| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আসলে আমরা অনেক সময় বলে থাকি যে বৃটিশরা আমাদের কে শাষন করে গেছে। কথাটা এক হিসাবে ঠিক আবার অন্যহিসাবে বলতে গেলে আমাদের এই উপমহাদেশে বৃটিশ রাজ্যের কোন যুদ্ধ জাহাজ বা যোদ্ধা-বাহীনি কিন্তু আসেনি বা বৃটিশ রাজন্যবর্গও এসব দিক প্রথমে খেয়াল রাখত না। আসলে এই উপমহাদেশ লুটে পুটে খেয়ে গেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি,যার শেয়ার হোল্ডারগন তৎকালীন বৃটিশ মন্ত্রী এম.পি. গন। আর তারা মনে করত বা নিজ দেশে প্রচার করত যে তারাই পৃথিবীর সবথেকে সভ্যজাতী আর পুরো পৃথিবীকে নানা কুসংস্কার যেমন উপমহাদেশের তথাকথিত অসভ্য মানুষ যারা সতি-দাহ প্রথা পালন করে, বিধবাদের কে মেরে ফেলে ইত্যাদি অনাচার থেকে আমরা না বাচালে কে তাদের শিক্ষা দিবে। তেমনই একটা নমুনা দেখুন চীনে তারা কিরত
এখন চীনের দিকে দৃস্টি দেয়া যাক। সমস্ত জাতীর মধ্যে অতি প্রাচীন জাতি হল এই চীন। তবে তা ভারতবর্ষের মত কোন ইউরোপীয় দেশের অধিন হয়ে যায় নি। সমস্ত দেশটাকে একত্রে বেধে রাখতে পারে এমন একটা কেন্দ্রীয় শাষন সেখানে ছিল। তার ফলে এবং বিদেশী আগন্তুকদের সাথে কিছু পরিমান লড়াই করে সে প্রায় উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝী কাল পর্যন্ত বিদেশীদের অধিনতাকে এড়িয়ে চলতে পেরেছিল। এরও একশ বছর আগে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে ভারত বর্ষ ভেঙে খান খান হয়ে পরল আর সেই সাথে চীনও দুর্বল হয়ে পড়ল তবু সে শেষ পর্যন্ত অখন্ডতা রক্ষা করে চলল। অপরদিকে জার্মান, বৃটেন, ফ্রান্স পুর্তগাল ইত্যাদি দেশের লোলুপ দৃস্টি যখন চীনের দিকে পড়ল তখন আমেরিকা যুক্তরাস্টের হুংকারে কেউ আর চীনের বেলায় বাড়াবাড়ী করতে পারল না কেননা আমেরিকায় শিল্প বিপ্লবের পর অার দাশ-প্রথা নিষিদ্ধ হওয়ার পরে সেই উনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের আহবানে সাড়া দিয়ে চীনের শাষক গোস্ঠী ব্যাপক হারে শ্রমিক পাঠায় সেখানে।
১৭৯২ সালের দিকের কথা ইংল্যান্ড একবার চীনের সাথে তাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য তোরজোর করেছিল কিন্তু ইউরোপে নানা গোলাযোগের কারনে তা আর হয়ে উঠেনি। বৃটিশদের চির শত্রু ফ্রান্সে নেপোলিয়নের পতনের কিছুকাল পরে তারা যখন স্বস্তির নিঃস্বাশ ফেলল তখন ১৮১৬ সালে আবার একটা বৃটিশ দুত পাঠানো হল। কিন্তু সেখানে আবার চীনের সম্ম্রাটকে সেজদা বা কোটাও করতে হত তারপ্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে যা বৃটিশ দুত কিছুতেই করতে চাইল না ফলে চীনের মহান সম্ম্রাট বৃটিশদুত লর্ড আমহার্স্টের সংগে দেখা করতেই রাজি হলেন না সোজা হুকুম দিলেন ফিরে যাও । কোটাও হচ্ছে ভুমিস্ঠ প্রনাম আপনারা অনেকেই চায়না মুভিতে দেখে থাকবেন। সুতরাং বৃটিশদের এবারের