নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীরবে তো কেটে গেল কতটা প্রহর, কাটুক না আরো কিছু প্রহর, নীরবেই......

কিচ্ছু বলার নেই, কারণ শুনার তো কেই নেই।

নীরব অনুধাবক

যা কিছু দেখি, সবই বুঝতে চেষ্টা করি, অনুভব করতে চেষ্টা করি, অনুধাবন করি। সবই নীরবে নিভৃতে।

নীরব অনুধাবক › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ আকাশের নীলিমা

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:২৪

 ১
আগামিকাল আকাশের সাক্ষাৎকার, জীবনের প্রথম চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে সে।
রাজশাহি থেকে ট্রেইনে, ইন্টারসিটি পদ্মা এক্সপ্রেস।
জানালার পাশে বসে অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ছে। সোহেল ভাই, নিহাল, কবির, অন্তর, ইসহাক-ইদ্রিস ভাইদের সাথে কতদিন একসাথে থাকার স্মৃতি। আর হ্যা – আরেকজনের কথাও মনে পড়ছে, নীলা!!


 ২
মাঝে মাঝেই এখন মনে পড়ে নীলার কথা। অনেক দিন হয়ে গেছে, তবুও মনে পড়ে। আবছা স্মৃতি।

নীলার সাথে আকাশের পরিচয়টা হয়েছিল অদ্ভুতভাবে, ধরতে গেলে অনেকটা সিনেমীয় বা নাটকীয় স্টাইল ও বলা যায় একে।¬¬

এরকম ভাবে এর আগে কেউ কারো সাথে পরিচিত হয়েছিল কিনা কে জানে!

এই ট্রেইনেই পরিচয়টা হয়েছিল, তাই আজ প্রতি মুহূর্তেই মনে পড়ছে নীলার কথা, সাথে সেই এইচএসএসি পরিক্ষার পরের সময়টা!


 ৩
আকাশ তখন সবেমাত্র HSC পরীক্ষা দিয়েছে। HSC পরীক্ষার পরের সময়টাতে বেশিরভাগ ছেলেরাই হঠাত বড় হয়ে যায়। ঘরের কোণ আর মায়ের আচল ছেড়ে বৃহৎ এই দুনিয়ায় প্রবেশ করে তারা।

অল্প কিছু ছেলে থাকে যারা তখনো পরিবার এর ছায়া থেকে বের হতে পারে না, তারা ব্যাতীত, বেশিরভাগ ছেলেই এই সময় নিজের সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পেতে থাকে। নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা হতে থাকে। জীবন কোন পথে যাবে তা বেছে নেয়ার সময় এই সময়টাই।

 ৪
আকাশ বেশ আগেই মায়ের কোল আর পরিবার এর ছায়া থেকে বের হয়ে চলে এসেছছিল দূরে পড়াশোনা করার জন্য। দেশের অন্যতম ব্যাস্ত শহর ঢাকায়।

ঢাকা শহর এক অদ্ভুত জায়গা, কখনোই ভাল লাগে নি আকাশের, আবার যে খুব খারাপ লাগে তাও না। এখানকার কিছু ব্যাপার তাঁর যেমন খুব খারাপ লাগে ঠিক তেমনি অনেক ব্যপার এ সে মুগ্ধও বটে।

ঢাকার চিরচেনা জ্যাম, যান্ত্রিক জীবন অন্য সবার মতো তাঁর ও খারাপ লাগে, কিন্তু এখানকার ব্যাস্ত জীবন পর্যবেক্ষণ এর মাঝেও সে খুঁজে পায় নানা ধরণের আনন্দের মাধ্যম।

বিকেল হলে লেকের পাড়ে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটা, মসজিদে নামায পড়ার পড় মানসিক পরিতৃপ্তি অনুভব, জিয়া উদ্যানে বসে মানুষের নানা কার্যকলাপ লক্ষ্য করা, তাদের নিয়ে একটু ভাবা, ব্যাস্ত রাস্তায় হাঁটা, রাতের অন্ধকার রাস্তায় একা একা ঘুমন্ত ঢাকা চষে বেড়ানো এসবে সে খুঁজে পায় এক অন্যরকম অনুভুতি। এ তাঁর অন্য জগত, যেখানে শুধু সে নিজেই বাসিন্দা।


 ৫
ঢাকায় সে থাকত একটা ব্যাচেলর মেস এ। একে সম্পূর্ণ মেস ও ঠিক বলা যায় না। এক বড় ভাই একা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে, সাথে আরো কয়েকজন কে নিয়ে একসাথে থাকে। সবাই যে আগে থেকেই পরিচিত তা কিন্তু নয়। এই একসাথে থাকতে যেয়েই তারা একে অপরের পরিচিত।

প্রথমেই সোহেল ভাই বাসাটা ভাড়া নেয়। ঢাকায় ব্যাচেলর মানুষ এর এইরকম একটা ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া পাওয়া অনেকটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার। সোহেল ভাই এই চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার টা কি করে জানি সম্ভব করে ফেলেছিলেন সেই ২০০৮ এ।

তখন তিনি সবেমাত্র অনার্স শেষ করেছিলেন। চাকরি খুঁজ করতেছিলেন এবং অল্প দিনের চেষ্টায় একটি উঠতি কোম্পানি তে চাকরিও পেয়ে যান। সোনার হরিণ বলা হয় সরকারি চাকরি কে, কিন্তু উনি যে অবস্থা থেকে এই চাকরি পেয়েছেন, তাতে এই চাকরি কে তাঁর বলা উচিত ছিলো হীরের হরিণ।

একা মানুষ, এতো বড় ফ্ল্যাট এ থাকতে হলে সম্পূর্ণ ভাড়া তাকে একা বহন করতে হয়, তাই তিনি চিন্তা করলেন, সাবলেইট দিবেন। এ চিন্তা থেকেই প্রথমে ৩ জন এবং পড়ে আরো ৪ জন ভাড়াটে উঠে তাঁর এই ফ্ল্যাট বাড়িতে। মালিকের অনাপত্তিপত্র পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল তাকে, অনেক গুলো শর্ত মেনে নিতে হয়েছে, ভাড়াটে দের ও সেসব জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মালিকের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত।


 ৬
এই বাসাতেই আকাশ এসেছিল ওই পরের ৪ জনের সাথে।

সোহেল ভাই সহ মেস এর সদস্য মোট ৮ জন।

প্রথম যে ৩ জন উঠেছিল, তারা এখন আর নেই। তাদের জায়গায় নতুন ৩ জন এসেছে আকাশ এখানে আসার বছর দেড়েক পরে। এখানের সবাই ছাত্র ভাড়াটে। ২ জন ঢাকা কলেজ এ এইবার ভর্তি হয়েছে ইন্টারমিডিয়েট এ, আরেকজন এসএসসি পরীক্ষার্থী। এই ৩ জনই আকাশের জুনিয়র।

মেস এ জুনিয়র থাকার একটা মজা আছে, তাদের যেকোন সময় কোন কাজের আদেশ দেয়া যায়। জুনিয়র ৩ জন যে সবসময় সব আদেশ মান্য করে তা নয়, কিন্তু মাঝে মাঝেই খুব জরূরি কিছু কাজ হয় তাদের দিয়ে। এই যেমন, কিছু দিন আগে, আকাশ তখন ভার্সিটি এডমিশন এর জন্য কোচিং করতেছিল, তখন হঠাত একদিন তাঁর বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আকাশের বাড়ি রাজশাহী। সে সবসময় ট্রেইন এ বাড়ি যায়। এত দূরের পথ ট্রেইনে দাঁড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যদি আসন পেতে হয় তবে ২ দিন আগে টিকেট করে নিতে হয়। এই ২ দিনই আবার আকাশের রসায়ন ক্লাস কোচিং এ। এই রসায়ন কে আকাশ ভয় পায় যম এর মতন। সে খুব করে চাচ্ছিল, যেন তাঁর এইবারের চান্স টা মিস না হয় এবং এ জন্য এই রসায়ন টা খুব ভাল করে পড়ছিল। ২ দিনের ২ টা ক্লাস ই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে কি করবে এই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। তাকে অন্যমনস্ক দেখে নিহাল এসে বলল, “ভাইয়া, কি হয়েছে?” নিহাল কে আকাশ বলল তাঁর এই ২ মুখী বিপদের কথা, টিকেট কাটতে গেলে তাঁর ক্লাস মিস হয়ে যাচ্ছে, টিকেট কাটা যেমন খুবই জরুরি তেমনি ক্লাস করাটাও অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। নিহাল তখনি বলেছিল, “ভাইয়া , টিকেট এর টাকাটা দেন, আমি যাচ্ছি”।



 ৭
নিহাল তখন এইচএসসি এর পরীক্ষার্থী, আর আকাশ এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে এডমিশন কোচিং করতেছে। নিহাল ঢাকা কলেজ এ পড়ে, আকাশ ও ঢাকা কলেজ এর প্রাক্তন ছাত্র। পরিচয় টা কলেজ এই হয়েছিল। স্পোর্টস ডে তে, আকাশ আর নিহাল একই সাথে রিলে দৌড় দিয়েছিল এবং বলতে গেলে আকাশ আর নিহালের বুদ্ধিমত্তার জন্যই ওই ৮০০ মিটার রিলেতে তারা জয়ী হয়েছিল।

নিহালের স্বপ্ন এথল্যাট হওয়া, এক সময় সে উসাইন বোল্ট এর চেয়েও জোরে দৌড়াবে, এই তাঁর স্বপ্ন ছিল, কিন্তু পরিবার চায় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, পরিবারের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছে নিহাল। সে এই বছর দৌড়ে অংশগ্রহণ ই করেনি। এই সবই আকাশ জানে, কিছু বলে না নিহাল কে! বলে কি হবে! বাবা-মা যখন সন্তানের চাওয়াটাকে গুরুতব না দিয়ে নিজেদের স্বপ্ন সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়, তখন সন্তানের ই তো কিছু করার থাকে না, মুখ বুজে সব মেনে নেয়। আর এইদিকে আকাশ তো তাঁর পরিবারের কেউ ই না, কলেজ এ পরিচয় হওয়া এক বড় ভাইমাত্র।

নিহাল আকাশের নিকট অনেক কৃতজ্ঞ। সে খুব ডিপ্রেসড ছিল একসময়, বাসা থেকে বলে তাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, কিন্তু তাঁর ইচ্ছা এথল্যাট হওয়া। ছোটবেলা থেকে দৌড়ে সে বড় হয়েছে দৌড়বিদ হওয়ার জন্য আর এখন কিনা তাকে হতে হবে কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ার!!

