নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।

ইউনুন খান

আমি একজন ছাত্র। আমার শখ ফটোগ্রাফিতে। এছাড়া নতুন কিছু জানতে ও জানাতে চেষ্টা করি।

ইউনুন খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রাচীন বাংলা।

০১ লা জুলাই, ২০১৬ দুপুর ২:১২

প্রাচীন যুগ তথ্যের স্বল্পতার কারণে
প্রাক-মুসলিম যুগের বাংলার ইতিহাস
পুনর্গঠন করা শ্রমসাধ্য ও কষ্টকর। এ
অসুবিধা আরও বেশি করে অনুভূত হয়
প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনায়- অর্থাৎ
প্রাচীনতমকাল থেকে খ্রিস্টীয় চার
শতকে বাংলায় গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠা
পর্যন্ত। এ সময়ের ইতিহাসের উপাদানের
জন্য নির্ভর করতে হয় বৈদিক,
মহাকাব্যিক ও পৌরাণিক সাহিত্যের
অপর্যাপ্ত তথ্য ও প্রাপ্তিসাধ্য
প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনাদির ওপর।
গুপ্তযুগ থেকে পরবর্তী সময়ের জন্য
আমরা প্রস্তরাদিতে উৎকীর্ণ লিপি ও
সাহিত্যাকারে লিখিত তথ্যাদি পাই।
এসব তথ্যে বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসের
উপাদান পাওয়া যায়।
পটভূমি জানা যায় যে,
সর্বপ্রাচীনকালে বাংলায় বিভিন্ন
জনগোষ্ঠীর লোক বসবাস করত এবং যে
অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠী বাস করত সে
অঞ্চল সেই জনগোষ্ঠীর নামে পরিচিত
হতো। এভাবে বঙ্গ, পুন্ড্র, রাঢ় ও গৌড়
নামক প্রাচীন জনপদসমূহ অনার্য
জনগোষ্ঠীর দ্বারা এ সব নামের অধ্যুষিত
অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে
মেঘনার ওপারে সমতট (কুমিল্লা-
নোয়াখালী অঞ্চল) ছিলো একটা
গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। এ জনপদের নাম
পুরোপুরি বর্ণনাত্মক এবং জনগোষ্ঠীর
সংশ্লিষ্টতা বর্জিত। চট্টগ্রাম ও
তৎসন্নিহিত অঞ্চল হরিকেল নামে
পরিচিত ছিলো। পরবর্তী বৈদিক
সাহিত্য থেকে অনার্য জনগোষ্ঠী
অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে এ সকল জনপদের
কথা জানা যায়।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের
মধ্যভাগে প্রাচীন ভারতের উত্তর-
পশ্চিমাঞ্চলে আর্য-প্রভাব অনুভূত হয়।
উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তে পৌঁছাতে
আর্যদের আরও বেশি সময় লাগে। তাই
বাংলার অধিবাসীগণ আর্যায়নের
প্রভাব বিলম্বে উপলব্ধি করে।
খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে আর্যরা
পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাংলায় প্রবেশ
করতে থাকে এবং সমগ্র বাংলাকে
আর্যায়িত করতে তাদের প্রায় এক
হাজার বছর সময় লাগে। ইতোমধ্যে
আর্যদের প্রভাব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত
হলেও উত্তরাঞ্চলের মধ্য দিয়ে
দীর্ঘকালীন যাত্রার ফলে আর্য প্রভাব
স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা ক্ষীণ হয়ে
পড়েছিল। ফলে বাংলার সংস্কৃতিতে
আর্যপূর্ব অর্থাৎ অনার্য উপাদানগুলি
দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় পায়।
এমনকি, ক্ষীণ আর্য প্রভাবাধীনেও
বাংলার লোকেরা তাদের জীবন ও
সংস্কৃতিতে অনার্য ও আর্যপূর্ব যুগের
বৈশিষ্ট্যাবলীও ধরে রাখতে পেরেছিল।
পাথরের তৈরী হাতিয়ারই মানব বসতির
সর্বপ্রাচীন নিদর্শন। পশ্চিমবঙ্গের
মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বর্ধমান জেলায়
প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথরের তৈরী
হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে। এ হাতিয়ার
ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী কখন প্রথম
বাংলায় বসতি স্থাপন করেছিলো তা
যথার্থভাবে, এমনকি অনুমানেও নির্ধারণ
করা কঠিন। এটা সম্ভবত ঘটেছিল দশ
হাজার বছর (বা তারও) আগে। নিষাদ বা
অস্ট্রিক কিংবা অস্ট্রো-এশীয় গোষ্ঠীর
অনার্য লোকেরাই এতদঞ্চলের আদি
বাসিন্দা। আজকের কোল, ভিল,
সাঁওতাল, শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি আদিম
অধিবাসীরা তাদের প্রতিনিধিত্ব
করছে। পরবর্তীকালে দ্রাবিড় ও
তিববতি-বর্মি ভাষাভাষী আরও দুটি
জাতি বাংলায় বসতি স্থাপন করে।
বর্ধমান জেলার অজয় নদের উপত্যকায়
পান্ডু রাজার ঢিবি তে আবিষ্কৃত
প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনাদি এবং অজয়,
কুনার ও কোপাই নদীর তীরবর্তী অন্যান্য
প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি বাংলার
প্রাগৈতিহাসিক যুগ সম্পর্কে নতুনভাবে
আলোকপাত করে। পান্ডু রাজার ঢিবি
একটি বাণিজ্যিক বন্দরের ধ্বংসাবশেষ।