মতও কাজ কিছুই হলনা আবার ইতিমধ্যে একটা ব্যবসা দ্রুত বেড়েই চলছিল তা হচ্ছে আফিমের ব্যবসা। তবে এটা নতুন ব্যবসা নয় কেননা ভারতবর্ষ হতে পন্চদশ শতাব্দীতে চীনে অনেক ভাল জিনিষের সাথে আফিমও আমদানি হত্। তবে আপনাদের বোঝার সুবিধার জন্য বলছি ভারতবর্ষ মানে তখনকার দিনে আফগানিস্তান পাকিস্তানকেও বুঝান হত। তবে উনবিংশ শতাব্দীর আগে এই ব্যবসা তেমন বড় পরিসরে হত না যা পরবর্তীতে ইউরোপীয়রা বাড়িয়ে তুলল। আর ইউরোপীয়দের মধ্যে একেকসময় একেক ব্যবসার প্রচন্ড ঝোক ছিল যেমন পুর্তগীজরা মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া অধিকার করার পর এদের নাম দিল স্পাইস আইল্যান্ড আর সমানে মসলা বিক্রি করত ইউরোপের বাজারে, বৃটিশরা আফ্রিকা থেকে যেমন করে মানুষদের শিকলদিয়ে বেধে ইউরোপে ও আমেরিকার বড় বড় বাজারে বিক্রি করত দাশ হিসাবে।ঠিক তেমনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিলকরগন দাদন দিয়ে আমাদের পুর্বপুরুষদের নিকট থেকে নীল কিনে ইউরোপে বিক্রি করত । ওরই ধারাবাহিকতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীগন উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝিতে চীনে আফিম ব্যবসা বাড়িয়ে তুলল। শোনাযায় ডাচরা সর্বপ্রথম এই আফিমের ব্যবহার শুরু করে, তারা তামাকের সংগে আফিম মিশিয়ে ধুমপান করত তাতে নাকি ম্যালেরিয়া হয় না। ডাচদের মারফত আফিমের ধুমপানের অভ্যাস চীনে গিয়ে পৌছাল। কিন্তু গেল খুব খারাপ রুপে, চীনের লোকেরা খাটি আফিমের ধুমপান করত কোন তামাক টামাকের ধার ধারত না তারা । এর ফলে দেশের মানুষের স্বাস্থ অনেক খারাপ হচ্ছিল আর এর দরুন দেশ থেকে অনেক টাকা বাইরে চলে যাচ্ছিল বলে চীনা সরকার এই অভ্যাস বন্ধ করে দেবার চেস্টা করলেন।
১৮০০ সালে চীনা সরকার সরাসরি ডিক্রি জারি করলেন যে কোন অবস্থাতেই দেশে আর আফিম অামদানি করা যাবে না। কিন্তু বিদেশীদের কাছে এটা একটা লাভের ব্যবসা বিশেষ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। তাই তারা লুকিয়ে আফিম আমদানি করতে লাগল আর চীনা কর্মচারীদের ঘুষ খাইয়ে হাত করে নিল যাতে তারা এই চোরাকারবারীকে বাধা না দেয়। চীনা সরকার তখন আইন করলেন তাদের কোন কর্মচারী বিদেশী কোন বনিকের সাথে দেখা করা বা কথা বলতে পারবে না। কোন বিদেশীকে চীনা বা মান্ডারীন ভাষা শিখানোও অপরাধ বলে গন্য হবে। আর এসব অপরাধের অনেক গুরুতর সাজার ব্যবস্থাও করা হল কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আফিমের ব্যবসা ঠিকই চলতে লাগল আর ঘুষ এবং দুর্নিতীও চলল পুরোদমে। আবার এদিকে বৃটিশ সরকার ১৮৩৪ সালে চীনের ব্যবসায়ে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল তা উঠিয়ে দিয়ে সকলের জন্য এই ব্যবসাকে উম্মুক্ত করে দিলেন । কতটা উদার..........। এর ফলে ব্যবসা আরও বেড়ে গেল কয়েকগুন।
