নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক.
মধ্যেরাতে গায়ে আধ ডজন ইঁদুরের বিচরণের ফলে ঘুম ভাঙলো৷ দেখতে পেলাম চারদিকে আবর্জনার ঝুপড়ি৷ সেই সূর্যাস্তের পর এসেছিলাম শহরে একটা কাজ নিয়ে৷ বাড়ি ফিরে যেতে পারলাম আর কই! সর্বশেষ মনে পড়ে সরাইখানায় ঢুকে মদ গিলতে শুরু করেছিলাম৷ কখন যে এখানে এসে পড়ে আছি কে জানে? অবশ্য আমায় যে মানুষজন ধরে এনে এখানে ফেলে রেখে যায়নি; এরই বা নিশ্চয়তা কী?! ইদানীং মানুষের যা আচার-আচরণ তা আর বলতে হয় না৷ ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধও নেই অন্যের প্রতি৷
রাত বেশ গভীর হয়ে গেছে৷ চাঁদ মামাও বিদেয় হতে চাচ্ছে দুনিয়া থেকে৷ এত রাতে ভালো মানুষের বালাই নেই। আশেপাশে যা দু-চারজন দেখা যাচ্ছে, তারাও আমার মতো মদ্যপ হয়েও পড়ে আছে। আর আছে কিছু শহরের নাম করা রক্ষীবাহিনী। অবশ্য এদেরও ভালো মানুষ বলার সুযোগ নেই৷ রাতের আঁধারের এমন কোনো অকাজ নেই যে তারা করে না৷ লুটপাট থেকে শুরু করে ধর্ষণ, খুন সবই করতে পারে। তাই এদের আর প্রশংসা করছি না৷ ভদ্র ঘরের ছেলেপেলেরাও এদের উপর বীতশ্রদ্ধ। নিরাপত্তার কথা বলতে গেলে ওদের থেকে আমাদের মতো মদ্যপ লোকজন কয়েকশো গুণে ভালো মানুষ। এরা অন্তত উদরপূর্তি হলে অন্যকে বিরক্ত করে না৷ আশেপাশের আবর্জনার স্তুপেই মাথা গুঁজে নেয়৷
যাক, বাবা! সূর্যোদয়ের পূর্বে চেতন ফিরে এসেছে৷ নইলে লোকালয় পারি দিয়ে বাড়ি পৌঁছানো মুশকিলের কাজ৷ আমি দেখতে যে দানবের মতো ঠিক তা না৷ ভয় হয় এলাকার কিশোরী-যুবতীরা মুখখানা দেখে ঘরবাড়ি ছেড়ে আবার আমার কাছে চলে না আসে৷ ওদের থাকতে দেবার মতো জায়গা আমার নেই। নেই কোনো সরাইখানা৷ শুধু শুধু দিনদুপুরে বিপদ ডেকে আনতে চাই না৷ তাই রাত করেই চলাচল করি। দিনে অবশ্য তেমন বিশেষ কাজও পড়ে না৷
আমায় ফিরে যেতে চিরচেনা জঙ্গলের উপর দিয়ে প্রাণপ্রিয় আস্তানায়। ওখানে একখানা ঘরই আছে আমার৷ এরপর ক্রোশ দুই-তিনেক সম্মুখে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে৷ অতটাও ছোট না যে দৃষ্টিসীমার মধ্যে এঁটে যাবে৷ কিন্তু আমি যেসব শহরবন্দর, গ্রামগঞ্জ পেরিয়েছি ওসবের তুলনায় বেশ ছোট৷ বলে রাখা ভালো আমি কিন্তু জঙ্গলে বাস করি না৷ জঙ্গলের ঠিক সামনেই আমার ঘরটা৷ মানুষের যাতায়াত করার জন্য অবশ্য জঙ্গলের পাশ দিয়ে বেশ চওড়া সড়ক আছে৷ তবে আমি ওসব ব্যবহার করি না৷ কে জানে রাতের বেলায় কোন দস্যুদলের হাতে প্রাণটা খুইয়ে দিতে হয় ওখান দিয়ে গেলে৷ আমার জন্য জঙ্গলই ভালো৷ কথায় আছে, “আপনের চেয়ে পর ভালো; পরের জঙ্গল ভালো৷” সম্ভবত আমার মতো কোনো এক মদ্যপ এই কথাটার আবিষ্কারক। আমারও আপন বলতে কেউই নেই। পরের ক্ষেত্রে একজন বন্ধু আছে৷ আর এই জঙ্গল৷ আমার এখন বাড়ি ফিরে বন্ধুটার খোঁজ নেয়া দরকার। ওর একখানা বদভ্যাস আছে। এজন্য ভয়ই হয় কখন কি করে বসে৷ ওসব পরে বলব৷
