![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
টানা গদ্যে লেখা ৫টি বয়ান
ক. ভাষা-সমস্যা
ভাষার সমস্যা আছে। সব কথা সে প্রকাশে সমর্থ নয়। যতই পণ্ডিতি করি, সান্ধ্যসুর ধরি, ঠিক যেন হলো না—আমার কী বলার ছিল? ‘কী’ বলার মধ্যে আমি কী ভাব বোঝাতে চেয়েও, শেষ পর্যন্ত বাক্য যেন বাগে এল না, বরং বিরাট বিট্রে করে বসল। কুয়োর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া চৈত্রমাসের মহাজোছনা যেন আমি আর তুলে আনতে পারলাম না। এদিকে পরিস্থিতি প্রতিদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে ঝুপঝাপ আঁতাত শুরু করে দিল। কারণ, এই কালপর্বের নাম যুদ্ধক্ষেত্র। আমাকে ক্রলিং করে মাটিতে বুক বাঁধিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ভ্রম হচ্ছে, তবে কি আমার বুকপকেটে সে-রকম কোনো চিঠি আছে—যার প্রেরক এক শহরবাসিনী, প্রহেলিকা চৌধুরী? কিন্তু ওই যে বললাম, ভাষার সমস্যা! ভাষায় আমি জোছনা দেখাতে পারছি না, সূর্যাস্ত দেখাতে পারছি না, যুদ্ধ দেখাতে পারছি না, রক্ত কতটা লাল দেখাতে পারছি না, বাতাসের বেআদব আচরণ দেখাতে পারছি না! এমনকি আমার মন এখন কতখানি অবাধ্য যে সে আমার ঘরেই থাকে না, প্রতিদিন একই রাস্তায় একই দিকে যায়—মনোগমনের এ বর্ণনা লিখে বোঝানো অসম্ভব! অ্যাবসার্ড!! কারণ, ভাষা শিল্পকে যতটা সমর্থন করে বা শিল্পীকেও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে পারে কিন্তু শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে যেটুকু প্রচ্ছন্ন দূরত্ব, যতটা লৌহবেদনা—ভাষা তা কখনোই স্পর্শ করতে পারে না। কতটা নির্মম, দুর্ভাগ্যপীড়িত, যদি বলো, এই ভাষাতেই আমাকে লিখে জানাতে হবে সেই প্রচ্ছন্ন দূরত্বের গল্প, লৌহবেদনার ইতিকথা? মন-আনমনা, বাক্য যেন ভাব বুঝল না, বাক্য বিরাট বিট্রে করে বসল। অথচ, কুয়োর মধ্যে চৈত্র মাসের মহাজোছনা গড়াগড়ি যায়... ভাষা-সমস্যা রচনাকাল: ২০০৪
খ. বসন্তদিন
রহস্যপুর গল্পটা পড়া শেষ হয়নি আমি সিরিয়াস পাঠক। পড়তে পড়তে পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা এগিয়ে যাই, তাকিয়ে দেখি গল্পের মধ্যে সোনার ঢেঁকি... পাড়ের শব্দও শুনি। ঠিক তক্ষুণি, পর্দাজুড়ে দৃশ্যমান, হাঁক দিয়ে চলে যায় দইঅলা বলে একটা চরিত্র, আমি তার পিছু পিছু এগিয়ে যাই কয়েক পৃষ্ঠা; হঠাৎ সামনে পড়ে পোড়ো রাজবাড়ি, রাজবাড়িটা ভাঙা ভাঙা এবং ভৌতিক... ভীতিলুব্ধ সিঁড়িতে একটা প্রজাপতি, আমি প্রজাপতিকে লক্ষ করে উপরে উঠতে থাকি। প্রত্নকোঠার ছাদের কিনারে গিয়ে বলি, ‘প্রজাপতি, তোমার আত্মজীবনী আমি মুখস্থ করতে