দিহানকে তিনি অনুরোধের আড়ালে আসলে আদেশ করছেন এবং এক্ষেত্রে দিহানের অপারগতা প্রকাশ মানে তার নিজ জীবনের উপর হুমকি বয়ে আনার সম্ভাবনা। এই কিছুদিন আগেই প্রায় বছরখানেক হবে, ইউনিভারসিটির অভ নিউ সাউথ ওয়েলসের ডাঃ টমাস ব্রাউন ‘ডি এন এ স্প্লাইসিং ইন্টারসেপশন অ্যান্ড আরটিফিশাল কোডোন ইন্ট্রোডাকশন’ নিয়ে গবেষণাটার প্রায় শেষের দিকে আত্মহত্যা করেন। তার মৃত্যুর ঠিক তিন দিন আগে দিহানকে সেলে কল দিয়েছিলেন। খুব উত্তেজিত শোনাচ্ছিলো তাকে।
“আই ডিড ইট ডিয়ান। আই ডিড ইট, আই সল্ভড দা লাস্ট পিস অফ দা পাযল”
“টম দ্যাটস ফ্যান্ট্যাস্টিক!!!” দিহান খুশীতে সত্যিই এক লাফ দিয়েছিল। ডাঃ টমাস ব্রাউনের অধীনেই ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভারসিটি স্কুল অভ মেডিসিনে দিহান তার পি এইচ ডি থিসিসটা করে। তখন থেকেই বছর দশেক ব্যাবধানের এই অসমবয়সী, অসম্ভব প্রতিভাবান কাজপাগল বিজ্ঞানীদ্বয়ের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পরে ডাঃ ব্রাউন নিউ সাউথ ওয়েলসে চলে গেলেও সেল ফোনের দৌলতে তাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকে।
দিহান জিজ্ঞাসা করলো, “ডিড ইউ টেল এইমি?”
“নো, আই হ্যাভন্ট টল্ড এনিওয়ান। ইউ আর দা ফার্স্ট টু নো। আই অ্যাম গোয়িং টু টেল এইমি টুমরো, ইটস হার বার্থডে ইউ নো, ইটস গোয়িং টু বি এ সারপ্রাইজ” পরের দিন থেকে ডাঃ ব্রাউন নিখোঁজ এবং আরো দুইদিন পর তার স্ত্রী এইমি তাদের লিভিং রুমের সিলিং ফ্যানে তার ঝলন্ত মৃতদেহটি দেখতে পান।
ডাঃ হামফ্রি আর কোনো ভনিতা না করে সাহায্য চাওয়ার কারনটা দিহানকে সরাসরি বলল। দিহানের এই নতুন আবিষ্কৃত টেকনোলজির মাধ্যমে তারা মানব শরীরের সকল কোষে সি ওয়ান নাইনটিন নামক এক ধরনের পদার্থ প্রবেশ করাতে চায়, যেটার কাজ কিনা মানবদেহের কোষসমুহের মেটাবলিযম অস্বাভাবিক রকমের কমিয়ে আনা, যাতে কোষসমুহ সুপ্ত নিদ্রার মাধ্যমে দেহটিকে বাচিয়ে রাখবে অথচ কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে প্রাণের স্পন্দন নির্ণয় করা যাবে না। অর্থাৎ সেই জীবন্ত ব্যাক্তিটিকে মৃত হিসাবে ঘোষণা দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা দুটি- প্রথমটি হচ্ছে সি ওয়ান নাইনটিন এখনো আনস্টেবল আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে এটা অতি সহজে সকল ফরেনসিক ল্যাবে সনাক্ত করা যায়। এই দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে দিহানের সাহায্য তাদের প্রয়োজন।
প্রটোকল বি নাইন্টিনের কয়েকটি প্রোজেক্টের মধ্যে একটি প্রজেক্ট এই সি ওয়ান নাইন্টিন তৈরি, মানব শরীরে আনডিটেক্টাবলী প্রবেশ ও সঠিক কার্যকারিতার উপর। দিহান এখানে দুই বছর চার মাস পাঁচদিন কাজ করেছে। তাকে যে কারনে এখানে মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে নিয়োগ করা হয়েছে, সে কাজটি তার তিনমাস আগেই শেষ। প্রতি মাসে সে মিলির সাথে সাতদিন করে কাটিয়ে এসেও নির্দিষ্ট সময়সীমার আগেই