পথ চলতে চলতে তো নিজের নামটাই বলতে ভুলে গেলাম৷ যাহোক, আমি হলাম এই অঞ্চলের বিখ্যাত মদ্যপ শাটার থিবাস৷ পিতামহ সম্ভবত ভবিষ্যৎ দেখেই নামটা দিয়েছিলেন৷ জীবনের পয়তাল্লিশটা গ্রীষ্ম পেরিয়ে গেছে৷ এর মধ্যে এমন কোনো জায়গায় নেই যেখানে আমাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়৷ প্রায় সব জায়গায় উপরি দরজার (ঝাপ/শাটার) মতো ঝোলানো হয়েছে৷ কোথাও পা উপরে দিয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়েছে৷ আবার কোথাও মাথা উপরে দিক দিয়ে ঝুলিয়েছে৷ এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ক্রুশেই ঝুলানো বাকি আছে৷ মানুষের দিনদিন যে হারে বদ হচ্ছে তাতে মনে হয় খুব দ্রুতই ক্রুশে ঝুলিয়ে দেবে৷ ইতিপূর্বে যেসব জায়গায় ধরা খেয়েছি সেগুলো অবশ্য আমার দুঃসাহসিকতাই ছিল৷ ঘরের জিনিসপত্র চুরির করতে গিয়ে যখন গায়ের অলঙ্কারে হাত দিতে গিয়েছি, তখনই ধরা খেয়ে ঝুলে গেছি স্বেচ্ছায়। ওসব অভিজ্ঞতা খারাপ ছিল না যদিও।
দুই.
দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে অবশেষে নিজ ডেরায় পৌঁছলাম। কিন্তু এখানে এসে এভাবে বিস্মিত হয়ে যাব তা ভাবিনি৷ পনের-বিশটা কুকুকের একটা জটলা আমার সামান্য ঘরটার সামনে ভিড় করে আছে। আর আমার সাথে একটা মানুষের বাচ্চা৷ না না, একটু ভুল হয়ে গেছে৷ আমার সাথেই একটা কুকুর৷ আর ঘরের সামনে কিছু মানুষের জটলা বেধে আছে৷ এই দুনিয়ায় মানুষের চেয়ে কুকুরই আপন। আমার কুকুরটাও সর্বেসর্বা জার্মান শেপার্ড। ওজনও ত্রিশের মতো হবে৷ বলতে গেলে রাতেরবেলায় ছোটখাটো বাঘের বাচ্চা নিয়ে ঘোরার মতো৷
নিশ্চিত কোহেনান আজকে নিজ গ্রামেই অকাজ করেছে৷ কোহেনান আমার বন্ধুর নাম। ইতিপূর্বে যার কথা স্মরণ করে বলেছিলাম যে, ওর একখানা বদভ্যাস আছে৷ এটা অবশ্য কাল হিসেবে আহামরি কিছু না৷ এসব হরহামেশাই হয়ে থাকে৷ তবে একটু অন্যভাবে৷ বদভ্যাসটা হলো, ও কিশোরী মেয়েদের ধরে ধরে এনে খায়৷ ইয়ে না মানে, যৌনতায় ওর কোনো আকর্ষণ নেই৷ ও আসলে রক্ত পান করে৷ এভাবে দু'শো বছর যাবৎ বেঁচে। আজ বোধহয় নিজ গ্রামে থেকেই কাউকে তুলে আনতে গিয়ে ধরা পড়েছে৷ আসলে আমার কোনো গ্রাম নেই৷ সামনে যেটা আছে ওটাকেই নিজের বলে পরিচয় দেই৷
আমি চুপিচুপি নিঃশব্দে ঘরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজের নিরাপত্তার জন্য ঘরটা ছিদ্রহীন রেখেছি৷ তাই নিজেও কায়দা করে ভেতরের অবস্থা দেখতে পারলাম না। এদিকে লোকজন সবাই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আছে৷ বর্শা, তরবারি, তীর-ধনুক, হাতুড়ি ইত্যাদি বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে ওকে পেলে এখনই চিড়ে খেয়ে ফেলবে৷ ওরা বেশ লম্ফঝম্প দিয়ে ডাকাডাকি করেও যখন কোনো সাড়া পেল না, তখন আমি নিজেকে ওদের সামনে মেলে ধরে বললাম, “কি হে মানবজাতি! তোমাদের কি ন্যূনতম ভদ্রতা নেই? রাতে মানুষের ঘুম নষ্ট করতে চলে এসেছ?”