চাই’, শুনেই, ডানাঅলা এই প্রায়পাখিটি উড়ে যায়। এবার আমিও উড়তে থাকি প্রায়পাখিটির সঙ্গে, পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা, বাক্যের পর বাক্য, শব্দের পরে শব্দ, প্রয়োজনীয় নৈঃশব্দ্য... প্রজাপতি, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তুমি কি কোনো বংশিবাদক, সুরের ফাঁদে ষড়যন্ত্র করছ? ট্র্যাপ করে পাহাড়ের দিকে টানছ? রহস্যপুর গল্পের তেইশতম পৃষ্ঠায় সেই হাইডআউট লোকেশন, পাঠক যেখানে অসহায়, দুরুদুরু-সন্ত্রস্ত কিন্তু এগিয়ে যেতে উৎসাহী। প্রতিষ্ঠিত অন্ধকারে মুখোমুখি এক মায়াবী অধ্যায়: আলো হয়ে প্রকাশিত নারী, নারীর সর্বাঙ্গে সদম্ভ আগুন, অহোরাত্র নারীকে পড়তে গিয়েই আগুনে পুড়তে হয়... এই নিয়তি নির্ধারিত বলে, মন পুড়ে যায়। পোড়া মন চিকিৎসাধীন... নার্সও দেখতে প্রায়নারী, মাসান্তে বেতনপ্রাপ্তা। আমি রহস্যপুর হাসপাতালে শুয়ে আছি, গল্পের মাঝামাঝি কোনো পৃষ্ঠায়। ...খুবই জানি, সুস্থ হলেই আবারও সেই ষড়যন্ত্র, প্রজাপতির। হয়তো আমারও খুব ইচ্ছে করবে, তার ডানার খোপের অন্ধকারে রং মেখে ঘুমিয়ে থাকি, জাগি। বোঝাই তো যাচ্ছে, এরপর গল্পে একটা খুন এসে যাবে। টিকটিকিরাও জানাচ্ছে, চিরকালই খুনের প্রেরণা নারী। সিরিয়াস পাঠক আমি, হিট লিস্টে আছি, সুতরাং খুন হয়ে যাব- এই ভয়ে অসুস্থ থাকি। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে (জন্মদোষে) নার্স ও নারীর আন্ত:পার্থক্যটুকু ধরার চেষ্টা করছি, পড়ার চেষ্টা করছি... আমার পোড়ামন চিকিৎসাধীন এদিকে বসন্তদিন...
গ. উত্তরের হাওয়া
কার কথা কীভাবে বলব আমি? বন থেকে প্রকাশিত দৈনিক ঝরাপাতা—কারা তাতে লেখে আর কারাই বা পাঠক-পাঠিকা? কার কাছে বলা যায়—উত্তরের হাওয়া আসে গুপ্তচর হয়ে? সন্ধে থেকেই ওঁত্ পেতে বসে আছে আততায়ী ঘ্রাণ, চন্দ্রমল্লিকার! মনে হয়, ভাবনা সম্প্রচার কেন্দ্রের আজ রজতজয়ন্তী, তুমুল ভাবনাসূচি…ভাবনাকে দেখতে আসে বুদ্বুদ—দোস্তে দোস্তে জুয়া খেলে কয়েক সেকেন্ড; এর মধ্যেই ঝাঁপ দেয় গনগনে কবিতাখসড়া, এর মধ্যেই উঁকি দিয়ে যায় এক স্বর্ণমৃগয়া, নড়ে ওঠে ঝোপঝাড়, যেহেতু সতর্ক…পদধ্বনি বাইপাস করে ছুটতে থাকি ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে বনবনানির নির্জনতায় যেখানে এলাম—ওহ কী দুরবস্থা, নিজেই রচনা করেছি সুনিপুণ আত্মঘাতী ব্যাকরণ—আমি এই জঙ্গলের গাছে গাছে ফেরার কোনো চিহ্ন এঁকে রেখে আসিনি, কীভাবে ফিরব? আমি কি আজ অরণ্যমন্ত্রী? না, আমি এই বনবাস উদ্যাপন করছি না। হাওয়া-বাতাসের অর্কেস্ট্রায় এই মর্মর কম্পোজিশন আমার ভালো লাগছে না। আমি