এর ফলে চীনের সরকার বেকে বসল আর লিন সে সি কে দায়িত্ব দিলেন অাফিম চোরাচালন বন্ধ করতে। আর তিনিও খুব কড়া হাতে দমন অভিযান শুরু করলেন। দক্ষিন চীনের গুয়াংজু রাজ্যের ক্যান্টন ছিল এই বেঅাইনি ব্যবসার বড়ো আড্ডা ফলে সে সি চলে গেলেন সোজা ক্যান্টনে। আর গিয়েই সমস্ত বিদেশী বনিকদের আদেশ দিলেন যার কাছে যত আফিম আছে তার সমস্তটা জমা দিয়ে দিতে হবে। প্রথমে এরা আদেশ মানতে অস্বিকার করল। লিন শেসি জোর করে তাদের মানিয়ে ছাড়লেন। আফিম ব্যবসায়ীদেরকে যার যার কুঠিতে আটকে ফেললেন। এদের অধিনস্ত চীনা কর্মচারী চাকর বাকর সহ সমস্ত মজদুরদের ছাড়িয়ে আনলেন শুধু তাই নয় বাইরে থেকে যাতে বৃটিশ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে কোন খাদ্যদ্রব্য না পৌছায় সেই ব্যবস্থা করলেন। এই জোরালো ব্যবস্থার ফলে ১৮৩৯ সালে মাদক ব্যবসায়ীরা কথা শুনতে বাধ্য হল আর কুড়ি হাজার বাক্স যার প্রতিটি বাক্সতে ৬০/৭০ কেজি করে আফিম থাকত, তারা চীনা কতৃপক্ষের হাতে তুলে দিল। লিন সে সি সমস্ত আফিম নস্ট করে ফেললেন। আর তাদের কে সোজা জানিয়ে দিলেন কোন জাহাজকেই অার ক্যান্টনে ভিড়তে দেয়া হবে না যদি না তার ক্যাপ্টেন প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি আফিম আমদিানী করবেন না। এই প্রতিশ্রুতি কেউ ভাঙলে চীনা সরকার ওই জাহাজ ও তার সমস্ত মালামাল বাজেয়াপ্ত করবেন।
কমিশনার লিন তার কাজে কোন ত্রুটি রাখলেন না ; যে কাজের ভার তার উপর দেয়া হয়েছিল তা তিনি খুব ভাল ভাবেই শেষ করলেন কিন্তু তিনি জানতেন না এর পরিনতি স্বরুপ চীন কে কি বিপদে পরতে হয়।
অবশেষে বাদল যুদ্ধ । চীনে আফিম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধই হচ্ছে আফিমের যুদ্ধ নামে পরিচিত। কিন্তু এ যুদ্ধ চীনাদের কাছে আফিমের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত হলেও পশ্চিমা বণিকদের নিকট এ যুদ্ধ ছিল বাণিজ্য যুদ্ধ। অর্থাৎ একই যুদ্ধ দুই পক্ষের নিকট ভিন্নভাবে পরিচিতি পেয়েছে। ১৮৪০ সালে এ্যাডমিরাল এলিয়টের নেতৃত্বে ইংরেজরা প্রচুর সৈন্য ও অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে চীনে আক্রমন করে। চীনারা এই আক্রমন প্রতিহত করে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়। এভাবে প্রথম ঈঙ্গ-চীন যুদ্ধ তথা প্রথম আফিমের যুদ্ধ সূচনা ঘটে। ইমানুয়েল সু বলেছেন, “এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে চীনারা বেআইনী আফিমের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল।” মূলত সে কারণেই ঐতিহাসিকরা এ যুদ্ধকে প্রথম আফিম যুদ্ধ হিসেবে নামকরণ করেছেন। যাইহোক চীনারা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অসীম সাহসের সঙ্গে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করলেও এলিয়টের নেতৃত্বাধীন বৃটিশ বাহিনীর যুদ্ধ কৌশল এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের নিকট পরাজিত হয় চীনা বাহিনী। এ যুদ্ধে প্রায় ২০,০০০ চীনা সৈন্য এবং মাত্র ৫০০ বৃটিশ সৈন্য নিহত হয়।