ওদের মধ্য থেকে একজন রাগে ফুসলাতে ফুসলাতে বলল, “ঘুম আমাদের নষ্ট হয়েছে৷ আমরা কারও ঘুম নষ্ট করতে আসিনি।”
“কী হয়েছে তোমাদের? কী চাও এখানে?”
“আমাদের একটা কুকুর এই ঘরে ঢুকে পড়েছে। অনেকক্ষণ যাবৎ ডাকাডাকি করার পরও কেউ খুলছে না। আমরা আমাদের কুকুর ফেরত চাই”
“দেখছ না ঘরটা ভেতর থেকে আটকানো? কুকুর ঢুকলো কীভাবে? ”
“ঢোকার সময় দরজা খোলা ছিল৷ ঢোকার সাথে সাথে কেউ দরজা আটকিয়ে দিয়েছে।”
ওদের কথা শুনে আমি নিশ্চিত যে এই কাজ কোহেনান ছাড়া কেউ করেনি। তবে চিন্তার বিষয় হলো, বেচারার রুচি এত নীচে কীভাবে নামল! মানুষের রক্ত রেখে একেবারে কুকুর! ব্যাপারটা সাংঘাতিক। এখন তো আমার ট্যানির জন্যও চিন্তা হচ্ছে৷ ট্যানি আমার কুকুরের নাম৷ প্রায় পাঁচ বছর যাবৎ আপন ভাইয়ের মতো মানুষ করছি৷ আমার সুখ দুঃখের একমাত্র সাথি ও সাক্ষী। আমি কপালের ভাঁজ ঢেকে বলতে লাগলাম, “দেখ ভাই, তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে৷ এটা আমার ঘর। আমার বন্ধু ছাড়া কেউ এখানে থাকে না৷ আর ওর কুকুরেও তেমন আগ্রহ নেই যে তোমাদেরটা চুরি করে নিয়ে আসবে৷ দেখ আমার কুকুরটা তোমাদের থেকে উন্নত ও চমৎকার। তাহলে কি প্রয়োজন আছে ওর অন্যের কুকুরের দিকে নজর দেওয়ার?”
