নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একজন ছাত্র৷ সারাজীবন ছাত্রই থেকে যেতে চাই৷ আমি সকলের কাছ থেকে শিখতে চাই৷ এবং যা শিখেছি তা শিখাতে চাই৷

যুবায়ের আলিফ

যুবায়ের আলিফ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিজ্ঞানের যুবরাজ ইবনে সিনা।

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:১২



ইবনে সিনা বিজ্ঞানের জগতে একটি নক্ষত্র৷ আরব সভ্যতায় খ্যাতিমান, মৌলিক ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী৷ বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের নাম আসলেই তার নাম স্মরণ করা হয়৷ পাশ্চাত্য দুনিয়া়ও তার মনীষা অবদানে প্রণত৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকে তার বই পাশ্চাত্যে চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অবশ্য পাঠ্য ছিল৷ ইবনে সিনার মনীষী দ্যুতি হারিয়ে যায়নি আজও৷
সংিক্ষপ্ত জীবনকাল
আবু আলী হোসাইন আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা উন 980 সালে আগস্ট মাসে বোখারার আফসানা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন৷ সেখানে ছয় বছর বয়সে মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং 10 বছর বয়সে পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেন৷ এর মধ্যে তিনি আরবী সাহিত্য অধ্যায়ন করে ফেলেন৷ ততপর বিভিন্ন শিক্ষকের নিকট থেকে ইসলামিক জ্ঞান ও ফিকাহ শিক্ষা গ্রহণ করেন৷ তিনি আব্দুল্লাহ নাতিলীর নিকট দর্শন জ্যামিতি ও জ্যোতিষ শাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং আপন প্রতিভাবলে তার শিক্ষককে ছাড়িয়ে যান৷ ঠিক এ সময় তিনি পদার্থবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যুৎপত্তি লাভ করেন৷ চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণা ও অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানে পরিপূর্ণতা সাধন করেন৷
কথিত আছে, যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে অস্তিত্ব ছিলনা তখন হিপোক্রিটাস তা সৃষ্টি করেন৷ যখন তা ধ্বংস হয়ে যায় তখন গ্যালন তার পুনরুজ্জীবিত করেন৷ যখন এটা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তখন আল রাজি এটা সুসংঘবদ্ধ করেন৷ আর তা ছিল৷ অসম্পূর্ণ ইবনে সিনা এসে কে পরিপূর্ণ রূপ দান করেন৷
18 বছর বয়স পর্যন্ত ইবনে সিনা রাতদিন অধ্যায়নে মগ্ন থাকতেন৷ নিদ্রা যাতে জ্ঞান অর্জনে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্য তিনি এক ধরনের পানীয় পান করতেন৷ তন্দ্রা ও নিদ্রা অবস্থায় তার মনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উদয় হতো, এবং কোন কোন জিজ্ঞাসা সমাধান স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত হতেন৷
ইবনে সিনা ইসমাইল প্রচারকদের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং তাদের কাছে গ্রীক দর্শন জ্যামিতি ও গণিত শাস্ত্রে প্রভুত পান্ডিত্য অর্জন করেন৷ চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে লিখিত সকল পাঠ শেষ করেন| এরিস্টোটল ইউক্লিড ও টলেমির গ্রন্থাবলী সাথে পরিচিত হন| কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্র কে তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন| মাত্র 17 বছর বয়সে তাঁর খ্যাতি এতই ছড়িয়ে পড়ে যে, মাননীয় সুলতান আরোগ্য লাভ করলে তিনি তাকে তার ইচ্ছা মাফিক কিছু দেবার ঘোষণা দেন। কিন্তু জ্ঞান পিপাসু ইবনে সিনা বাদশার নিকট লোভনীয় কোন কিছু না চেয়ে কেবল তার রাজকীয় লাইব্রেরীতে অধ্যায়নের সুযোগ চান। সুলতান ইবনে সিনার অভিপ্রায় মোতাবেক লাইব্রেরীর গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এতে তিনি এতই প্রীত হন যে, খাওয়া-দাওয়া নিদ্রা পর্যন্ত ত্যাগ করেন । এ সময় তিনি তার অপরিসীম বুদ্ধিমত্তা , অন্যান্য সাধারণ স্মৃতিশক্তিও বোধশক্তির মাধ্যমে প্রভুত জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু তার এই অবস্থা বেশি দিন যেতে না যেতে 20 বছর বয়সে তার পিতার মৃত্যু হয়। আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন সুলতান নুহ এর মৃত্যুতে। কারণ শাসনকর্তার মৃত্যুতে বুখারায় রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে তিনি বুখারা ত্যাগ করেন। এক হাজার এক সালে ইবনে সিনা খারিজম পৌছেন। সেখানে আলী বিন মামুনের দরবারে আল বিরুনী ,আল ইরাকি, আবুল খায়ের প্রমুখ পন্ডিত ও সুফিদের সাক্ষাত লাভ করেন। এখানে কিছু দিন অবস্থানের পর তিনি ইরাকের রওনা হন। কিন্তু সেখানে বেশি দিন অবস্থান করতে না পেরে 1009 সালে জুরজানে রওনা হন। এখানে এসে তিনি আরেক সংকটের কবলে পড়লেন। 1015 সালে জুরজান হতে রায় যাত্রাকালে দায়লাম-এ-বুয়াহ রাজত্বের অবসানে যে সকল ছোট ছোট রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল সেসব অঞ্চলে সংকটময় অবস্থার সম্মুখীন হন। এ সময় তিনি কখনো মন্ত্রী ,কখনো চিকিৎসক ,কখনো দার্শনিক ,কখনোবা উপদেষ্টার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। 1022 সালের শুরুতে তিনি বুয়াইদ আমীর আজাদউদ্দৌলার পৃষ্ঠপোষকতায় বাস করতেন। আমির ছিলেন একজন জ্ঞানানুরাগী ব্যক্তি। তিনি ইবনে সিনা কে যথেষ্ট সম্মান করতেন। আমিরের কাছে থাকাকালে ইবনে সিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি ক্রমাগত কৃশ ও দুর্বল হয়ে পড়লে ইস্পাহানি গমন করেন। এখানে তিনি কিছুকাল ভালো থাকলেও পুনরায় হামাদান যাত্রা করেন। এখানে এসে তিনি তীব্রভাবে রোগাক্রান্ত হন। ফলে এ মহান বিজ্ঞানী 4 রমজান 428 হিজরী মোতাবেক, 1037 সালে জুন মাসে ইন্তিকাল করেন। হামাদানে এখনো তার কবর বিদ্যমান আছে।