এ বন্দরের সাথে শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ
অঞ্চলসমূহেরই ব্যবসা-বাণিজ্য চলত না,
বরং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের
সাথেও এর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো।
খ্রিস্টীয় চার শতক থেকে পরবর্তী
সময়ের প্রাচীন বাংলার ইতিহাস
সম্পর্কে মোটামুটিভাবে একটা স্বচ্ছ
ধারণা পাওয়া যায়। রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকেই এ
সময়কার বাংলার ইতিহাসকে
ক্রমান্বয়িক আর্যায়িতকরণ ও
আর্যপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠার যুগ বলা হয়।
গ্রিক ও ল্যাটিন উৎস থেকে (খ্রিস্টপূর্ব
তিন শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক)
‘গঙ্গারিডি’ (গ্রিক) বা গঙ্গারিডাই
(ল্যাটিন) নামক পূর্ব ভারতের একটি
শক্তিশালী রাজ্যের কথা জানা যায়। এ
রাজ্য সামরিক দিক থেকে খুবই
শক্তিশালী ছিল। পন্ডিতগণ বাংলার
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গঙ্গার
(ভাগীরথী ও পদ্মা) মোহনার কাছে
গঙ্গারিডাই-র অবস্থান নির্দেশ করেন।
বগুড়া জেলার মহাস্থানের ধ্বংসাবশেষ
প্রাচীন পুন্ড্রনগর হিসেবে চিহ্নিত। এ
পুন্ড্রনগরে প্রাপ্ত মহাস্থান ব্রাহ্মী
লিপি বাংলার অংশ বিশেষের ওপর
মৌর্য শাসনের (খ্রিস্টপূর্ব তিন শতক)
প্রমাণ বহন করে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের
ফলে প্রমাণিত হয় যে, খ্রিস্টীয় বারো
শতক পর্যন্ত সমগ্র প্রাচীন যুগে এ নগরে
নগরকেন্দ্রিক প্রশাসন ও সাংস্কৃতিক
কেন্দ্র বিদ্যমান ছিল।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে (খ্রিস্টপূর্ব
তিন শতক) উল্লেখ আছে যে, সারা
ভারতে বঙ্গের (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা)
মিহি সুতিবস্ত্র উল্লেখযোগ্য একটি
বাণিজ্যিক পণ্যদ্রব্য ছিল। গ্রিক ও
ল্যাটিন লেখকগণও (মোটামুটি একই
সময়ের) এ কথা উল্লেখ করেছেন। তাই
একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে,
বাংলায় মিহি সুতিবস্ত্র বয়নের ঐতিহ্য
সুপ্রাচীন কালের। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ
করা যায় যে, পোড়ামাটির ফলক তৈরিও
বাংলার একটি প্রাচীন শৈল্পিক
ঐতিহ্য। খনন কাজের ফলে পান্ডুরাজার
ঢিবিতে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকসমূহ
বাংলার এ শিল্পের প্রাচীনত্বের
প্রমাণ দেয়।
গুপ্ত শাসন খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে মৌর্য
সাম্রাজ্যের পতন থেকে খ্রিস্টীয় ৪র্থ
শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান পর্যন্ত
সময়ের বাংলার ইতিহাস অস্পষ্ট।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা প্রথম শতকের
কতকগুলি সুদৃশ্য পোড়ামাটির মূর্তি
মহাস্থান, তাম্রলিপ্তি ও চন্দ্রকেতুগড়ে
আবিষ্কৃত হয়েছে। এ আবিষ্কার প্রমাণ
করে যে, শুঙ্গ ও কুষাণ আমলে বাংলার
শ্রীবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। দি পেরিপ্লাস
অব দি ইরিথ্রিয়ান সি এবং টলেমির
বর্ণনা থেকে অনুমিত হয় যে, খ্রিস্টীয়
প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে বাংলার সমগ্র
বদ্বীপ অঞ্চলে একটি শক্তিশালী রাজ্য
গড়ে উঠেছিলো।
ধারনা করা হয়, সমুদ্রগুপ্তের শাসনাধীনে
(খ্রিস্টীয় চার শতক) গুপ্ত সাম্রাজ্যের
বিস্তার লাভের প্রাক্কালে বাংলা
কতগুলি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল।
আনুমানিক চার শতকের মাঝামাঝি
সময়ে স্বাধীন রাজ্যগুলির প্রায় সবকটাই
সমুদ্রগুপ্তের শাসনাধীনে চলে আসে।
সমতট (কুমিল্লা-নোয়াখালীসহ মেঘনার
অপর তীরের এলাকা) তাঁর সাম্রাজ্যের
বাইরে থাকলেও করদরাজ্যে পরিণত হয়।
সমুদ্রগুপ্তের পুত্র ও উত্তরাধিকারী
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পূর্বাঞ্চলে তাঁর
অধিকৃত এলাকাসমূহ সুসংহত করেন। ছয়
শতকের শেষের দিকে নামের শেষে
‘গুপ্ত’ উপাধিধারী একজন রাজা কর্তৃক
(বৈণ্যগুপ্ত) এ অঞ্চল শাসিত হতো বলে
মনে হয়। পাঁচ শতকের গুপ্ত সম্রাটগণের
(কুমারগুপ্ত থেকে বুধগুপ্ত) বেশ কয়েকটি
তাম্রশাসন উত্তরবঙ্গে পাওয়া গেছে। এ
থেকে এ অঞ্চলে সুপ্রতিষ্ঠিত গুপ্ত
শাসনের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
তাম্রশাসনগুলি সুবিন্যস্ত স্থানীয়
প্রশাসনের অস্তিত্বেরও সাক্ষ্য দেয়।
গুপ্ত সম্রাটগণ স্থানীয় জনসাধারণের
অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রশাসন
ব্যবস্থা গড়ে তোলার কৃতিত্বের
দাবিদার। স্থানীয় প্রশাসন কাঠামোর
যে প্রমাণ গুপ্ত তাম্রশাসনগুলিতে