আমার প্রশ্ন শুনে ওরা জবাব দিতে যাবে এমন সময় নেকরের একটা হুঙ্কার দিয়ে কোহেনান একটা কুকুরের খণ্ডিত মস্তক মাথায় আর পুরো রক্তাক্ত চামড়াটা গলায় জড়িয়ে দরজা খুলে বের হলো৷ আমি ভাবলাম এটাই সুযোগ এই জটলা দূর করার৷ আমি ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ভূত ভূত বলে চিৎকার করে দৌঁড় দিলাম। কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে দেখতে পেলাম লোকগুলো কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ অতি ভয়ে সবাই থ বনে গেছে৷ ওদের চেতনা ফেরাতে আমি চিৎকার করে বললাম, “বাঁচতে চাইলে পালাও।”
আমার চিৎকার আর কোহেনানের আগ্রাসী নড়নচড়ন ওদের চেতনা ফেরাতে সাহায্য করেছে৷ ভূতে ভয়ে সবাই এতক্ষণে ভোঁদৌড় দিচ্ছে৷ আমিও যে একেবারে ভয় পাইনি, তা না৷ ওর এমন ভয়াবহ দানবীয় অবস্থা ইতিপূর্বে চোখে দেখিনি৷ ট্যানিও বেশ ভয় পেয়েছে৷ কিয়ৎক্ষণ গত হবার পর কাউকে ফিরতে না দেখে ঘরের দিকে অভিমুখ করলাম৷ খানিক আগাতেই চোখে পড়ল কোহেনান সটান হয়ে পড়ে রয়েছে৷ এতক্ষণে খেয়েছে৷ শালারা যাওয়ার আগে মরণ কামড় দিয়েই গেল কিনা কে জানে? দৌঁড়ে গিয়ে ওর মাথাটা জানুতে তুললাম৷ বেচারা একেবারে মরার মতো হয়ে গেছে৷ কালক্ষেপণ না করে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে বন্ধু?”
“গত ছ' সপ্তাহ যাবৎ কিশোরী তো দূরের কথা কোনো মানুষের রক্তই জিভে পড়েনি। আমার অবস্থা এখন মৃত প্রায়৷ কুকুরটা থেকে কিছুটা রক্ত কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু তা কাজ করেনি৷”
“আচ্ছা, কথা হলো তুমি একটা কুকুরকে ফাঁসালে কীভাবে? আমার কাছে বিষয়টা আগ্রহোদ্দীপক।”
কোহেনান মুচকি হেসে বলল, “সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।”
ওর এমন হেয়ালীপূর্ণ কথার সাথে আমি অপরিচিত নই৷ কথাগুলোর বিশাল ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। এখন সেই সময় নেই৷ আমি ওর সব কথা শোনার সাথে সাথে নিজের হাতে একটা রগ কেটে মুখের উপর ধরলাম৷ রক্তে গন্ধে কোহেনান পাগলপারা প্রায়। সময় নষ্ট না করে আমার কাটা জায়গায় এক চুমুক দিল। মনে হচ্ছে আমার শরীরের সব রক্ত এক শ্বাসেই শেষ করে ফেলবে৷ তবুও আমি কিছু বললাম না৷ পনের-বিশ সেকেন্ড যাবার পর হাত ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, “তোমার রক্তে আস্পেন আর ওক গাছের উপাদান৷ এটা আমাদের জন্য বিষাক্ত।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি ছোট থেকে এসব গাছ খেয়ে বড় হয়েছি?”
“হতে পারে৷ অসম্ভব কিছু না।”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও। এমন কোনো সম্ভাবনা আছে কি মদ্যপের রক্ত তোমাদের জন্য বিষাক্ত?”
“এমন কোনো সম্ভাবনা নেই৷ আমরাও ব্যাপক হারে মদ গিলি৷ আমাদের কোনো সমস্যা হয় না এতে৷ সম্ভবত তোমার ধমনিতে জাত ভ্যাম্পায়ার শিকারী বংশের রক্ত বহমান৷ এটাই আমার জন্য বিষাক্ত।”
“কথাটা অবিশ্বাস্য৷ আমার উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কেউ বেঁচে নেই যে খোঁজ খবর নিয়ে সত্যটা জানব৷ ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না৷ এখন ঘুমিয়ে যাও। আগামীকাল তোমার জন্য টাটকা যুবতী শিকার করে নিয়ে আসব। আশাকরি, এতে তোমার অবস্থার উন্নতি ঘটবে।”
তিন.