ইবনে সিনার রচনাবলীঃ
দুটি ফার্সিতে রচিত গ্রন্থ ব্যতীত আর সবগুলো গ্রন্থ আরবি তে রচিত৷ পদ্যেও তার কিছু রচনাবলি আছে৷ তিনি ১২৫ টি,কারো মতে ১৮০ টি গ্রন্থ রচনা করেন৷ ইবনে সিনার রচিত কয়েকটি গ্রন্থ নিম্নরুপঃ
1৷ কিতাব আশ শিফাঃদর্শনের উপর একটি বৃহৎ বিশ্বকোষ৷ ১৮ খন্ডে বিভক্ত এ রচনাটি তার অল্প বয়সের রচনা হলেও নিতান্ত বিশাল প্রকৃতির৷ মধ্যযুগে ইউরোপে এটি একটি প্রামান্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হত৷ মুসলিম বিশ্বে এখনো এটি মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত৷ 1302 হিজরীতে তেহরানের লিথো প্রেসে এর কয়েকটি খন্ড মুদ্রিত হয়৷ এর কোনো খন্ডের অনুবাদ ল্যাটিন ভাষাও আছে৷ এত সমগ্র দর্শন ছাড়াও ন্যায়শাস্ত্র ও অধিবিধানের উপর আলোচনা করেন।
2। আল কানুন ফিত তীব: চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর লিখিত তার বিশ্ব বিশ্রুত গ্রন্থ। চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশ্বকোষ ইউরোপে ক্যানন অফ মেডিসিন নামে পরিচিত। ইবনে সিনার আরবি পদ্ধতির শীর্ষস্থানীয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কানুন চিকিৎসা বিজ্ঞান ও শল্যবিদ্যা সম্পর্কিত এই এক পরিপূর্ণ বিশ্বকোষ। এ গ্রন্থে রোগ, ঔষধ ও অসংখ্য রোগের চিকিৎসার সমাধান দেওয়া আছে। এ গ্রন্থে রোগ নিবারণ ও ওষধ প্রস্তুত প্রণালী সম্বন্ধেও বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ভেষজ দ্রব্যগুণ বিষয়ে ঔষধ সমূহের যথার্থ তত্ত্ব ভেষজ বিদ্যার অনুসরণীয় পদ্ধতি সমূহের একটি নকশাও তিনি এতে অঙ্কন করেছেন। ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে আল কানুন এর প্রভাব কে অতিরঞ্জিত করা যায় না। স্যার টমাস ক্লিফোর্ড আল বুট Encyclopaedia Britannica তে বলেন ইবনে সিনার কানুন হিপোক্রিটাস ও মধ্যযুগীয় দিকপাল গ্যালন এর কৃতিত্ব কে ম্লান করে দিয়েছিল। অধ্যাপক হিট্টি বলেন দ্বাদশ শতক হতে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোতে এ গ্রন্থটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রধান পথ প্রদর্শক ছিল। মুসলিম বিশ্বে এখন পর্যন্ত এটি প্রধান বিশেষ করে ইউনানী পদ্ধতির এটি প্রধান প্রামাণ্য গ্রন্থ ।Dr. William Osler " The Evolution Of Modern Medicine" নামক গ্রন্থে ইবনে সিনার আল কানুন গ্রন্থ সম্পর্কে মন্তব্য করেন এটি যে কোন গ্রন্থের তুলনায় দীর্ঘসময় মেডিকেল বাইবেল রূপে রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে ইবনে সিনা এতো বেশি সম্মানিত যে চিকিৎসা অনুষদের বিরাট হল ঘরে তার প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে।
মুদ্রণ পদ্ধতির আবিষ্কার 30 বছর পর চোদ্দোশো ছিয়াত্তর সালে এটি রোম থেকে মুদ্রিত হয় । আল কানুন এর সর্বপ্রথম ল্যাটিন অনুবাদ Cremonese এর Gherardo করেন, ভেনিস 1544 সালে কয়েক খণ্ড মুদ্রিত হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে আল-কানুন 20 বারের বেশি বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়। সম্ভবত আজ পর্যন্ত চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর রচিত এত জনপ্রিয় ও বহুল পাঠ্য গ্রন্থ রচিত হয়নি।
3৷ আল আদাবিয়াতুল কলবিয়াঃ চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর লিখিত ইবনে সিনার ২য় গ্রন্থের নাম৷ Bilge যা তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং আরবী মূল ইবারতসহ ইবনে সিনার নবম শতবার্ষিকীতে স্মৃতি পুস্তুক হিসেবে প্রকাশিত হয়৷
4৷ রেসালায়ে ফিল হীকমাহ ওয়াত তাবয়ীয়াহঃ পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত তিনি এ গ্রন্থে পদার্থবিদ্যা, নভমন্ডলীয়, পদার্থসমুহ, মানবীয় বৃত্তি সম্বন্ধে, চিন্তামূল্ক ও সীমা নির্দেশক বিষয়ে আলোচনা করেছেন৷ এছাড়া শাস্ত্র, চুক্তি, বর্ণমালা পৃথক পৃথক প্রবন্ধ রয়েছে৷
5৷ উয়ুন আল হিকমাতঃ দশ খন্ডে বিভক্ত দর্শনের উপর লিখিত গ্রন্থ৷ এছাড়া সিদিদীয়া, দানেশনামা, কিতাবু লিসানুল আরাবি ফিল লুগাত, কিতাবুল হাইয়ান ওয়ান নাবাত,আন নাযাত, আল আনমাতুছ ছালছাল আখিরা, রিসালাতুজ জাওয়ারা ইত্যাদি তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সম্ভারের মধ্যে অন্যতম৷ এসব গ্রন্থ রচনা ছাড়া বিজ্ঞান ও দর্শনের উপর অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেন৷ তবে তার শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে আশ-শিফা এবং কানুন ফিত তিব৷ এ দুটি গ্রন্থের জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন।


ইবনে সিনার দর্শন:
মুসলিম জাহানের একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হিসেবে ইবনে সিনা ছিলেন প্রাচ্যে শেষ এবং অ্যারিস্টটলিও দার্শনিক। তার প্রচেষ্টায় অ্যারিস্টটলিও দর্শন চর্চা সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়েছিল। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ফারাবীও শিষ্য। তিনি প্রথম দর্শন বহু চেষ্টার পরেও বুঝতে পারছিলেন না। পরে ফারাবী রচনাবলী পাঠ এর ফলে তিনি অ্যারিস্টোটলের গভীর চিন্তা ধারায় প্রবেশ করেন। ফারাবীর রচনাবলী তাঁকে দার্শনিক মানস গঠনে সহায়তা করে এবং তিনি অ্যারিস্টোটলের গ্রন্থের ব্যাখ্যা প্রদানে অনুপ্রাণিত হন। তিনি তার সঞ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে অ্যারিস্টোটল এবং প্লেটোর দর্শনের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আপন চিন্তাধারাকে সমৃদ্ধ করেন। বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থাবলী এবং মতবাদ সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে নিজস্ব দার্শনিক চিন্তাধারা কে নতুনরূপে সাজান। তার ধারণা যে দর্শন ধর্ম হবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। দর্শনের কাজ যুক্তির সাথে ঈমানের সমন্বয় সাধন নয়; বরং যুক্তির সাথে জীবনের সমস্যাগুলি ব্যাক করাই এর কাজ। ইবনে সিনার মতে দর্শন চর্চায় পরিপূর্ণ ও বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ সম্পর্কে ইবনে সিনা মতবাদ হচ্ছে; আল্লাহ্ অপরিহার্য এক সত্তা। তিনি কাল‚ সীমা ও গতির ঊর্ধ্বে। তার মতে দু'ধরনের সত্তা আছে সম্ভাব্য ও অপরিহার্য। সম্ভাব্য সত্তা অপর কোন সত্তা হতে বিকাশ লাভ করে কিন্তু অপরিহার্য্য সত্তা সম্পূর্ণ স্বাধীন। এটি কোন কিছুর সাথে সম্পর্কিত নয় । একাধিক বা একটি কারণ হতে সম্ভাব্য সত্তা জন্মগ্রহণ করে; পক্ষান্তরে অপরিহার্য সত্তা কোন কারণজাত নয়। সম্ভাব্য সত্তা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু অপরিহার্য সত্তা চিরন্তন । আর এই অপরিহার্য সত্তাই মহান আল্লাহ। অপরিহার্য সংজ্ঞা মাত্র একটি। সত্তার গুনাবলি তার অস্তিত্বর সাথে অভিন্ন। ইবনে সিনা তার দার্শনিক মতবাদ এ আত্মার উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তার শ্রেষ্ঠ দার্শনিক গ্রন্থ The Healing মনস্তত্ত্ব কে কেন্দ্র করে তাঁর আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদের উদ্ভব। অবিনশ্বর সত্তা এবং এটি আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে এসেছে‚ দেহের কোন অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। তার মতে সকল সত্তার মৌলিক কারণ আল্লাহ। সমস্ত জড়জগৎ তার ওপর নির্ভরশীল। কেননা‚ তিনি ব্যতীত কোনো অস্তিত্বই রূপ লাভ করত না। মানব সৃষ্টি তত্ত্ব সম্পর্কে প্লেটোর মতবাদ অধিকাংশ আরবি দার্শনিক মেনে নিলেও ইবনে সিনা তা গ্রহণ করেননি। তার অভিমত হলো আত্মাগুলো অনন্তকাল পূর্ব হতেই তৈরি হয়ে আছে। মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সম্বন্ধে ইসলামের প্রত্যাবর্তন সূত্রই বিশ্বাস করেন। অ্যারিস্টোটলের অনুসারী হলেও ইবনেসিনা আল্লাহ ও বিশ্ব সম্পর্কীয় প্রশ্ন গ্রিক দর্শনের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে। অ্যারিস্টোটলের মতবাদ হল জগৎ চিরন্তন। আল্লাহ বিশ্ব জগতের সৃষ্টিকর্তা নন বরং গতিধারার নিয়ন্ত্রক। পক্ষান্তরে ইবনে সিনা বলেছেন এই বিশ্ব অনন্ত এবং তার আদি কারণ আল্লাহর সৃষ্টি। এই সূত্রই কার্যকরণের যুগপৎ ঘটমান প্রকৃতিকে কে প্রতিষ্ঠা করে।