তার কাজ শেষ করেছে। মিলি জানে মানুষের জটিল কিছু রোগ নিরাময়ের জন্য দিহান তার আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে মানব কল্যানে রিসার্চের কাজে নিয়োজিত। স্বামীকে নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। হোম ইকোনমিক্স থেকে অনার্স পাশ করে দিহানের সাথে বিয়ের পর পরই অ্যামেরিকায় চলে এসে এতদিন একটু টানাটানির মধ্যেই দিন কেটেছে তার। দিহানকে সে কোনদিন বুঝতে দেয়নি তার কষ্টটা। দশ বছর প্রেমের পর এই বিয়ে। মিলি মুখ ফুটে কিছু না বললেও দিহান প্রতিটি মুহূর্তে মিলির কষ্টটা টের পেয়েও নিশ্চুপ থাকতো। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতো। তাই প্রচুর অনিচ্ছা সত্তেও এই আর্মি প্রোজেক্টে কাজ করলেও, প্রতিমাসে মিলির হাস্যজ্জল মুখ আর তাদের ঘরদোরের দৈন্যতার ছাপ মুছে গিয়ে চকচকে ভাবটা দেখে তার ভালোই লাগতো। মিলিও মাসের বাকি দিনগুলো এতদিনের উইন্ডো শপিঙের বদলে আসল শপিং করে বেশ খুশিই থাকতো। তার নতুন প্রতিবেশী হেলেনের সাথে বেশ সখ্যতাও গড়ে উঠেছে। দিহান কাজে যোগ দেয়ার কিছু দিনের মধ্যেই হেলেন মিলির নিঃসঙ্গ জীবনে যেন এক আশীর্বাদ। হেলেন আবার সাউথ কোস্ট প্লাজা শপিংমলের একটি প্রসাধনী দোকানের সেলস গার্ল। মাঝে মাঝে কোনো জিনিস সেল-এ দিলে সাথে সাথে মিলিকে খবর দেয়। দুজন মিলে স্যাটারডে নাইট গেইম শো দেখে, মাঝে মাঝে একসাথে লাঞ্চ খায়, কখনো আবার ডিনার। একসাথে শপিংও করে, একে অন্যকে গিফট দেয়। মিলির দিনগুলো বেশ ভালই কেটে যায়।
এই প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে প্রজেক্ট ডাইরেক্টর ডঃ ডেইভিড কিম্বলের সাথে পরিচয় দিহানের। উনি দিহানের মত সিভিলিয়ান না, একজন আর্মি সাইয়েন্টিফিক কোর পার্সোনাল। সি ওয়ান নাইনটিন-এর আবিষ্কারক। কিন্তু শেষ ধাপে এসে সি ওয়ান নাইনটিনের মলেকুলার আনস্টেবিলিটি ভদ্রলোকটির এক চরম ব্যর্থতা, যার জন্য কিনা পুরো প্রোজেক্টটাই ভেস্তে যাওয়ার দশা। এই প্রোজেক্টে প্রস্তুত প্রথম পদার্থটার নাম ছিল সি ওয়ান। কিন্তু একেবারেই ত্রুটিপূর্ণ, টার্গেট প্রোডাক্টের ধারে কাছে না। তাই পারফেকশনের অভিপ্রায় ধারাবাহিক ভাবে এলো সি টু, থ্রি করে শেষে সি ওয়ান নাইন্টিন। কিন্তু সি ওয়ান নাইন্টিনের একটিমাত্র সমস্যা মলেকুলার আনস্টেবিলিটি নিয়ে ডঃ কিম্বলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও এই দুটি বছর কোনো সুরাহা করতে পারেননি।
দিহানের কাজ যখন একদম শেষের পর্যায় তখন একদিন টি ব্রেকের সময় ক্যাফেটেরিয়ায় বসে দিহান আর ডঃ কিম্বলে স্ন্যাক্স খাচ্ছিলেন আর সি ওয়ান নাইনটিনের এই ত্রুটিটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। দিহানকে ডঃ কিম্বলে তার সমস্ত রিসার্চ পেপারগুলো দেখিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন। অহংকারী এই ভদ্রলোকটি যেখানে দিহানের সাথে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলতেন না, আর কালে ভাদ্রে যখন বলতেনও