নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জাহেদুল ইসলাম

সময়ের কাজ সময়ে করতে পছন্দ করি

জােহদুল ইসলাম

সততায় সফলতা

জােহদুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

সার্কের ২৭ বছরের সফলতা-ব্যর্থতার একটি মূল্যায়ন

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১৭

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগীতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সার্ক। দেখতে দেখতে আজ ২৭টি বছর কেটে গেল। এরই মধ্যে সার্ক সদস্যদেশগুলোর প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে ১৭ টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই জোট গঠিত হয়েছিল তা কি সত্যিই পূরণ হয়েছে? মূলত সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অনেক কিছুই এখনো যথাযথ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সার্কের সফলতার পথে প্রধান অন্তরায় বলে মনে করা হয় এই অঞ্চলের দুই পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানকে। তাদের মধ্যকার পারস্পারিক বিরোধ সার্ক সদস্য দেশগুলোকে কোন সমঝোতায় আসতে দেয়নি। এছাড়া অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যকার ছোট খাট দ্বন্দ্বগুলোও এখনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি। ফলে সার্কের যথাযথ কার্যকারিতা আজ লক্ষ্য করা যায় না।

সার্কের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে মালদ্বীপের আদ্দু শহরে। সম্মেলন শেষে ২০ দফা ঘোষণা দেওয়া হলেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রকৃত যে সমস্যাগুলো রয়েছে সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়নি। বিশ্বব্যাপী যেখানে অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজমান সেখানে আদ্দু সম্মেলনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে আজ অর্থনৈতিক মন্দা। বাংলাদেশের রপ্তানী কমেছে ৩৯ভাগ। অপরদিকে বানিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩ ভাগ। মুদ্রাস্ফিতি ক্রমাগত বাড়ছে। এই চিত্র নেপাল, শ্রীলংকা কিংবা মালদ্বীপেও লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৩ভাগেরও বেশি অর্থ্যাৎ প্রায় ১.৫ বিলিয়ন লোকের বাস দক্ষিণ এশিয়ায় অথচ তারা বিশ্বের মোট জিডিপির মাত্র ২.৩ভাগ ভোগ করে।

সার্কের একটি বড় অগ্রগতি ছিল ঝড়ঁঃয অংরধহ ঋৎবব ঞৎধফব অৎবধ (ঝঅঋঞঅ) চুক্তি স্বাক্ষর। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত আদ্দু ঘোষনায় ২০০৬ সাল থেকে কার্যকর হওয়া সাফটা চুক্তির পূর্ন বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছিল কিন্তু ভারতের অসহযোগীতার জন্য তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ভারত তাতে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক আরোপ করেছে। যদিও অনেক পন্যের শুল্ক মুক্ত ঘোষনা দিয়েছে কিন্তু তার অধিকাংশ পণ্যই দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো উৎপাদন করে না। ফলে এই সুবিধাকে অন্যান্য দেশগুলো কাজে লাগাতে পারছে না। ঝঅঋঞঅ কে ঘঅঋঞঅ (ঘড়ৎঃয অসবৎরপধ ঋৎবব ঞৎধফব অৎবধ) এর মতো সফল বানিজ্য জোট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হতো যদি ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মতো সকল দেশের স্বার্থ আদায়ে স্বচেষ্ট হতো।

