নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস । তবু , উড়েছিনু, এই মোর উল্লাস

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ

নিজ জীবনোপন্যাসের নায়ক

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি ধর্ষণ ও আমাদের প্রতিক্রিয়া

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:১২

লক্ষপ্রাণের হার্টথ্রব নায়িকা হিমিকা ধর্ষিত হয়েছিল । সারারাত কেঁদেছে, সারাদিন কেঁদেছে । অনেকগুলো বিকেল,অনেকগুলো সন্ধ্যা আর অনেকগুলো রাত একা একা নিঃস্ব হয়ে কেঁদে কাটিয়েছে, যেখানে তার পাশে তার দুঃখ শোনার কেউ নেই ----না কোন ফ্যান,না কোন সাংবাদিক, না কোন মিডিয়া । সে শুধু কাঁদত, আর ভাবতো তার সৃষ্টিকর্তা তার কথা শুনছে । একসময়য় তার কান্নাকাটিতেও ক্লান্তি এল , নিজেকে শেষ করে দিতে ফ্যানে ওড়না পর্যন্ত প্যাঁচিয়ে ফেললো ।

হিমিকা আত্মহত্যা করতে পারেনি । সেরাতে তার ইস্পাতের মতন মনোবল বাঁচায় নি,কিংবা বাবা - মায়ের মুখও মনে পড়েনি তার । সে ভয় পেয়েছিল । ফ্যানে ঝুলানো ওড়না তার কাছে পেত্নীর ঠ্যাঙ এর মতন মনে হয়েছিল তাই ঝুলতে পারেনি । সেই মেয়েটি সকাল বেলা সব বলে দিল । বলে দিল তার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা,কীভাবে, কার দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল সব বলে দিল ।

গ্রামের গরীব মেয়ে মুনিরা পার্মেন্টসে এসে ধর্ষিত হয় । কোন এক সন্ধ্যারাতে কাজ শেষে বাড়ী ফিরতে যাবে তখন তার মুখ চেপে ধরে সর্বনাশ করা হয় । মুনিরা হাঁটতে ভুলে গিয়েছিল,কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল এমনকি কথা পর্যন্ত বলতে ভুলে গিয়েছিল । তবু তার সাথে থাকা মেয়েগুলো ঠিক বুঝে গিয়েছিল রক্তাক্ত সেই তাণ্ডবলীলা । মুনিরা তাদের কাউকে বলেনি সে ধর্ষিতা, শুধু মুখখানি একটু তোলে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে মুখ লুকিয়েছিল । তাতেই সবাই বুঝে গিয়েছিল ।

মৌমিতা আর তাওসীফ দুজনেই চাইল্ড এবিউজের শিকার । মৌমিতা তখন মাত্র পাঁচ কিংবা ছয় । তার কাপড় ঠিক ছিল,শরীরে মাংসপিণ্ডও গজায় নি । তবু আল্লাহ বোধহয় তার কপালে ধর্ষিতা সীল লাগানো স্থির করে ফেলেছিলেন । তাই অনেকগুলো 'আদরের' স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও শেষ রক্ষা হয়নি । মৌমিতা ধর্ষিতা হয় তারই এক আত্মীয়ের কাছে ।

তাওসীফ চোখ বন্ধ করে সে রাতের কথা চিন্তা করলেই তার গলায় কে যেন আঁকড়ে ধরে । সে রাতে তার দূর সম্পর্কের মামা তার শরীরে চিরুনি অভিযান চালিয়েছিল । কিলবিল করা হাত দুটোকে সে বাঁধা দিতে পারেনি । দশ বছরের তাওসীফের উপর একটা পশু সে রাতে অত্যাচার চালায়, তাওসীফ তখনো বুঝেনি কি হচ্ছিল । কিন্তু আজ বুঝে,সে ধর্ষিত হচ্ছিল ।

মৌমিতা আর তাওসীফ কাউকে সে কথা বলতে পারেনি । কাকে বলবে ?
একসময় সমাজে জোয়ার আসলো । সেই অনলাইন জোয়ারে মৌমিতা আর তাওসীফ তাদের সব কথা বলে দিল ।

হিমিকার বক্তব্যের পর সমস্ত মিডিয়াতে সে রসালো বস্তু হয়ে উঠলো । কত রঙ্গে,কত ঢঙ্গে তাকে নিয়ে কাহিনী বানানো হল । পত্রিকার বিক্রি বাড়লো,হিমিকা হয়ে গেল 'কাগুজে প্রস্টিটিউট ' । লোকজন লোলুপ কণ্ঠে বলে, 'হারামজাদী, মাগী! '

