| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাসে পরিবর্তনের প্রত্যাশা কখনোই থেমে থাকে নাই। কালের বিবর্তনে এই দেশের মানুষ প্রতিবারই নতুন নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে, নতুন ভাবে বিচার করে এবং নতুনের পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ও করছে , নতুন করে স্বপ্ন দেখেছে । কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই দেশের রাজনীতি সবসময়ই দলীয় আনুগত্যের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। একসময় এই দেশের মেহনতী জেলে সম্প্রদায়ের স্লোগান ছিল “জাল যার, জল তার।” এই স্লোগান তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। অথচ আজ সেই স্লোগান রাজনীতির ময়দানে রূপান্তর হয়ে দাড়িয়েছে “ টাকা যার, মনোনয়ন তার, পেশীশক্তি যার রাজনীতি তার " । এটি শুধু একটি স্লোগান ই নয়, এটি রাষ্ট্রের এক ভয়াবহ মূল্যবোধের পতনের প্রতিচ্ছবি। যেখানে আদর্শের জায়গা দখল করে নিয়েছে স্বার্থ, ন্যায়ের জায়গায় এসেছে সুবিধা, আর জনগণের জায়গা দখল করে নিয়েছে অর্থের প্রভাব।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল ত্যাগ, আদর্শ ও সংগ্রামের প্রতীক। তখন রাজনীতি মানে ছিল মানুষের মুক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম । কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতি ক্রমে এক ভিন্ন কাঠামোতে পৌঁছতে শুরু করে, যেখানে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদের হাতে থেকে ছিনতাই হয়ে গেছে । রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বুর্জোয়া স্বার্থগোষ্ঠী, পেশিশক্তি, স্বজনপ্রীতি ও পারিবারিক তন্ত্রের হাতে। আজ রাজনীতিতে দলীয় মনোনয়ন থেকে শুরু করে পদ বা ক্ষমতা সবকিছুই নির্ধারিত হয় অর্থ, প্রভাব, পেশীশক্তি ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে। বড় রাজনৈতিক দলের পদ পদবী আর নির্বাচনে মনোনয়নপ্রাপ্তি এখন যেন এক ধরনের ব্যবসায়িক বিনিয়োগ, যার রিটার্ন প্রত্যাশা করা হয় ক্ষমতায় গিয়ে।
স্বাধীনতার পর থেকে গড়ে ওঠা এই প্রবণতা শুধু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকেই দুর্বল করে দেয়নি, এটি ধীরে ধীরে ধ্বংস করেছে গণতন্ত্রের নৈতিক ভিত। যখন “টাকা যার, পদ ও মনোনয়ন তার” হয়ে ওঠে বাস্তবতা, তখন সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে বিশ্বাস হারায়। তরুণ প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নেয় রাজনীতির প্রতি, আর সমাজে গড়ে ওঠে এক গভীর হতাশার সংস্কৃতি। তরুণ সমাজ আজ দেশের ভবিষ্যৎ, কিন্তু তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনীতি কখনোই নৈতিক হতে পারে না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি ঐতিহাসিক বাঁকে তরুণরাই ছিলেন পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি। অথচ আজকের বাংলাদেশে তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। কারণ তাদের ভেতরে একটি ধারণা দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নিয়েছে রাজনীতি মানেই দুর্নীতি, প্রতারণা ও ক্ষমতার খেলা। তাদের এই ধারণা পুরোপুরি প্রায় সঠিক । কারণ দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে যারা আধিপত্য বিস্তার করেছেন, তারা তরুণদের কণ্ঠরোধ করেছেন, যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্য পেশীশক্তি আর ধন সম্পদকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলস্বরূপ রাজনৈতিক দলগুলো পরিণত হয়েছে পারিবারিক, কর্পোরেট এবং স্বার্থনির্ভর সংগঠনে।
কিন্তু এখন সময় এসেছে তরুণদের আবার রাজনীতিতে ফিরে আসার। কারণ পরিবর্তন আসবে তরুণদের হাত ধরেই। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে মেধাবী ও নৈতিকতার প্রতীক তরুণদের অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি। “আগামীর বাংলাদেশ, তারুণ্যের বাংলাদেশ” এটি শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি জাতির আশা, মানুষের স্বপ্ন এবং মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ইতিমধ্যে নিজেদের নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই নির্বাচন কি শুধুই আরেকটি গতানুগতিক নির্বাচন, নাকি এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে এমন একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন ? কারণ এই নির্বাচন কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, এটি বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আত্মোৎসর্গের ফসল। তবুও দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, তারা হয়তো ভোটের ফল আগেই নির্ধারণ করে রেখেছে।