এমনকি এই দেশগুলোর মাঝে আন্তঃবানিজ্য সম্পর্কেরও তেমন উন্নতি হয়নি। এই অঞ্চলের দেশগুলো বহির্বিশ্বের সাথে যে বাণিজ্য পরিচালনা করে তার একটা ক্ষুদ্র অংশ নিজেদের মধ্যে করে থাকে। এই বাণিজ্য ঘাটতি অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জন্য আরো প্রকট। বাংলাদেশের পন্য রপ্তানীর তুলনায় আমদানি বেড়েছে প্রায় ৮ গুণ, সবচেয়ে বেশি ভারত ও পাকিস্তানের সাথে। অথচ সার্কে এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই। আর এখানে বানিজ্য ঘাটতির একটি বড় কারণ হলো এই দেশগুলোর অসম অর্থনীতি। এই অঞ্চলের বড় অর্থনৈতিক শক্তি হলো ভারত। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মোট জিডিপির ৭৭.৮ ভাগ, বানিজ্যের ৪০.৩ ভাগ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের ৭৫.৮ ভাগই ভারতের দখলে। গবেষণায় বলা হয় যে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ভারত হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ঐ সময় ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতার ভিত্তিতে ভারতের জিডিপি পরিমান হবে ৮৫.৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এমতাবস্থায় যদি বাংলাদেশ কিংবা নেপালের অর্থনীতি ভারতের সাথে পাল্লা দিতে যায় তবে তার টিকতে পারবে না। বরং বড় অর্থনীতি ছোট অর্থনীতিকে গ্রাস করবে। ফলে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার নামে ভারতের অর্থনৈতিক আধিপত্য কায়েম হবে। এই অসম অর্থনীতির সমস্যা সমাধান করতে না পারলে বানিজ্যেও সমতা আসবে না। আর অর্থনৈতিক সমতা নিয়ে আসা সার্কের পক্ষ্যে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

দক্ষিণ এশিয়ার আর একটি বড় সমস্যা হলো দারিদ্রতা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৪ ভাগ এখনও দারিদ্র। ভারতে ২০০৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ২৭.৫। অথচ তা হ্রাস না পেয়ে ক্রমাগত বেড়েছে এবং ২০১০ সালে তার পরিমান দাড়ায় ৩৭.০২ ভাগ। ভারতের কোন কোন রাজ্যে দারিদ্রতা এখনো এতটাই প্রকট যে সেখানে প্রায় প্রতিদিন ৫ হাজার শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যায়। ১৯৯১সালের দরিদ্র দূরীকরন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সামরিক ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করলেও ভারত ও পাকিস্তান তাদের সামরিক ব্যয় মোটেও কমায়নি। বরং সেই কমিশন আজ শুধুই ফাইলবন্দি রয়েছে, বাস্তবায়ন হয়নি।

আদ্দু ঘোষনায় জ্বালানী সংকট মোকাবেলার জন্য একটি সমীক্ষা চালানো হয়। কারণ এই অঞ্চলের একটি বড় সমস্যা হলো জ্বালানী। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ নেপাল ও ভূটান জ্বালানী সমৃদ্ধ হলেও বাংলাদেশের মত দেশগুলো সেই জ্বালানী খুব সহজে আনতে পারে না। এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভারতের বিভিন্ন প্রটোকল। অথচ ভারত নিজে নেপাল ও ভুটানের সাথে যৌথভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কিন্তু সে বহুপাক্ষিক উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহনে নারাজ। ফলে ভারতে নিজ স্বার্থ এবং অসহযোগীতার জন্য এই অঞ্চলের জ্বালানী সংকট এখনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি। আফগানিস্তান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানী সরবরাহের ক্ষেত্রেও ভারত বাঁধা হয়ে দাড়ায়। ফলে অন্যান্য দেশগুলো জ্বালানী সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