ইবনে সিনা ও পদার্থবিদ্যা:
ইবনে সিনা নিকট পদার্থবিদ্যা একটি চিন্তামূলক শিল্প। যার বিভিন্ন বিষয়বস্তু আছে। 1 বাস্তবে স্থিত বস্তুসমূহ এবং 2 ধারণাগত বস্তুসমূহ। পদার্থবিদ্যা তিনি গতি ‚মিলন‚ শক্তি‚ অসিমতা‚ আলোক ও উত্তর সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেন। তিনি বলেন আলোক অনুভূতির কারণ যদি আলোক কেন্দ্র হতে বিচ্ছুরণ আলোক কণা হেতু হয় আলোকের গতি সসীম থাকবে। নিয়ে নির্দিষ্ট ওজনের আলোচনাও করেছেন। "তিসআ রিসালা ফি হিকমাতি ওয়াত তারবিয়াহ" নামক গ্রন্থে পদার্থবিদ্যা বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার পৃথক পৃথক আলোচনা করেছেন। ইবনে সিনার মতে ধাতুসমূহের পরস্পর রূপান্তর করন সম্ভব নয় কেননা এরা বিভিন্ন। মনে হয় তিনি যেন ধাতুর রাসায়নিক প্রক্রিয়া বিশ্বাসী ছিলেন না। তার প্রবন্ধ মা দুনিয়াত (খনিজ পদার্থ সমূহ )13 শতাব্দি পর্যন্ত ইউরোপে ভূতত্ত্ব বিষয়ে ধ্যান-ধারণার একমাত্র উৎস ছিল।


জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও ইবনে সিনা
পর্যবেক্ষণ বিশুদ্ধ করতে হলে বিশুদ্ধভাবে গণনা করার যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। জ্যোতির্বিজ্ঞান আলোচনা করতে গিয়ে বিশুদ্ধ গণনা করার উপযোগী যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করার চিন্তাই প্রথমে ইবনে-সিনা কে পেয়ে বসে। এ বিদ্যার প্রতি তার এত অনুরাগ ছিল যে‚ শেষ বয়সে তিনি গতিশীল পরিমাপ যন্ত্রের মত (Vernier) সূক্ষ্ম গণনা করার উপযোগী একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এর মাধ্যমে যেন যান্ত্রিক সংযোজন নিখুঁত ভাবে হয়ে থাকে। এ শাস্ত্রে ইবনে সিনার প্রভূত জ্ঞান ছিল। তিনি কয়েকটি জ্যোতিষ্ক বীক্ষনাগার স্থাপন ছাড়াও হামাদানের কয়েকটি মান মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।


মনোবিজ্ঞানী ইবনে সিনা:
মনোবিজ্ঞানীর আলোচনা ইবনে সিনা ক্রমানুসারে উদ্ভিদ মন (নফসে নাবাতি) হতে শুরু করেও জীবন মন (নফসে হাইওয়ানি)
জীবন মন থেকে শুরু করে মানব মন (নফসে ইনসান) এর দিকে
অগ্রসর হয়েছেন। মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে তার লিখিত গ্রন্থের নাম কিতাব আন নফস।
1. উদ্ভিদ মনে বিভিন্ন শক্তি কাজ করছে । যথা খাদ্য গ্রহণের শক্তি ও প্রজনন শক্তি।
2. জীব মন দুটি শক্তি। অনুভব এবং গতিশক্তি নিয়ে তা গঠিত। গতিশক্তি আবার দু'ভাগে বিভক্ত। উদ্দীপক শক্তি যার কাজ শক্তি উৎপাদন করা কর্মশক্তি স্নায়ুমণ্ডলী এবং গোশত পেশির উপর ক্রিয়াশীল ।
3. মানবীয় মন নিজ প্রাথমিক অনুভূতি গুলোকে বুদ্ধি ও বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছাবার জন্য গুণ অর্জন করে । তাহা বাহ্যিক হতে পারে এবং অভ্যন্তরীণও হতে পারে। বাহ্যিক গুণাবলী প্রথমটি হলো মন:সৃষ্টি তা ঐ সমস্ত দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করা যায় । এ গুণাবলীগুলো হলো কল্পনা শক্তি ‚রূপায়ণ শক্তি ‚ধারণা শক্তি ও স্মরণশক্তি। ইবনে সিনার মতে এগুলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সাথে সম্পর্কিত।


ইবনে সিনার শরীয়ত ও সুফিতত্ত্ব:
ইবনে সিনা তার 'ইশারাত' গ্রন্থের শেষ পরিচ্ছেদে 'মাকামাতুল আরেফিন' তথা তত্ত্বজ্ঞানী আলোচনা প্রসঙ্গে তাসাউফ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তার মতে তত্ত্বজ্ঞানী তিনিই যিনি মানতেক ও ইলম হতে সরে এসে হাকীকতের নৈকট্য ও মিলন লাভ করে আল্লাহর রাজ্যে উপনীত হন। আরিফগণের কয়েকটি ঘাঁটি পার হতে হয় এবং তার বিভিন্ন স্তরও রয়েছে। সমস্ত পর্যায় গুলোর মধ্যে রয়েছে- অনাসক্ত জীবন‚ সংযমশীলতা‚কৃচ্ছতা সাধন‚ উনিক স্বীকৃতিকে ক্রমে মিলনজনিত বিস্মৃতির অবস্থায় পরিণত করা। প্রখ্যাত সুফী তত্ত্ববিদ আবু সাঈদ আবুল খায়ের এর নিকট লিখিত ইবনে সিনার পত্রাবলী তাসাউফের প্রতি তাঁর অনুরাগে সাক্ষ্য দেয়। এ বিষয়ে তার লিখিত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে রয়েছে- ইশক‚ রিসালা ফী মাহিয়াতিস সলাত এবং কিতাব ফী মানাজ জিয়ারা। তন্মধ্যে চারটি পুস্তক লাইডেন হতে 1894 সালে Mehren কৃত ফার্সি ভাষায় অনুবাদ ও মূল 1899 সালে প্রকাশিত হয়। ইবনে সিনার ঐশীতত্ত ফারাবী ও রাসাইলু ইখওয়ানিস সাফার সমন্বয়ে গঠিত। দার্শনিক স্বীকার করেন যে আঁকলের সাথে সাথে ঈমান থাকা আবশ্যক। ইবনে সিনার মতে‚ ঈমান আকলের পরিপূর্ণ রূপ: সুতরাং ঈমান আকলের পূর্ণতা দান কর। তার মতে‚ শরীয়ত হিকমতের বিপরীত নয়। তার অস্তিত্ব পরস্পরের জন্য আবশ্যক। ইবনে সিনা আরো বলেন‚ রসূলগণের মর্যাদা দার্শনিকদের ঊর্ধ্বে এবং ওহীর স্থান হল এক মহান এবং উন্নত অনুভূতির। ওহী‚ ইলহাম এবং স্বপ্ন আল্লাহর প্রজ্ঞার অংশবিশেষ। তার মতে শরীয়তের কাজ হল- "মানব জাতির সংশোধন।" প্রশাসনিক ও আধ্যাত্মিক উপায় শরীয়তের কাজ সংঘটিত হয়। এদের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্য নবীগণ যেভাবে এখতিয়ার প্রাপ্ত তা সাধারণ মানুষের জন্য নয়৷ শরিয়ত এবং প্রজ্ঞার ব্যাপারে ইবনে সিনা শরিয়তের নিকটতর৷
এজন্য তার সমস্ত দর্শন ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ধর্মতত্ত্বের সাথে মিশেছে৷

ইবনে সিনার ধর্ম বিশ্বাসঃ
ইবনে সিনার পরিবার ছিল শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী৷ তিনি সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শিয়া আকিদা ও বিশ্বাস গ্রহন করেননি বলে নিজেই উল্লেখ করেছেন৷ ত্নি কোনো মাজহাবের অনুসারী ছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে তার বই 'রেসালায় জুদিয়া' (ফার্সি ভাষায় রচিত) এর ৭২ পৃষ্ঠাব্যাপি উর্দু ভূমিকা রচনা করতে গিয়ে হাকীম সৈয়দ জিল্লুর রহমান (রিসার্চ অফিসার, মুসলিম ইউনিভার্সিটি, আলীগড়) লিখেছেন- মহিউদ্দিন ইবনে আবিল ওয়াফা আল জওয়াহেরুল মুজিয়া ফি তবকাতিল হানাফিয়া- নামক গ্রন্থে ইবনে সিনাকে হানাফী উল্লেখ করে শুধু এতটুকু লিখেছে যে, তিনি হামাদানে ইন্তেকাল করছেন৷ (পৃষ্ঠা ২৩)