যুদ্ধ অবসান হয় যেভাবেঃ
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চীনা সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য চীনা সম্রাট চিয়া চিং দ্রুত ইংরেজদের সাথে শান্তি স্থাপনে ব্যগ্র হন। প্রথমেই দেশপ্রেমিক লিন সে সুকে পদচ্যুত করে নির্বাসিত করা হয় এই অপরাধে যে তার ‘হঠকারী পদক্ষেপ’ এই যুদ্ধের জন্য দায়ি। এরপর চীনা সামন্ততান্ত্রিক সরকার কতকগুলো অপমানজনক শর্ত মেনে নিয়ে বৃটিশদের সাথে একটি অসম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। যে চুক্তিটি নানকিং এর চুক্তি নামে পরিচিত। ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্টে নানকিংয়ের চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রথম আফিমের যুদ্ধের আবসান হয়।
নানকিং সন্ধিঃ
ইংরেজরা চীনের নিকট থেকে মোট ২১ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার ক্ষতিপূরণ হিসাবে লাভ করে। এই ২১ মিলিয়নের মধ্যে যুদ্ধের জন্য সামরিক ক্ষতিপূরণ ১২ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার, লিন কর্তৃক বিনষ্ট আফিমের মূল্য ছিল ৬ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার এবং ক্যান্টনে হং বণিকদের বকেয়া ঋণ শোধের জন্য দিতে হয়েছিল ৩ রৌপ্য ডলার।
ক্যান্টনে কো-হং এর একচেটিয়া বাণিজ্যিক আধিপত্যের অবসান ঘটে।
ক্যান্টন, অ্যাময়, ফু-চাও নিংপো, সাংহাই- এই পাঁচটি বন্দরই ইংরেজদের কাছে উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বলা হয় যে, ব্রিটিশ কনসাল, বণিকেরা এবং তাদের পরিবারবর্গ এই অঞ্চলগুলিতে বসবাস করতে পারবে।
হংকং ইংরেজদের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দুই তরফের মধ্যে সরকারী চিঠিপত্রের ব্যাপারে সমতা স্বীকৃত হয়।
বিদেশী পণ্যের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক ধার্য করা হবে এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই পরিমাণ নির্ধারিত হবে।
যুদ্ধ পরবর্তী বিদেশী প্রভাবগুলো কি ছিল এবং তার ফলে কি হলঃ
বোগের সন্ধি চুক্তিঃ
১৯৪৩ সালের ১৮ অক্টোবর নানকিং সন্ধি চুক্তির সম্পূরক একটি সন্ধি চুক্তি চীন ও বৃটেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধি চুক্তি বোগের সন্ধি চুক্তি নামে অভিহিত। এই সন্ধির শর্তসমূহ-
১.আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যের উপর ৪ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হবে। রপ্তানিকৃত পণ্যের নির্ধারিত শুল্কের পরিমান হবে
১.৫০ শতাংশ থেকে ১০.৭৫ শতাংশ।
২. ব্রিটিশরা চীনে “অতি আঞ্চলিক অধিকার” লাভ করে। অর্থাৎ ব্রিটিশ কনসালরা চীনে বসবাসকারী
ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার করতে পারবে।
৩. ইংল্যান্ডকে চীনে সর্বাপেক্ষা অনুগৃহীত দেশের মর্যাদা দেওয়া হয়। বোগের সন্ধি চুক্তিকে হুমেনের সন্ধি চুক্তি বলেও অভিহিত করা হয়।
ওয়াংশিয়ার সন্ধি চুক্তিঃ
নানকিং চুক্তির পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বণিকেরা চীনে কিছু সুযোগ সুবিধা আদায় করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। ১৮৪৩ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কালেব কাশিং নামে বৈদেশিক দপ্তরের এক পদস্থ কর্মচারীকে চীনে পাঠায়। তার সঙ্গে আরও একজন সঙ্গি ছিলেন। তারা মাঞ্চু সরকারের কাছে আর্জি রাখেন যে, বৃটেনকে চীনে যে সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে আমেরিকাকেও সে সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এর অন্যথা হলে আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। ১৮৪৪ সালের মে মাসে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ চীন অভিমুখে আসতে থাকে। সন্ত্রস্থ চীনা সরকার আমেরিকার সাথে একটি অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ১৮৪৪ সালের জুলাই মাসের চীন ও আমেরিকার মধ্যকার এ চুক্তিকে ওয়াংশিয়া চুক্তি বলা হয়।
সন্ধির শর্তবলীঃ
চীনে বসবাসকারী কোন মার্কিন নাগরিক যদি কোন চীনার সাথে কোন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে তার বিচার করবেন আমরিকান কনসাল। একজন আমরিকান অপরাধীকে বিচার করার এক্তিয়ার চীনা আদালতের থাকবে না।
আমদানিকৃত বা রপ্তানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক ধার্য করার সময় বা এই শুল্কের হার পরিবর্তনের সময় চীনা সরকারকে আমরিকান কনসালের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। অর্থাৎ শুল্ক ধার্য করার স্বাধিকার চীন সরকার হারাতে বাধ্য হল।
বিদেশী বাণিজ্য-জাহাজ যখন তখন চীনের অভ্যান্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং সরকারের অনুমতি ছাড়াই চীন ছাড়তে পারবে। তাছাড়া আমরিকানরা পাঁচটি উম্মুক্ত বন্দরে তাদের গির্জ বানাবার অধিকার লাভ করে। বার বছর পর এই সন্ধির চুক্তি পুনর্বিন্যাস করা হবে।
হোয়াম্পেয়ার সন্ধিঃ
একইভাবে ব্রিটিশরা নানকিং সন্ধির মাধ্যমে এবং আমেরিকানরা ওয়াংশিয়া সন্ধির মাধ্যমে যে সুযোগ সুবিধা লাভ করে ফরাসীরাও হোয়াম্পেয়ার সন্ধির মাধ্যমে একই সুযোগ সুবিধা আদায় করে ছাড়ে। বরং তারা আরও কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা লাভ করে। যেমন চীনের পাঁচটি বন্দরে পাঁচটি ক্যাথলিক গির্জা তৈরির অনুমতি লাভ করে।