প্রতিরাতের মতো একদিন সরাইখানায় মদ নিয়ে পড়ে আছি৷ সপ্তাহে একদিন পতিতা, নর্তকী বা গায়িকা ভাড়া করার কথা বলে কোহেনানের জন্য নিয়ে যাই। মহাজনের সাথে চুক্তির সময় পয়সা পুরো করে দেই৷ তাই না ফেরা যুবতীদের কথা আমায় আর জিজ্ঞেস করে না৷ একদিন মহাজন হাস্যরসে শাসিয়ে বলেছিল, “থিবাস আমার থেকে ভাড়ায় মাল নেওয়ার পর কোনোদিন ফেরত আসেনি৷ বোধহয় এত পরিমাণে তোহফা দেয় যে এখন নিজেই ব্যবসা খুলে বসেছে অন্য এলাকায়।” আমি তার কথার জবাব না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে এসেছিলাম সেদিন৷
নারীর ভাড়া উঠাতে যেয়ে ইদানীং আমার অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে গেছে৷ কোহেনানকে সেদিন জানিয়ে দিয়েছি আবার নিজের শিকার নিজে করতে৷ আমার মানুষ শিকারের যোগ্যতা নেই৷ অন্তত নিজের এলাকায় কাউকে শত্রু বানাতে চাই না৷ কোহেনান আমার কথায় অবশ্য রাগ করেনি৷ মদ গিলতে গিলতে টেবিলের উপর গা মেলে উবু হয়ে শুয়ে পড়লাম৷ প্রতিদিনের মতো আজকেও একদফা ঘুমানোর ইচ্ছে আছে এখানে৷ কিন্তু মানুষের হঠাৎ চেচামেচিতে চেতনা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম৷
সরাইখানার ফটকের সামনে মানুষজনের জটলা পাকিয়েছে৷ মাথা উঁচু করে দেখতে পেলাম রাজকীয় পোষাকে কয়েকজন রক্ষী কিছু একটা পড়ে শোনাচ্ছে৷ কান খাড়া করেও তেমন কিছু ঠাহর করতে পারলাম না৷ অগত্যা অচল দেহটাকে আত্মা দিয়ে টেনে নিয়ে গেলাম সেখান। রাজ রক্ষী উঁচু গলায় শোনালো, রাজা অতিসত্বর ভাড়াটে সাহসী যোদ্ধাদের যোগাযোগ করতে বলেছেন৷ রাজ্য জুড়ে রক্ত খেকো ভ্যাম্পায়ারদের আস্ফালন বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এদের দমন করতে হবে যেকোনো মূল্যে। যদি কেউ ভ্যাম্পায়ারের মস্তকসহ রাজার সাথে সাক্ষাত করে তবে তাকে স্বর্ণমুদ্রা পুরষ্কার দেওয়া হবে৷ রাজার বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে চাকরিও মিলতে পারে৷
এসব শুনে আমার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল। নিজের ঘরেই তো ভ্যাম্পায়ার লালনপালন করছি নিজের পয়সা খুইয়ে৷ তাহলে একে হত্যা করে নিজে কেন পয়সার মালিক হবো না৷ উপরন্তু সেদিনের পর থেকে কোহেনান আমাকে হয়তো শত্রুই মনে করে৷ ও তো ভেবেই আছে আমি ওদের শত্রু বংশের লোক৷ তাহলে ওর ধারণাই সত্য করি৷ কিন্তু এজন্য আমার ভ্যাম্পায়ার হত্যার কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে৷ এসবে অবশ্য বন্ধুবর কোহেনান ছাড়া অন্য কেউ তেমন কাজে আসবে না৷