পাওয়া যায় তা নিঃসন্দেহে বাংলার
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রথম নিদর্শন।
তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।
শশাঙ্ক খ্রিস্টীয় ছয় শতকের শেষের
দিকে পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের অধীনে
পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার অংশ বিশেষে
গৌড় রাজ্যের উদ্ভব হয়। সাত শতকের
প্রথম দিকে শশাঙ্ক গৌড়ে ক্ষমতা দখল
করেন। মগধ তার রাজ্যের অংশ ছিল। এ
বিষয়ে তেমন কোনো বিরোধ নেই যে,
তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম অতি
গুরুত্বপূর্ণ রাজা। বাংলার ইতিহাসে
শশাঙ্কই প্রথম যিনি বাংলার বাইরে
উত্তর ভারতে প্রাধান্য বিস্তারকল্পে
আক্রমণাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
এদিক থেকে তিনি পরবর্তীকালের পাল
বংশীয় রাজা ধর্মপাল ও দেবপাল -এর
আক্রমণাত্মক উত্তর ভারতীয় নীতির
অগ্রদূত। কর্ণসুবর্ণ ছিল তার রাজ্যের
রাজধানী।
মাৎস্যন্যায়ম শশাঙ্কের মৃত্যুর পর
বাংলায় বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য যুগের শুরু
হয়। মোটামুটিভাবে ৬৫০ থেকে ৭৫০
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক শতকেরও বেশি
সময় ধরে গৌড়ের ইতিহাস খুবই অস্পষ্ট। এ
সময়ে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর (৬৪৬ অথবা ৬৪৭
খ্রিঃ) পর বাংলায় রাজনৈতিক
বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়, তার
মন্ত্রীরা বলপূর্বক তার রাজ্য দখল করে
নেয় এবং চৈনিক দূত ওয়াঙ-হিউয়েন সে
অভিযাত্রার পর তিববতের ক্ষমতাধর
রাজা শ্রং-সান-গ্যাম্পো কয়েকটি
অভিযান পরিচালনা করেন। সাত শতকের
দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় দুটি নতুন
রাজবংশের আবির্ভাব ঘটে- গৌড় ও
মগধে (পশ্চিম বাংলা ও দক্ষিণ বিহার)
পরবর্তী গুপ্ত বংশ এবং বঙ্গ ও সমতটে
(দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) খড়গ
রাজবংশ। কিন্তু এ দুটি রাজবংশের
কোনোটাই বাংলায় শক্তিশালী শাসন
প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি।
খ্রিস্টীয় আট শতকের প্রথমার্ধে
পুনঃপুনঃ বৈদেশিক আক্রমণে বাংলা
বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য ছিল কনৌজ রাজ
যশোবর্মণের (৭২৫-৭৫২ খ্রি.) আক্রমণ।
কাশ্মীরের ললিতাদিত্য অচিরেই
যশোবর্মণের গৌরবকে ম্লান করে দেন।
গৌড়ের পাঁচ জন রাজা ললিতাদিত্য
কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলেন বলে
কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহন উল্লেখ
করেছেন। এ থেকে গৌড়ের রাজনৈতিক
বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত
পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে
স্থানীয় প্রধানগণ স্বাধীন হয়ে ওঠেন
এবং নিজেদের মধ্যে প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ লিপ্ত হন। পুনঃপুনঃ
বৈদেশিক আক্রমণ রাজনৈতিক
ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং তাতে
বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী একশ বছর
বাংলায় কোনো স্থায়ী সরকার ছিলো
না বললেই চলে। সমগ্র দেশ অভ্যন্তরীণ
কলহ- কোন্দলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এবং
বৈদেশিক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়েছে।
গোপাল-এর উত্থানের আগে খ্রিস্টীয়
আট শতকের মাঝামাঝি সময়ের
রাজনৈতিক অবস্থাকে পাল আমলের
একটি লিপিতে (খালিমপুর তাম্রশাসন)
মাৎস্যন্যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ
অরাজকতা ও নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে
পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের
আবির্ভাব হয়। পাল তাম্রশাসনে উল্লেখ
পাওয়া যায় যে, গোপাল উল্লিখিত
অরাজক অবস্থার (মাৎস্যন্যায়ম) অবসান
ঘটান। পাললিপিতে দাবি করা হয় যে,
পাল বংশ আট শতকের মাঝামাঝি
সময়ে গোপাল কতৃক প্রতিষ্ঠিত
রাজবংশ নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে
প্রায় চার শত বছর বাংলা শাসন করে।
আঠারো প্রজন্মের সুদীর্ঘ এ শাসনামলে
পাল বংশের ইতিহাসে বিভিন্ন ধরনের
উত্থানপতন পরিলক্ষিত হয়। তবে এ
বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই
যে, প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল
রাজাদের শাসন একটি গৌরবোজ্জ্বল
অধ্যায় ছিল। পাল রাজাদের দীর্ঘ
সময়ের ইতিহাস বিভিন্ন পর্যায়ে
আলোচনা করা যায়- যেমন (১) ধর্মপাল
(আ. ৭৮১-৮২১ খ্রি.) ও দেবপাল-এর (আ.