পরিশেষে যুদ্ধের চুড়ান্ত ফলাফল হিসেবে আমি বলতে পারি যে চীনা চিং সরকার প্রথম আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে তারা কতকগুলো অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হল। তদুপুরি চীনে আফিমের ব্যবসাতো বন্ধ হলোই না বরং তা আরও ব্যাপক হারে বেড়ে গেল। অসম চুক্তির মাধ্যমে চীন তার নিজস্বতা হারাল, কাউটাউ প্রথা বিলুপ্ত হল, নজরানা প্রথা বিলুপ্ত হল। শুধু তাই নয় এখন চীনকেই উল্টো বিদেশী শক্তিগুলোকে সম্মান দিতে হচ্ছে। সর্বোপরি তার চুড়ান্ত ফলাফল হল দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ।
পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলোর হাতে চীনের লান্জনা এই শুরু হল। তার সে নিভৃত একক জীবন আর রইল না। বিদেশী বানিজ্যকে তার মেনে নিতে হল আর মেনে নিতে হল খৃস্টান মিশনারিদে অশুভআগমনকে। সাম্রাজ্যবাদের অগ্রদুত হিসাবে এই মিশনারিরা চীনদেশে অনেক কান্ডই করে গেছে। এর পর থেকে চীনকে যতবার যত বিপদেই পড়তে হয়েছে তার অনেক ব্যপারেই এদের হাত ছিল। এদের আচরন অনেক ব্যপারেই ছিল অসহনীয় ও অভ্রদ্র অথচ চীনা আদালত তার বিচার করতে পারত না। নতুন সন্ধিটির শর্তই ছিল এরুপ, যে বিদেশীরা চীনে আসবে তারা চীনা আইন বা চীনা বিচারালয়ের অধীন থাকবে না। তাদের বিচার হবে তাদের নিজস্ব আদালতে। এই প্রথার নাম ছিল বর্হিদেশীয় সংক্রান্ত নীতি। প্রথাটি বিলুপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের পরে । আর এতকাল ধরে মিশনারিরা যেসব চীনাদের খৃষ্টান বানিয়েছে তারাও এই বিশেষ ব্যবহারের দাবি জানাত যার অধিকার চাইবার অধিকার কোন কালেই তাদের ছিল না কিন্তু তাতে কি হবে তাদের পেছনে রয়েছে স্বয়ং মিশনারী প্রভু; শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী জাতির মহামান্য প্রতিনিধি সে। অনেক সময় এরা এক গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের গন্ডগোল বাধিয়ে দিত আর যার ফল স্বরুপ প্রজারা এক সময় ক্ষেপে উঠত মিশনারীদেরকে আক্রমন করত অনেক সময় মেরে ফেলত। সংগে সংগে পেছন থেকে গ্রামবাসীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ত এদের পৃষ্ঠপোষক সেনা, মিশনারীরা আর তাদের পৃষ্ঠপোষক সেনারা সে অপরাধের একেবারে ভয়ংকর প্রতিশোধ নিয়ে তবেই ছাড়ত। আর প্রতিবারই তারা তাদের শর্তকে আপডেট করত বসাত আরও নতুন নতুন শর্ত। নিজেরাই পায়ে পাড়া দিয়ে গন্ডগোল পাকাত আর এর ফায়দাও নিত চরমভাবে। চীনে আজ পর্যন্ত যত বিদ্রোহ হয়েছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভয়ানক এবং নিষ্ঠুর একটি বিদ্রোহও শুরু করেছিল একজন চীনা খৃষ্ঠান। এই বিদ্রোহের নাম তাইপিং বিদ্রোহ’ 1850 সালের দিকে এর শুরু হয়। এই বিদ্রোহ শুরু করেছিল যে তার নাম হুঙ সিন চুয়ান্ তিনি একটি স্লোগান শুরু করলেন যে পৌত্তলিকদের হত্যা কর এই বলে সারা দেশ ব্যাপী ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এর ফলে অসংখ্য মানুষ নিহত হল। এই বিদ্রোহের ফলে চীনের অর্ধেকেরও বেশী স্থান লন্ডভন্ড হয়ে গেল। 