যে-ই কথা সে-ই কাজ। রক্ষীদের ঘোষণা শুনে ট্যানি কে নিয়ে ডেরার দিকে দৌঁড় লাগালাম। এসে দেখি কোহেনান কেবলই রাতের খাবার শেষ করে একটা কিশোরীর দেহখানা বাইরে ফেলে এসেছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে মাংসাশী প্রাণীগুলো ভোজ উৎসবে মেতে উঠবে৷ স্বতঃস্ফূর্ত মনোভাব দেখে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, বন্ধু ভ্যাম্পায়াররা কি মরে না? ”
“না, আসলে প্রাকৃতিকভাবে এদের মৃত্যু নেই৷ হত্যা করলে অবশ্য মারা যায়৷ এদের আবার জীবিতও করা যায়৷ তবে একজন ভ্যাম্পায়ার জীবিত করার থেকে আরেকটা বানানো সহজ৷ ঘাড়ের রগ দেখে দু ঘাহ বসিয়ে দিলেই হয়ে গেল৷ আর জীবিত ভ্যাম্পায়ারের মধ্যে একটা সমস্যাও আছে৷ এরা জীবন পেয়েই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ যে ব্যক্তি পূর্বে তাকে হত্যা করেছে তাকে ধরে হত্যা করে নয়তো তার বংশধর হত্যা করে ফেলে। এজন্য মরে যাওয়া ভ্যাম্পায়ারদের জীবিত করতে তেমন আগ্রহ দেখায় না।”
আমি ওর কথা শুনে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ কায়দা করে নয় একে হত্যা করলাম ঠিকই; কিন্তু পরবর্তীতে কোনোভাবে জীবিত হলে তো আমার জীবন শেষ৷ না, এভাবে হবে না৷ জীবন যাতে ফিরে না পায় সেই ব্যবস্থা আছে কিনা দেখতে হবে৷ পুড়িয়ে ফেললে হয়তো কেচ্ছা খতম হয়ে যেত৷ কিন্তু রাজা যদি দেহটা দেখতে চায় তখন কী জবাব দেব?! এসব ভাবতে ভাবতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাদের জীবন আসলে কীভাবে ফিরে পায়? মানুষ কি এমন কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে যার ফলে ভ্যাম্পায়াররা আর জীবন লাভ করতে পারে না?”
“আসলে ভ্যাম্পায়ারদের কোনো জীবন নেই৷ জীবন থাকলে বয়স থাকে৷ আমি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ভ্যাম্পায়ার হয়েছিলাম৷ আজ দুশো বছর পার হতে চলছে৷ কিন্তু এখনও আমি পঁয়ত্রিশ বছরের তাগড়া যুবক। মানুষরা ভ্যাম্পায়ার হত্যার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কিন্তু কোনোটাই কাজের না৷ অনেকে ওক আর আস্পেন গাছের কাষ্ঠনির্মিত ক্রুশবিদ্ধকরে হত্যা করে চেয়েছে৷ ধর্মীয় কারণে শক্তিশালী মনে করত এই প্রক্রিয়াকে। আবার অনেকে হৃদপিণ্ডে লৌহ ফলা ঢুকিয়ে কবর দিত যেন জীবন পেলে ওটা কাজ না করে৷ এগুলো কোনো কিছুই কাজের না৷ রক্ত চলাচলের রাস্তার পরিশুদ্ধ থাকলে জিভ দিয়ে গলায় রক্ত যাওয়ার সাথে সাথেই ভ্যাম্পায়াররা জীবত হয়ে যায়৷ হাত-পা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলে অন্য কারোটা এনে লাগিয়ে দিলেই সেটার সমস্যা সমাধান।”
ওর কথার মাঝখানে বাম হাত দিয়ে বললাম, “যদি দেহে অন্য কারও মাথা লাগানো হয় তাহলে?”