জানি, এক দিগ্বালিকা বড় হচ্ছে ঘরের মধ্যে, রাতে; বাইরে বসন্তপূর্ণিমা, বাইরে অঙ্গার বৈরাগীর গান—পাতা-টাতা নাই বনে, ভালোবাসি তোমারে, হরিণেরা কি জানে, ভালোবাসি তোমারে…? ঘরের মধ্যে বড় হচ্ছে বালিকা, বালিকারা বড় হচ্ছে কার জন্যে—এই প্রশ্ন কোনো প্রশ্নই হয়ে উঠত না, যদি, আমাদের কবিতার চেয়ে করে আসা লোকাচার, ধর্মাচার, তদীয় গ্রন্থাচার বড় না হতো! আমি জানি এক দিগ্বালিকা বড় হচ্ছে ঘোরের মধ্যে, ঘরের মধ্যে, জনপদে। সে বালিকা জানে তার ভালোবাসা সেই ডালিম, ধীরে ধীরে বড় হয়, লুব্ধক প্রেমিকের হাতে পড়লেই পাকা ডালিমটা ফেটে যায়, পাকা ডালিম ফাটা ডালিম ভেতরটা দেখিয়ে দেয়…আমি সেই ফলের রসময়ী দানাগুচ্ছ থেকে বহুদূরে এক স্বর্ণমৃগয়ার খপ্পরে পড়ে এই বনভূমির মধ্যে…আজ আর এই গ্রিন অভিবাস পছন্দ করছি না। যদিও কোকিল ডাকছে, এতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে, স্বাভাবিকতার পতন ঘটছে। এ সময় কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে, এ সময় উত্তরের হাওয়া আসে গুপ্তচর হয়ে, দক্ষিণের বারান্দায় ওঁত্ পেতে বসে থাকে আততায়ী ঘ্রাণ, চন্দ্রমল্লিকার…মনে হয়, শিহরণ শব্দের অর্থ বুঝতেই দিগ্বালিকা আজ আর স্কুলে যাবে না, কিন্তু স্কুলে যাবার নাম করে সে ঠিকই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বে… শিহরণ, তোর কথা কীভাবে লিখব আমি?
ঘ. জঙ্গলের মধ্যে জাদুঘর
জঙ্গল দেখলেই মনে হয়, ঐ জঙ্গলের একদম ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। অসংখ্য গাছে গাছে ভরা অবিরাম পাতায় পাতায় হাওয়া-বাতাসের অর্কেস্ট্রা আর অগণন পাখিতে পাখিতে নরম পালকে পালকে ডিসপ্লে করা গ্রিনমিউজিয়াম... এই পৃথিবীতে যতগুলো জঙ্গল আছে, প্রায় প্রত্যেকটা জঙ্গলের মধ্যেই একটা করে জাদুঘর আছে জাদুঘরে, গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মরচেধরা অনেকদিন আগের একটা বাইসাইকেল। সেই সাইকেলটা কার গো, কার? যথা অপরিণামদর্শি কৌতূহলে, জঙ্গলে প্রবেশ করিয়া যে বালক আর কোনদিন ফিরে আসিল না, তার? জংলিপনায় স্নাতকোত্তর আমি, জঙ্গল দেখলেই বুঝতে পারি- এই জঙ্গলের ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। বাইসাইকেল আছে। বালক-পুরুষ ফিরতে না-পারার জনশ্রুতি আছে। জনশ্রুতির অধিক রহস্য, সেটাই ধরিত্রী, অবলীলা চৌধুরীর লাবণ্য; লাবণ্যের ভেতরে মিশিমিশি আফ্রিকা, ঘনান্ধকার আমাজান... সাহস করে একবার ঢুকে পড়লেই জাদুঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাবার প্রেরণা পাওয়া যাবে। ক্লান্ত সাইকেল গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে এবং সম্ভবত আমার আর কোনওদিন ফিরে আসা হবে না... হবে না এ অঞ্চলে এটাই সত্য, জঙ্গলে হারানো পুরুষ শেষপর্যন্ত কিংবদন্তি হয়ে যায়