1862 সাল পর্যন্ত প্রায় দু-কোটি লোক মারা পরল। চীন সরকার মনে প্রানে বিশ্বাস করল যে এর মুলে রয়েছে খৃষ্ঠান মিশনারীরা । এই ধারনার ফলেই বোঝা যায় তাদের কে চীনা সরকার কত ঘৃনা করত। তাদের চোখে মিশনারিরা ছিল সাম্রাজ্যবাদের চর। একজন ইংরেজ লেখন বলেছেন” প্রথমে মিশনারি, তার পর রনতরী, তার পর জমি দখল। চীনাদের মতে এই হচ্ছে ঘটনার পরম্পরা।
এই ধর্মোম্মাদ পাগল যে বিদ্রোহের নেতা, সম্পুর্নভাবে দমিত হওয়ার পুর্বেই তাতে এত বড়ো একটা কান্ড ঘটে গেল, এটা কেমন আশ্চর্য লাগে। এই লোকটার সাফল্যের প্রকৃত কারন হচ্ছে চীনে তখন প্রাচীন কালের রীতি নীতি গুলো ভেঙে পরছিল। বেড়ে যাচ্ছিল করের চাপ অথেনৈতিক ব্যবস্থাটাও পাল্টে যাচ্ছিল, মানুষের মনেও অসন্তোষ জমে উঠছিল। দেশের সর্বত্র মান্চু সরকার বিরোধী গুপ্ত সমিতি জেগে উঠছিল। দেশের বাতাসেই তখন বিপ্লবের বীজ ভেসে বেরাচ্ছে। বিদেশীদের বানিজ্য আফিম ও অন্যান্য জিনিষের ব্যবসা- এর অবস্থা আরও খারাপ করে দিচ্ছিল। ইউরোপ আমেরিকায় তখন শিল্প বিল্পবের জয়জয়কার তাদের দেশে উৎপাদিত সমস্ত পন্য নিজেদের দেশে বিক্রি করা যায় না তাই তারা এসব মাল চীন ভারতের মত বড় বড় বাজারেও বিক্রি করতে লাগল ফলে স্থানীয় ব্যবসা সংকুচিত হবার উপক্রম হল বেড়ে গেল অর্থনৈতিক অরাজগতা আর লোকের দুর্দশা, তাইপিং বিদ্রোহেরও জোর বেশী হয়ে উঠল এতে ।
এই ছিল চীনের তখনকার অবস্থা। আবার এদিক দিয়ে রানি মহান রানী ভিক্টোরিয়ার সময় ও বৃটিশরা আফ্রিকা থেকে লোকদের জোর পুর্বক ধরে এনে দাশ বানিয়ে আমেরিকার দক্ষিন অন্চলে বড় বড় খামারে বিক্রি করত । আর সেই খামারে উৎপাদিত তুলা বৃটেনের ল্যাংকাশায়ারে কারখানায় গিয়ে তৈরি হত কাপড় চোপড়। এই সমস্ত কাপড় কেনার মত লোক তখন বৃটেনে ছিল না তাই তারা এসব চীনে বিক্রি করত। এটা একটা ছোট দৃষ্টান্ত বা তৎকালীন বানিজ্যের একটা ছোট নমুনা। আর এই অবস্হা তখন ফ্রান্স জার্মান ইতালী আমেরিকা সব দেশেই ছিল আর চীন ভারত ছিল বড় বাজার। বৃটেন ছাড়া অন্যান্য দেশ ভারতের বাজারে সুভিধা করতে পারত না কারন এটা ছিল তার সরাসরি উপনিবেশ এখানকার বানিজ্য কর বন্দর ইত্যদি সবই ছিল তাদের কর্মচারীদের হাতে। তাই চীনের ব্যাপারে তাই বিভিন্ন দেশের দাবি বেড়েই চলল আর চীনা কতৃপক্ষের কাছে এত দেশের এত দাবি মেনে নেওয়ার মত অবস্থা ছিল না। চীনের আভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলা আর বিপদ আপদের সুযোগ নিয়ে এই ইউরোপীয় জাতীরা তার কাছ থেকে যথাসম্ভব সুযোগ-সুভিধা আর জমি আদায় করে নিচ্ছিল। এর অনেক পরে এসে জাপানও সেই বিদ্যা চর্চা শুরু করল।চীনের অবস্থাও ভারতের মতই হত। সেও এক বা একাধিক ইউরোপিয় দেশের বা জাপানের অধিন দেশে হয়ে যেত কিন্তু তাদের পারস্পরিক রেষারেষী ইউরোপে 1875 সালের দিকে জার্মানদের কর্তক ফ্রান্সের হেরে যাওয়া ও নতুন জার্মান নামে এক নতুন সাম্রাজ্যের উদয় হওয়ায় আর দুর থেকে আমেরিকা যুক্তরাস্ট্রোর হুংকারে চীন তখন কোনমতে গ্যাংরেপ থেকে বেচে যায়।