ইবনে আবিল ওয়াফা (হি. ৬৯৬-৭৭৫) ইবনে সিনাকে হানাফঈ মাজহাবের অনুসারী বলে তার ধর্মীয় আকীদা বিশ্বাসের আরো একটি দিক তুলে ধরেছেন৷ হানাফী ওলামাদের উপর রচিত এই গ্রন্থটির নাম হতেই প্রমানিত হয় যে, ইবনে সিনাকে এর অন্তর্ভুক্ত করে তাকে হানাফী মাজহাবের অনুসারীরুপে চিত্রিত করা হয়েছে৷ ইবনে সিনার রচনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তার সমগ্র রচনার মধ্যে শুধু ৬৮ টি রচনা ধর্ম সংক্রান্ত৷ হামদর্দ তিব্বীয়া কলেজ করাচির সাবেক অধ্যাপক খাজা বরজওয়ান আহমদ ইবনে সিনার 'মাজহাব ও আকীদা' সম্পর্কে লিখেছেন' "তার রচনাবলি থেকে জানা যায় যে, তিনি শিয়া সুন্নির বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন এবং যখনই তার প্রয়োজন হতো, সমস্যাগুলোর সমাধানে মস্তিষ্ক অস্থির হয়ে যেতো তখন তিনি বুখারার জামে মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করতেন, আবার চলে আসতেন৷ তিনি সেখানে শুয়ে পড়তেন অথবা ধ্যান মগ্ন হতেন৷" হাকীম রেজওয়ান এতদসংক্রান্ত ইবনে সিনার একটি পত্রের উল্লেখ করেন, যা তিনি আবুল খায়ের সূফি কে লিখেছিলেন৷ এতে তার আকীদা-বীশ্বাসের সম্যক পরিচিতি পাওয়া যায়৷ চিঠির একটি উদ্ধৃতি এরুপঃ বন্ধু আবু সাইদ! তোমার জাহের-বাতেন,আওয়াল-আখের একমাত্র আল্লাহর জন্যে হওয়া উচিৎ৷...... আল্লাহ পাক পবিত্র এবং বে-আইব, দোষমুক্ত, তিনি গোপনে এবং প্রকাশ্যেও আছেন৷ তিনি প্রত্যেক বস্তুতে জ্ঞানগতভাবে বিরাজমান এবং তার নূর প্রত্যেক বস্তুতে বিরাজমান আছে৷ যা এটা প্রমাণ করে যে, তিনি সর্বদা একক৷ তোমার জানা আবশ্যক যে, সকল কাজের মধ্যে সালাত সর্বোত্তম, আর রোজা হচ্ছে সবচেয়ে আরামদায়ক৷ অনুরূপভাবে সাদকা সকল পূণ্যের অধিকতর উপকারী পূণ্য৷ রিয়া সকল কাজ বিনষ্টকারী এবং জ্ঞান শ্রেষ্ঠত্বের মূল আর মারেফত সকল কিছুর উর্ধ্বে৷

ইবনে সিনা একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন৷ দার্শনিক মতবাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, তার ঈমান নিয়ে বিভিন্ন সময় সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে৷ কিন্তু তার গুরুত্বপূর্ণ রচনাসমূহের মাঝেও ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়৷ ধর্মহীনতার অভিযোগ তার সময়ও উত্থাপিত হয়েছিল৷ এ ব্যাপারে ইবনে সিনা দূঃখ পেয়েছিলেন৷ লিখেছিলেন চতুষ্পদি কবিতা -
আমাকে কাফের বলা কখনো সহজ নয় অতো৷
ধর্মের অবস্থা দৃঢ়তর, আমার আস্থার এই মতো৷
ব্যক্তি বিশ্বে আমি অপরুপ, আমি যদি ধর্মহীন,
তাহলে কোথাও নেই একটিও মুসলিম মু'মিন৷
ইবনে সিনা ইসলামের সাধারণ ইবাদত নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন৷ কোনো বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক সমস্যার সমাধান করতে না পারলে তিনি প্রার্থনার জন্য মসজিদে ছুটে যেতেন৷ তিনি একজন উচু স্তরের আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন৷
তার ধর্ম চিন্তার মধ্যে সবসময় ঐক্য প্রচেষ্টা লক্ষণীয়৷ শরিয়ত এবং প্রতিভার ব্যাপারে ইবনে সিনা সবসময়ই শরিয়তের নিকটতর৷

তাওহীদ সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল সবসময় যৌক্তিক ও সাযুজ্যপূর্ন৷ ইবনে সিনার বক্তব্য হলো, এক হতে অনেক হতে পারে কিন্তু অনেক থেকে এক হতে পারে না৷ কারণ অনেকের মধ্যে কেউ আগে, কেউ পরে আসবে৷ একপর্যায়ে যদি দুটি সত্তারও আবির্ভাব হয় তার মধ্যেও একটি আগে ও অন্যটি পরে হবে৷ আর দটি যদি সমশক্তিসম্পন্ন হয় তাহলে দুটির সংঘাতে একটি কার্যকর এবং অন্যটি অকার্যকর হয়ে পড়বে৷ এক্ষেত্রে এক সত্তাই সকলের উপর প্রভাব বিস্তার করবে৷ তাই একত্ববাদের ধারনাই সঠিক৷

ইবনে সিনার সামগ্রিক পরিচয় বিস্তৃত আলোচনার দাবী রাখে৷ বহুমুখী বিষয়ে তার অসামান্য মনীষার দ্যুতি ছড়িয়েছিল৷ তিনি একটি মহাজীবনের অধিকারী ছিলেন৷ জগৎ ইতিহাসের এই অসামান্য জ্ঞান সাধক ও বিজ্ঞানের যুবরাজ জ্ঞান অন্বেষণকারীদের জন্য ৬ টি মূল্যবান উপদেশ রেখে গেছেন৷ যথাঃ
১৷ এমন কিছু অন্বেষণ করো না, যা দ্বারা তুমি লজ্জিত ও অপমানিত হবে৷
২৷ এমন কিছু বিশ্বাস করো না- যার দ্বারা তুমি মুর্খদের অন্তর্ভুক্ত হবে৷
৩৷ হয় তুমি বিচক্ষণ বা মেধাবী হও, নতুবা শক্তিশালী হও৷ এর একটির অন্যথা হয়ো না৷
৪৷ এমন কিছুর বিশ্বাসী হয়ো না- যার ফলে তুমি সাধারন মানুষের দিকে ধাবিত হয়৷
৫৷ নাস্তিক্য দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ো না৷
৬৷ এমন কিছু অন্বেষণ করো- যা তোমাকে দেওয়া হবে৷


ইউরোপীয় রেনেসাঁয় ইবনে সিনার প্রভাবঃ
ইউরোপে রেনেসাঁয় যুগে যুগে ইবনে সিনার বহু গ্রন্থ প্রথমে ল্যাটিন এবং পরে অন্য অন্য ভাষায় অনূদিত হয়৷ ৭১২-১০০৫ সন পর্যন্ত টলেডো মুসলিমদের অধীনে থাকায় এখানে প্রচুর আরবি গ্রন্থ জমা হয়েছিল, তেমনি এখানকার খ্রিস্টান, ইহুদিরাও আরবি ভাষায় বেশ লব্ধ হয়ে উঠেছিল৷ এ সুযোগে স্পেনে প্রধান ধর্মাধক্ষ্য রেমন্ড (১১৩০ সাল) আরবি গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করার জন্য একটি অনুবাদ কেন্দ্র স্থাপন করেন৷ ইবনে সিনার 'কানুন' ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষায় অনূদিত হয়৷ তার বহু গ্রন্থ ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁর দরুন প্রভাব বিস্তার করে৷ ইউরোপের পশ্চিম প্রান্তে স্পেনীয় মুসলিমদের সহায়তায় ঘুমন্ত ইউরোপ আস্তে আস্তে চোখ খুলতে থাকে৷ দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের প্রকৃত জাগরণ আসে৷ এই শতকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়৷ ত্রয়োদশ শতকে এটা আরো প্রবলতর হয়৷ J.J.Washk একে ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ বলেছেন৷ এখান থেকেই ইউরোপের আধিপত্য শুরু হয়৷ তারা প্রাচ্যের বিভিন্ন জ্ঞান বিজ্ঞান নিজেদের করায়ত্ত করে ফেলে৷ ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে নতুন সভ্যতার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়- কিন্তু মজার বিষয় হলো এই বুনিয়াদের ভিত্তি ছিল মুসলিম সভ্যতার উপর৷