৮২১-৪৬১ খ্রি.) অধীনে পাল বংশের
উত্থান ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার যুগ।
এরপরে আসে (২) স্থবিরতার যুগ (আ.
৮৬১-৯৯৫-১০৪৩) শাসনামলে এ স্থবিরতার
যুগের অবসান ঘটে এবং পাল বংশের
পুরনো গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ
কারণে তাকে পাল বংশের দ্বিতীয়
প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। পাল বংশের শেষ
অধ্যায় হলো অবনতি ও অবক্ষয়ের যুগ।
অবশ্য রামপাল (আ. ১০৮২-১১২৪), তার
তেজোদ্দীপ্ত শাসন দ্বারা
সাময়িকভাবে এ অবক্ষয়ের যুগকে রোধ
করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর পাল
সাম্রাজ্য বেশি দিন টিকে থাকেনি।
বারো শতকের তৃতীয় চতুর্থাংশে সেন
বংশের উত্থানের ফলে পাল
সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
পাল বংশের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার যুগ
ছিল ধর্মপাল ও দেবপালের
তেজোদ্দীপ্ত শাসনকাল। এ যুগের পাল
রাজারা উত্তর ভারতে প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ
হওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন।
উত্তর ভারতে প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য
তাঁরা পশ্চিম ভারতের গুর্জর-প্রতিহার
এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটদের সাথে
এক ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে লিপ্ত হন।
ধর্মপাল ছিলেন একজন একনিষ্ঠ বৌদ্ধ
এবং বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক।
বিক্রমশীলা মহাবিহার (কলগং থেকে ৬
মাইল উত্তরে এবং বিহারের ভাগলপুর
থেকে ২৪ মাইল পূর্বে পাথরঘাটা নামক
স্থানে) তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। নবম
থেকে বারো শতক পর্যন্ত এটি ছিল সমগ্র
ভারতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ
শিক্ষাকেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম।
পাহাড়পুরের (বাংলাদেশের নওগাঁ
জেলায়) সোমপুর মহাবিহার ধর্মপালের
অপর একটি বিশাল স্থাপত্য কর্ম।
ধর্মপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী
দেবপাল পিতার অনুসৃত আক্রমণশীল
নীতি অব্যাহত রাখেন। উত্তর ভারতে
প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতা
তাঁর সময়েও অব্যাহত থাকে। তিনি হয়ত
প্রাথমিক কিছু সাফল্য লাভ করেন,
কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুর্জর-প্রতিহারগণ
কনৌজ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তাদের
সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়। তবে পাল
সাম্রাজ্য দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং
উত্তর-পূর্বে কামরূপএর দিকে বিস্তার
লাভ করে।
ধর্মপাল ও দেবপালের শাসনামল পাল
সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তির যুগ। এ দুজন
শাসক বাংলার দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল
এবং বিহারে পাল সাম্রাজ্য সংহত
করেন। তাঁদের আমলে প্রথমবারের মতো
বাংলা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে
একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের মর্যাদা
লাভ করে। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের
বিরুদ্ধে বাংলা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
এ সময় সর্বত্র বিজয় সূচিত হয়। কিন্তু
দেবপালের মৃত্যুর সাথে সাথেই এ
গৌরবময় যুগের অবসান ঘটে এবং শুরু হয়
স্থবিরতার যুগ। এ স্থবিরতা ক্রমশ পাল
সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে
যায়।
পাল সাম্রাজ্যের স্থবিরতা পাঁচজন
রাজার শাসনামলব্যাপী একশ বছরেরও
অধিককাল যাবৎ চলে। ধর্মপাল ও
দেবপালের আমলে যে শৌর্যবীর্য ও
শক্তির প্রকাশ ঘটে, এ আমলে তা ছিল
একেবারেই অনুপস্থিত। এ সময় সাম্রাজ্য
বিস্তারের আদৌ কোনো চেষ্টা করা
তো হয়ই নি, বরং বৈদেশিক হামলা এবং
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করার শক্তিও
পাল রাজাদের ছিল না। দশ শতকের
মাঝামাঝি সময়ে কম্বোজগণ পশ্চিম ও
উত্তর বাংলার অংশবিশেষে অনেকটা
স্বাধীন হয়ে ওঠে। কিছুকালের জন্য পাল
সাম্রাজ্য শুধু বিহারের অংশবিশেষে
সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। শিলালিপি থেকে
কম্বোজ গৌড়পতিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে
জানা যায়।
প্রথম মহীপাল (আ. ৯৯৫-১০৪৩ খ্রি.) পাল
সাম্রাজ্যের হারানো শৌর্য অনেকটা
ফিরিয়ে আনেন এবং সাম্রাজ্যে নতুন
প্রাণশক্তির সঞ্চার করেন। তিনি উত্তর
ও পশ্চিম বাংলার হূতরাজ্য পুনরুদ্ধার
করেন এবং পালবংশের হারানো গৌরব
পুনরুদ্ধার করে সাম্রাজ্যের ভিত সুদৃঢ়
করেন। কিন্তু মহীপাল ও রামপালের
মধ্যবর্তী রাজাদের রাজত্বকালে এ
বংশের গৌরব সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে
আসে। উত্তর ভারতের শক্তিসমূহের
পুনঃপুনঃ আক্রমণ (কলচুরি ও চন্ডেলা)
পাল রাজাদের দুর্বলতাই প্রকাশ করে।
দ্বিতীয় এ মহীপালের রাজত্বকালে (আ.