আকাশ কে ঐদিন দৌড়ের পরেই সে সব খুলে বলেছিল। সে ম্যাথ এ খুব দুর্বল, তাই সে খুব ডিপ্রেসড ছিল, আর ইঞ্জিনিয়ারিং নাকি তাঁর ভালোও লাগে না। সেই সময় ই আকাশ বুঝেছিল, এইদেশে বাবা-মা কে বুঝিয়ে ছেলের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা একেবারে অসম্ভব না হলেও খুব কঠিন। তাই সে উল্টো পথে হেটেছিল, নিহাল কে সে পরের ৪ মাসে ম্যাথ এর নানা কৌশল দেখিয়ে ম্যাথ ভীতি কাটিয়ে তুলে, আর ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতি সৃষ্টি করে এক অদম্য আগ্রহ। আজ নিহালের চোখে-মুখে আর হৃদয়ের স্বপ্নও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার।




 ৮
মেসেই আরেক জুনিয়র হলো নিহালের বন্ধু কবির। কবির খুবই স্বল্পভাষী, সবসময় নিজের পড়াশোনা নিয়েই ব্যাস্ত সে। ক্লাসের প্রথম, আর পুরো কলেজ এ ২য়। তাঁর লক্ষ্য ছিল সামনের টেস্ট পরিক্ষায় সম্পূর্ণ কলেজ এ প্রথম হওয়া।

৩ নাম্বার জুনিয়র ছেলেটা ছিল এসএসসি পড়ুয়া। এত ছোট বয়সেই সে কেন নিজ বাড়ি ছেড়ে বাইরে পড়তে এসেছে, তা একটা রহস্য বটে। প্রথমে আকাশ তাঁর সম্পর্কে অনেক জানার চেষ্টা করেছে, কিন্তু অন্তর নামের ছেলেটি কিছুই বলে নি তাকে, কিন্তু পরে বলেছিল, আর তা শুনে আকাশ শুধুই অবাক হয়েছিল।

আজকাল অন্তর কেও অনেক মনে পড়ে।



 ৯
এ সবই ২০১২ এর কথা। আকাশ এই মেস বাসা তে উঠেছিল ২০১০ এ, এসএসসি পাশ করেই রাজশাহী ছেড়ে চলে এসেছিল এই রাজধানী তে পড়াশোনা করার জন্য। আকাশের বড় ভাই এর বন্ধু ছিল সোহেল ভাই, সোহেল ভাই তখনো থাকতেন এই বাসাতেই, সোহেল ভাই ই তাকে জায়গা দিয়েছিল আর ২০১০-১২ এই ২ বছর তাকে ছোট ভাই এর মতই রেখেছিল এই অচেনা ঢাকায়।

প্রথম উঠা ৩ ভাড়াটে এর পড়াশোনা শেষ হওয়ার তারা চলে যায় ২০১০ এ, তখনি এই মেস এ আগমন ঘটেছিল আকাশের। একই সময়ে এসেছিল, ঢাকা ইউনিভার্সিটির রাজ ভাই এবং ইশান ভাই।

রাজ ভাই আর ইশান ভাই এর সাথে ভালোভাবে পরিচয় হওয়ার আগেই তারা চলে যায়, তাদের জায়গায় আসে নিহাল আর কবির। তাদের কে অবশ্য আকাশ ই এনেছিল এই বাসায়।




 ১০
আরও ৪ জন থাকত এই বাসায়, রহিম ভাই, তিনি বীমা কোম্পানি তে চাকরি করতেন, ইসহাক ভাই পুবালী ব্যাংক এর ক্যাশ এ থাকেন, ইদ্রিস ভাই, বেকার, চাকরি খুজতেছেন আর তাঁর বন্ধু নিরব। সে একটি কোচিং এ পড়ায় আর ইদ্রিস ভাই আছেন টিউশনি এর উপর।

এই ৪ জনই ২০১০ থেকে আকাশের কিছুদিন আগে থেকেই এই বাসাতেই আছেন, সবাই অবিবাহিত চাকুরিজিবী। তাদের সাথে আকাশের খুব কমই দেখা বা কথা হয়েছে, সবাই খুবই ব্যাস্ত মানুষ।

২০১২ এর জানুয়ারি তে সোহেল ভাই প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হলেন, আর ফেব্রুয়ারি তেই বেইয়ে করে ফেলেই বাসা টা ছেড়ে দিলেন। আকাশ এতদিন পর্যন্ত সোহেল ভাই এর সাথে এক রুমে ছিল, যাওয়ার আগে রেখে গেলেন অন্তর কে!

এতদিন বাসার সকল দায়িত্ব ছিল সোহেল ভাই এর, তারপর ই সবথেকে সিনিয়র ছিলেন ইসহাক ভাই, তাঁর উপর ই গিয়ে বর্তাল সব দায়দায়িত্ব। তিনিও সব ছোট ব্যাচেলরদের সামলাতেন শক্ত হাতেই।




 ১১
অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো আকাশ, ট্রেইনের ঝাকুনি তে।
সকাল ৭ টায় ট্রেইন ছেড়েছে রাজশাহী থেকে।
এখন ১০ টা। ট্রেইন স্টপেজ পাবনার ঈশ্বরদী তে। অনেক্ষণ একটানা বসে থাকায় কোমর টা কেমন যেন করছিল। তাই সে স্টেশন এ নেমে পড়ল। কিছুক্ষণ হেটে শরীরের ভারসাম্যটা ঠিক করলো সে। কিছু খাবার নিয়ে ট্রেইনের দিকে হাটা শুরু করতেই দেখলো ট্রেইন চলা শুরু করেছে।

একটু দোউড়েই সে ট্রেইনে উঠে দরজায় দাড়াল, হঠাত দেখলো এক লোক দৌড়ে আসছে তাঁর দরজার দিকেই, সে হাত বাড়িয়ে দিল, ততক্ষণে ট্রেইনের গতি বেশ হয়েছে, সে একটানে লোকটিকে ট্রেইনে তুলে নিল।

সিটে গিয়ে বসতেই আকাশের আবার আগের সম্পূর্ণ ঘটনা মনে পড়ে গেল। নীলার সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল এইভাবেই নীলাকে টেনে ট্রেইনে তুলতে গিয়েই!!

তাঁর মাথাটা এখন ঝিমঝিম করছে, বাইরের রোদ জানালা দিয়ে মাথায় এসে লাগছে। প্রচন্ড গরম। আকাশ জানালাটা বন্ধ করে দিল।



 ১২
আকাশ তখন খুব ব্যাস্ত। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল প্রায়। ফরম উঠানো হয়ে গেছে প্রায় সব জায়গা থেকেই। প্রথম পরীক্ষা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ। নিহাল ১০ দিন আগেই টিকেট কেটে এনেছিল ট্রেইন এর আর গতকাল সোহেল ভাই চট্টগ্রাম থেকে ফেরার সময় চট্টগ্রাম টু ঢাকার ২ টা টিকেট কিনে এনেছেন। আজ সকালে আকাশ দেখা করতে গিয়েছিল সোহেল ভাই এর সাথে। তিনি টিকেট ২ টা দিয়ে বলেন, “ভালভাবে পরীক্ষা দিও, ফেরার সময় টিকেট পাবে না ভেবে টিকেট ২ টা কিনে আনলাম, নিয়ে নাও।”

আকাশ আর তাঁর কলেজের বন্ধু নাজিম যাবে একসাথে। নাজিম চলে যাবে তাঁর বড় ভাই এর বাসায় আগ্রাবাদ এ, আর আকাশ উঠবে হোটেল এ। কারণ নাজিম এর সিট পড়েছে আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ এ, আর আকাশ এর ইউনিভারসিটির ভিতরে বিবিএ অনুষদ এ।


 ১৩
পরীক্ষা ছিল ১২ তারিখ এ। ১০ তারিখ রাত ১১ টায় তূর্ণা নিশিতা এক্সপ্রেসযোগে যাত্রা শুরু করলো ২ বন্ধু। পৌছার কথা ছিল ভোর ৫ টায়, কিন্তু লেইট করে পৌছল, সকাল ৭ টায়।

নাজিম এর মামাতো ভাই এসে নিয়ে গেল তাকে স্টেশন থেকে, আকাশ বেরিয়ে পড়লো শহরের উদ্দেশ্যে।
পুরো অচেনা শহর, জীবনের প্রথমবারের মতো এসেছে সে এখানে, সম্পূর্ণ একা। বড় ভাইয়া সাথে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আকাশ মানা করে দিয়েছে, তাঁর সকল বন্ধু একা যাচ্ছে, সেও একা যাবে। কিন্তু এখানে এসে কেন জানি তাঁর মনে হচ্ছে ভাইয়া কে সাথে নিয়ে আসলেই মনে হয় ভালো ছিলো।

স্টেশন থেকে বের হচ্ছিল অগণিত ছাত্র। সবাই এসেছে পরীক্ষা দিতে। সবার চোখেই এক স্বপ্ন, প্রথম পরিক্ষাতেই চান্স পেয়ে যাওয়া। দল বেধে বেরিয়ে যাচ্ছে স্টেশন থেকে যার যার গন্তব্যে। আকাশের তখন খুব অসহায় লাগছিলো। কেনো সে একা আসার সিদ্ধান্ত নিলো।

স্টেশন থেকে বের হয়ে একটু এগোতেই রিকশাওয়ালা মামুরা সবাই ডাকতে লাগলো কোথায় যাবেন বলে। আকাশ কিছুই বলে না, একটু একটু করে এগোতে লাগলো, কিন্তু রিকশাওয়ালারা নাছোড়বান্দা, তাঁর পিছু পিছু আসতেই লাগলো। সে আশে-পাশে চেয়ে দেখলো নতুন প্রায় সবার পিছনেই রিকশাওয়ালারা যাচ্ছে, তারা জানে এরা সবাই এই শহরে নতুন, যে কোন উপায়ে রিকশায় উঠাতে পারলেই একটু বেশি ভাড়া পাওয়া যাবে।

আকাশ হাটতে হাটতে প্রায় এক কিলো এগোলো, কিছু খাওয়া প্রয়োজন, একটা হোটেল এ ঢুকে ডিম-রুটি দিয়ে নাস্তা শেষ করলো। এ যেন আটা বা ময়দার রুটি নয়, মপ্নে হল কোন শক্ত পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে। কোনভাবে হাত দিয়ে টেনে আলাদা করতে না পেরে, শেষ পর্যন্ত দাত দিয়ে টেনে ছিড়তে হয়েছিল ঐ রুটি।

