নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস । তবু , উড়েছিনু, এই মোর উল্লাস

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ

নিজ জীবনোপন্যাসের নায়ক

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কালশিটের গর্ব

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:৩৮

মোরসালাত বক্সী সাহেব টেবিলে বসে উশখুশ করতে লাগলেন । বেশ কয়েকবার গলা খাঁকারি আর ইতিউতি করার পর বড় বিবিকে জিজ্ঞেস করলেন, 'মুছাম্মত মুমতাহিনা আম্মিজান কাঁহা? '

বড় বিবি হালিমা উত্তর না দিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে দিলেন । তারপর সুর নরম আর যথাসম্ভব ধীর করে বললেন , 'ওয় শু রাহা হ্যায় । '


মোরসালাত সাহেবের মধ্যে তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না । তিনি ধীরে সুস্থে খাওয়া শেষ করে 'আলহামদুলিল্লাহ' বললেন, থেমে থেমে তিনবারে এক গ্লাস পানি শেষ করে 'শুকরাল্লাহ' বলে বিবির দিকে দৃষ্টি স্থির করলেন । তারপর উর্দুতে যা বললেন সেগুলোর বাংলা করলে দাঁড়ায় , 'ঘুমাচ্ছেন মানে ? উনি কি ফজরের সালাত আদায় করেননি ? আর উনি খাবেন না ? '


হালিমা বক্সী স্বামীর দিকে খেজুরের প্লেট এগিয়ে দিলেন । ভীত গলায় কোনমতে আওয়াজ বের করলেন, 'মুমি আজকে সাওম করছে । '

'মুমি কে ? আমার মেয়ের নাম মুছাম্মত মুমতাহিনা । নাম বিকৃতি কবিরা গুনাহ । তওবা কর । ' বলেই মোরসালাত সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন । চিন্তিত মুখে খেজুর চিবুতে লাগলেন । বাড়িতে অশান্তির বাতাস ঢুকেছে তিনি বুঝতে পারছেন । মুমতাহিনার হঠাৎ করে সাওম করার ব্যাপার তার কাছে পরিষ্কার ।
দেশের অবস্থা ভাল না,তারমধ্যে গতকাল মেয়ে এসে বলল, 'ওয়ালিদান,কালকে ভার্সিটিতে মিছিল আছে । আমি আপনার অনুমতি প্রার্থনা করছি । '

মোরসালাত সাহেব উনার বিস্ময় লুকাতে পারেননি । তার মেয়ে বলছে কী এসব ? তার মেয়ে মুছাম্মত মুমতাহিনা বক্সী যাবে মিছিলে ? বেগানা মেয়েছেলের সাথে ঢলাঢলি, হাঁটাহাঁটি করবে ? তাও আবার কাফেরদের মিছিল ! ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ !

এই দেশটায় সত্যি সত্যি শয়তান ভর করেছে । ভারতের হিন্দুদের ষড়যন্ত্রে দেশে ভাষা নিয়ে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে । মুসলমানের দেশ,এখানে সবার জন্য উর্দু শেখা জরুরী । উর্দু হল উন্নত মুসলমানের লক্ষ্মণ । জাহেল বাঙ্গালি এসব বুঝে না ।

জাহেলদের বোকামি মানা যায়,কিন্তু তার নিজের মেয়ের মুখে এটা কোন কিসিমের বাতচিত ? মেয়ের উপর দুষ্টু জ্বীনের আছড় পড়েছে । মোরসালাত বক্সী কোন কালাম আওড়িয়ে ফুঁ দিবেন সেটা নিয়ে ধন্দে পড়ে যান ।

দ্রুত কয়েকটা সূরা কালাম আওড়িয়ে তিনি সাহস ফিরে পেলেন । আম্মাজানের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বললেন, 'আম্মাজান, আপ ঠিক হ্যায় না ? '


মুমতাহিনা উত্তরে যা বলল তাতে উনার গলায় পান আটকে গেলো । মেয়ে তো দেখি সত্যি সত্যি কাফেরদের মিছিলে যেতে চাইছে ! এই মেয়ে তার নিজের পরহেজগার মেয়ে তো ? মোরসালাত বক্সীর ভয় জাগে । এজন্যই গুরুজনেরা বলতেন মেয়েছেলের বেশি শিক্ষার দরকার নেই । মেয়েকে ইহুদি,নাসারা,হিন্দুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেওয়া ভুল হয়েছে । ভুল না হলে কি আর সেদিনের মেয়ের চটাং চটাং কথা শুনতে হয় !