ইবনে সিনা বিজ্ঞানের জগতে একটি নক্ষত্র৷ আরব সভ্যতায় খ্যাতিমান, মৌলিক ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী৷ বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের নাম আসলেই তার নাম স্মরণ করা হয়৷ পাশ্চাত্য দুনিয়া়ও তার মনীষা অবদানে প্রণত৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকে তার বই পাশ্চাত্যে চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অবশ্য পাঠ্য ছিল৷ ইবনে সিনার মনীষী দ্যুতি হারিয়ে যায়নি আজও৷
সংিক্ষপ্ত জীবনকাল
আবু আলী হোসাইন আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা উন 980 সালে আগস্ট মাসে বোখারার আফসানা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন৷ সেখানে ছয় বছর বয়সে মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং 10 বছর বয়সে পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেন৷ এর মধ্যে তিনি আরবী সাহিত্য অধ্যায়ন করে ফেলেন৷ ততপর বিভিন্ন শিক্ষকের নিকট থেকে ইসলামিক জ্ঞান ও ফিকাহ শিক্ষা গ্রহণ করেন৷ তিনি আব্দুল্লাহ নাতিলীর নিকট দর্শন জ্যামিতি ও জ্যোতিষ শাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং আপন প্রতিভাবলে তার শিক্ষককে ছাড়িয়ে যান৷ ঠিক এ সময় তিনি পদার্থবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যুৎপত্তি লাভ করেন৷ চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণা ও অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানে পরিপূর্ণতা সাধন করেন৷
কথিত আছে, যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে অস্তিত্ব ছিলনা তখন হিপোক্রিটাস তা সৃষ্টি করেন৷ যখন তা ধ্বংস হয়ে যায় তখন গ্যালন তার পুনরুজ্জীবিত করেন৷ যখন এটা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তখন আল রাজি এটা সুসংঘবদ্ধ করেন৷ আর তা ছিল৷ অসম্পূর্ণ ইবনে সিনা এসে কে পরিপূর্ণ রূপ দান করেন৷
18 বছর বয়স পর্যন্ত ইবনে সিনা রাতদিন অধ্যায়নে মগ্ন থাকতেন৷ নিদ্রা যাতে জ্ঞান অর্জনে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্য তিনি এক ধরনের পানীয় পান করতেন৷ তন্দ্রা ও নিদ্রা অবস্থায় তার মনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উদয় হতো, এবং কোন কোন জিজ্ঞাসা সমাধান স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত হতেন৷
ইবনে সিনা ইসমাইল প্রচারকদের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং তাদের কাছে গ্রীক দর্শন জ্যামিতি ও গণিত শাস্ত্রে প্রভুত পান্ডিত্য অর্জন করেন৷ চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে লিখিত সকল পাঠ শেষ করেন| এরিস্টোটল ইউক্লিড ও টলেমির গ্রন্থাবলী সাথে পরিচিত হন| কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্র কে তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন| মাত্র 17 বছর বয়সে তাঁর খ্যাতি এতই ছড়িয়ে পড়ে যে, মাননীয় সুলতান আরোগ্য লাভ করলে তিনি তাকে তার ইচ্ছা মাফিক কিছু দেবার ঘোষণা দেন। কিন্তু জ্ঞান পিপাসু ইবনে সিনা বাদশার নিকট লোভনীয় কোন কিছু না চেয়ে কেবল তার রাজকীয় লাইব্রেরীতে অধ্যায়নের সুযোগ চান। সুলতান ইবনে সিনার অভিপ্রায় মোতাবেক লাইব্রেরীর গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এতে তিনি এতই প্রীত হন যে, খাওয়া-দাওয়া নিদ্রা পর্যন্ত ত্যাগ করেন । এ সময় তিনি তার অপরিসীম বুদ্ধিমত্তা , অন্যান্য সাধারণ স্মৃতিশক্তিও বোধশক্তির মাধ্যমে প্রভুত জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু তার এই অবস্থা বেশি দিন যেতে না যেতে 20 বছর বয়সে তার পিতার মৃত্যু হয়। আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন সুলতান নুহ এর মৃত্যুতে। কারণ শাসনকর্তার মৃত্যুতে বুখারায় রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে তিনি বুখারা ত্যাগ করেন। এক হাজার এক সালে ইবনে সিনা খারিজম পৌছেন। সেখানে আলী বিন মামুনের দরবারে আল বিরুনী ,আল ইরাকি, আবুল খায়ের প্রমুখ পন্ডিত ও সুফিদের সাক্ষাত লাভ করেন। এখানে কিছু দিন অবস্থানের পর তিনি ইরাকের রওনা হন। কিন্তু সেখানে বেশি দিন অবস্থান করতে না পেরে 1009 সালে জুরজানে রওনা হন। এখানে এসে তিনি আরেক সংকটের কবলে পড়লেন। 1015 সালে জুরজান হতে রায় যাত্রাকালে দায়লাম-এ-বুয়াহ রাজত্বের অবসানে যে সকল ছোট ছোট রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল সেসব অঞ্চলে সংকটময় অবস্থার সম্মুখীন হন। এ সময় তিনি কখনো মন্ত্রী ,কখনো চিকিৎসক ,কখনো দার্শনিক ,কখনোবা উপদেষ্টার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। 1022 সালের শুরুতে তিনি বুয়াইদ আমীর আজাদউদ্দৌলার পৃষ্ঠপোষকতায় বাস করতেন। আমির ছিলেন একজন জ্ঞানানুরাগী ব্যক্তি। তিনি ইবনে সিনা কে যথেষ্ট সম্মান করতেন। আমিরের কাছে থাকাকালে ইবনে সিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি ক্রমাগত কৃশ ও দুর্বল হয়ে পড়লে ইস্পাহানি গমন করেন। এখানে তিনি কিছুকাল ভালো থাকলেও পুনরায় হামাদান যাত্রা করেন। এখানে এসে তিনি তীব্রভাবে রোগাক্রান্ত হন। ফলে এ মহান বিজ্ঞানী 4 রমজান 428 হিজরী মোতাবেক, 1037 সালে জুন মাসে ইন্তিকাল করেন। হামাদানে এখনো তার কবর বিদ্যমান আছে।