হোটেল থেকে বের হয়ে দেখলো তখনো তাঁর পিছু নেয়া ২ টি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। সে একটায় উঠলো। বললো কিছুক্ষণ শহরে ঘুরিয়ে দেখাতে। রিকশাওয়ালা তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- মামা কি পরীক্ষা দিতে এসেছেন?
- হ্যা।
- এবার ই প্রথম আইছেন এই শহরে?
- হ্যা, আপনি কি স্থানীয়?
- না, আমিও এইহানে রিকশা চালাইতে আসছি। ২ বছর ধরে এহানেই আছি, শুধু ঈদে বাড়িত যাই।
- আপনার পরিবার এখানেই থাকে?
- হ্যা, ওরাও এহানেই থাকে।
- দেশের বাড়িতে কে কে আছে, আপনার বাবা-মা?
- না, হেরা তো কবেই মইরা গ্যাছে।
- তাহলে ঈদে যে বাড়ি যান?
- নাড়ির টান, বুঝেন না! বাপের ভিটা টা বেচি নাই, এহনো আছেই, শেষকালে ওইহানেই ফিরা যামু।
- ও।
- কোথায় উঠবেন মামা?
- হোটেল এ।
- কোন হোটেল এ?
- দেখি, যেটা ভালো হয়।
- এইদিকে ভালো একটা হোটেল আছে, নিয়ে যামু কি আপনাকে?
- আচ্ছা যান, বলল আকাশ।

একটু এগোতেই একটা সুন্দর হোটেল চোখে পড়ল, নাম “গ্র্যান্ড পার্ক হোটেল” আকাশ বলল, দাড়ান, এইটাতে যাই। রিকশাওয়ালা থেমে বলল, “মামা, এই হোটেল টা ভালো না, এইহানে যাইয়েন না, অনেক সমস্যা হয়”। আকাশ সরল মনে তাকে বিশ্বাস করে বলল, “তাহলে ভালো একটায় নিয়ে যান”।



 ১৪
কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে রিকশাওয়ালা “হোটেল নির্মলা” নামের একটা হোটেল এ নিয়ে আসল আকাশ কে। ভিতরে গিয়ে রিশেপসন এ গিয়ে কি জানি বলে আসল সে। এসে বলল মামা, এইহানে থাকেন খুব ভালো, কোন সমস্যা নাই। আকাশ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভাড়া দিতে গেলো। বলল কতো দিতে হবে? ভাড়া শুনে এই আকাশের মাথায় আরেক আকাশ ভেঙে পড়ল। মাত্র ২৫ মিনিটের মতো সে রিকশায় ছিল, ভাড়া চাইছে ১০০ টাকা, এবং এক টাকাও সে কম নিবে না, তার যুক্তি সে তাকে অনেক যায়গা ঘুরিয়েছে এবং একটা ভাল হোটেল এর সন্ধান দিয়েছে এজন্য এটা তাঁর প্রাপ্য। আকাশ আর ঝামেলায় না গিয়ে ১০০ টাকা দিয়ে তাকে বিদেয় করলো।

সে নিচতলায় একটা রুম ভাড়া করলো, ম্যানেজার কে তাঁর ভালোই মনে হলো। ম্যানেজার বলল খাবার ইচ্ছে করলে বাইরে থেকেও নিতে পারে, অথবা হোটেল এর বয় কে টাকা দিলে সে বাইরে থেকে নিয়ে এসে দেবে।

প্রথম দিনের বিল চুকিয়ে আকাশ রুমে গেলো। গোসল সেরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে বের হয়ে প্রথমেই সোহেল ভাই কে কল দিয়ে তাঁর হোটেল থেকে পতেঙ্গা যাওয়ার সিএনজি ভাড়া শুনে নিয়ে একটা সিনজি ভাড়া করে চলে গেল পতেঙ্গায়। এইবার আর সে ভুল করে নি, প্রত্যেকবার কিছু করার আগে সোহেল ভাই থেকে ফোন করে জেনে নিচ্ছে কি করতে হবে। সোহেল ভাই তাকে অবশ্য একটু বকা দিয়েছে প্রথমেই রিকশাওয়ালা কাম দালাল এর ক্ষপ্পরে প্যড়ে বোকা বনে যাওয়ার জন্য। আর হোটেল এ সাবধানে থাকার পরামর্শ দিলেন।

দুপুর আর বিকেল টা পতেঙ্গা বন্দর এ কাটিয়ে ফিরে এল সে হোটেল এ, সন্ধ্যায় খেয়ে নিলো হোটেল বয় এর নিকট টাকা দিয়ে খাবার নিয়ে এসে, এজন্য হোটেল এর লোককে টাকা দিতে হলো ৫০ টি। মনে মনে ভাবলো আকাশ এর থেকে বাইরে গিয়ে নিজে খেয়ে আসাই তো ভালো ছিলো।

দুপুরে শুধু ব্যাগ টা হোটেল এ রেখেই চলে গিয়েছিল রুমে তালা দিয়ে। এখন ফিরে রুম টা দেখল ভালোভাবে। ছোট একটা সিঙ্গেল রুম। একটা খাট, তাতে মেরুন রঙ এর একটা চাদর। একটা তৈলাক্ত বালিশ। আকাশ তাঁর তোয়ালে বের করে বালিশ এর উপর রেখে দিল। সামনে ছোট টেবিলটার উপর একটা সাদা-কালো টেলিভিশন রাখা, এই দিনেও হোটেল এ সাদা-কালো টেলিভিশন দেখে খুব অবাক হয়েছিল আকাশ। এটাচড বাথরুম। সব মিলিয়ে খারাও মনে হল নাহ। কমদামে ভালই হোটেল পাওয়া গেছে ভাবলো সে।
এমনিতেই সে খুব ক্লান্ত ছিল, লম্বা ট্রেইন জার্নি আর বিকেলের পতেঙ্গা যাওয়া আসার সিএনজি জার্নি করে সে অনেক ক্লান্ত হয়েছিল। ভেবেছিল রাতে একটু পড়াশোনা করবে সকালের পরিক্ষার জন্য। কিন্তু চোখ আর খোলা রাখতে পারছিলো নাহ। তাড়াতাড়ি আবারো গোসল করে ঘুমিয়ে পড়লো সে।

কয়েক ঘন্টা পরে যখন পিঠে একের প এক ছাড়পোকা কামড় দেয়া শুরু করলো, তখনি সে অল্প দামের হোটেল এ থাকার মজা টা বুঝতে শুরু করলো। ঘড়িতে সময় দেখলো রা ১ টা। সে ভাবলো আর ঘুমোতে যখন পারবো না, জেগে একটু পড়াশোনা করা যাক।

সে রসায়ন বই টা বের করে খুলতেই দরজায় নৃদু আওয়াজ আসলো। সে ভেবে পেলো না এত রাতে দরজায় কে আসলো। সে মনে মনে আল্লাহ্‌ কে ডাকতে আরম্ভ করলো। একটু পড় ম্যানেজার এর গলা শুনা গেলো, “স্যার, দরজা খোলেন”। আকাশ আশ্বস্ত হয়ে দরজা খুললো, ম্যানেজার বললো এই যে নেন। আকাশ দেখলো ম্যানেজার এর পিছনে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই বুঝে ফেললো কি ঘটছে এইখানে। আকাশ শুধু বলতে পারলো আপনি ভুল করছেন, আর মনে মনে বার বার আল্লাহ কে ডাকতে লাগলো। তখন ম্যানেজার ও বুঝতে পারলেন নিজের ভুল, ও সরি স্যার, আমি ভেবেছি আপনি ১০৪ নাম্বার রুম এর। এই বলে সে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেলো। আকাশ সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লো। সে অনেক ভয় পেয়েছিল, এরকম ভয় জীবনে এর আগে পায় নি। অযু করে সে নফল নামায পড়তে বসলো, বিপদ থেকে রক্ষার শোকরানা হিসেবে।


 ১৫
নামায শেষে কিছুক্ষণ পড়তেই ফযরের আযান পড়লো, এই সময়েই সে ফযর নামাজ ও শেষ করে রেডি হওয়া আরম্ভ করলো। সকাল ৮ টায় তাঁর পরীক্ষা, শিফট সিস্তেম করায় এই ঝামেলা, তাঁর পরীক্ষা প্রথম শিফটে পড়েছে। সাড়ে পাচটায় সে ব্যাগ সহ একেবারে বেড়িয়ে পড়ল হোটেল থেকে, এই হোটেল এ আর ফেরার ইচ্ছা নেই তাঁর, যদিও ২ দিনের ভাড়াই সে পরিশোধ করেছে। রাত ৮ টায় বাস, সে ঠিক করেছে, এর আগ পর্যন্ত সে বাইরেই ঘুরবে।

সিএনজি ভাড়া করে ইউনিভার্সিটি পৌছাতেই সাড়ে ৬ টা বেজে গেলো। যে বন্ধু দের সিট এই ইউনিভার্সিটিতেই পড়েছিল তাদের ফোন করে দেখলো প্রত্যেকের ফোন ই বন্ধ। রাগে সে নিজের ফোন ও বন্ধ করে ফেলল।

সোয়া ৭ টার মাঝেই সে নিজের আসন খুঁজে নিয়ে বসে পড়ল, বিবিএ অনুষদ এর ১১২ নাম্বার রুম এ তাঁর সিট পড়েছিল, জানালার পাশে। ওএমআর শীট দিয়ে দিল পৌনে ৮ টায়। এ সময় সে হঠাত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো নীল রং এর জামা পড়া একটি মেয়ে দৌড়ে ২ তলায় উঠছে, পিছন থেকে দেখায় তাঁর মুখটি সে দেখতে পায় নি। এইসব গুরুত্বপূর্ণ পরিক্ষায় কেউ কি এরকম দেরী করে আসে!!


 ১৬
৯ টায় পরীক্ষা শেষ হলো। আশানুরূপ পরিক্ষাই দিয়েছিল আকাশ। সন্তুষ্ট চিত্তে আকাশ বের হয়ে আসলো। বাস স্ট্যান্ড টা রেইল স্টেশনের পাশেই, তাই সে ভাবলো ভার্সিটির শাটল ট্রেইন দিয়েই সে চট্টগ্রাম স্টেশন এ যাবে, তারপর সেখান থেকে বাস স্ট্যান্ড এ গিয়ে বসে থাকবে বাস ছড়ার আগ পর্যন্ত। সন্ধ্যায় নাজিম সেখানে আসবে, পড়ে ২ জন একসাথে চলে আসবে।

ফোন অন করে বড় ভাইয়া আর মা কে ফোন করে জানালো পরীক্ষা ভাল হয়েছে, এরপর নাজিম কে কল দিলো, নাজিম জানালো তাঁর পরিক্ষাও ভালো হয়েছে, কিন্তু সে আজ আকাশ এর সাথে যেতে পারবে নাহ।
তাঁর মামাকে নিয়ে সে পরের দিন ঢাকা ফিরবে! আকাশ এর মেজাজ আবারো খারাপ হয়ে গেলো, সে আবারো ফোন বন্ধ করে দিলো। ভার্সিটির স্টেশনে গিয়ে দেখে মাত্রই একটি ট্রেইন ছেড়ে দিল আর তাতে তিল ধারণের জায়গা নেই। সে আর সেটাতে উঠার চেষ্টা না করে বসে রইলো। ৪৫ মিনিট পড় দেখলো আরেকটা ট্রেইন আসলো এবং সাথে সাথেই ট্রেইন এর ছাদ ভরে গেলো ছাত্র দিয়ে।

আকাশ দৌড়ে একটা বগিতে উঠে পড়ে দেখলো কয়েকটা সিট খালি আছে দরজার পাশেই!
সে নিজের ব্যাগ দিয়ে ২ টা সিট দখল করলো। এক জন এসে জিজ্ঞেস করলো কেউ আছে এইখানে? আকাশ নিজের অজান্তেই বললো হ্যা আছে।!