ঙ. কুরঙ্গগঞ্জন : হরিণের লজ্জা দেখার লোভ
বাঙলা কবিতা লিখি। লিখতে গিয়ে, হঠাৎ একটা শব্দ নিয়ে খটকা লাগে। হয়তো শব্দটার অর্থ কিছুটা আবছা মতোন, আর তখনই অভিধান খুলে বসি। অভিধানে সব শব্দের মানে লেখা আছে। যেমন, কুলঙ্গি মানে হচ্ছে- জিনিশপত্র রাখার জন্য দেয়ালের মধ্যস্থিত ছোট খোপ। দিগন্তমোহে আমি মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে দেখি: নিভে যাওয়া বাল্যকাল একটি মাটির কুপি হয়ে জ্বলে জ্বলে উঠছে খোপ-কুলঙ্গিত, মামাবাড়ির সেকালের দেয়ালে... একরাতে, মা তখনও অবিবাহিত, নিরক্ষর নানীর শোবার ঘরের কুলঙ্গিতে লুকিয়ে রাখা তার একগুচ্ছ ভুল বানান-সমৃদ্ধ প্রেমপত্র ধরা পড়ে যাওয়ায়, হন্তদন্ত মামাদের সুপাত্র সন্ধান জরুরি হয়ে পড়ে। হবু বরগুলো হবু অবস্থায়-ই মরে যায়। থাক সেসব কথা, এখন কুলঙ্গি শব্দটার পরিষ্কার মানে কি- সেটা দেখবার জন্য যখন সংক্ষিপ্ত বাঙলা অভিধান খুললাম, খুঁজছি ক... কা... কু... কুলঙ্গি খুঁজে পাওয়ার অন্তত তেইশটি শব্দ আগে চোখে পড়ল অদ্ভুত এক শব্দ, শব্দটা কুরঙ্গগঞ্জন? কুরঙ্গগঞ্জন মানে- হরিণকে লজ্জা দেয় এমন; হরিণ থেকে উৎকৃষ্ট। যারা কবিতা পড়েন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি- কুরঙ্গগঞ্জন শব্দের মানে বুঝেছেন? না, আমি ঠিক বুঝিনি। কারণ হরিণকে লজ্জা দেয় এমন কোন প্রাণী আছে- উদাহরণ হিসেবে সেটা অভিধানে নেই। কোথায় এমন কে আছে যে, তাকে দেখে হরিণ লজ্জা পেয়ে যাবে? তাছাড়া হরিণের কী নেই যা তার মধ্যে আছে? এদিকে, হরিণ থাকে সুন্দরবনে, হরিণ থেকে উৎকৃষ্ট সে থাকে কোথায়? সমুদ্রে, পাহাড়ে-- নাকি এই প্রহেলিকায় শহরের মেট্রো গলির পরের গলির শেষের একলা একটা বাড়ি?
কুরঙ্গগঞ্জন-এর আভিধানিক অর্থ জানার পরও মাথায় নানা প্রশ্ন আসে। প্রশ্নে প্রশ্নে প্রেম ঘন হয়। ভাবি, যদি কোনো ভেরিগুড ম্যুড ছুটে আসে একদিন লেখার সময়, সে লেখায় হঠাৎ করেই বসিয়ে দেব কুরঙ্গগঞ্জন শব্দটি, হয়তো হরিণের লজ্জা দেখার লোভে, নয়তো হরিণ থেকে উৎকৃষ্ট কাউকে দেখার আকাঙ্ক্ষায়
আকাশ যেমন নীল, প্রত্যেকদিন সেরকমই কবির অভিপ্রায়...
©somewhere in net ltd.
১|
৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:২৪
সুস্মিতা শ্যামা বলেছেন: Uhh! Ki vulval shironam den, Thakur Da! Er nam Jodi tana godyo hoi, tobe kobita kake bole! Shihoron ER bornona. Pore Ami e shihorito!