১০৭৫-১০৮০ খ্রি.) পালবংশের এ দুর্বলতা
সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। এ সময়
কৈবর্ত প্রধান দিব্য এক সামন্ত
বিদ্রোহের মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে
(উত্তর বাংলা) স্বাধীন শাসন
প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। কেন্দ্রীয় শাসন
দুর্বল হয়ে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই
বিচ্ছিন্নতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
উত্তর বাংলায় দিব্য-র সাফল্য এ
প্রবণতার উজ্জ্বল উদাহরণ।
রামপালের (আনু. ১০৮২-১১২৪ খ্রি.)
শৌর্যবীর্য ও শক্তি ছিল পাল বংশের
শেষ গুরুত্বপূর্ণ আলোকচ্ছটা। তিনি উত্তর
বাংলায় পাল আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা
করে পালদের রাজ্য বিস্তারের সক্ষমতা
প্রমাণ করেন। কিন্তু এ সাফল্য ছিল
ক্ষণস্থায়ী এবং তাঁর উত্তরাধিকারীগণ
এতোই দুর্বল ছিলেন যে সাম্রাজ্যের
ক্রমাগত পতন রোধে তাঁরা ব্যর্থ হন। এ
পরিস্থিতিতে সম্ভবত পালদের অধীনস্থ
একজন সামন্ত রাজা বিজয়সেন শক্তি
সঞ্চয় করার সুযোগ পান এবং বারো
শতকের মাঝামাঝি সময়ে পালদের
বাংলা থেকে উৎখাত করেন। এভাবে
বিজয়সেনের নেতৃত্বে বাংলায় এক নতুন
শক্তি সেনবংশের উদ্ভব হয়। সেনগণ
ছিলেন দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট অঞ্চল
থেকে আগত ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয়।
প্রায় চারশ বছর স্থায়ী পাল বংশের
শাসন বাংলায় একটি সুদৃঢ় সরকার
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুযোগ বয়ে আনে। এ
শাসন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।
পালগণ একটা সফল প্রশাসনিক কাঠামো
গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাদের
ভূমিভিত্তিক সাম্রাজ্য কৃষি নির্ভর
ছিল। পাল অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য
তেমন গুরুত্ব পায় নি। ব্যবসায়িক
কর্মকান্ড সম্ভবত দেশের অভ্যন্তরে
সীমাবদ্ধ কিংবা বড়জোর পার্শ্ববর্তী
অঞ্চলসমূহে প্রসারিত ছিল। আট শতকের
পর তাম্রলিপ্তি বন্দরের পতন সমুদ্রপথে
বাংলার বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব
থেকে পালদের বঞ্চিত করে।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালদের দীর্ঘ শাসন
বাংলায় এক ধরনের উদার ধর্মীয় আবহ
সৃষ্টি করে। এ আমলে হিন্দু-বৌদ্ধ
সম্প্রীতি ও সহাবস্থান লক্ষ করা যায়।
পাল যুগের সামাজিক ও ধর্মীয়
পরিমন্ডল সহিষ্ণুতা নীতি এবং
পারস্পরিক সহ-অবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি
করে এবং এ মনোভাব বাংলার ইতিহাসে
সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে।
শিল্পকলার ক্ষেত্রে বহুবিধ সাফল্যের
জন্যও পালযুগ গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধ বিহারের
স্থাপত্যরীতির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়
পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারে। এ
স্থাপত্যরীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার
দেশসমূহের পরবর্তী স্থাপত্য
কাঠামোকে প্রভাবিত করে। বাংলার
পোড়ামাটির ফলক শিল্প এ যুগে চরম
উৎকর্ষ লাভ করে। পালদের ভাস্কর্য
শিল্প পূর্ব-ভারতীয় শিল্প রীতির একটা
বিশেষ পর্যায় হিসেবে স্বীকৃত হয়। পাল
যুগেই বাংলার ভাস্করগণ তাদের
শৈল্পিক প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে
সক্ষম হন। এ যুগের সাহিত্য কর্মের অতি
সামান্য অংশই কালের করাল গ্রাস
থেকে রক্ষা পেয়েছে। তথাপি উত্তর
বাংলার কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর
রামচরিতম এক অসামান্য শ্লোক সৃষ্টির
নিদর্শন হয়ে আছে। রামচরিতমের
শ্লোকগুলির প্রত্যেকটি দ্ব্যর্থবোধক।
পরবর্তী যুগের কাব্য সংকলনে দশ ও
এগারো শতকের কবিদের রচিত অনেক
শ্লোক স্থান পেয়েছে। এ যুগে
তালপাতায় লেখা কিছু সচিত্র বৌদ্ধ
পান্ডুলিপি চিত্রশিল্পের উৎকর্ষের
সাক্ষ্য বহন করে। এ সকল সাফল্যের বিষয়
বিবেচনা করে পাল যুগকে সংগত
কারণেই বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের
সর্বাপেক্ষা গৌরবময় যুগ হিসেবে গণ্য
করা যায়।
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজবংশসমূহ
প্রাচীন যুগে বেশ কিছুকাল ধরে দক্ষিণ-
পূর্ব বাংলা স্বাধীন রাজনৈতিক
স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিল বলে মনে
হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর
থেকে শুরু করে সেনবংশের উত্থান
পর্যন্ত বাংলার বদ্বীপ অঞ্চল উত্তর ও
পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক ব্যবস্থার
সাথে আত্তীকৃত ছিল না, যদিও সময়ে
সময়ে তা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
খ্রিস্টীয় ছয় শতকের প্রথমার্ধে দক্ষিণ-
পূর্ব বাংলায় স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের
উদ্ভব হয়। ছয়টি তাম্রলিপিতে এ
রাজ্যের তিনজন রাজা যথাক্রমে
গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেবের
নাম পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা
শশাংকের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল
কিনা তা নির্ণয় করা যায় না। এ
অঞ্চলে ‘ভদ্র’ উপাধিধারী একটি
রাজবংশের অস্তিত্ব ছিল বলে পন্ডিতগণ
ধারণা করেন।
খ্রিস্টীয় সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে
পরবর্তী গুপ্তগণ যখন গৌড়ের শাসন
ক্ষমতা দখল করেন তখন দক্ষিণ-পূর্ব
বাংলায় খড়গ বংশের অভ্যুদয় ঘটে। খড়গ
বংশের রাজাগণ তিন পুরুষ ধরে সমতট
(কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চল) শাসন
করেছেন। তাঁদের রাজধানী ছিল
কর্মান্ত-বাসক (কুমিল্লার নিকটবর্তী বড়
কামতা)। তাম্রশাসন থেকে লোকনাথ ও
শ্রীধারণ রাত নামক দুজন অর্ধ-স্বাধীন
সামন্ত প্রধানের কথা জানা যায়। এঁরা
খ্রিস্টীয় সাত শতকে সমতটের কয়েকটি
অংশে রাজত্ব করেন।
খ্রিস্টীয় আট শতকে দেব রাজবংশএর
অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা একটি বড় ও
শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়। তাঁদের
রাজধানী ছিল ময়নামতি-লালমাই
অঞ্চলের দেবপর্বত (শহরটির সঠিক
অবস্থান এখনো নির্ণয় করা যায় নি)।
চারপুরুষ ধরে দেববংশীয় রাজাগণ
(শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব ও
ভবদেব) সমতট শাসন করেন। তাঁরা ছিলেন
উত্তর ও পশ্চিম বাংলা এবং বিহারের
উপর কর্তৃত্বকারী প্রথম দিকের পাল
রাজাদের সমসাময়িক। দেব বংশীয়
রাজাগণ ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ময়নামতী অঞ্চল
বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে
প্রসিদ্ধি লাভ করে। প্রত্নতাত্ত্বিক
খননকার্যের ফলে ময়নামতিতে
কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার (বৌদ্ধদের ধর্মীয়
ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) আবিষ্কৃত হয়েছে।
এগুলির মধ্যে শালবন বিহার, আনন্দবিহার
ও ভোজবিহার উল্লেখযোগ্য। দেববংশের
রাজাগণ এগুলি তাঁদের রাজধানী
দেবপর্বতের সন্নিকটে নির্মাণ
করেছিলেন। ক্রুশাকৃতির কেন্দ্রীয়
মন্দির নির্মাণের শৈল্পিক রীতি
পূর্ণতা পায় পাহাড়পুর বিহারে। এ
নির্মাণ কৌশল শুরু হয়েছিল ময়নামতী
অঞ্চলে। এখানে এ রীতির আদি ও
অপেক্ষাকৃত ছোট সংস্করণ পরিলক্ষিত
হয়। ময়নামতীতে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষের
মধ্যে উন্নতমানের মৃৎফলকও রয়েছে।
ময়নামতীতে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ এ
অঞ্চলে ভাস্কর্য শিল্পের উৎকর্ষের
সাক্ষ্য বহন করছে।
খ্রিস্টীয় নয় শতকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়
হরিকেল রাজ্যের উদ্ভব হয়। সম্ভবত
চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত এ রাজ্য
বিস্তৃত ছিল। হরিকেল রাজাদের পর
চন্দ্র রাজবংশ ক্ষমতা দখল করে। এ
বংশের শাসকগণ পাঁচ পুরুষ ধরে
( ত্রৈলোক্যচন্দ্র, শ্রীচন্দ্র , কল্যাণচন্দ্র,
লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্র) প্রায় ১৫০ বছর
(আনু. ৯০০-১০৫০ খ্রি.) শাসন করেন। সমগ্র
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা এবং উত্তর-
পূর্বে সিলেটসহ বঙ্গ ও সমতটের বিস্তীর্ণ
অঞ্চল তাঁদের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত
ছিল। ঢাকার দক্ষিণে বর্তমান
মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর ছিল
তাঁদের রাজধানী। চন্দ্রবংশীয় রাজগণ
ছিলেন যথেষ্ট শক্তিশালী এবং তাঁরা
ছিলেন উত্তর ও পশ্চিম বাংলার
সমসাময়িক পাল রাজাদের সমকক্ষ।
শ্রীচন্দ্র ছিলেন এ বংশের শ্রেষ্ঠ
রাজা। তাঁর সময়ে চন্দ্র সাম্রাজ্য
সীমান্তের ওপারে কামরূপ (আসাম)
পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তাঁর
তাম্রশাসনগুলিতে গৌড়ের সাথে যে
সংঘাতের উল্লেখ রয়েছে তা সম্ভবত এ