ট্রেইন ছাড়তে দেরি দেখে আকাশ দরজায় এসে দাড়াল। ট্রেইন এর দরজায় বাইরেটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগে আকাশের। মাঝেই মাঝেই যখন সে বাড়ি যায় তখনি সে দরজায় দাঁড়ায় কিছু সময় এর জন্য। সব কিছু ট্রেইন এর সাথে মিলিয়ে যেন আকাশ এর পাশে পাশে চলতেছে, এইটা দেখতে আকাশের খুব ভালো লাগে। রাতের বেলা ত্রেইন এর জানালা দিয়ে যখন চাঁদ দেখা যায়, তখন আকাশ অবাক হয়ে চাঁদ এর দিকে তাকিয়ে থাক। দেখা যক্সায় চাঁদ ও তাঁর পাশে পাশেই চলছে। আকশের তখন মনে হয় চাদটা শুধুই তাঁর, একান্তই তাঁর!!


 ১৭
এসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেইন ছেড়ে দিল, ট্রেইন ছেড়ে দিতেই দেখে একটি মেয়ে দৌড়াছে ট্রেইন ধরার জন্য। আকাশ কি মনে করে হাত বাড়িয়ে দিলো। মেয়েটি দৌড়ে এসে হাত ধরলো। স্টেশন এর প্লাটফর্ম অনেক নিচু হওয়ায় মেয়েটি ট্রেইন এর নাগাল পাচ্ছিলও না, আকাশ নিজের সর্বশক্তি দিয়ে এক হাতে ট্রেইন দরজা দরে, মেয়েটিকে অন্য হাতে টান দিল। এইবার মেয়েটি ট্রেইন এর দরজায় পা দিতে সক্ষম হল এবং একটু পরেই ট্রেইনে উঠে এসেই আকাশ কে ধন্যবাদ দিলো হাসিমুখে।

আকাশ কিছু না বলে তাঁর সিটের দিকে এগোল, মেয়েটিও তাঁর পিছে পিছে গিয়ে বললো আমার নাম নীলিমা কাম নীলা আর তুমি? নাম বলার এই অদ্ভুত স্টাইল এ আকাশ অবাক না হয়ে পারল না! আকাশকে দেখেই নীলা বুঝে গিয়েছিল সেও তাঁর মতই পরীক্ষার্থী, তাই সয়ারাসরি তুমি ই বলেছিল! আকাশ এমনিতেই প্রথম কথায় ছোট বড় সবাই কে আপনি বললেও নীলার ক্ষেত্রে তা করলো না, সরাসরি তুমিই বললো। আকাশ এবার তাকে বসতে বললো এবং ব্যাগ সরিয়ে জায়গা করে দিলো। নিজের নাম টাও জানালো নীলাকে। একটু আগে যে আকাশ কে জিজ্ঞেস করেছিলো এই সিটে কেউ আছে কিনা, সে আকাশ কে দেখে একটা মুচকি হাসি দিলো। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মুচকি হাসির পিছনে একটা করে রহস্য থাকে, যা কেউ কখনো জানতে পারে না, আকাশ ঐ মুচকি হাসির রহস্য খুজতে গেলো না।

নীলা তাঁর ব্যাগ টা উপরের ক্যারিয়ার এ রাখার জন্য একটু সামনে গেলো। আকাশ পিছনে তাকিয়ে অবাক হলো, এই মেয়েটিকেই সে সকালে দৌড়াতে দেখেছিল। আকাশ এবার কথা বলা শুরু করলো-
- নামটা এইভাবে বললে কেনো?
- আমার নাম নীলিমা চৌধুরি নীলা, প্রথমে কাউকে বললে সবটূকু না বলে বলি নীলিমা কাম নীলা, এতে সম্পূর্ণ নাম ও যেমন বলা হয়, তেমনি ডাক নামটাও বলা হয়ে যায়!
- ও, তা সকাল বেলা ওইভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেনো?
- আরেহ, তুমি আমাকে সকালেও দেখেছো নাকি?
- হ্যা, আমি নিচতলায় পরীক্ষা দিয়েছি, জানালার পাশে সিট ছিল, দেখলাম তুমি ২য় তলায় দৌড়ে যাচ্ছ।
- আর বলো নাহ, আমি ভেবেছি আমার সিট বিজ্ঞান অনুষদ এ, তাই প্রথমে ঐখানে যাই, কিন্তু ঐখানে যেয়ে দেখি আমার সিট বিবিএ অনুষদ এ। এদিকে পরীক্ষা প্রায় শুরু হল বলে। ওখান থেকে তাই পরে প্রায় দৌড়েই বিবিএ অনুষদ এ যাই। তখনি হয়তো তুমি দেখেছো!

মেয়েটার কথা বলায় অন্যরকম একটা টান আছে, শুধু শুনতেই ইচ্ছে হয়। আকাশ শুধু শুনেই যাচ্ছিল, মেয়েটা একটানা অনেকগুলো কথা বলে গেলো। কথায় কথায় জানা হলো মেয়েটার বাড়ি কুষ্টিয়ায়, বাবা চাচ্ছিলেন মেয়ে যেন শুধু কুষ্টিয়া আর ঢাকায় পরীক্ষা দেয়। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছা আরো পরীক্ষা দেবে, সারা দেশ দেখবে, স্বপ্ন সীমাহীন! তাঁর বাবার কথা ছেলেদের মত অত ঘুরতে হবে না, মেয়ের কথা ছেলেরা পারলে আমি পারবো না কেনো! কিন্তু বাবা কোনভাবেই রাজি হন নাহ! তাই বাবাকে বলেছে ঢাকায় পরীক্ষা দেয়ার জন্য যাচ্ছে, ঢাকায় তাঁর মামার বাসা। ৮ তারিখে ঢাকায় এসেছিল, সেখান থেকে তাঁর এক ভাই কে বলে ১১ তারিখ রাতের এক এডমিশন কোচিং এর রিজার্ভ বাসে একটা সিট ম্যানেজ করে নিয়েছে চট্টগ্রাম আসার জন্য এবং মামা বাসায় ছিলেন নাহ, মামীকে বলেছে বান্ধবীর বাসায় যাবে, এই বলে ১১ তারিখ বিকেল এ বের হয়ে চলে এসেছে চট্টগ্রাম! কোচিং এর বাস এ তাঁর ২ বান্ধবী ছিল, তাদের সাথে বাবা-মা ও ছিল। তাদের সাথে মিলে সে এসেছে! বাস চট্টগ্রাম জিইসি এর মোড় এ সবাইকে নামিয়ে দিয়েছে এবং আজ সন্ধ্যায় সেখান থেকেই আবার নিয়ে যাবে সবাইকে! বোনের বিপরদের কথা বলে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম আসার জন্য ম্যানেজ করেছিল! এখন নীলা ঠিক করেছে, ফিরবে ট্রেইনে!

আকাশ এতক্ষণ শুধু অবাক হয়ে শুনেই যাচ্ছিল। একটা মেয়ে একা এসেছে পরীক্ষা দিতে সম্পূর্ণ অচেনা এক শহরে! ভাবতেই অবাক লাগছে তাঁর। এ কি করে সম্ভব! প্রথমে বিশ্বাস ই হতে চাচ্ছিল না তাঁর। কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় ছিল না, মেয়েটার কথা শুনে মনে হচ্ছিল এ মেয়ে মিথ্যা বলতে পারে নাহ।

অতি হালকা গড়নের মেয়ে নীলা, নীল জামায় তাকে স্বর্গের অপ্সরীর মত লাগছিলো। আকাশ জানালার পাশের সিটে তাকে বসিয়েছে, চুল গুলো খোলা ছিল, বাতাসে তা নীলার মুখের উপর এলো হয়ে আসছে, কিন্তু সে তা ঠিক না করে অমনিই রেখে দিচ্ছে, অন্য কাউকে হয়তো এভাবে পাগুলের মতো লাগতো, কিন্তু নীলাকে লাগছে সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দৃশ্য যেন তাঁর সৌন্দর্য কে বাড়িয়ে দিয়েছে আরও বহুগুণে। আকাশ শুধু অবাক থেকে অবাকতর হচ্ছিল নীলাকে দেখে।


 ১৮
লোকাল ট্রেইন, খুব ধীরে ধীরে চলে, লোকে মাঝে মাঝে একে গরুর গাড়ি বলে, কেন বলে আকাশ এই শাটল ট্রেইন এ না উঠলে বুঝতে পারতো নাহ। কথায় কথায় অনেক কথা হয়ে গেলো ২ জনের মাঝে। নীলা বলছিল এখান থেকে সে স্টেশন এ যাবে, টিকেট কেটে বিকেল এর ট্রেইনেই ঢাকা ফিরে যাবে। ট্রেইন এর টিকেট কেটে মামাকে জানাবে যেন তাকে রাত এ স্টেশন এ নিতে আসে, আর তারপর বাসায় গিয়ে ক্ষ্মা চেয়ে নিবে। কথাগুলো এত সহজভাবে বলে ফেললো সে। একটুও ভাবলো না, যে সে না বলে এতদুর এসেছে, এটা শুনলে তাঁর পরিবার তাকে কি বলবে। আসন্ন বাঁধাকে সে একদম ই গ্রাহ্য করে না তা তাঁর কথাতেই খুব ভালো বুঝা যায়। আকাশ বললো এর আগেও কি বাসায় না বলে এমন ভ্রমণ করেছে কিনা! সে বললো এতদুর কখনো একা আসেনি, তবে এমন ধরণের কাজ আরও অনেক করেছে। বাসায় না বলে ২ দিন বান্ধবির বাসায় থেকেছে, বাড়িতে না বলে মামাকে ফোন দিয়ে মামার বাসায় চলে এসেছে, পরে অবশ্য যখন সবাই জেনেছে, তখন প্রচুর বকেছে, কিন্তু এডভেঞ্চার এ সে যে আনন্দ টা পায়, বকা তা কোন অংশেই কমাতে পারে নাহ!