ইবনে সিনার রচনাবলীঃ
দুটি ফার্সিতে রচিত গ্রন্থ ব্যতীত আর সবগুলো গ্রন্থ আরবি তে রচিত৷ পদ্যেও তার কিছু রচনাবলি আছে৷ তিনি ১২৫ টি,কারো মতে ১৮০ টি গ্রন্থ রচনা করেন৷ ইবনে সিনার রচিত কয়েকটি গ্রন্থ নিম্নরুপঃ
1৷ কিতাব আশ শিফাঃদর্শনের উপর একটি বৃহৎ বিশ্বকোষ৷ ১৮ খন্ডে বিভক্ত এ রচনাটি তার অল্প বয়সের রচনা হলেও নিতান্ত বিশাল প্রকৃতির৷ মধ্যযুগে ইউরোপে এটি একটি প্রামান্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হত৷ মুসলিম বিশ্বে এখনো এটি মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত৷ 1302 হিজরীতে তেহরানের লিথো প্রেসে এর কয়েকটি খন্ড মুদ্রিত হয়৷ এর কোনো খন্ডের অনুবাদ ল্যাটিন ভাষাও আছে৷ এত সমগ্র দর্শন ছাড়াও ন্যায়শাস্ত্র ও অধিবিধানের উপর আলোচনা করেন।
2। আল কানুন ফিত তীব: চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর লিখিত তার বিশ্ব বিশ্রুত গ্রন্থ। চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশ্বকোষ ইউরোপে ক্যানন অফ মেডিসিন নামে পরিচিত। ইবনে সিনার আরবি পদ্ধতির শীর্ষস্থানীয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কানুন চিকিৎসা বিজ্ঞান ও শল্যবিদ্যা সম্পর্কিত এই এক পরিপূর্ণ বিশ্বকোষ। এ গ্রন্থে রোগ, ঔষধ ও অসংখ্য রোগের চিকিৎসার সমাধান দেওয়া আছে। এ গ্রন্থে রোগ নিবারণ ও ওষধ প্রস্তুত প্রণালী সম্বন্ধেও বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ভেষজ দ্রব্যগুণ বিষয়ে ঔষধ সমূহের যথার্থ তত্ত্ব ভেষজ বিদ্যার অনুসরণীয় পদ্ধতি সমূহের একটি নকশাও তিনি এতে অঙ্কন করেছেন। ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে আল কানুন এর প্রভাব কে অতিরঞ্জিত করা যায় না। স্যার টমাস ক্লিফোর্ড আল বুট Encyclopaedia Britannica তে বলেন ইবনে সিনার কানুন হিপোক্রিটাস ও মধ্যযুগীয় দিকপাল গ্যালন এর কৃতিত্ব কে ম্লান করে দিয়েছিল। অধ্যাপক হিট্টি বলেন দ্বাদশ শতক হতে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোতে এ গ্রন্থটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রধান পথ প্রদর্শক ছিল। মুসলিম বিশ্বে এখন পর্যন্ত এটি প্রধান বিশেষ করে ইউনানী পদ্ধতির এটি প্রধান প্রামাণ্য গ্রন্থ ।Dr. William Osler " The Evolution Of Modern Medicine" নামক গ্রন্থে ইবনে সিনার আল কানুন গ্রন্থ সম্পর্কে মন্তব্য করেন এটি যে কোন গ্রন্থের তুলনায় দীর্ঘসময় মেডিকেল বাইবেল রূপে রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে ইবনে সিনা এতো বেশি সম্মানিত যে চিকিৎসা অনুষদের বিরাট হল ঘরে তার প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে।
মুদ্রণ পদ্ধতির আবিষ্কার 30 বছর পর চোদ্দোশো ছিয়াত্তর সালে এটি রোম থেকে মুদ্রিত হয় । আল কানুন এর সর্বপ্রথম ল্যাটিন অনুবাদ Cremonese এর Gherardo করেন, ভেনিস 1544 সালে কয়েক খণ্ড মুদ্রিত হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে আল-কানুন 20 বারের বেশি বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়। সম্ভবত আজ পর্যন্ত চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর রচিত এত জনপ্রিয় ও বহুল পাঠ্য গ্রন্থ রচিত হয়নি।
3৷ আল আদাবিয়াতুল কলবিয়াঃ চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর লিখিত ইবনে সিনার ২য় গ্রন্থের নাম৷ Bilge যা তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং আরবী মূল ইবারতসহ ইবনে সিনার নবম শতবার্ষিকীতে স্মৃতি পুস্তুক হিসেবে প্রকাশিত হয়৷
4৷ রেসালায়ে ফিল হীকমাহ ওয়াত তাবয়ীয়াহঃ পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত তিনি এ গ্রন্থে পদার্থবিদ্যা, নভমন্ডলীয়, পদার্থসমুহ, মানবীয় বৃত্তি সম্বন্ধে, চিন্তামূল্ক ও সীমা নির্দেশক বিষয়ে আলোচনা করেছেন৷ এছাড়া শাস্ত্র, চুক্তি, বর্ণমালা পৃথক পৃথক প্রবন্ধ রয়েছে৷
5৷ উয়ুন আল হিকমাতঃ দশ খন্ডে বিভক্ত দর্শনের উপর লিখিত গ্রন্থ৷ এছাড়া সিদিদীয়া, দানেশনামা, কিতাবু লিসানুল আরাবি ফিল লুগাত, কিতাবুল হাইয়ান ওয়ান নাবাত,আন নাযাত, আল আনমাতুছ ছালছাল আখিরা, রিসালাতুজ জাওয়ারা ইত্যাদি তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সম্ভারের মধ্যে অন্যতম৷ এসব গ্রন্থ রচনা ছাড়া বিজ্ঞান ও দর্শনের উপর অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেন৷ তবে তার শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে আশ-শিফা এবং কানুন ফিত তিব৷ এ দুটি গ্রন্থের জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন।


ইবনে সিনার দর্শন:
মুসলিম জাহানের একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হিসেবে ইবনে সিনা ছিলেন প্রাচ্যে শেষ এবং অ্যারিস্টটলিও দার্শনিক। তার প্রচেষ্টায় অ্যারিস্টটলিও দর্শন চর্চা সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়েছিল। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ফারাবীও শিষ্য। তিনি প্রথম দর্শন বহু চেষ্টার পরেও বুঝতে পারছিলেন না। পরে ফারাবী রচনাবলী পাঠ এর ফলে তিনি অ্যারিস্টোটলের গভীর চিন্তা ধারায় প্রবেশ করেন। ফারাবীর রচনাবলী তাঁকে দার্শনিক মানস গঠনে সহায়তা করে এবং তিনি অ্যারিস্টোটলের গ্রন্থের ব্যাখ্যা প্রদানে অনুপ্রাণিত হন। তিনি তার সঞ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে অ্যারিস্টোটল এবং প্লেটোর দর্শনের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আপন চিন্তাধারাকে সমৃদ্ধ করেন। বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থাবলী এবং মতবাদ সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে নিজস্ব দার্শনিক চিন্তাধারা কে নতুনরূপে সাজান। তার ধারণা যে দর্শন ধর্ম হবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। দর্শনের কাজ যুক্তির সাথে ঈমানের সমন্বয় সাধন নয়; বরং যুক্তির সাথে জীবনের সমস্যাগুলি ব্যাক করাই এর কাজ। ইবনে সিনার মতে দর্শন চর্চায় পরিপূর্ণ ও বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ সম্পর্কে ইবনে সিনা মতবাদ হচ্ছে; আল্লাহ্ অপরিহার্য এক সত্তা। তিনি কাল‚ সীমা ও গতির ঊর্ধ্বে। তার মতে দু'ধরনের সত্তা আছে সম্ভাব্য ও অপরিহার্য। সম্ভাব্য সত্তা অপর কোন সত্তা হতে বিকাশ লাভ করে কিন্তু অপরিহার্য্য সত্তা সম্পূর্ণ স্বাধীন। এটি কোন কিছুর সাথে সম্পর্কিত নয় । একাধিক বা একটি কারণ হতে সম্ভাব্য সত্তা জন্মগ্রহণ করে; পক্ষান্তরে অপরিহার্য সত্তা কোন কারণজাত নয়। সম্ভাব্য সত্তা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু অপরিহার্য সত্তা চিরন্তন । আর এই অপরিহার্য সত্তাই মহান আল্লাহ। অপরিহার্য সংজ্ঞা মাত্র একটি। সত্তার গুনাবলি তার অস্তিত্বর সাথে অভিন্ন। ইবনে সিনা তার দার্শনিক মতবাদ এ আত্মার উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তার শ্রেষ্ঠ দার্শনিক গ্রন্থ The Healing মনস্তত্ত্ব কে কেন্দ্র করে তাঁর আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদের উদ্ভব। অবিনশ্বর সত্তা এবং এটি আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে এসেছে‚ দেহের কোন অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। তার মতে সকল সত্তার মৌলিক কারণ আল্লাহ। সমস্ত জড়জগৎ তার ওপর নির্ভরশীল। কেননা‚ তিনি ব্যতীত কোনো অস্তিত্বই রূপ লাভ করত না। মানব সৃষ্টি তত্ত্ব সম্পর্কে প্লেটোর মতবাদ অধিকাংশ আরবি দার্শনিক মেনে নিলেও ইবনে সিনা তা গ্রহণ করেননি। তার অভিমত হলো আত্মাগুলো অনন্তকাল পূর্ব হতেই তৈরি হয়ে আছে। মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সম্বন্ধে ইসলামের প্রত্যাবর্তন সূত্রই বিশ্বাস করেন। অ্যারিস্টোটলের অনুসারী হলেও ইবনেসিনা আল্লাহ ও বিশ্ব সম্পর্কীয় প্রশ্ন গ্রিক দর্শনের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে। অ্যারিস্টোটলের মতবাদ হল জগৎ চিরন্তন। আল্লাহ বিশ্ব জগতের সৃষ্টিকর্তা নন বরং গতিধারার নিয়ন্ত্রক। পক্ষান্তরে ইবনে সিনা বলেছেন এই বিশ্ব অনন্ত এবং তার আদি কারণ আল্লাহর সৃষ্টি। এই সূত্রই কার্যকরণের যুগপৎ ঘটমান প্রকৃতিকে কে প্রতিষ্ঠা করে।