দিহানের প্রতি তার নাক সিটকানো ভাবটা প্রকাশ করতে পেছ পা হতেন না, সেখানে এমনভাবে সাহায্য চাওয়াটা হাতির কাদায় পড়ার সামিল। দিহান কেন জানি লোকটিকে ফিরিয়ে দিতে পারলো না। ক্যাফেটেরিয়ায় বসেই দিহান সি ওয়ান নাইনটিনের বেসিক ফর্মুলার ত্রুটি ও সমাধান বলে দিল। কিন্তু তার ঠিক ঘন্টা খানেক পর ডঃ হামফ্রি দিহানকে ডেকে প্রোজেক্ট ডাইরেক্টরের চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে সি ওয়ান নাইনটিনটা দ্রুতগতিতে পারফেক্ট করতে বললেন। দিহান কোনো উচ্চবাচ্চ করলো না। ডঃ কিম্বলেকেও বাকি কয়টাদিন আর ধারে কাছে দেখলো না। বুঝতে পারলো তাদের সবার উপর সর্বক্ষণ কড়া নজরদারি রয়েছে।
আজ তার কাজে যোগদানের দুই বছর চার মাস পাঁচদিন। গতকাল টার্গেট প্রোডাক্ট সি এফ ওয়ান টোয়েন্টি, তার অ্যান্টিডোট ও ডিটেকশন কিট সব বুঝিয়ে দিয়ে আজ মিলির কাছে ফিরে যাচ্ছে। সে ঠিক করেছে এদেশে আর দুদণ্ডও নয়। যত তাড়াতাড়ি পারে বাংলাদেশে ফিরে যাবে। মাকে কতদিন সামনাসামনি দেখেনি, মনটা যেন কেমন করছে। স্কাইপিতে কথা হয়, মন ভরে না।
মিলি আজ খুব খুশি। আগামীকাল রাতে তাদের ফ্লাইট, কতদিন পর যে দেশে ফিরছে। প্যাকিং প্রায় সবই শেষ, শুধু টুকটাক কয়েকটি জিনিস বাকি। টিকেট পাসপোর্ট সব আগে থেকেই হ্যান্ড ব্যাগে ভরে রেখেছে। দিহানকে ছেড়ে আর কোনদিন থাকতে হবে না তার, কথা দিয়েছে দিহান। ঐ নতুন কাজে যোগদানের পর অনেক তাল বাহানা করে মিলিকে ঐখানে বাসা ভাড়া করে নিয়ে যায়নি দিহান। এমনকি কর্মস্থানটি দেখতে চাইলেও আজ নিয়ে যাব, কাল নিয়ে যাব করে প্রতিবার এড়িয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মিলির অন্য সন্দেহ হলেও মন থেকে তা জোর করে ঝেড়ে ফেলেছে। এইসব ভেবে আজ ওর নিজেকেই নিজের খুব বকতে ইচ্ছা করছে। সকালে দিহানের বাসি মুখে চা খাওয়ার অভ্যাস। চা বানাতে গিয়ে দেখে চিনি শেষ, গতকালও মনে হল যেন সে দেখেছিল চিনির বয়ামটা ভরা। কি জানো হয়তো মনের ভুল। মিলি দৌড়ে পাশের বাসায় হেলেনের কাছ থেকে একটু চিনি এনে দিহানকে চা’টা দিয়েই দৌড়ে নাস্তা বানাতে গেল।
অনেকক্ষণ হল নাস্তা দিয়েছে টেবিলে। দিহানের কোনো পাত্তা নেই। আবার ঘুমিয়ে পড়লো নাকি ভেবে মিলি তাদের বেডরুমে গিয়ে দেখে দিহান একদৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মিলির বুকটা ধক করে উঠলো। আস্তে করে ডাকল, “দিহান” কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভয়ে আতঙ্কে দৌড়ে গিয়ে দিহানের শরীরটা ধরতেই মনে হল অসাড়। পাগলের মত বুকের উপর কান চেপে ধরলো। তার সমস্ত পৃথিবীটা এক নিমেষ ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে গেল। হৃৎস্পন্দনহীন দেহটা ধরে মিলি উন্মাদের মত চিৎকার করতে লাগলো।