বাংলাদেশে এখন ভোট শুধু একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয় এটি সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। যখন মানুষ ভোট দিতে ভয় পায়, যখন ভোটের ফল আগেই নির্ধারিত থাকে, তখন রাষ্ট্রে জন্ম নেয় এক গভীর রাজনৈতিক শূন্যতা। আর সেই শূন্যতা তৈরি হয় যখন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে জনগণের ভোটাধিকারকে অস্বীকার করে। অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। সেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ বুঝে নিয়েছে, রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রকৃত উৎস তারা নিজেরাই। “ভোট যার, সিদ্ধান্তও তার” এই কথাটি কেবল একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয় বরং এটি গণতন্ত্রের আসল মর্মবাণী। এটি জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, রাষ্ট্র কোনো দল বা ব্যক্তির সম্পত্তি নয়, এটি নাগরিকদের সম্মিলিত অধিকার।
আজ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে বুঝে ফেলেছে, ভয়, বিভাজন, দলীয় অন্ধত্ব ও অর্থের দাসত্ব থেকে রাজনীতিকে মুক্ত না করলে গণতন্ত্র টেকসই হতে পারে না। দলীয় অন্ধত্ব বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। একটি দল ক্ষমতায় থাকলে তাদের সমর্থকরা সমস্ত অন্যায়কে “রাজনৈতিক বাস্তবতা” হিসেবে মেনে নেয়, আর বিরোধী দল সুযোগ পেলেই প্রতিশোধের রাজনীতিতে নেমে পড়ে। এর ফলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে দলীয় স্বার্থে বন্দি হয়ে পড়ে। বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, শিক্ষা, এমনকি গণমাধ্যমও দলীয় প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে না। এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার এক রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ, যার নেতৃত্ব দিতে পারে তরুণ প্রজন্ম। তাদের চিন্তা হতে হবে মুক্ত, বিশ্লেষণধর্মী এবং মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ। “দল নয়, দেশ আগে” এই নীতি যদি তরুণরা গ্রহণ করে, তাহলে রাজনীতি আবার ফিরে পাবে তার আদর্শিক মর্যাদা।
আজকের তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তিতে দক্ষ, তথ্যনির্ভর এবং বৈশ্বিক বাস্তবতায় সচেতন। তারা জানে যে যুক্তি, জবাবদিহিতা ও তথ্যই প্রকৃত শক্তি। তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি হতে হবে তথ্যভিত্তিক, যুক্তিনির্ভর এবং গণমুখী। তরুণদের অংশগ্রহণেই সম্ভব রাজনীতিতে নতুন সংস্কৃতি তৈরি করা যেখানে থাকবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গণঅংশগ্রহণ।
কিন্তু এজন্য তরুণদের আগে সচেতন হতে হবে, সংগঠিত হতে হবে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করতে হবে নির্বাচনে। কারণ যে প্রজন্ম ভোট দেয় না, তাদের কণ্ঠ রাষ্ট্রে শোনা যায় না। যারা কেবল সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ করে কিন্তু ভোটকেন্দ্রে যায় না, তারা নিজেরাই পরিবর্তনের সুযোগ হারিয়ে ফেলে। আজ যখন রাজনীতি বিশ্বাস হারিয়েছে, তখন দরকার নতুন আস্থা, নতুন আদর্শ এবং নতুন নেতৃত্বের। এই পরিবর্তনের জন্য যেমন প্রয়োজন সৎ, মেধাবী ও সংগ্রামী তরুণ নেতৃত্ব, তেমনি প্রয়োজন সাধারণ মানুষের সাহসী অংশগ্রহণও। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের একটি বড় অংশই তরুণ, যাদের অধিকাংশের এটিই হবে জীবনের প্রথম ভোট। তাদের সেই প্রথম ভোট, প্রথম সিদ্ধান্ত, প্রথম অংশগ্রহণই হতে পারে নতুন বাংলাদেশের সূচনা। একটি বাংলাদেশ, যেখানে পদমর্যাদা নয় যোগ্যতা মূল্যায়িত হবে যেখানে রাজনীতি মানে ক্ষমতা নয় সেবা যেখানে অর্থ নয় আদর্শই হবে মনোনয়নের মানদণ্ড। বাংলাদেশ আজ এক নতুন ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। অর্থের রাজনীতি, অন্ধ আনুগত্য ও নৈতিক অবক্ষয়ের এই সময়েই তরুণদের ভোটই পারে গণতন্ত্রকে পুনর্জীবিত করতে। তাই এখন প্রয়োজন কেবল একটি প্রশ্ন নয়, একটি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা “আমার ভোট আমি দেব, ন্যায় ও তারুণ্যের পক্ষে দেব ।” আজ যদি আমরা এই প্রতিজ্ঞা নিতে পারি, তবে “জাল যার, জল তার” নয়, নতুন প্রজন্ম বলবে “ভোট যার, সিদ্ধান্ত তার। আর এই সিদ্ধান্ত হবে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে।” এই সিদ্ধান্তই হবে একটি নতুন, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অঙ্গীকার।
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:২৫
মেঘনা বলেছেন: বাংলাদেশের আজকের তরুণ প্রজন্ম - কোরআনের বাইরে যাওয়ার সাহস দেখাতে জানে না।