অঞ্চলের কম্বোজ বংশীয় রাজাদের
সাথে ঘটেছিল। এ সংঘর্ষ সম্ভবত
পরোক্ষভাবে প্রথম মহীপালের
রাজত্বের শুরুর দিকে পালগণ কর্তৃক
তাদের পিতৃরাজ্য (রাজ্যম্ পিত্র্যম্)
পুনরুদ্ধারের সুযোগ করে দিয়েছিল।
এগারো শতকের শেষ দিকে পাল
সাম্রাজ্যে কৈবর্ত বিদ্রোহ এর সুযোগে
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বর্মণ রাজবংশীয়রা
এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলে। বর্মণ
রাজবংশএর পাঁচজন রাজা (জাতবর্মণ,
হরিবর্মণ, শ্যামলবর্মণ, ভোজবর্মণ) একশ
বছরের কিছু কম সময় (আনু. ১০৮০-১১৫০
খ্রি.) রাজত্ব করেন। বর্মণরা সেনদের
দ্বারা বিতাড়িত হন। বর্মণগণ ছিলেন
হিন্দু এবং তাঁদেরও রাজধানী ছিল
বিক্রমপুর।
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার শাসকগণ চট্টগ্রাম-
কুমিল্লা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উপকূল
দিয়ে পরিচালিত সামুদ্রিক বাণিজ্যের
উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত
বহুসংখ্যক রৌপ্য মুদ্রা এর সত্যতা প্রমাণ
করে। নয় থেকে এগারো শতকের
মধ্যবর্তী সময়ে আরব বণিক ও নাবিকদের
বিবরণ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার
উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে সমন্দর বন্দর
দিয়ে সমুদ্র পথে ব্যাপক বহির্বাণিজ্যের
কথা জানা যায়। আরবদের বর্ণিত এ
সমন্দর বন্দরটিকে বর্তমান চট্টগ্রাম
বন্দরের কাছাকাছি কোনো স্থান বলে
চিহ্নিত করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব
বাংলার শাসকগণ এ বাণিজ্যিক
কার্যক্রমের ফলে রৌপ্য মুদ্রা তৈরীর
জন্য প্রয়োজনীয় রূপার পাত সংগ্রহ
করতে সক্ষম হন। এ আমলের তথ্যাদি
থেকে নৌযান নির্মাণের কারখানার
অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। এ থেকে
ক্রমপ্রসারমান সামুদ্রিক বাণিজ্যের
চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এতদঞ্চলের
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্পর্কেও নিঃসন্দেহ
হওয়া যায়।
সেন বংশীয় শাসন বারো শতকের
শেষের দিকে বিজয়সেন সেন সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন
দাক্ষিণাত্যের কর্নাটের বাসিন্দা।
পাল সম্রাট রামপালের শাসনামলে
পশ্চিমবঙ্গের একজন সামন্ত নরপতিরূপে
বাংলার রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব
ঘটে। রামপালের পর পাল বংশের
অবক্ষয়কালে বিজয়সেন স্বীয় প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠা করেন এবং ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা
দখল করেন। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়
বর্মণদের পরাভূত করেন এবং অতঃপর
উত্তর ও পশ্চিম বাংলা থেকে পালদের
বিতাড়িত করেন। উত্তর বিহার এবং
তদসন্নিহিত অঞ্চলেও তিনি স্বীয়
অধিকার বিস্তারের প্রয়াস পান। তেরো
শতকের প্রারম্ভে মুসলিম বিজয়ের পূর্ব
পর্যন্ত পালগণ কোনোক্রমে দক্ষিণ
বিহারে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায়
রাখেন।
সেনগণ বাংলায় একশ বছরেরও বেশিকাল
ধরে (আনু. ১০৯৭-১২২৩ খ্রি.) কর্তৃত্ব করেন।
এ বংশের পাঁচজন নৃপতি (বিজয়সেন,
বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন , বিশ্বরূপসেন ও
কেশবসেন) এ সময়ে রাজত্ব করেন। এটা
লক্ষণীয় যে, মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী র
আক্রমণ পশ্চিম ও উত্তর বাংলার
অংশবিশেষে সেন শাসনের অবসান ঘটায়
(১২০৪ খ্রি.)। লক্ষ্মণসেন পিছু হটে এ সময়
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় তাদের অধিকৃত
অঞ্চলে চলে আসেন। লক্ষ্মণসেনের
মৃত্যুর পর তাঁর দু পুত্র এখানে কিছুকাল
রাজত্ব করেন। আরও লক্ষণীয় যে,
বিজয়সেন বর্মণ ও পালদের ক্ষমতাচ্যুত
করে সমগ্র বাংলাকে একক শাসনাধীনে
আনতে সক্ষম হন এবং ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত এ অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে।
সুতরাং এক অর্থে বলা যায় যে, শুধু সেন
আমলেই সমগ্র বাংলা একক শাসনাধীনে
আসে। পূর্ববর্তী চার শতক ধরে দক্ষিণ-
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য
বাংলার ইতিহাসে গভীর সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলেছিল। চন্দ্র ও
বর্মণদের রাজধানী বিক্রমপুর সেনদের
সময়েও রাজধানী ছিল। এ বংশের প্রথম
তিনজন রাজা বিজয়সেন (আনু. ১০৯৭-১১৬০
খ্রি.), বল্লালসেন (আনু. ১১৬০-১১৭৮ খ্রি.)
