নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কারাগার ইংরেজিতে যাকে প্রিজন আর প্রাচীন ফরাসি প্রিসাউন বলা হয়। কারাগার কী, এটা নিয়ে আর বিশদ বলার কিছু নেই। সবারই জানা আছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারের সঙ্গে আমাদের দেশের কারাগারের বিশল তফাত। আমাদের কারাগারে বন্দিদের মূল্যায়ন করা হয় তাদের অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার মাধ্যমে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কারাগারে বন্দিদের মূল্যায়ন করা হয় তাদের অপরাধের বিবেচনায়। সম্প্রতি আমাদের কারাগারে বন্দি ব্যবস্থা আবারো আলোচনায় এসেছে। ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড বাংলাদেশের একটি বহুল আলোচিত বিতর্কিত এমএলএম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যা পনজি স্কিম নামক প্রতারণামূলক পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা করত। যার বিরুদ্ধে এদেশের লাখো বেকার মানুষকে মিথ্যা স্বপ্নের প্রলোভন দেখিয়ে লুটে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। ধ্বংস করে দিয়েছে লাখো মানুষের স্বপ্ন, পথে বসিয়েছে লাখো পরিবারকে। বিতর্কিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের গ্রেফতার করে বিচারের জন্য জেলে পাঠানো হয় ২০১২ সালে। এই জেলখানা ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিদের জন্য কি সত্যি জেলখানা নাকি আরাম-আয়েশ ও নতুনভাবে ব্যবসা পরিচালনার জায়গা? না, এই জেলখানা মোটেও তাদের জন্য স্বাভাবিক জেলখানা নয়। তার প্রমাণ আমাদের গত কয়েক দিনের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কিছু সংবাদ।
ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমিন দীর্ঘ তিন মাস ধরে শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে অবস্থান করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেলে; আর সেখানে বসেই অনলাইনভিত্তিক অ্যাপস জুমের মাধ্যমে প্রায় পাঁচশত কর্মী নিয়ে নিয়মিত ব্যবসায়িক মিটিং পরিচালনা করতেন এবং নতুন এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। রফিকুল আমিনের সেই ব্যবসায়িক মিটিংয়ের কথা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে সরকারসহ কারা কর্তৃপক্ষ একটু নড়েচড়ে বসে। ইতোমধ্যে ৪ প্রধান কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত ও ১৩ কারারক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। সেই সঙ্গে রফিকুল আমিনকে হাসপাতালে প্রিজন সেল থেকে কেরানীগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়।
আমাদের দেশে কারাগারের এমন চিত্র নতুন নয়। এর আগে চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ভারতীয় নাগরিক জিবরান তায়েবী হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত আসামি চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাবেক সভাপতি খলিলুর রহমানের ছেলে ইয়াসিন রহমান টিটুর কথা সকলেরই জানা। ১৯৯৯ সালের ৯ জুন অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে জিবরান তায়েবীকে আগ্রাবাদের শেখ মুজিব রোডের চুংকিং রেস্টুরেন্টের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ২০০৭ সালের ২৮ মার্চ হাইকোর্ট ওই মামলার রায়ে অন্যতম আসামি ইয়াসিন রহমান টিটুকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন। রায় ঘোষণার সময় তিনি যুক্তরাজ্যে ছিলেন। চার বছর পর ২০১১ সালে দেশে ফিরে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাভোগ শুরু করেন। অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে এক বছরের বেশি সময় তিনি হাসপাতালে কাটান। পরে এ বিষয়ে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট হলে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর কারাগারে ডিভিশন নিয়ে আয়েশি জীবনযাপনই করছিলেন টিটু। এমনকি কারাগারে বসেই দীর্ঘদিন ধরে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য তত্ত্বাবধান করছেন। তবে হত্যা বা এ জাতীয় নৃশংস অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সাধারণত ডিভিশন পাওয়ার কথা নয়। তবে কথায় আছে, টাকার জোরই আজকাল বড় জোর। এই বছর জানুয়ারিতে টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে কারাগারের ভিতরেই কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেওয়াই স্টিলের ব্যবসায়িক নীতিনির্ধারণী সভা করার। এই সভা চলাকালে প্রতিষ্ঠানের সাবেক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে কারাগারের ভিতরেই মারধরের অভিযোগও তোলা হয়েছে টিটুর বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এই সভা আয়োজন করা হলেও সেদিন ‘মারধরের শিকার’ কেডিএস গ্রুপের কেওয়াই স্টিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মুনির হোসেন খান এই কিছুদিন আগে এই নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে মুখ খোলেন। পুরান ঢাকার সাংসদ হাজী সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিম কারামুক্ত হওয়ার পর তার গোঁফের স্টাইল ও রাজকীয় বেশভুষাই প্রমাণ করে কারাগারে তার আয়েশি জীবনের অবস্থা।
