নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি ও বলতে চাই !

ওয়াসিম ফারুক হ্যাভেন

ব্লগিং হউক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।

ওয়াসিম ফারুক হ্যাভেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জুলাই জাতীয় সনদ বাংলাদেশের জনগণের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার

০২ রা নভেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:০১


বাংলাদেশের ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থান নতুন নয়। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয় এটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জমে থাকা দুঃশাসন, দুর্নীতি, দলীয়করণ, বিচারহীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধী কাঠামোর বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক সামাজিক ও রাজনৈতিক জনজাগরণ। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় “জুলাই জাতীয় সনদ” একটি নতুন গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতির দলিল, যা কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ফল নয় বরং এটি জনগণের রক্ত, ত্যাগ ও প্রত্যাশার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। দীর্ঘ পনেরো বছরের দুঃশাসনে আওয়ামী লীগ সরকার যে চরম দলীয় নিকৃষ্টতম রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিল, তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সব ভিত্তি ধ্বংস করে দেয়। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশন সবখানেই দলীয় ছায়া বিস্তৃত হয়েছিল। স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পর এসে নাগরিক স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেবল বিলাসবহুল শব্দমাত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়ংকর অপব্যবহার, বিচারহীন হত্যা, গুম, দমননীতি ও সর্বব্যাপী দুর্নীতি বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল এক পূর্ণাঙ্গ ফ্যাসিস্ট শাসন। এমন অন্ধকার সময়ে ছাত্র, শ্রমিক, নারী, প্রবাসী ও মধ্যবিত্ত সহ দেশের সকল শ্রেনীর মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে উদিত হয় নতুন এক গণতন্ত্র পুনর্জাগরণের সূর্য।

এই গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত পথেই জনগণের দাবি ওঠে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও জবাবদিহি পুনঃপ্রতিষ্ঠার। সেই দাবির পরিণতিতেই ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর প্রণীত হয় “জুলাই জাতীয় সনদ” যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্য কমিশনের হাতে রচিত। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধির অংশগ্রহণে গঠিত এই কমিশনই এই ঐতিহাসিক সনদের রূপরেখা তৈরি করে। সনদের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রের সকল স্তরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গণঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, যেন আর কোনো ব্যক্তি বা দল রাষ্ট্রযন্ত্রের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে।

এই সনদের প্রস্তাবনা স্পষ্ট ও ঐতিহাসিক এটি আমাদের মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পরবর্তী নতুন সামাজিক চুক্তি, যেখানে রাষ্ট্রের চরিত্র হবে গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও মানবিক। সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কারই এখানে মূল দিকনির্দেশনা। রাজনীতিকেন্দ্রিক নয়, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ঐক্যের মধ্য দিয়েই নতুন বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সনদে প্রস্তাবিত ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন গুলি হলো জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন যা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের মেরুদণ্ড। এই কমিশনগুলো এমন বাস্তবমুখী প্রস্তাব দিয়েছে, যা কার্যকর হলে প্রশাসন ও রাজনীতি উভয়ই নতুন ভিত্তিতে দাঁড়াবে। দলীয় প্রভাবমুক্ত পুলিশ, মেধাভিত্তিক জন প্রশাসন, এবং জনগণের নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণের গ্যারান্টি এসব প্রস্তাব কেবল কাঠামোগত সংস্কার নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার পুনরুজ্জীবন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি সংবিধান সংস্কার। সনদে প্রস্তাব করা হয়েছে সংবিধানের ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদের মতো ধারাগুলোর বিলোপ, যা একসময় স্বৈরাচারী সরকারগুলোর রাজনৈতিক অপরাধকেও সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিল। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতা, এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা সর্বোচ্চ দশ বছর নির্ধারণের সুপারিশ সবকিছুই একটি জবাবদিহিমূলক রাজনীতির কাঠামো নির্মাণের প্রচেষ্টা।
সনদের আরেক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হলো দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব। স্বাধীনতার পর একক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ দলীয় স্বার্থে নির্বাহী বিভাগের হাতিয়ার হয়ে পড়েছিল। প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ বা রাষ্ট্রপরিষদ আইন প্রণয়নে ভারসাম্য আনবে, যা প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা ও নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির পথ খুলে দেবে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও সনদ যুগান্তকারী। সংসদে নারী আসন ১০০ তে উন্নীত করা, দলীয় মনোনয়নে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী বাধ্যতামূলক করা এবং স্থানীয় সরকারে নারীর নেতৃত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এসব প্রস্তাব নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।

তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব হলো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই এই সনদে বলা হয়েছে, নির্বাচনের আগে ও চলাকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট গ্রহণ করতে হবে, যেখানে প্রতিটি ধাপ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, মেয়াদ, প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ ও সংসদ ভেঙে দেওয়ার সময়সীমা পর্যন্ত সনদে বিস্তারিতভাবে নির্ধারিত আছে যা বাস্তবায়িত হলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক চক্র ভাঙা সম্ভব হবে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসও সনদের অন্যতম দিক। রাষ্ট্রপতি পাবেন দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো সংস্থাগুলিতে নিয়োগের ক্ষমতা যা ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হবে। প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও মেধাভিত্তিক নির্বাচনের সুপারিশও এসেছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। এইসব প্রস্তাব বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অতি প্রয়োজনীয়। কারণ রাষ্ট্র আজও দলীয় মেরুকরণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দুর্নীতির জালে বন্দী। “জুলাই জাতীয় সনদ” যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি কেবল রাজনৈতিক সংস্কার নয় এটি হবে রাষ্ট্রীয় পুনর্জন্মের সূচনা।

কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় সনদ বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটুকু? ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের সংস্কার প্রচেষ্টা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে। ১৯৯৬ সালে প্রবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও একসময় গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ ছিল, কিন্তু ২০১১ সালে সেটি বাতিল করে স্বৈরতন্ত্রের পথ সুগম করা হয়েছিল। তাই “জুলাই জাতীয় সনদ ” যেন ইতিহাসের আরেক অপ্রয়োগিত দলিল হয়ে না থাকে, তার জন্য প্রয়োজন তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন ও সাংবিধানিক অন্তর্ভুক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা ও সাফল্য নির্ভর করছে সনদটি কত দ্রুত আইনি রূপ পায় তার ওপর। জনগণ যেভাবে রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে এই নতুন পথ খুলেছে, রাষ্ট্র যদি সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে আবারও ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে। তাই এই সনদ কেবল নীতিনির্দেশ নয় এটি একটি জাতির আত্মত্যাগের প্রতীক, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নৈতিক ভিত্তি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সনদ কার্যকর ও টেকসই করতে কী প্রয়োজন? উত্তর আসবে একটাই তা হলো গণভোট। কারণ জনগণের অনুমোদন ছাড়া কোনো দলিলই প্রকৃত বৈধতা পায় না। “জুলাই সনদ" কে যদি জনগণের মুক্তির সনে পরিনত করতে হয় তবে তা জনগণের কণ্ঠেই অনুমোদন পেতে হবে। গণভোট সেই বৈধতার সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক পথ। বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু সিদ্ধান্ত জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই নেওয়া হয়েছে, যার ফল হয়েছে ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবিশ্বাস। এবার সে ভুলের পুনরাবৃত্তি হলে তা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য হবে চরম দুঃখের । জুলাই সনদে প্রস্তাবিত কাঠামোগত পরিবর্তন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক জবাবদিহি এই সবকিছুই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। এই সংস্কারগুলো জনগণের সম্মিলিত মত ছাড়া টেকসই হবে না। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ নিজের হাতে নির্ধারণ করবে তারা কেমন রাষ্ট্র চায়। এটি হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার বাস্তব প্রয়োগ, একটি নতুন জাতীয় ঐকমত্যের সূচনা। তাতে নতুন সরকার বা প্রশাসনিক কাঠামোও পাবে এক অনড় গণসমর্থনের ভিত্তি যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বিরোধ কমিয়ে এনে জাতীয় ঐক্যকে দৃঢ় করবে।

অন্যদিকে, গণভোট এড়িয়ে গেলে জনগণ আবারও প্রান্তিক হয়ে পড়বে। জনগণের অনুমতি ছাড়া বাস্তবায়িত কোনো সনদ টেকসই হয় না বরং তা পরিণত হয় নতুন বিতর্ক ও বিভাজনে। তাই গণভোট কেবল প্রয়োজন নয় এটি এখন অপরিহার্য। এখন সময় এসেছে জনগণের মালিকানার পুনঃপ্রতিষ্ঠার। গণভোটের মাধ্যমেই রাষ্ট্রে সেই মালিকানা বাস্তবে রূপ পাবে। “জুলাই জাতীয় সনদ” তখনই সফল হবে, যখন তা কেবল সরকারের নয়, জনগণের দলিল হবে। জনগণই নির্ধারণ করবে, তারা কেমন বাংলাদেশ চায় দলীয় শাসনের বাংলাদেশ, নাকি জনগণের সার্বভৌম বাংলাদেশের।নবাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। “জুলাই জাতীয় সনদ” কেবল প্রশাসনিক সংস্কারের প্রস্তাব নয়, এটি একটি নতুন জাতীয় চুক্তির প্রতীক যার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে নাগরিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এই সনদের বিলম্বিত বাস্তবায়ন মানে আবারও ফ্যাসিবাদ, দমননীতি ও একচেটিয়া শাসনের অন্ধকারে ফিরে যাওয়া। আর বাস্তবায়ন মানে একটি স্বচ্ছ, মানবিক ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপ।এখন সময় প্রতিশ্রুতির বাস্তব প্রয়োগের। জনগণের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই সনদ বাস্তবায়নই হবে শহীদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার সর্বোচ্চ প্রকাশ। “জুলাই জাতীয় সনদ” হলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শেষ আশার আলো। এই আলো নিভে গেলে আর ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই বিলম্ব নয় অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের আগেই এই সনদের গণভোট অনুষ্ঠিত হোক যাতে রাষ্ট্র আবার জনগণের হাতে ফিরে আসে, এবং বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই হয়ে ওঠে জনগণের সার্বভৌম বাংলাদেশ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৪৮

জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:



জুলাই সামরিক ক্যু'এর সনদ হচ্ছে, আপনাদের রাজাকারীর সনদ। আবারো নিজামীরা বুঝতে পারবে রাজাকরীর মুল্য।

২| ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: জুলাই সনদ আসলে এক ধরনের ফাজলামো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.