'দেখিয়ে ওয়ালিদান, জোয়ান লোগো মা কি ভাষা কো লিয়ে মিছিল কার রাহা হ্যায়.... মায়ের ভাষার অধিকার সবার আছে । আমাকে উর্দুতে কথা না বলতে দিলে কেমন হবে বলো ? আমি মায়ের ভাষার সম্মানার্থে যাচ্ছি । ... ঠিক হ্যায় ... । আপনি যখন চাইছেন না,তবে যাবো না । তবে কাল থেকে আমিও আর উর্দু বলবো না,ইংরেজি বলব ।


মোরসালাত বক্সী আর সহ্য করতে পারলেন না,হাতে বাটালীর মতন একটা ছিল,সেটা দিয়েই দিলেন ।

অনেকদিন পর প্রাণের আম্মিজানকে মারতে গিয়ে নিজেকে হত্যা করার মত কষ্ট লাগছিল । কিন্তু আম্মিজান ভুল করেছেন, তিনি নিরুপায় । হিন্দুয়ানি বাংলা ভাষার সাথে পবিত্র উর্দুর তুলনা বরদাশত করতে পারেন না । মেয়ের উপর নাপাক জ্বীনের কুদৃষ্টি পড়েছে । তিনি ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে আম্মিজানের ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ । অচিরেই তিনি লাহোরে পাত্র সন্ধানের জন্য ভাইকে পত্র লিখবেন । এদেশে এসে তিনি বড় ধরণের ভুল করেছেন ।

মুখ ঢেকে ফুঁপাতে থাকা আম্মিজানকে দেখে উনার বুক ফেটে যেতে লাগলো । যাওয়ার আগে বলে গেলেন, 'আম্মিজান, ম্যায় মাফি মাঙতা হু... আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দান করুন । '

***

মেয়ে সেদিন থেকে ঘরের ভেতর নিজেকে বন্দি করে রেখেছে । কিছু খাচ্ছেও না । অতি আদরের মেয়ে । মোরসালাত সাহেব অসহায় বোধ করতে লাগলেন । ইচ্ছা করছে আম্মিজানকে কোলে নিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে । কিন্তু অন্যায়ের কাছে তিনি কোমল হতে পারেননা ।

***

মোমতাহিনা অনেকক্ষণ ধরে হাতের কালচে জখমের দিকে তাকিয়ে আছে । সাদা হাতের উপর রক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে গেছে ।

কাল প্রথম যখন আঘাত পেল,চিৎকার করতে ইচ্ছা হচ্ছিল । আঘাতের চেয়েও অপমান আর প্রত্যাখানের কষ্ট লেগেছিল বেশি । কিন্তু সে এটাও বুঝতে পারছিল তার আব্বা ভুল করছেন । নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া সে সমর্থন করতে পারবে না । সারা দেহে কালশিটে বসালেও না ।

নিজের কালশিটের উপর হাত বুলিয়ে মুমতাহিনা শান্তি অনুভব করল । কেটে গিয়ে রক্ত বের হলে আরও ভালো হত।

দুপুরে নাকি বেশ কয়েকজন গুলি খেয়ে রক্ত দিয়েছে । সে ও একটু রক্ত দিতে পারলে খুশি হত। বাংলা ভাষার জন্য উর্দুভাষীর রক্ত । কারণটা খুব সাধারণ : মায়ের ভাষার প্রতি সম্মান ।
আঘাতের চিহ্নটা গর্বের চিহ্ন হয়ে গেছে আনারকলি গুলাগুলির খবর নিয়ে আসার সাথে সাথেই । সেখানে হাত রেখে অস্পষ্ট হাসি ছড়িয়ে দিল সারা মুখে, স্পষ্ট বাংলায় বলল---- "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই । '

উর্দুভাষীদের দেওয়ালে সেটা অদ্ভুত প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করলো ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ২:০০

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: চমৎকার। সত্যিই ভাল লিখেছেন।

২| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:৫৯

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অসাধারণ| গল্পে অভিনবত্ব আছে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.