হলমার্ক গ্রুপের অর্থ কেলেঙ্কারি একটি বহুল আলোচিত ঘটনা। দেশে অনেক কর্তাব্যক্তিদের সহযোগিতায় সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখা থেকে হলমার্ক ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। পরে এই ঘটনায় হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তানভীরের স্ত্রী জেসমিন ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি, যেখানে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা-নেওয়া করার কথা, সেখানে তানভীর ও তার স্ত্রী জেসমিন ব্যক্তিগত মাইক্রোবাসে চেপে কারাগার থেকে আদালতে আসা-যাওয়া করতেন! স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন, তারা কি কারাগারে ছিলেন নাকি নিজ বাসায়ই অবস্থান করেছেন? আর গত কয়েক দিন আগে তুষারের ঘটনা তো রীতিমতো ব্যাপক আলোচনায় জন্ম দেয়। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বিধি লঙ্ঘন করে এক নারীর সঙ্গে একান্ত সময় কাটিয়েছেন তুষার। এতে কারাগারেরই দুই কর্মকর্তা কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রতœা রায় ও ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলায়েন সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ৬ জানুয়ারি ২০২১ কারাগারের ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশনের (সিসিটিভি) ক্যামেরায় এ চিত্র ধরা পড়েছে।
এর আগে কোনো জটিল রোগ ছাড়াই টানা দীর্ঘ ২০ মাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেলে ছিলেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রকাশ পাওয়ার পর তাকে হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। যদিও রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় কারাগার থেকে মুক্তি পান এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। ওই একই সময় আমরা দেশের কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী আমিন হুদার বেলায় একই ঘটনা দেখেছি। যদিও আমিন হুদা পরে জেলখানাতেই মৃত্যুবরণ করেন। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী অনেকেই জেলখানায় থেকেও তাদের সন্ত্রাসের সাম্রাজ্য ঠিকভাবেই রক্ষণাবেক্ষণ করার অভিযোগ আছে। কারাগারে বসেই হত্যা চাঁদাবাজি সবই নাকি করছেন তারা। টাকা হলে নাকি আমাদের দেশের কারাগারের কয়েদিদের সবই মেলে। এর আগে চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ২১ মামলার আসামি হামকা বাহিনীর প্রধান নুরুল আলম চট্টগ্রাম কারাগারে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে বলে তথ্য পেয়েছেন পুলিশ। মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সংগৃহীত ইয়াবা এবং গাঁজা কারারক্ষীর মাধ্যমে নেওয়া হতো কারাগারের অভ্যন্তরে। এমন ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। গত ডিসেম্বরে কারাগারের ভিতরে সব ধরনের অবৈধ মাদকদ্রব্যের সরবরাহ বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে আটটি নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ ও আমাদের সরকার সব সময়ই এই নিয়ে কেন যেন উদাসীন।
কারাগারে কিছু বন্দি আয়েশি জীবনযাপন করলেও অধিকাংশ বন্দিই তাদের ন্যূনতম প্রাপ্যটুকু থেকেও বঞ্চিত। এই বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন লেখক ও উদ্যোক্তা মুশতাক আহমেদ। গত বছর মে মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গ্রেফতার হন লেখক মুশতাক আহমেদ ও জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর। লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর যখন সারা দেশ এর প্রতিবাদে উত্তাল তখন এক রকম বাধ্য হয়েই কারাগারে বন্দি অসুস্থ কার্টুনিস্ট কিশোরকে জামিন দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে অসুস্থ কিশোরকে চোখ-কানসহ অন্যান্য চিকিৎসার জন্য থাকতে হয় হাসপাতালে। বাংলাদেশে কারাগারে মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ঘটনা। আর কারাগারে মৃত্যুর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারা কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলেই দাবি করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃতের পরিবার এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে মেনে নিতে মোটেও রাজি নয়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে কারাগারে ৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে জেলখানায় মারা গেছেন কমপক্ষে ৩৩৮ জন বন্দি। কারাগারে একজন রোগী অসুস্থ হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে খুব একটা আমলে নেয় না কারা কর্তৃপক্ষ। এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিষয়। জেলখানাতে একটা হাসপাতাল থাকলেও সেখানে থাকতে হলে চিকিৎসা নিতে হলে টাকা থাকতে হবে। হঠাৎ যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে পারমিশন লাগবে। সেই পারমিশন নিতে নিতে যদি কেউ মারা যান, তাহলে বলা হবে স্বাভাবিক মৃত্যু।
জাহালমের কথা হয়তো আমরা ভুলেই গিয়েছি। দুর্নীতি দমন কমিশনের করা এক মামলার তদন্তের গাফিলতির প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তাকে। পরে যদিও এই নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হলে কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম। অথচ আমাদের কারাগারগুলোতে এমন অনেক জাহালমই আছেন যারা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ বিনা অপরাধে ও বিনা বিচারে কারাগারে বন্দিজীবন পার করছেন। অবশ্য এর জন্য কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের বিচারব্যবস্থার দায়ও কম না। কারাগার অপরাধীকে শুধু বন্দি করে সাজা ভোগের স্থানই নয়, কারাগার একজন অপরাধীর ভিতরে অপরাধবোধ জন্ম দিয়ে সংশোধনের জায়গা। যাতে অপরাধী কারাগার থেকে বেরিয়ে সমাজের মূলধারার মানবিক হয়ে বাঁচতে পারে। অথচ আমাদের দেশে কারাগার থেকে বের হয়ে একজন অপরাধী আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। কারণ কারাগারই অপরাধের স্বর্গরাজ্য। দেশের কারাগারগুলো এতটাই নাকি দুর্নীতিগ্রস্ত যে অনেকেই কথায় বলে, আমাদের দেশের কারাগারের ইট-পাথর সবই নাকি টাকার জন্য হা করে বসে থাকে। তাই কারাগারগুলো বিত্তবান প্রভাবশালী অপরাধীদের জন্য আরাম আয়েশের স্থান আর সাধারণ কয়েদিদের জন্য দুনিয়াবি জাহান্নাম।
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই জুলাই, ২০২১ রাত ১:২৪
ফড়িং-অনু বলেছেন: পুরো দেশটা এক কারগার। কারগার এখন সবার।