ইবনে সিনা ও পদার্থবিদ্যা:
ইবনে সিনা নিকট পদার্থবিদ্যা একটি চিন্তামূলক শিল্প। যার বিভিন্ন বিষয়বস্তু আছে। 1 বাস্তবে স্থিত বস্তুসমূহ এবং 2 ধারণাগত বস্তুসমূহ। পদার্থবিদ্যা তিনি গতি ‚মিলন‚ শক্তি‚ অসিমতা‚ আলোক ও উত্তর সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেন। তিনি বলেন আলোক অনুভূতির কারণ যদি আলোক কেন্দ্র হতে বিচ্ছুরণ আলোক কণা হেতু হয় আলোকের গতি সসীম থাকবে। নিয়ে নির্দিষ্ট ওজনের আলোচনাও করেছেন। "তিসআ রিসালা ফি হিকমাতি ওয়াত তারবিয়াহ" নামক গ্রন্থে পদার্থবিদ্যা বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার পৃথক পৃথক আলোচনা করেছেন। ইবনে সিনার মতে ধাতুসমূহের পরস্পর রূপান্তর করন সম্ভব নয় কেননা এরা বিভিন্ন। মনে হয় তিনি যেন ধাতুর রাসায়নিক প্রক্রিয়া বিশ্বাসী ছিলেন না। তার প্রবন্ধ মা দুনিয়াত (খনিজ পদার্থ সমূহ )13 শতাব্দি পর্যন্ত ইউরোপে ভূতত্ত্ব বিষয়ে ধ্যান-ধারণার একমাত্র উৎস ছিল।


জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও ইবনে সিনা
পর্যবেক্ষণ বিশুদ্ধ করতে হলে বিশুদ্ধভাবে গণনা করার যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। জ্যোতির্বিজ্ঞান আলোচনা করতে গিয়ে বিশুদ্ধ গণনা করার উপযোগী যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করার চিন্তাই প্রথমে ইবনে-সিনা কে পেয়ে বসে। এ বিদ্যার প্রতি তার এত অনুরাগ ছিল যে‚ শেষ বয়সে তিনি গতিশীল পরিমাপ যন্ত্রের মত (Vernier) সূক্ষ্ম গণনা করার উপযোগী একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এর মাধ্যমে যেন যান্ত্রিক সংযোজন নিখুঁত ভাবে হয়ে থাকে। এ শাস্ত্রে ইবনে সিনার প্রভূত জ্ঞান ছিল। তিনি কয়েকটি জ্যোতিষ্ক বীক্ষনাগার স্থাপন ছাড়াও হামাদানের কয়েকটি মান মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।


মনোবিজ্ঞানী ইবনে সিনা:
মনোবিজ্ঞানীর আলোচনা ইবনে সিনা ক্রমানুসারে উদ্ভিদ মন (নফসে নাবাতি) হতে শুরু করেও জীবন মন (নফসে হাইওয়ানি)
জীবন মন থেকে শুরু করে মানব মন (নফসে ইনসান) এর দিকে
অগ্রসর হয়েছেন। মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে তার লিখিত গ্রন্থের নাম কিতাব আন নফস।
1. উদ্ভিদ মনে বিভিন্ন শক্তি কাজ করছে । যথা খাদ্য গ্রহণের শক্তি ও প্রজনন শক্তি।
2. জীব মন দুটি শক্তি। অনুভব এবং গতিশক্তি নিয়ে তা গঠিত। গতিশক্তি আবার দু'ভাগে বিভক্ত। উদ্দীপক শক্তি যার কাজ শক্তি উৎপাদন করা কর্মশক্তি স্নায়ুমণ্ডলী এবং গোশত পেশির উপর ক্রিয়াশীল ।
3. মানবীয় মন নিজ প্রাথমিক অনুভূতি গুলোকে বুদ্ধি ও বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছাবার জন্য গুণ অর্জন করে । তাহা বাহ্যিক হতে পারে এবং অভ্যন্তরীণও হতে পারে। বাহ্যিক গুণাবলী প্রথমটি হলো মন:সৃষ্টি তা ঐ সমস্ত দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করা যায় । এ গুণাবলীগুলো হলো কল্পনা শক্তি ‚রূপায়ণ শক্তি ‚ধারণা শক্তি ও স্মরণশক্তি। ইবনে সিনার মতে এগুলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সাথে সম্পর্কিত।


ইবনে সিনার শরীয়ত ও সুফিতত্ত্ব:
ইবনে সিনা তার 'ইশারাত' গ্রন্থের শেষ পরিচ্ছেদে 'মাকামাতুল আরেফিন' তথা তত্ত্বজ্ঞানী আলোচনা প্রসঙ্গে তাসাউফ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তার মতে তত্ত্বজ্ঞানী তিনিই যিনি মানতেক ও ইলম হতে সরে এসে হাকীকতের নৈকট্য ও মিলন লাভ করে আল্লাহর রাজ্যে উপনীত হন। আরিফগণের কয়েকটি ঘাঁটি পার হতে হয় এবং তার বিভিন্ন স্তরও রয়েছে। সমস্ত পর্যায় গুলোর মধ্যে রয়েছে- অনাসক্ত জীবন‚ সংযমশীলতা‚কৃচ্ছতা সাধন‚ উনিক স্বীকৃতিকে ক্রমে মিলনজনিত বিস্মৃতির অবস্থায় পরিণত করা। প্রখ্যাত সুফী তত্ত্ববিদ আবু সাঈদ আবুল খায়ের এর নিকট লিখিত ইবনে সিনার পত্রাবলী তাসাউফের প্রতি তাঁর অনুরাগে সাক্ষ্য দেয়। এ বিষয়ে তার লিখিত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে রয়েছে- ইশক‚ রিসালা ফী মাহিয়াতিস সলাত এবং কিতাব ফী মানাজ জিয়ারা। তন্মধ্যে চারটি পুস্তক লাইডেন হতে 1894 সালে Mehren কৃত ফার্সি ভাষায় অনুবাদ ও মূল 1899 সালে প্রকাশিত হয়। ইবনে সিনার ঐশীতত্ত ফারাবী ও রাসাইলু ইখওয়ানিস সাফার সমন্বয়ে গঠিত। দার্শনিক স্বীকার করেন যে আঁকলের সাথে সাথে ঈমান থাকা আবশ্যক। ইবনে সিনার মতে‚ ঈমান আকলের পরিপূর্ণ রূপ: সুতরাং ঈমান আকলের পূর্ণতা দান কর। তার মতে‚ শরীয়ত হিকমতের বিপরীত নয়। তার অস্তিত্ব পরস্পরের জন্য আবশ্যক। ইবনে সিনা আরো বলেন‚ রসূলগণের মর্যাদা দার্শনিকদের ঊর্ধ্বে এবং ওহীর স্থান হল এক মহান এবং উন্নত অনুভূতির। ওহী‚ ইলহাম এবং স্বপ্ন আল্লাহর প্রজ্ঞার অংশবিশেষ। তার মতে শরীয়তের কাজ হল- "মানব জাতির সংশোধন।" প্রশাসনিক ও আধ্যাত্মিক উপায় শরীয়তের কাজ সংঘটিত হয়। এদের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্য নবীগণ যেভাবে এখতিয়ার প্রাপ্ত তা সাধারণ মানুষের জন্য নয়৷ শরিয়ত এবং প্রজ্ঞার ব্যাপারে ইবনে সিনা শরিয়তের নিকটতর৷
এজন্য তার সমস্ত দর্শন ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ধর্মতত্ত্বের সাথে মিশেছে৷

ইবনে সিনার ধর্ম বিশ্বাসঃ
ইবনে সিনার পরিবার ছিল শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী৷ তিনি সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শিয়া আকিদা ও বিশ্বাস গ্রহন করেননি বলে নিজেই উল্লেখ করেছেন৷ ত্নি কোনো মাজহাবের অনুসারী ছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে তার বই 'রেসালায় জুদিয়া' (ফার্সি ভাষায় রচিত) এর ৭২ পৃষ্ঠাব্যাপি উর্দু ভূমিকা রচনা করতে গিয়ে হাকীম সৈয়দ জিল্লুর রহমান (রিসার্চ অফিসার, মুসলিম ইউনিভার্সিটি, আলীগড়) লিখেছেন- মহিউদ্দিন ইবনে আবিল ওয়াফা আল জওয়াহেরুল মুজিয়া ফি তবকাতিল হানাফিয়া- নামক গ্রন্থে ইবনে সিনাকে হানাফী উল্লেখ করে শুধু এতটুকু লিখেছে যে, তিনি হামাদানে ইন্তেকাল করছেন৷ (পৃষ্ঠা ২৩)