দিহানের দেহটা এখন হাসপাতালের মর্গের একটি ধাতব ড্রয়ারের মধ্যে রাখা হচ্ছে। কাল পরশুর মধ্যে অটপ্সি হবে। হেলেন মিলিকে হাজার না করা সত্তেও পিছন পিছন এসেছিল, মর্গ পর্যন্ত। দুজন অর্ডারলি আস্তে করে রাখতে গিয়ে দিহানের দেহটা হাত ফোসকে ড্রয়ারের মধ্যে ধপাস করে পরে গেল। মাথাটা জোরে বারি খেয়ে দাঁতে দাঁত ঠুকে গেল। কিন্তু এজন্য এমন একটি ব্যাপার ঘটল যা দিহান ছাড়া আর কারো জানার কথা না। উপরের ডান দিকের দ্বিতীয় আক্কেল দাতটির মধ্যে লুকনো সি ওয়ান টোয়েন্টির অ্যান্টিডোট ক্যাপসুলটা ফেটে গিয়ে তা ধিরে, অতি ধিরে দিহানের জিহ্বার তলা দিয়ে শোষিত হয়ে শরীরে সমস্ত কোষে প্রবেশ করতে শুরু করলো। মিলির মুখ দিয়ে ‘আহ’ করে একটি শব্দ বেড়িয়ে এলো, মনে হল তার দিহানটা কত যে ব্যাথা পেল।
হেলেনের গাড়ীতে করেই মিলি বিকালে ফিরে এসেছে। দেশে ফোন করে খবরটা জানানোর মানসিক অবস্থা তার নেই। সারা রাত একটানা সোফায় বসে কাটিয়ে দিল। পরেরদিন সন্ধ্যার দিকে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো। দিহানের শরীর থেকে খুলে নেয়া সব জিনিস পত্র হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিলির কাছে হস্তান্তর করতে চায়। হেলেন আজ ডিউটিতে গেছে তাই বাসে করে মিলি হাসপাতালে চলে এলো। জিনিসগুলো হাতে নিয়ে ধিরে ধিরে মর্গের দরজাটার সামনে এসে উপস্থিত হল। আরেকবার দিহানকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল মিলির। মর্গের এই দিকটা একটু জনমানব শুন্য। একজন ডাক্তার হঠাৎ দরজা খুলে বের হয়ে মিলির একেবারে মুখোমুখি পড়লো। মিলি চিনতে পারলো। এ’ই কালকে দুপুরে এখানে ডিউটিতে ছিল।
“ইয়েস?” ডাক্তারটা জিজ্ঞাসা করলো।
“ক্যান আই সি মাই হাসবেন্ড ফর ওয়ান মোর টাইম, প্লিজ!” লোকটা কি যেন ভেবে বলল, “ওকে বাট মেইক ইট কুইক” ঘরে ঢুকে দিহানের দেহ রাখা ড্রয়ারটা টেনে বের করে বলল, “ফাইভ মিনিটস। আইল বি ব্যাক ইন ফাইভ মিনিটস” লোকটার হাবভাব দেখে মনে হল বাথরুমে যাচ্ছিলো।
লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর মিলি দিহানের নিথর দেহটার উপর আলতো করে হাত রেখে বলল, “কালকে মাথায় খুব ব্যাথা পেয়েছিলে?” হাতটা মাথায় বুলিয়ে দিতে গিয়ে চমকে সরিয়ে নিল। দিহান মিলির দিকে তাকিয়ে হাসছে। “ব্যাথা লেগেছিল। ঠিক হয়ে গেছে” মিলি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। একি মতিভ্রম না স্বপ্ন, বাস্তব তো হতেই পারে না। দিহান ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাপতে কাপতে মিলির হাত থেকে নিয়ে কাপড়গুলো পড়লো। মিলিকে বলল, “সময় বেশি নাই, ভীষণ বিপদ, আমি যা যা বলবো ঠিক তা তা কর মিলি, তা না হলে সত্যিই এবার পরপারে পারি দিতে হবে”
দিহান ড্রয়ারটা বন্ধ করে হাসপাতালের মর্গের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সি সি ক্যামেরা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাস্তার নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে মিলির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। ডাক্তারটি ফিরে আসার পর মিলি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাসপাতালের সামনে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বেরিয়ে দিহানের কাছে চলে গেল। দিহান বার বার বলে দিয়েছে কোনভাবেই বুঝানো যাবেনা, যে দিহান জীবন্ত। ডঃ হামফ্রির ঐখানে কন্ট্রাক্ট সই করার সময় দিহান সম্পূর্ণ গোপনিয়তার অঙ্গীকার বদ্ধ হলেও তারা বিশ্বাস করতে পারেনি দিহানকে। আততায়ী কেইট, হেলেন ছদ্দবেশে মিলির উপর এবং মিলির সাথে থাকাকালীন দিহানের উপরও নজর রাখছিল। দিহানের দেশ ত্যাগ করার খবর হেডকোয়াটারে পৌঁছালে হেলেনের কাছে দিহানকে সি এফ ওয়ান টোয়েন্টি প্রয়োগে মেরে ফেলার নির্দেশ সমেত একটি প্যাকেজ আসে, যার মধ্যে সি এফ ওয়ান টোয়েন্টির চিনি সদ্রিশ দানা থাকে। ঘটনার আগেরদিন রাতে মিলির বাসায় এসে হেলেন ওদের চোখের আড়ালে চিনির বয়াম পুরো খালি করে ফেলে। এরপর পরেরদিন মিলি দিহানের চায়ের জন্য যে দু চামুচ চিনি চাইতে আসে তারমধ্যে সি এফ ওয়ান টোয়েন্টির দানা মিশিয়ে দেয়। ওরা সব কিছু ফেলে শুধু জানটা হাতে করে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হল।
দিহান আর মিলি এখন দেশের মাটিতে। কিন্তু কেউই তাদের পরিবারের সাথে এখনও দেখা করেনি। যথেষ্ট কালক্ষেপণ হয়নি বলে দিহানের ধারনা। কেউ এখনো ওদের পরিবারের সদস্যদের উপর নজর রাখছে। দেশের মাটিতে পা ফেলেই দিহান ওর এক বিশ্বস্ত বন্ধুর মাধ্যমে ওর মায়ের কাছে সব জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেয়, প্লেনে বসেই লিখেছে সেটা। এরপরই দুজন মিলে গা ঢাকা দেয়। একটি গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি করে কোনমতে দিন চলে যেতে থাকে। ইদানিং সব কিছু স্বপ্নের মত লাগে মিলির। মাঝে মাঝে উদাস দৃষ্টিতে পশ্চিমাকাশের পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে ও’। যখন একেবারে আধার ঘনিয়ে আসে, একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার পাশ থেকে উঠে এসে রাতের খাবারের আয়োজন করতে শুরু করে। দৈনন্দিন রুটিনে দাঁড়িয়েছে এটি। দীর্ঘ অপেক্ষার পালা, দীর্ঘ একঘেয়ে মন হতাশ করা অপেক্ষা, যেন দুপক্ষের সীমাহীন ধৈর্যের এক বিষম প্রতিযোগীতা। কতদিন আর নজরদারী করবে ডাঃ হামফ্রির চর, দিহানের ধারনা, একদিন না একদিন ঠিকই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে ওরা।
আজ হঠাত দিহানের ইচ্ছা করলো মিলির সাথে বসে সূর্যাস্ত দেখবে। কাছে গিয়ে মিলির হাত ধরতেই দৃঢ় ভাবে দিহানের হাত চেপে ধরল ও’। চোয়ালের মাংশপেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠলো, চোখে জমে থাকা জলটুকু গাল বেয়ে গড়িয়ে দিহানের হাতের উপর পড়তেই চমকে উঠলো দিহান। মিলির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উষ্ণ জলের বিন্দুগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকালো। গনগনে আগুনের মত জ্বলছে ওগুলো, ফিকে হয়ে আসা সূর্যালোকের চেয়ে অনেক বেশী তীব্র, অনেক বেশী জীবন্ত।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:১৪
আমি ৎৎৎ বলেছেন: ভাল লেগেছে।