নীলা এসএসসি পরিক্ষার পরে থেকেই ঢাকায় থাকে, মামার ওখানে। পড়েছে শহীদ লেঃ আনোয়ার গার্লস কলেজ এ। মামা আর্মি অফিসার। তাঁর ওখানেই এখনো থাকে। মামাকে বললে বাবার নিষেধ স্বত্বেও তিনি নীলাকে নিয়ে আসতেন চট্টগ্রাম এ। নিজের মেয়ের মতই আদর আর স্নেহ করেন তিনি নীলাকে, কিন্তু তিনি ট্রেনিং এর জন্য দেশের বাইরে ছিলেন, এজন্য নীলা তাকে কিছু জানাতে পারেনি। আজ সকালে তিনি দেশে ফিরেছেন!

আকাশ কে নীলা তাঁর সব কথাই বলে ফেলল, প্রচুর কথ বলা মেয়ে এবং অনেক চঞ্চল। অচেনা জায়গায় অনেক রকমের বিপদ হতে পারে এ যেন তাঁর কল্পনার বাইরে, সবাইকে আপন করে নেওয়ার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে তাঁর মাঝে। আকাশ প্রথমেই তা বুঝতে পেরছে, আকাশ কে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, অতি অল্প কথায় আকাশ নিজের সম্পর্কে বলে ফেলল। আকাশ কে নীলা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, সে কি বিব্রত বোধ করছে নাকি তাঁর সাথে কথা বলতে!!

এবার আকাশ ও সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মিশে গেল নীলার সাথে। হাস্যরসের নানা কথায় তারা চলে এল পাহাড়তলী স্টেশন এ। এখান থেকেই নীলা চলে যাবে ঢাকায়। মনে হতেই আকাশের কেমন লাগলো, মুখে কিছু প্রকাশ করলো নাহ। সবে মাত্র দুপুর হয়েছে, তাঁর বাস রাত ৮ টায়। নীলা কে নিয়ে ট্রেইন থেকে নেমে স্টেশন এ হাটা শুরু করলো। নীলা বললো, ব্যাগ টা ধরতে সে, টিকেট এর জন্য লাইন এ দাঁড়াবে। এবার আকাশের কেমন লাগলো, সে একটা মেয়ের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে আর মেয়েটা টিকেট কাটবে, এ তো অসম্ভব। সে কিছু না বলে নীলাকে তাঁর ব্যাগটা ধরিয়ে কাউন্টার এর দিকে এগোল, গিয়েই হতাশ হয়ে ফিরে এলো। বিশাল লম্বা লাইন। সিট পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। নীলাকে এ কথা বলতেই নীলার মুখে একটু চিন্তার ছায়া পড়লো। সে বললো, এখানে বাস কোথা থেকে যায় জানো কি? আকাশ মাথা নেড়ে জানালো সে জানে। নীলা বললো তাকে সেখানে নিয়ে যেতে, স্টেশন এর পাশেই বাস কাউন্টার। সেখানে যেয়ে আকাশ প্রায় প্রত্যেকটা বাসের কাউন্টার এ খোজ নিয়ে দেখলো সব টিকেট শেষ, কোনটাতেই আসন নেই! এ কথা শুনে নীলা সত্যিই মুষড়ে পড়লো। এরকমটা হতে পারে, সে তা ভাবেই নি। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া স্পষ্ট দেখা গেলেও মুখে কিছু বললো নাহ, বললো, চলো এখন খাওয়া দাওয়া করি, ক্ষুধা পেয়েছে। আকাশ তাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট এ গেলো, নীলা ওয়াশরুম এ গেলে, আকাশ নাজিম কে আবারো কল দিলো, কনফার্ম হওয়ার জন্য যে সত্যি আজ থেকে যাবে কিনা! নাজিম জানালো সে সত্যি আজ থেকে যাবে, মনে মনে খুশিতে লাফ দিলো আকাশ, কিন্তু ফোনে নাজিম কে সংক্ষিপ্ত একটা ঝাড়ি দিয়ে ফোন আবারো বন্ধ করে দিলো।

 ১৯
অনেকটা বিষণ্ণ বদনে ওয়াশরুম থেকে ফিরে এল নীলা। নীলাকে হাসিমুখে যেমন অনিন্দ্য সুন্দর লাগে, বিষণ্ণ বদনে তাঁর মুখটাকে অসম্ভব মায়াময় লাগে। তাঁর দুঃখ ভরা মুখ দেখে আকাশের ও খারাপ লাগলো। খাবার এর অর্ডার দিয়ে আসলো আকাশ। দেখা গেলো খাবার খাওয়ার সময় একটা কথাও বললো না নীলা। খাবার শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল ২ জনে। দেখে নীলা কিছু বলছে নাহ। আকাশ ও কিছু বললো না, একসাথে ২ জনে রাস্তায় হাটা শুরু করলো। কিছুদুর এগিয়ে যাওয়ার পর একটা ছোটখাট টিলা এর মত জায়গা চোখে পড়লো, পাশে বেঞ্চি রাখা কিছু। জায়গা টা পার্কের মত মনে হল অনেকটা। অনেকক্ষণ পর নীলা বললো বসবো একটু। রাস্তার পাশে বেঞ্চিতে বসলো নীলা। আকাশ ব্যাগটা নীলার পাশে রেখে হাটতে লাগলো, একটু এগিয়ে যেয়ে দেখতে পেল পার্কটিতে মেলা বসেছে।

এক লোক সাপ খেলা দেখাচ্ছে, এইসব দেখলে আকাশের হাসি পায়, তবু আজ কেন জানি, দেখতে লাগলো দাঁড়িয়ে। আজ আকাশের মনটা অনেক ভালো। কিছুক্ষণ সাপ খেলা দেখে মেলায় দোকানগূলো ঘুরতে লাগলো। একটি দোকানে যেয়ে দেখলো কিছু ব্রেইসলেট, আকাশ বেশ দেখে শুনে একটা ব্রেসলেট কিনে ফেললো, কেনো কিনলো সে নিজেও জানে না, কিন্তুই কিনে ফেললো। উজ্জ্বল নাহ, খুব হালকা রং এর।

একটি নীল পাথরের আংটি হাতে নিতেই নীলার কথা মনে পড়ল তাঁর। দেখলো প্রায় ৩০ মিনিট হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি ফিরতি পথ ধরলো। ফিরে এসে দেখে নীলা বেঞ্চেই বসে আছে, কিন্তু তাঁর মুখ দু’হাত দিয়ে ঢাকা। সে এসে নীলাকে ডাকলো, নীলা কিছু বললো নাহ। আকাশ বললো কি হয়েছে? নীলা এইবার মুখ থেকে হাত সরালো, দেখলো তাঁর মুখ সম্পূর্ণ ফোলা, মনে হল একটু আগেই কেদেছে। আকাশ বললো সরি, তোমাকে একা রেখে যাওয়া উচিত হয় নি। নীলা বললো, না তা নয়, আমার আসলে একা এখানে আসাই উচিত হয় নি। আমি এতদিন শুধু চেনা জায়গায় বারবার একা গিয়েছি, কিন্তু অচেনা জায়গায় কি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তা আমার জানা ছিল না। আমি তো ভেবেছি অতি সহজেই ট্রেইন বা বাস যেকোন একটা দিয়ে চলে যাবো, আগে তো সবসময় তাই করেছি, কিন্তু এমন অবস্থায় কখনো পড়ি নাই।

আকাশ দেখলো নীলা প্রায় কান্না করবে আবারো এমন অবস্থা। আকাশ এবার বললো যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে তবে তুমি আমার সাথে ঢাকায় ফিরতে পারো, দেখি আমি তোমার জন্য বাসের টিকেট ম্যানেজ করতে পারি কিনা। এ কথা বলার সাথে সাথেই নীলার মুখে স্পষ্ট কৃতজ্ঞতার ছাপ দেখতে পেল আকাশ। মুখে শুধু একটা সম্মতির হাসি দিলো।

এবার আকাশ টিকেট ম্যানেজ করার নামে একটু দূরে যেয়ে বন্ধ ফোনটা কানে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলার অভিনয় করল। কিছু কিছু সময় আসে, যখন একটু মিথ্যা অভিনয় করতে হয়, সেটা শুধুই নিজেকে সান্তনা দেয়ার জন্য না, অপরজনের কাছে নিজেকে একটু তুলে ধরার জন্য!!

নীলার মুখ থেকে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া চলে যেয়ে আবার আগের মত লাবণ্য ফিরে এসেছে দেখে আকাশের মনটা এমনিতেই ফুরফুরে হয়ে গেলো। নীলাকে বললো চলো একটু ঘুরে আসি। নীলা হেসে বলল, চলো!


 ২০
আকাশ আর নীলা পাশাপাশি হাটছিলো। বেলা প্রায় ৩ টা। বাসের এখনো প্রায় ৫ ঘন্টা বাকি! নীলাকে আকাশ জানিয়েছে, সে নীলার জন্য একটা টিকেট এর ব্যাবস্থা করে ফেলেছে, বাস ৮ টায়, কোন সমস্যা হবে না। বলেই বুঝে ফেলেছে এ কথা তাকে বলার প্রয়োজন ছিল না, চঞ্চলা এই মেয়েটা নিজেকে সম্পূর্ণভাবেই আকাশের উপর সমর্পণ করে দিয়েছে। এখন নীলাকে ঢাকায় পৌছে দেয়া আকাশের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন আকাশের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। রানীর সেবায় যেন সে সেনাপতির মত আদেশের অপেক্ষায় ছিল। একটা চুইংগাম মুখে দিয়ে সেটা দিয়ে বাবল বানানোর চেষ্টা করছে নীলা, দেখেই হেসে ফেললো আকাশ! একদম বাচ্চাদের মতোই রয়ে গেছে মেয়েটা এখনো। ২ জনে হাটতে হাটতে একটা মন্দির এর পাশে চলে এসেছিল, নীলা বলল চলো আমরা এখানে যাই, আকাশের আপত্তি স্বত্বেও নীলা তাকে টেনে নিয়ে মন্দির এ প্রবেশ করলো। একে একে সব মূর্তির সাথে আকাশ কে পরিচয় করিয়ে দিল, আকাশ ও ছেলে মানুষের মতোই সবাইকে হ্যালো বললো। স্বরস্বতী আর লক্ষী দেবীর সাথে নীলার কি বাক্যালাপ, মনে পড়লেই এখনো আকাশ আপন মনেই হেসে ফেলে! কি ছেলেমানুষ ই না ছিল মেয়েটা।

লক্ষী দেবীর কাছে তাঁর এত্তগুলো নালিশ, কেনো তাকে সে একটা এয়ার রিং দিচ্ছে না, সে তাঁর বাবাকে বললেই এনে দিবে, কিন্তু সে বাবার কাছে নেবে না, সে দেবীর কাছ থেকেই নিবে! দেবীর কাছে সব হিন্দুরা প্রার্থনা করে অনেক কিছুই পায়, তাঁর বান্ধবী রা নাকি তাকে বলেছে লক্ষী দেবীর কাছে তারা যত্ত গহনা আর খেলনা চেয়েছে, তাঁর নাকি সব পেয়েছে, তাহলে নীলা কেন পাবে না? সে বললো এমন করলে কিন্তু দেবীর সাথে সে আড়ি দেবে!

আকাশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে শুধু নীলার কান্ড দেখছিলো।

এবার লক্ষী দেবীকে রেহাই দিয়ে নীলা গেলো বিদ্যার দেবী স্বরস্বতী এর কাছে। ওরে বাবা! এর কাছে আরো অনেক বেশি নালিশ তাঁর। কলেজ এ থাকতে নাকি দেবীর জন্যই সে ফেইল করেছিল। তাঁর কোন বান্ধবী তাকে বলেছিল এই দেবীর কাছে বিদ্যা চাইলে সে অনেক জ্ঞান দান করেন, কিন্তু নীলা ঢাকেশ্বরী মন্দির এ গিয়ে চেয়ে এসেছিল তাঁর বান্ধবী এর সাথে, কিন্তু দেবী তাকে নিরাশ করেছে, কেনো নিরাশ করলো?

আকাশ এবার আর কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলো না! জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? নীলা এবার অভিমানি গলায় বললো, কলেজ এ পড়ার সময় আমি দেবী কে বলে গিয়েছিলাম আগামীকাল আমি পরিক্ষায় না পড়ে যাবো, আমাকে হায়েস্ট নাম্বার পাইয়ে দিবে, কিন্তু সে পরিক্ষায় আমি ০ পেয়েছিলাম। কারণ আমি ভেবেছি দেবী আমাকে পাইয়ে দেবে নাম্বার, তাই তো আমি আগের রাতে কিছুই পড়ি নি।

আকাশের এ কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা হল। দেখলো তাঁর মতোই নীলাও হাসছে, ২ জনেই অনেক্ষণ হাসলো।

দেবীদের সাথে নীলার মান-অভিমানের কথা শেষ হলে তারা বেড়িয়ে পড়লো ওখান থেকে। তারপর সামনেই একটা চার্চ চোখে পড়ায় নীলা বলে চলো না, ওখান থেকেও একটু ঘুরে আসি। আকাশের কিঞ্চিৎ আপত্তি নীলার আগ্রহের কাছে হার মানলো। আকাশের মতোই নীলাও কখনো চার্চ এ যায় নি! এবার ই তারা প্রথম চার্চ এ গেলো। চার্চ এর ফাদার তাদের জিজ্ঞেস করলো তারা কেনো চার্চ এ এসেছে, নীলা খুব শান্ত ভাবে আশ্চর্য ধীরতার সাথে বললো আমরা আপনাদের সম্পর্কে জানতে এসেছি। ফাদার মৃদু হেসে বললো এসো বাছারা! চার্চ এর শুধু প্রার্থনা ঘরটি ই তারা দেখতে পেলো। ফাদার তাদের প্রার্থনা করার কায়দা দেখালো, বাইবেল এর কয়েকটি কথা এবং সেগুলোর মাহাত্য সম্পর্কে তাদের জানালো। আকাশ-নীলা একযোগে ফাদার এর কথা শুনে গেলো। এগুলো শুনতে শুনতে বিকেল হয়ে গেলো। ফাদার কে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো ২ জনেই।

 ২১
চার্চ থেকে বেরিয়ে আকাশ খোজ করলো চট্টগ্রামের বিখ্যাত শাহী মসজিদ এর। এ মসজিদ দেখার শখ তাঁর অনেক দিনের। কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করে মসজিদ এ পৌছালো তারা। নীলাকে বাইরে বসিয়ে রেখে অযু করে মসজিদ এ প্রবেশ করলো। মসজিদ টা ঘুরে দেখে নামায শেষ করে বেরিয়ে এল সে। মসজিদ এ প্রবেশ করলেই মন টা একদম দুঃখশূন্য হয়ে যায় আকাশের। প্রাণবন্ত হয়ে উঠে অনেক।

সামনেই ফুচকার দোকান দেখে নীলা বলে ফুচকা খাবো। আকাশ মুচকি হেসে বলে তাহলে প্রতিযোগিতা, কে কয়টা খেতে পারে! নীলা বলে যে জিতবে তাঁর জন্য কি থাকবে? আকাশ কিছু না ভেবেই বলে ফুচকার বিল সে দেবে আর এখান থেকে ডান দিকের মোড়ে যেয়ে প্রথম যে দোকান পড়বে তা থেকে যা কিনে চাইবে তাই পাবে সে। নীলা মৃদু হেসে বললো, চলো তাহলে!

আকাশ ভেবেছিলো সহজেই নীলা কে হারিয়ে দেবে, কিন্তু আকাশ ২২ টির বেশি সিঙ্গেল ফুচকা খেতে পারলো না। নীলা আকাশের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে ২৫ টি তে যেয়েই থামলো। প্রাণখোলা হাসিতে নীলাকে অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগছিলো।
নীলা কখনো জানতেও পারলো না, আকাশ ইচ্ছে করেই হেরেছিলো তাঁর কাছে, শুধু তাঁর বিজয়ের ওই হাসিটি দেখার জন্য। কেন জানে না, আকাশ, নীলাকে তাঁর খুব আপন মনে হচ্ছিল, এত অল্প সময়ের মধ্যেই কেমন আকাশের এত কাছে সে গেছে, যা অন্য কেউ কখনোই পারে নি।

চুক্তিমতো বিল চুকিয়ে আকাশ ডান দিকের মোড় পেরিয়ে প্রথম দোকানে প্রবেশ করলো, দেখে ঘড়ির দোকান। নীলা কে বললো কোনটা নেবে? নীলা হেসে বললো, হেরেছো তুমি, তোমার জন্য সান্ত্বনা পুরস্কার হলো, তুমি যেটা পছন্দ করে দিবা, আমি সেটাই নিবো। আকাশ তাঁর কেনা ব্রেইসলেটটির কালারের সাথে মিলিয়ে একটি ঘড়ি নিলো। নীলা সাথে সাথেই তা হাতে পড়ে নিলো, নিজের হাতের টা খুলে ব্যাগ এ রাখলো। ঘড়ী কিনে তারা দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লো।

বাইরে এসেই আকাশ দেখলো, নীলা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বারবার হাসছে। আকাশ জিজ্ঞেস করতেই দেখলো, ঘড়িটি চলছে না। পরে তারা আবার ফিরে গেলো দোকানে। দেখলো, তারা ব্যাটারী দোকানে ফেলে গিয়েছিলো। আকাশ ও জানতে পারে নি, নীলাই ব্যাটারি খুলে রেখে গিয়েছিলো। এবার দোকানে আসার পর নীলা বললো, আমি তোমাকে ঘড়ি কিনে দিতে পারবো না, কারণ আমি জিতেছি, তবে বন্ধু হিসেবে, তোমার ঘড়ির চেইন টা বদলে দিবো। তারপর নিজের পছন্দ মতো একটা চেইন পছন্দ করলো, যেটায় খোদায় করা অক্ষরে A লিখা ছিলো। আকাশের ও খুব পছন্দ হলো। মনে মনে খুশি হলেও মুখে শুধু মৃদু ধন্যবাদ দিলো।

এবার নীলা তাঁর চোখের চশমার গ্লাস চেইঞ্জ করার জন্য চশমার দোকানে গেলো। আকাশ দোকানে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিলো। আকাশ শুধু আজ সারাদিন নিয়ে ভাবতেছিলো। এ কি করে সম্ভব, বিধাতা কি এই লিখে রেখেছিলেন? নীলার সাথে তাঁর এভাবে দেখা হয়ে গেলো কেনো? জবাব নেই! কে দেবে জবাব?

 ২২
ট্রেইনের ঝাকিতে আকাশের ঘোড় কেটে গেলো। তাঁর ট্রেইন যমুনা সেতু পার হচ্ছে। এই সেতু সে অসংখ্যবার দেখেছে। একবার সে বাসে ঢাকা আসার সময় এই সেতুর মাঝে নেমেছিলো। কত স্মৃতিঘেরা সেতু। বন্ধুরা মিলে সেবার অনেক মজা করেছিলো এইখানে। রাহাত সেতুর মাঝে শুয়ে অনেক বড় জ্যাম এর সৃস্টি করেছিল। আকাশরা তো ঘাবড়ে গিয়েছিলো। পরে তাদের বাসের ড্রাইভার বের হয়ে ট্রাফিক পুলিশ কে বলে সে আসলে অজ্ঞান হয়ে বাস থেকে পরে গেছে, সে যাত্রায় তাঁর রেহাই পেয়ে যায়। রাহাত আসলেই অন্যরকম ছিলো। রাহাত এর সাথে কথা হয় না কতদিন!! গ্রীন কার্ড পেয়ে সে আমেরিকা চলে গিয়েছে। প্রথম প্রথম ফোন করত অনেক, এখন আর করে না, ব্যাস্ত হয়ে গেছে হয়তো। আকাশ ও তো এখন অনেক ব্যাস্ত। পড়াশোনা করা শেষ। এবার যে করেই হোক একটা চাকরি যোগাড় করতেই হবে। ভাইয়া একা তো অনেকদিন ধরেই সংসার টা চালাচ্ছে, ছোট ভাই আর বোনটাও এখন বড় হয়ে গেছে, ভাই এর নিজের পরিবার আছে, আকশ কে যে করেই হোক, কালকের ইন্টারভিউ এই চাকরি টা পেতে হবে। আকাশ এর প্রস্তুতি ও খারাপ নাহ। ব্যাংক এর জন্যই সে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ও আছে, এখন বাকিটা আল্লাহ্‌ এর ইচ্ছা। আল্লাহ্‌ ভরসা করেই আছে সে!