ও লক্ষ্মণসেন (আনু. ১১৭৮-১২০৬ খ্রি.)
ছিলেন এ বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
শেষ দুজন নরপতির (বিশ্বরূপ সেন ও
কেশবসেন) দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অত্যন্ত
সীমিত অঞ্চলের উপর আধিপত্য ছিল।
সেন রাজাগণ ছিলেন হিন্দু এবং তাঁদের
রাজত্বকাল বাংলায় হিন্দু ধর্মের
পুনরুত্থানের যুগ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বর্ণপ্রথার কঠোরতার ওপর ভিত্তি করে
বল্লালসেন গোঁড়া হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা
বিন্যস্তকরণে প্রয়াসী হয়েছিলেন বলে
জানা যায়। যে সমাজ দীর্ঘদিন ধরে
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার আবহে এবং হিন্দু-
বৌদ্ধ সম্প্রীতির মধ্যে এগিয়ে চলছিল
সে সমাজে হিন্দু ধর্মীয় গোঁড়ামি
ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা হিসেবে একে
চিহ্নিত করা যায়। বাংলায় বৌদ্ধ
ধর্মের অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে সমাজ
ব্যবস্থার এ পরিবর্তনকে ধরা যেতে
পারে। এটা অস্বাভাবিক নয় যে,
সেনদের দ্বারা গোঁড়া হিন্দুধর্মের
পুনরুত্থান বৌদ্ধ ধর্মের জন্য ছিল একটা
প্রচন্ড আঘাত। এ কারণেই সঠিকভাবে
বলা হয় যে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি এ আঘাত
দূরদেশ থেকে আগত ইসলামের মাধ্যমে
আসেনি, এসেছে নিকটবর্তী ধর্মের
ঈর্ষান্বিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে। এ
কথা সত্য যে, মুসলমানদের বাংলায়
আগমনের আগেই বৌদ্ধ ধর্ম
মারাত্মকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছিল।
বাংলায় এ হিন্দু- বৌদ্ধ বৈরিতা এবং
সেন আমলে হিন্দু গোঁড়া ধর্মমতের
পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বাংলার
ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এ
ঘটনা পরম্পরা বাংলায় ইসলাম ধর্ম
প্রসারে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে
থাকতে পারে।
অপর একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও সেন আমল
গুরুত্বপূর্ণ। এ যুগে বাংলায় সংস্কৃত
সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। সেন রাজাদের
প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কিছুটা
তাঁদের দ্বারা সৃষ্ট আবহের কারণে
সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যচর্চার সুস্পষ্ট
বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সংস্কৃত কাব্য-
সাহিত্যে বাংলার অবদানের মধ্যে
সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে জয়দেব এর
গীতগোবিন্দ। লক্ষ্মণসেনের রাজসভায়
জয়দেব ছিলেন অন্যতম অলঙ্কারস্বরূপ।
তাঁর সভায় অপরাপর গুণী ব্যক্তি ছিলেন
কবি ধোয়ী (পবনদূত প্রণেতা),
উমাপতিধর, গোবর্ধন (আর্যা-সপ্তশতীর
লেখক) ও শরণ। এ পাঁচজনকে
লক্ষ্মণসেনের রাজসভার পঞ্চরত্ন
হিসেবে গণ্য করা হয়।
শ্রীধরদাসের সংকলন সদুক্তিকর্ণামৃত
সমকালীন ও পূর্ববর্তী যুগের কাব্যকৃতির
রত্নভান্ডার বলে পরিগণিত হয়ে থাকে।
এতে রয়েছে দশ থেকে বারো শতকের
মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত ৪৮৫ জন কবির
২৩৭০টি কবিতা। এ যুগে ধর্মশাস্ত্র
প্রণেতা ভবদেব ভট্ট ও জীমূতবাহনের
আবির্ভাব ঘটে। রাজা বল্লালসেন ও
লক্ষ্মণসেন লেখক হিসেবে কম
কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন না। এ
যুগেই রচিত হয় হলায়ূধের ব্রাহ্মণসর্বস্ব।
এ ছাড়াও এযুগে আরও সাহিত্যকর্মের
সন্ধান পাওয়া যায়। এ কথা অবশ্যই
স্বীকার্য যে, বারো শতকের সেন
শাসনাধীন বাংলায় সংস্কৃত সাহিত্যের
অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়।
এ যুগে শৈল্পিক কৃতিত্বের অপর ক্ষেত্র
হচ্ছে ভাস্কর্য। সেনযুগে বাংলার
ভাস্কর্য শিল্পের চরম উন্নতি ঘটে।
বাংলার ভাস্কর্যের আঞ্চলিক
বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র ধারাও এ যুগে
সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.