জলবায়ু ইস্যুটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ সবচেয়ে বেশি জলবায় ঝুকিপূর্ন দেশ। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে হারে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে তা যদি কমানো না যায় তাহলে এ শতাব্দীর শেষের দিকে মালদ্বীপ সাগরের বুকে তলিয়ে যাবে। মালদ্বীপের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকষর্ণের জন্য প্রেসিডেন্ট নাশিদ সমুদ্রের নিচে তার মন্ত্রিসভার মিটিংও করেছেন, যা সারা বিশ্বে একধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আর বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে যদি সমুদ্রের পানি ১ মিটার বৃদ্ধি পায় তাহলে ১৭ভাগ উপকূলীয় এলাক পানির নিচে তলিয়ে যাবে, যা ২০ মিলিয়ন পরিবেশগত উদ্বাস্তুর (ঊহারৎড়হসবহঃধষ জবভঁমব) সৃষ্টি করবে। অথচ বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য মোটেও দায়ী নয়। বাংলাদেশ বছরে মাত্র ০.২ টন কার্বন নিঃসরণ করে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি কার্বণ নিঃসরণকারী দেশ হলো ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ঈধৎনড়হ-ফর-ঙীরফব ওহভড়ৎসধঃরড়হ অহধষুংরং ঈবহঃৎব’ (ঈউওঅঈ) থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী কার্বন নির্গমনে ভারতের অবস্থান তৃতীয় এবং প্রতিবছর সে প্রায় ২০৬ কোটি ৯৭ লাখ ৩৮ হাজার টন কার্বন নিঃসরণ করে থাকে। অথচ বিভিন্ন জলবায়ু সম্মেলনে তাকে কার্বন কমানোর ব্যাপারে সবসময়ই অনাগ্রহী দেখা যায়। কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ বৃদ্ধি ও জলবায়ু তহবিল গঠনে ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গলা মিলিয়ে বিরোধীতা করে অথচ আঞ্চলিক দেশগুলো কথা চিন্তা করে না। ভারতের অসহযোগীতার কারণে গত ২৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দোহা জলবায়ু সম্মেলনেও সার্কভুক্ত দেশেগুলো জোড়ালো ভাবে তাদের দাবী উত্থাপন করতে পারেনি। অন্যান্য দেশগুলো যেখানে ২০২০ সালে কার্বন নির্গমনের পরিমান ৮৫ভাগ কমাতে চায় সেখান ভারত তা চায় না। যদিও কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু তহবিল গঠনে একটি সমঝোতা হয়েছে, যাকে অবশ্যই বিশ্ববাসীর জন্য ভাল বলা যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখনো তাতে ইতিবাচক মনোভাব পোষন করেনি। সূতরাং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সেখান থেকে কি পায় তাই হলো দেখার বিষয়।

তবে অনেক ক্ষেত্রেই সার্ক সফলতার পরিচয় দিয়েছে। পারস্পারিক কৃষি সহায়তা, সন্ত্রাস দমনে সহায়তা, শিক্ষা সহায়তা, দুর্যোগ মোকাবেলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক ভাল পদক্ষেপ গৃহিত হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সাতে এটা একান্তই নগন্য। তাই আগামী দিনে সার্ককে কার্যকর করতে হলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বানিজ্যিক বাঁধা গুলো কমিয়ে আনতে হবে, সমুদ্র ও স্থলবন্দরে প্রযুক্তি সেবা বাড়াতে হবে, প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে, বৃহৎ শক্তির ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে, বানিজ্য তদারকির জন্য একটি যথাযথ পর্যবেক্ষক দল গঠল করতে হবে, এই অঞ্চলের আর একটি অর্থনৈতিক জোট বিমসটেককে আরো কার্যকর করা ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। সার্কের ১৮তম সম্মেলন নেপালে হওয়ার কথা থাকলেও অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক কারণে এখনো তার সময় নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। সার্ককে অধিক কার্যকর করার জন্য সদস্য দেশগুলোর মাঝে যে সমস্যা আগে তার সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রস্বার্থকে বড় করে দেখার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্বার্থকেও বড় করে দেখতে হবে। অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক ক্ষেত্র সহ অন্যান্য সকল বিষয়ে পারস্পারিক সহযোগীতা জোরদার করতে পারলে আগামী দিনে সার্ক একটি সফল আঞ্চলিক জোট হিসেব প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে ভারতকে। আর যদি তা করা সম্ভব না হয় তবে আগামী দিনে সার্কের টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

জাহেদুল ইসলাম

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.