ট্রেইন যমুনা সেতু পার হয়ে নিজস্ব গতিতে চলা শুরু করেছে। আকাশ আবারো অতীতে ফিরে গেলো নীলার কাছে।


 ২৩
নীলা চশমা লাগিয়ে বেরিয়ে এসেই চিৎকার দেয় ওই যে প্যাগোডা, বৌদ্ধদের প্রার্থনার জায়গা। আকাশ কে বারবার বলতে লাগলো তাকে সেখানে নিয়ে যেতে। আকাশ নীলা কে নইয়ে এগিয়ে গেলো। কিন্তু এখানে মন্দির আর চার্চ এর মতো এত সহজেই প্রবেশ করতে পারলো নাহ। এখানকার লোকেরা তাদের প্রবেশ এর অনুমতি দিলোই নাহ। হতাশ হয়ে ফিরে এল ২ জনেই।

আকাশ কে নীলা বললো আবারো আমি চট্টগ্রাম আসবো, তুমিও আসবে, সেবার আর তোমাকে নিয়ে যেতে বলবো না, আমিই তোমাকে নিয়ে এই প্যাগোডা তে প্রবেশ করবো, মনে রেখো কথাটা। নীলার বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো আকাশ।

নীলা বললো
- কবে এসেছো এখানে?
- গতকাল সকালে।
- ছিলে কোথায়?
- হোটেল এ।
- ছেড়ে দিয়েছো?
- নাহ, আজ পর্যন্ত ভাড়া নিয়েছি।
- আমি ফ্রেশ হবো, আমাকে নিয়ে যাও।
- হোটেল এ?
- হ্যা।

নীলার নির্লিপ্ত জবাবে আকাশ অবাক হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু প্রয়োজন সেহেতু যাওয়া ছাড়া উপায় ও ছিলো নাহ। ২ জনে মিলে ফিরে গেলো হোটেল এ। রিসেপশন এ ম্যানেজার কে আকাশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলো। ম্যানেজার এর সম্মতিতে আকাশ রিসেপশন এ বসে রইলো, নীলা রুম এ যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো, পরে নীলাকে রিসেপশন এ বসিয়ে রেখে, আকাশ রুমে যেয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো একেবারে।


 ২৪
সন্ধ্যা ৭ টার দিকে তারা হোটেল থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ড এর দিকে হাটা শুরু করলো। রাতের রাস্তায় হেটে চলা সত্যিই অন্য রকম এক অনুভুতি। পাশে নীলা থাকায় এই হেটে চলার মাঝে অন্যরকম এক শীতল শান্তির পরশ পাচ্ছিল আকাশ। নীলা কথা বলে উঠল
- উল্কাপাত দেখেছো?
- হ্যা, কেনো?
- ধূমকেতু দেখেছো?
- নাহ, সেটা তো আর উল্কার মতো প্রায় ই হয় না।
- এখন বলো, আমি তোমার জীবনে উল্কা না ধূমকেতু?

এমন প্রশ্নে আকাশ থমকে গেলো, কিছু ভেবে পাচ্ছিল না, কি জবাব দেবে! আসলে সে নিজেও বুঝতে পাচ্ছিল না, কেন বিধাতা তাকে হঠাত নীলার মুখোমুখি করলেন। উল্কা আর ধুমকেতু নিয়ে ভাবা শেষ হওয়ার আগেই আবার নীলার প্রশ্ন

- সিগারেট খাও?
- নাহ, কেনো?
- কখনোই খাও নি?
- নাহ, একবার ঠোটে ছুই নি।
- আমি কিন্তু ছুয়েছিলাম একবার, কেনো জানো?
- শুনেছিলাম, সিগারেট এর ধুয়ার সাথে নাকি দুঃখ সব উড়ে যায়।
- তোমার দুঃখ কি উড়িয়ে দিতে পেরেছিল সিগারেট এর ধুয়া?
- নাহ, এসব আসলে মানুষের মনগড়া কথা। সত্যিকারের দুঃখ টা কোনভাবেই কমে না, সেটা সিগারেট ও কমাতে পারে না, ভুলাতেও পারে না।
- তোমার কিসের দুঃখ, জানাতে পারো, বন্ধু হিসেবে।
- পরের সাক্ষাতে বলবো।

বলেই নীলা চুপ হয়ে গেলো। এদিকে তারা প্রায় বাস স্ট্যান্ড এ এসে গিয়েছিলো। আকাশ রাস্তার জন্য কিছু খাবার কিনে নিলো, নীলা কিছু বলছিলো নাহ। বিরিয়ানি, কেক, বিস্কুট, কোক আর পানি নিয়ে ২ জনে বাসে উঠে পড়লো।

বাস ছাড়তেই আকাশ বললো
- জবাব পেয়েছি তোমার কথার।
- কী?
- তুমি বলেছিলে তুমি উল্কা না ধুমকেতু, তাই না?
- হ্যা।
- তোমার সাথে এই যদি একমাত্র দেখা হয় তাহলে তুমি ধুমকেতু, কিছুদিন পর আবার দেখা হলে তোমাকে উল্কা বলা যাবে, কিন্তু তখন তোমাকে আর আমি উল্কা থাকতে দেবো না, আমার আকাশে তোমাকে চাঁদ বানিয়ে নেবো।
- সত্যি তো?

নিজের কথায় আকাশ নিজেই অবাক হয়ে যায়, নীলার কথার জবাব দিতে পারে না সে। আবার নীরবতা। ২ জনই চুপ থাকে। এ নীরবতা ভাঙ্গে না কেউই। বাস চলতে থাকে।

কিন্তু নীলার মতো মেয়ে বেশিক্ষন চুপ করে থাকতে পারে না হয়তো। বাস কিছুক্ষণের মাঝেই সীতাকুণ্ড প্রবেশ করে। সীতাকুণ্ডের পাহাড়গুলো দেখে নীলার কি উচ্ছাস! একটু পরপর ই আকাশ কে ডেকে বলে দেখ, কি বড় পাহাড়! নীলা আবারো বলে
- আমার অনেক দিনের শখ হলো বাংলাদেশের সরবোচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চারপাশ টা দেখবো, মাঝেই মাঝেই আমি ছাদে উঠে যেখানে পানির ট্যাংক থাকে, ওখানে উঠে চারপাশ দেখি। নিজেকে নিজেকে রাণি রাণি মনে হয় তখন।
- বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাহাড় কেনো? কেনো পৃথিবীর সবথেকে বড় পাহাড়ের চূড়া নয় কেনো? স্বপ্ন যেহেতু, সেটা অনেক বড়ো না কেনো?

এটা শুনে নীলা একটু চুপ থাকে, তারপর আবার বলে
- আমি বাংলাদেশ কে ভালবাসি, কখনো এই দেশের বাইরে যেতে চাই না, এখানের বাইরে গেলে আমি মরেই যাবো।
- এতো ভালবাসো?
- হুম, আমি তো নিজেকে বিদেশে কল্পনাই করতে পারি নাহ!
- খুব ভালো।

ভালো বলেই আকাশ চুপ করে যায়। ভাবে আবারো নীলা কে নিয়ে, কি মেয়েরে বাবা! সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছে, একা! অথচ শুধু এই দেশেই থাকতে চায় সারাজীবন। সত্যি অদ্ভুত এই মেয়ে।

নীলার দিকে তাকায় আকাশ, তন্দ্রালু চোখ তাঁর। চোখে-মুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। নীলাকে জানালার পাশে বসিয়েছে আকাশ। উপরের আকাশে নীল রং এর চাঁদ। চাঁদের নীল আলো নীলার মুখে পড়েছে। আকাশের কাছে নীলাকে স্বর্গের অপ্সরী মনে হচ্ছে। সে যে এই পৃথিবীর কেউ, আকাশের বিশ্বাস ই হতে চায় না।

নীলা, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। একটু পড়েই ঢলে পড়লো আকাশের কাধে নীলার মাথা। আকাশ শুধু থমকে বসে রইলো। সব কিছু তাঁর স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সে কিছু ভাবতেই পারছে নাহ। হঠাত বাস রাস্তার ডিভাইডার এ প্রচন্ড ঝাকি খেলো, নীলা জেগে যেতে পারে ভেবে আকাশ চোখ বন্ধ করলো। নীলা সত্যি জেগে গেলো। আস্তে করে আকাশের কাধ থেকে মাথা তুলে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আমরা এখন কোথায় আছি”। আকাশ জবাব দিলো না। জবাব না পেয়ে আবারো নীলা আকাশের কাধে মাথা রেখে চুপ করে থাকলো। আকশ ও কিছু বললো না আর।

বাস কুমিল্লায় থামলো বিরতির জন্য একটা রেস্টুরেন্ট এ। নীলা নেমে রস্টুরেন্ট এ ঢুকলো, পিছু পিছু আকাশ ও। আকাশ শুধু ২ টা রুটির অর্ডার করলো, নীলা বললো কিছু খাবে না, সে বাসে উঠেই বিরিয়ানি খেয়েছিলো। নীলা মামাকে ফোন করলো, এত রাতে নীলার ফোন পেয়ে মামা অবাক হয়ে গেলো। বারবার জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? মামাকে আশ্বস্ত করে নীলা বলল, সব ফিরে বলছি, তুমি শুধু সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড এ আসো ২ ঘন্টা পর। নীলার মামা চিন্তিত হয়ে ফোন রেখে দিলেন। শুধু ভাবলেন এ মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না, কখন যে কি করে!!

নীলা আকাশ কে বললো, বাসের টিকেট কোথায়? আকাশ বললো আমার কাছে। নীলা বললো প্রথম থেকেই তোমার কাছে টিকেট ছিলো, তাই না? আকাশ এবার ধরা পড়ে গেলো, তাই কিছু বললো না। নীলা টিকেট দেখতে চাইলো। আকাশ নীলাকে টিকেট টা দিয়ে খাবার আনতে চলে গেলো। খাবার আনার সময় দূর থেকে আকাশ দেখলো নীলা টিকেট এ কি যেনো লিখছে, কাছে আসতেই দেখলো ফোন নাম্বার লিখছে ওখানে নীলা। আকাশ কিছু বললো না। এসেই বললো, তুমি তাহলে খাবেই না? নীলা চমকে মাথা তুলে বললো না, তুমি খাও। আকাশের খাওয়া শেষ হলে নীলা টিকেট টা ফেরত দিলো। আকাশ সেভাবেই তা পকেট রেখে দিলো।

তারপর আবার শুরু হলো যাত্রা। কিছু কথাবার্তা হতেই নীলা আবার ঘুমিয়ে গেলো, আকাশের কাধে আবারো মাথা! আকাশ শুধু আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকলো। হঠাত তাঁর ব্রেসলেট টার কথা মনে পড়ল, সে ব্যাগ থেকে তা বের করে নীলার ডান হাতে পরিয়ে দিলো। সত্যি খুব সুন্দর মানিয়েছে হাতে। আকাশ শুধু হাত ২ টার দিকে চেয়ে রইলো।
এক হাতে তাঁর দেয়া ঘড়ি, অন্য হাতে ব্রেসলেইট টা।