আফিমের যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে অনেক অপ্রাসংগিক কথা বলে ফেললাম, কিন্তু এর পরের ঘটনা বুঝতে হলে এর ক্ষানিকটা আপনাদের জানা দরকার ছিল। নইলে ঘটনার ধারাবাহিকতাকে সঠিকভাবে বোঝা যাবে না, ইতিহাসের ঘটনা আকস্মিক ভাবে কখনও ঘটেনা, ঘটে তার কারন , তার গোড়ায় অনেকগুলো কারন একত্রিত হয়ে, তবেই সে ঘটায়। কিন্তু এই সমস্ত কারনগুলিকে সবসময় দেখা যায় না বা সবাই দেখতেও পায় না, এরা থাকে বাইরের নানাবিধ ব্যাপারের তলায় লুকিয়ে। চীনের মাঞ্চু সম্ম্রাট গন এর কিছুদিন আগে পর্যন্তও বিপুল বিক্রমের সহিত সাম্রাজ্য শাষন করে আসছিল ও তাদের প্রাচীন প্রথাও অটুট রেখেছিল আর মেনে চলছিল কনফুসীয় দর্শন অতিন্দ্রীয় কে কখনও ইন্দ্রীয়ের উপর স্থান দিয়ো না। কিন্তু তারা তাদের ছাত্রদের বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তেমন আগ্রহী ছিলেন তারা অতীত ঐতিহ্যনিয়েই গর্ব করত। আর অন্যদিকে ইউরোপে প্রায় অস্টাদশ শতাব্ধীর শেষ পর্যন্ত পোপ আর গোড়া খৃষ্ঠানদের অত্যাচারে বিজ্ঞান চর্চা প্রায় বন্ধিই ছিল বলতে গেলে তখনকার দিনে শেলী শেক্সপিয়ারদের খুব কদর ছিল আর বিজ্ঞানিদের হয় পুড়িয়ে মারা হত না হয় সমাজচ্যুত করা হত । রসায়ন শাস্ত্র কে ফাদাররা বলত শয়তানের বিদ্যা, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শুরতেই ইউরোপের ধ্যান ধারনা পাল্টে যায়, বিভিন্ন দেশের রাজ পরিষদ থেকে ফাদারদের কার্য সংকুচিত করা হয় বা তাদের রাজনীতির বাইরে রাখা হয় । তাদের বলা হল যে তোমরা ধর্ম নিয়েই থাক । শুরু হল বিজ্ঞানরে জয়জয়কার অার আবিস্কৃত হল নতুন নতুন অনেক সৃত্র ও যন্ত্র। তখন কবি ও সাহিত্যিকদের মনে করা হত অকেজো জীব আর বিজ্ঞানীদের অপরিসীম শ্রদ্ধা করা হত। কিন্তু চীন তার অতীত নিয়েই রইল । 1842 সালে যে প্রথম আফিমের যুদ্ধে বৃটিশ বাহিনীর কাছে শক্তিশালী চীনের পরাজয় ঘটল তার মুল কারন বৃটিশ বাহিনী অনেক বেশী আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত ছিল।
এদিকে আবার চীনে প্রথম প্রবেশ করল বৃটেন; যুদ্ধ টুদ্ধ যা করার তাও করল বৃটেন; কিন্তু সেমাই পায়েশে এসে ভাগ বসাল ফ্রান্স ও আমেরিকা। তাই বৃটেন কিছুতেই তৃপ্ত হতে পারল না। এদিকে তাইপেং বিদ্রোহ নিয়েও চীনা সরাকার ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ল বাইরের কোন শক্তিকে মোকাবেলা করার সাধ্য তার আর রইল না। এই সময়কালকে বিদেশীদের জন্য চীনে সেরা সময় বলা যায়। এমতাবস্থায় বৃটেন চীনের সাথে যুদ্ধ বাধানোর আরেকটা ফন্দি খুজতে লাগল। যা পরের পর্বে লিখব।
©somewhere in net ltd.