“দেহটা কাজ করে মাথার নির্দেশে৷ দেহ যার মাথাও তার৷ যা বলছিলাম আরকি। রক্ত চলাচলের পরিশুদ্ধ রাস্তা যদি কেউ নষ্ট করে দিতে পারে তাহলেই কেল্লা ফতেহ৷”
“বিষয়টা কেমন? একটু বুঝিয়ে বলতো।”
“মনে করো আগুন দিয়ে বা আগুনের তৈরী এমন কোনো অস্ত্র দিয়ে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেললে শরীরের চর্বি পুড়ে গলে একেবারে লেগে যায়৷ ওখানে রক্তগুলো কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ মাথার সাথে দেহের যোগসাজশ করতে পারেনা৷ তাই বলা যায়, অমন মাথা দিয়ে আর কাজ হবে না৷”
আসলেই মানব ছাড়া সকল জাতির মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কমই আছে৷ এরা পুনরায় জীবন পেলেও জ্ঞান বুদ্ধি পায় না৷ নইলে কেউ জানের দুশমনের কাছে নিজেদের দূর্বলতা প্রকাশ করে! এতে অবশ্য আমার উপকার হয়েছে। এক ঢিলে হাজার পাখি মারার ব্যবস্থা হয়ে গেল। মরণ ফাঁদ একটা। মরবে পাখি হাজারটা৷ এসব কথার বেশ কিছুদিন গত হওয়ার পর যখন স্মৃতিপট থেকে মুছে যাওয়ার উপক্রম তখন শহুরে কামাড় দিয়ে একখানা কুড়াল বানিয়ে আনলাম৷ একেবারে বিশুদ্ধ লোহা৷ ধারের অবশ্য খুব দরকার নেই আপাতত।
ছেচল্লিশতম গ্রীষ্মের এক সকালে সূর্যটা বেশ জায়গা নিয়েই উঠেছে৷ কোহেনান এমনিতেই দিনে বের হয় না৷ সূর্যের আলোতে তো আরও না৷ নিজের কাজ মানে শিকার বা লুটতরাজ যা-ই করুক সেগুলো রাতের আঁধারে করে৷ সূর্যের আগমনী বার্তা পেয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায়৷ সেদিনও এর ব্যত্যয় হয়নি। আমিও সুযোগ বুঝে বসে গেলাম আগুনে কুড়ালটা গরম করে নিতে। সাথে একটা হাতুড়িও ছিল৷ বলা যায় না এক কোপে ধর না নামাতে পারলে দ্বিতীয়টি মারা সুযোগ নাও মিলতে পারে৷ তাই হাতুড়ি দিয়ে হলেও কাজ সারতে হবে। ট্যানিকে পাহাড়ায় রেখেছি কোহেনানের অবস্থা দেখে রাখতে৷
কুড়াল আগুনের তাপে লাল টকটকে হয়ে উঠেছে৷ এখনই সময় কাজ সমাধা করার৷ ঘরে গিয়ে দেখতে পেলাম বিছানার বাহিরের দিকে ঘাড় বের করে বুকের উপর ভর করে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে সে। এতো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি৷ কুড়ালটা ঘাড় বরাবর করে নিলাম। তিনবার জায়গাটা ঠিক করার পর সর্বশক্তি দিয়েই একটা কোপ দিলাম৷ এক কোপেই ধর নেমে গেছে৷ কালক্ষেপণ না করে খণ্ডিত মস্তকের কাটা অংশে মিনিট দুই উত্তপ্ত কুড়ালটা ধরে রাখলাম৷ চর্বি মাংস গলে একাকার। অতঃপর লাশটা জঙ্গলের ধারে ফেলে দিয়ে রাজা দরবারের দিকে ছুটে চললাম৷
২| ২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:০২
শায়মা বলেছেন: অনুবাদ আর গল্পটাও ভয়ংকর হলেও ভালো লেগেছে।
২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:৪০
যুবায়ের আলিফ বলেছেন: অনুবাদ না এটা। আমার লেখাই।
৩| ২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:১৩
রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার গল্প। থ্রিল আছে।
২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:৪০
যুবায়ের আলিফ বলেছেন: ধন্যবাদ
৪| ২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:৫২
শায়মা বলেছেন: বাহ!! তবে অসাধারণ হয়েছে ভাইয়া।
২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:০৫
যুবায়ের আলিফ বলেছেন: ধন্যবাদ
৫| ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩৭
প্রথম সারির নিরাপদ ব্লগার বলেছেন: নিজের লেখা হলে অনেক ভালো হয়েছে।
পড়ার সময় ভাবানুবাদের অনুভূতি পেয়েছি। এক নং মন্তব্যের সাথে সহমত।
©somewhere in net ltd.
১| ২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:২৫
সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: এতো বড় লেখা! কেউ পড়বেনা। প্লিজ ছোট ছোট করে কয়েক খন্ডে দিন।