আকাশ কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো, মনে নেই, বাসের কন্ডাক্টর এর হাকে ঘুম ভাঙ্গলো। ভোর হয়ে গেছে। নীলা তখনো ঘুমিয়ে। সায়েদাবাদ যারা নামবে, তাদের প্রস্তুত হতে বলছে। আকাশ নীলাকে ডাকলো। নীলা উঠে দেখে তাঁর মামা তাকে বারবার কল দিচ্ছে, নীলা মামাকে বললো, প্রায় এসে পড়েছে। ফোনটা টা রাখতেই, কন্ডাক্টর বললো, সায়েদাবাদের যাত্রীরা নামুন। নীলাকে আকাশ কিছু বলার সুযোগ ই পেল না, সব কি দ্রুত ই না ঘটে গেলো। নীলা শুধু মৃদু একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে গেলো।

আকাশ এর তখন সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। গাবতলী স্ট্যান্ড এ সে নামলো। বাস থেকে নামতেই দেখেই, নিহাল, কবির, অন্তর, সোহেল ভাই, ইদ্রিস ভাই, ইসহাক ভাই, তাঁর নিজের বড় ভাই সবাই এইখানে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ কি হচ্ছে তা ভাবতেই পারছিলো নাহ। ভাইয়া দৌড়ে এসে আকাশ কে জড়িয়ে ধরে বললো, কি হয়েছিলো রে তোর? কোন সমস্যা? আমাদের জানালি না কেনো?
সবাই একের পর এক প্রশ্ন করছিল। নিহাল তো আকাশ দেখেই জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো।
আকাশ বোকার মতও দাঁড়িয়ে ছিলো তখন। ভাইয়া বললো, তোকে কি ছিনকারী ধরেছিল? সোহেল ভাই বললো, কোন সমস্যা হলে কল দিতে বলেছিলাম মনে ছিলো না? সারাদিন এ কি একবার ও যোগাযোগ করা গেলো না? কারো নাম্বার ই মুখস্ত ছিলো না?

আকাশের এতক্ষণে হুশ হলো যে, সে তো গতকাল দুপুর থেকে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। সবার প্রশ্নবাণে আকাশ শুধুই থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষগুলো তাকে এত ভালোবাসে সে কল্পনাও করতে পারে নাই, সোহেল ভাই এই বাস এর টিকেট কেটেছিলো, তাই তারা সবাই সারারাত এখানে এসে বসেছিল। বড় ভাইয়া রাজশাহী থেকে ছুটে এসেছে। এই ভালবাসা অমূল্য। আকাশ এদের ভালবাসা সারাজীবন ধরে পেতে চায় এভাবেই।

শেষ পর্যন্ত আকাশ তাঁর ফোন বন্ধ করে আর খোলার কথা মনে ছিল না, এ কথা বলার পরও ভাইয়ারা তাকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য বকা ঝকা করতে লাগলো। বকাও মাঝে মাঝে কত মধুর হয় আকশ সেদিন বুঝতে পেরেছিল।

আর সবকিছুর মাঝেও আকাশের চোখে তখন নীলার বিদায়বেলায় রহস্যময় হাসি ভাসছিল আর ঘুম জড়ানো কন্ঠে ধন্যবাদ টা কানে বাজছিল………….


 ২৫
ধন্যবাদ।

মেয়েলি কন্ঠে কথাটা শুনতেই আকাশ লাফিয়ে উঠলো। দেখলো, ট্রেইনে একটি মেয়ে আরেকজন কে ধন্যবাদ দিলো। ট্রেইন এয়ারপোর্ট স্টেশন এ এসে থেমেছে।

২০১৭ সাল এখন।
নীলার সাথে দেখা হয়েছিল ২০১২ এর অক্টোবর এ। আজো সব মনে পড়ে আকাশের। কারণ তারপর নীলার সাথে তাঁর আর কোনদিন ও দেখা হয় নি। কত খুঁজেছে। কোন লাভ হয় নি।
নীলাকে সে বলেছিলো, পরের বার দেখা হলে তাকে নিজের আকাশে চাঁদ করে নেবে, তা আর হয় নি। নীলা আকাশের জীবনে এক ধূমকেতু হয়েই রয়েছে এখনো।

এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আকাশ নেমে গেলো স্টেশন এ। খুবক্লান্ত লাগছে।

সোহেল ভাইদের বাসায় এসে উঠলো সে। সোহেল ভাই এর এক ছেলে আর এক মেয়ে। বাচ্চা ২ টা অনেক কিউট। মাত্রই কথা বলা শিখেছে ছোট ছেলেটা। আকাশ কে যখন বাচ্চারা মামা বা চাচা ডাকে, আকাশের খুব ভালো লাগে।

সোহেল ভাই কাজের জন্য বাইরে ছিল। বাচ্চাদের সাথে একটু খেলা করেই ঘুমাতে গেলো ক্লান্ত আকাশ।
কাল সকালে তাঁর ভাইভা। চাকরিটা তাকে পেতেই হবে।



 উপসংহার
আজ আকাশের ভাইভা। ফযরের সময় ঘুম থেকে উঠেই নামায পড়ে বসে আছে সে। সোহেল ভাই ও তাঁর সাথে বসে আছে। বার বার সাহস দিচ্ছে তাকে। আকাশ অবশ্য ঘাবড়াচ্ছে না। সে জানে, আল্লাহ্‌ রহমত করবে।

১০ টায় ইন্টারভিউ। আকাশ আজ একটু তাড়াতাড়িই বের হল। ৭ টায় রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লো সে। সোহেল ভাই গাড়ি করে পৌছে দিতে চাইলো, কিন্তু আকাশ বললো, সে বাসেই যাবে। সোহেল ভাই জানে, তাকে জোর করে লাভ নেই। তাই যেতে দিল তাকে। মনে মনে আকাশের জন্য শুভ কামনা করলো।

বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ। আজো প্রচন্ড ভীড়। সকাল ৭ টার বাসে বেশিরভাগ লোক অফিস এ যায়। প্রত্যেকটা বাস এ অসম্ভব ভীড় থাকে।
২ বারের চেষ্টায় ২ টা বাসে সে উঠতে পারে নি। এবার যে করেই হোক সে উঠবে। মনে মনে স্থির করলো সে।

এর পর ই একসাহে ৩ টা বাস আসলো। সবাই উঠতে পারলো এবার। আকশ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো এবার। বাস ছেড়ে দিতেই, একটি মেয়েলী চিৎকার শুনলো সে, দাড়ান দাড়ান, সে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো, একটি মেয়ে দৌড়াচ্ছে।

ড্রাইভার কে বলে বাস স্লো করালো আকাশ, মেয়েটি কাছে আসতেই হাত বাড়িয়ে দিল সে। মেয়েটি বাসে উঠেই হাপাতে লাগলো। হাতের কাগজ দেখে বুঝলো মেয়েটিও ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। আকাশ মেয়েটি উঠে পড়েছে দেখে পিছনে গিয়ে সিটে বসলো। দেখলো মেয়েটিও তাঁর দিকেই আসছে!

মেয়েটি ধন্যবাদ দিলো। আস্তে করে বললো, আপনি না হলে এই বাসটাও মিস করছিলাম প্রায়। আকাশ একটু হাসলো শুধু।

তারপরই মেয়েটি বললো, “আমি নীলিমা নীলা, আপনি?”

কথাটা শুনেই আকাশ চমকে তাকালো তাঁর দিকে! হ্যা, ওই তো। আকাশ কিছু বলছে না দেখে, মেয়েটি তাঁর হাত আকাশের চোখের সামনে তুলে নাড়িয়ে বললো, কি হলো?
আকাশ আরো অবাক হয়ে দেখলো, মেয়েটির হাতে সেই ব্রেসলেট আর আর ঘড়ি। রং পুরোনো হয়ে গেছে, কিন্তু আকাশের চিনতে ভূল হয়নি।

মেয়েটি এবার তাকে মৃদু ধাক্কা দিলো। কিন্তু আকাশের ঘোর তো কাটছেই না। সে শুধু ভাবছে, নীলা কে কি করে জবাব দেবে, যে বাসের টিকেট টি পরে আর সে খুঁজে পায় নি!!!!!!!!!

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০৬

পরিবেশ বন্ধু বলেছেন: লম্ভা গল্পকথা কিছুটা পড়েছি শুরুটা অনেক ভাল পরের অংশ পড়ে নেব । শুভকামনা

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:১৫

নীরব অনুধাবক বলেছেন: হুম বেশ লম্বাই হয়ে গেছে, পড়ার পর কেমন লাগলো জানাবেন, হাজার হোক আমার প্রথম গল্পকথা বলে কথা!!!! ধন্যবাদ ভাই।

২| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪৩

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: ব্লগীয় প্রেক্ষাপটে, এত দীর্ঘ গল্প থেকে পাঠকের মতামত জানার ব্যাপারটি বেশ কঠিন হয়ে যাবে।
অন্য কিছু গল্প দিন, যা তুলনামুলক ভাবেই ছোট। সেই গল্প পড়ে মতামত জানানো যাবে। তবে এখানে যা প্রকাশ করেছেন, তার ব্যাপারেও মতামত দিব, পরে একসময় পড়ে।


শুভ কামনা রইল

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৭

নীরব অনুধাবক বলেছেন: প্রথম লিখা তো, তাই অনেক বড় হয়ে গ্যাছে। :(
আর নতুন লেখক তো, তাই লেখার সীমা মাথায় ছিলো নাহ। :P

আপনার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

৩| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৩৫

হোয়াইট ফায়ার বলেছেন: অসাধারন।

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৮

নীরব অনুধাবক বলেছেন: এত্তগুলা ধন্যবাদ আপনারে ;)

৪| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪০

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: অনেক লিখেছেন । তবে আমার মতে কয়েক জায়গায় টেনে অযথাই বড় করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে ।

আমি ব্যাক্তিগতভাবে গল্পের প্রয়োজনে বড় লেখার পক্ষপাতী । স্বল্প লেখায় অনেক সময় লেখার মূল ভাব ও গতি প্রকৃতি ভালোভাবে প্রতিস্ফুটিত হয় না ।

ভালো থাকবেন ।।

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৫

নীরব অনুধাবক বলেছেন: সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই। আপনিও ভালো থাকবেন। :)

৫| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৬

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
হাত খুলে লিখেছেন বিস্তৃতি সহযোগে ৷ স্মৃতি,বিস্মৃতি,জীবনকর্ষণ, প্রেরণা ও স্বপ্নকথন পুরোটা জুড়েই ছিল ৷ আবহ ছিল শেষাংশ পর্যন্ত ৷

বারবার পূণর্পাঠে বাহুল্যতা ছেটে ফেলে খানিক সম্পাদনা সাথে যথার্থ শব্দের ব্যবহার করে পূর্ণতা আসবে ধীরে ধীরে ৷ পাঠকের মতামত হিসেবে নিবেন ৷

মঙ্গল হোক ৷

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৭

নীরব অনুধাবক বলেছেন: পরামর্শের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.