ইবনে আবিল ওয়াফা (হি. ৬৯৬-৭৭৫) ইবনে সিনাকে হানাফঈ মাজহাবের অনুসারী বলে তার ধর্মীয় আকীদা বিশ্বাসের আরো একটি দিক তুলে ধরেছেন৷ হানাফী ওলামাদের উপর রচিত এই গ্রন্থটির নাম হতেই প্রমানিত হয় যে, ইবনে সিনাকে এর অন্তর্ভুক্ত করে তাকে হানাফী মাজহাবের অনুসারীরুপে চিত্রিত করা হয়েছে৷ ইবনে সিনার রচনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তার সমগ্র রচনার মধ্যে শুধু ৬৮ টি রচনা ধর্ম সংক্রান্ত৷ হামদর্দ তিব্বীয়া কলেজ করাচির সাবেক অধ্যাপক খাজা বরজওয়ান আহমদ ইবনে সিনার 'মাজহাব ও আকীদা' সম্পর্কে লিখেছেন' "তার রচনাবলি থেকে জানা যায় যে, তিনি শিয়া সুন্নির বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন এবং যখনই তার প্রয়োজন হতো, সমস্যাগুলোর সমাধানে মস্তিষ্ক অস্থির হয়ে যেতো তখন তিনি বুখারার জামে মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করতেন, আবার চলে আসতেন৷ তিনি সেখানে শুয়ে পড়তেন অথবা ধ্যান মগ্ন হতেন৷" হাকীম রেজওয়ান এতদসংক্রান্ত ইবনে সিনার একটি পত্রের উল্লেখ করেন, যা তিনি আবুল খায়ের সূফি কে লিখেছিলেন৷ এতে তার আকীদা-বীশ্বাসের সম্যক পরিচিতি পাওয়া যায়৷ চিঠির একটি উদ্ধৃতি এরুপঃ বন্ধু আবু সাইদ! তোমার জাহের-বাতেন,আওয়াল-আখের একমাত্র আল্লাহর জন্যে হওয়া উচিৎ৷...... আল্লাহ পাক পবিত্র এবং বে-আইব, দোষমুক্ত, তিনি গোপনে এবং প্রকাশ্যেও আছেন৷ তিনি প্রত্যেক বস্তুতে জ্ঞানগতভাবে বিরাজমান এবং তার নূর প্রত্যেক বস্তুতে বিরাজমান আছে৷ যা এটা প্রমাণ করে যে, তিনি সর্বদা একক৷ তোমার জানা আবশ্যক যে, সকল কাজের মধ্যে সালাত সর্বোত্তম, আর রোজা হচ্ছে সবচেয়ে আরামদায়ক৷ অনুরূপভাবে সাদকা সকল পূণ্যের অধিকতর উপকারী পূণ্য৷ রিয়া সকল কাজ বিনষ্টকারী এবং জ্ঞান শ্রেষ্ঠত্বের মূল আর মারেফত সকল কিছুর উর্ধ্বে৷

ইবনে সিনা একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন৷ দার্শনিক মতবাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, তার ঈমান নিয়ে বিভিন্ন সময় সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে৷ কিন্তু তার গুরুত্বপূর্ণ রচনাসমূহের মাঝেও ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়৷ ধর্মহীনতার অভিযোগ তার সময়ও উত্থাপিত হয়েছিল৷ এ ব্যাপারে ইবনে সিনা দূঃখ পেয়েছিলেন৷ লিখেছিলেন চতুষ্পদি কবিতা -
আমাকে কাফের বলা কখনো সহজ নয় অতো৷
ধর্মের অবস্থা দৃঢ়তর, আমার আস্থার এই মতো৷
ব্যক্তি বিশ্বে আমি অপরুপ, আমি যদি ধর্মহীন,
তাহলে কোথাও নেই একটিও মুসলিম মু'মিন৷
ইবনে সিনা ইসলামের সাধারণ ইবাদত নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন৷ কোনো বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক সমস্যার সমাধান করতে না পারলে তিনি প্রার্থনার জন্য মসজিদে ছুটে যেতেন৷ তিনি একজন উচু স্তরের আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন৷
তার ধর্ম চিন্তার মধ্যে সবসময় ঐক্য প্রচেষ্টা লক্ষণীয়৷ শরিয়ত এবং প্রতিভার ব্যাপারে ইবনে সিনা সবসময়ই শরিয়তের নিকটতর৷

তাওহীদ সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল সবসময় যৌক্তিক ও সাযুজ্যপূর্ন৷ ইবনে সিনার বক্তব্য হলো, এক হতে অনেক হতে পারে কিন্তু অনেক থেকে এক হতে পারে না৷ কারণ অনেকের মধ্যে কেউ আগে, কেউ পরে আসবে৷ একপর্যায়ে যদি দুটি সত্তারও আবির্ভাব হয় তার মধ্যেও একটি আগে ও অন্যটি পরে হবে৷ আর দটি যদি সমশক্তিসম্পন্ন হয় তাহলে দুটির সংঘাতে একটি কার্যকর এবং অন্যটি অকার্যকর হয়ে পড়বে৷ এক্ষেত্রে এক সত্তাই সকলের উপর প্রভাব বিস্তার করবে৷ তাই একত্ববাদের ধারনাই সঠিক৷

ইবনে সিনার সামগ্রিক পরিচয় বিস্তৃত আলোচনার দাবী রাখে৷ বহুমুখী বিষয়ে তার অসামান্য মনীষার দ্যুতি ছড়িয়েছিল৷ তিনি একটি মহাজীবনের অধিকারী ছিলেন৷ জগৎ ইতিহাসের এই অসামান্য জ্ঞান সাধক ও বিজ্ঞানের যুবরাজ জ্ঞান অন্বেষণকারীদের জন্য ৬ টি মূল্যবান উপদেশ রেখে গেছেন৷ যথাঃ
১৷ এমন কিছু অন্বেষণ করো না, যা দ্বারা তুমি লজ্জিত ও অপমানিত হবে৷
২৷ এমন কিছু বিশ্বাস করো না- যার দ্বারা তুমি মুর্খদের অন্তর্ভুক্ত হবে৷
৩৷ হয় তুমি বিচক্ষণ বা মেধাবী হও, নতুবা শক্তিশালী হও৷ এর একটির অন্যথা হয়ো না৷
৪৷ এমন কিছুর বিশ্বাসী হয়ো না- যার ফলে তুমি সাধারন মানুষের দিকে ধাবিত হয়৷
৫৷ নাস্তিক্য দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ো না৷
৬৷ এমন কিছু অন্বেষণ করো- যা তোমাকে দেওয়া হবে৷


ইউরোপীয় রেনেসাঁয় ইবনে সিনার প্রভাবঃ
ইউরোপে রেনেসাঁয় যুগে যুগে ইবনে সিনার বহু গ্রন্থ প্রথমে ল্যাটিন এবং পরে অন্য অন্য ভাষায় অনূদিত হয়৷ ৭১২-১০০৫ সন পর্যন্ত টলেডো মুসলিমদের অধীনে থাকায় এখানে প্রচুর আরবি গ্রন্থ জমা হয়েছিল, তেমনি এখানকার খ্রিস্টান, ইহুদিরাও আরবি ভাষায় বেশ লব্ধ হয়ে উঠেছিল৷ এ সুযোগে স্পেনে প্রধান ধর্মাধক্ষ্য রেমন্ড (১১৩০ সাল) আরবি গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করার জন্য একটি অনুবাদ কেন্দ্র স্থাপন করেন৷ ইবনে সিনার 'কানুন' ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষায় অনূদিত হয়৷ তার বহু গ্রন্থ ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁর দরুন প্রভাব বিস্তার করে৷ ইউরোপের পশ্চিম প্রান্তে স্পেনীয় মুসলিমদের সহায়তায় ঘুমন্ত ইউরোপ আস্তে আস্তে চোখ খুলতে থাকে৷ দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের প্রকৃত জাগরণ আসে৷ এই শতকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়৷ ত্রয়োদশ শতকে এটা আরো প্রবলতর হয়৷ J.J.Washk একে ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ বলেছেন৷ এখান থেকেই ইউরোপের আধিপত্য শুরু হয়৷ তারা প্রাচ্যের বিভিন্ন জ্ঞান বিজ্ঞান নিজেদের করায়ত্ত করে ফেলে৷ ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে নতুন সভ্যতার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়- কিন্তু মজার বিষয় হলো এই বুনিয়াদের ভিত্তি ছিল মুসলিম সভ্যতার উপর৷

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:০৪

তারেক ফাহিম বলেছেন: পোষ্টটি সরাসরি প্রিয়তে স্থান পেল।


অনেক গভির আলোচনা তাঁর সম্পর্কে।

পোষ্টে লাইক ও ++

২| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৫:২৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: ইবনে সিনা পিডিয়া!!!!!!!!!!

বিস্তারিত তথ্য সমৃদ্ধ পোষ্টে ভাললাগা
শো-কেসে রেখে দিলাম :)

++++++

৩| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৭:৫৮

রাজীব নুর বলেছেন: অল্প কথায় এত সব কথা বলা যেত।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.