হিমিকা কাউকে পাশে পায়নি । না তার ফ্যান,না তার ফেইম,না তার বাবা মা । শুধু কলঙ্ক কুড়িয়েছিল যেন দোষটা তার নিজের ।
পাশে পেয়েছিল সেই পেত্নীটিকে, যাকে সে ভয় পেয়েছিল । তাই এক রাতে পেত্নীর ঠ্যাঙগে ধরে সে ঝুলে পড়ে ।পরম বিশ্বস্ততায় ।

মুনিরা সব ভুলতে চেয়েছিল । কাঁদতে, হাসতে যেমন ভুলে গিয়েছিল,তেমনি ভুলতে চেয়েছিল সে সন্ধ্যাটাকে । ভুলতে হয়তো পারতো না,কিন্তু চেষ্টা করতো । কিন্তু সমাজ তাকে ভুলতে দেয়নি । গ্রামের সমাজে সালিশ বসে,মুনিরা একঘরে হয় ।

সমাজের কেউ তার পাশে আসেনি । বাজারের মাসী তিন দিন পর খাবার নিয়ে এসেছিল । মুনিরা আজ বাজারে থাকে । পান খায়,ঠোঁট লাল করে বসে থাকে । কেউ কিছুই বলে না । সেদিনকার সালিশের কর্তাব্যক্তিরা পর্যন্ত আজকাল তার কাছে ধর্না দেয় । বলে,'মুনিরা, একটা পান সাজাতো! '

মৌমিতা আর তাওসীফ দুজনেই অনলাইনে হট টপিক হয়ে গেল । সুশীল থেকে দুঃশীল, সেলেব্রিটি থেকে আমজনতা সবাই তাদের সাহসের প্রশংসা করল,তাদের পাশে দাঁড়ালো, তাদের প্রতি সমবেদনা জানালো ।

ইস্যু গেল, ইস্যু এল । মৌমিতা আর তাওসীফের কথা পুরনো হল,চাপা পড়ে গেল । কিন্তু যে সত্য তারা প্রকাশ করেছে,সে সত্য পুরনো হল না । মৌমিতা মাঝেমাঝেই মেসেজ পায়,"এ্যাই খানকি, লাগাবি? নাকি জোর করবো? "
মৌমিতার শরীর কুঁকড়ে যায় ।

মেসেজ পড়ে তাওসীফের শরীর গুলিয়ে ওঠে । "তুই কি হিজড়া? দিবি নাকি একরাত? তুই পোলা হইলে তরে জোর করে কেমনে? শালা বাঞ্চোত! "

হিমিকা, মুনিরা, মৌমিতা আর তাওসীফ আমাদের সংখ্যালঘু কেউ নয়,বরং এরাই সংখ্যাগুরু । বিশেষ করে মৌমিতা আর তাওসীফের মতন গল্প আমাদের অনেকেরই আছে । অনেকে বলে দিচ্ছেন , বাকীরা বলতে সংকোচ করছেন ।

কিন্তু এরকম বলে আসলে লাভ কী হচ্ছে ? আপনার সাহসের প্রতি প্রশংসা এবং সম্মান রেখেই বলছি, সেই সাথে যারা সমবেদনা জানায় তাদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, নষ্ট এই সমাজের নষ্ট ভণ্ড সহানুভূতি কারোর দরকার নেই । এরকম করুণা দেখানোর টেণ্ডেন্সিরপ্রতি ঘৃণা করা উচিত ।

যেখানে ধর্ষনকে পুঁজি করে সংবাদপত্রের কাটতি বাড়ানো হয়,যেখানে সামান্য কিছু সহমর্মিতা মাখানো শব্দের পেছনে মুচকি হাসি লুকানো থাকে, সেরকম সহানুভূতির কী দরকার ?

একজন ধর্ষিত কিংবা ধর্ষিতার ক্ষতটুকু আমরা বুঝতেই পারিনা । যদি বুঝতে পারতাম, তাহলে সান্ত্বনাসূচক কথা বলার আগে কয়েকবার চিন্তা করতাম । তারা প্রতিনিয়ত যে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যায়,সেটা উপলদ্ধি করতে পারলে করুণামাখা কথা বলতে ভয় পেতাম । তাদের সুঃসহবাসের মুখোমুখি যদি আমরা হতাম,তবে কোন কিছু বলতেও লজ্জা লাগতো আমাদের । শুধু শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে পারতাম তখন ।

যে মানুষটা ধর্ষণের মতন এত বড় দুর্ঘটনারর পরও বেঁচে আছে,সারভাইব করেছে,তাকে শ্রদ্ধা ছাড়া কিছু দেওয়ার নেই আমাদের । আমাদের বাচ্চাদের দেখিয়ে বলতাম, "এরা সত্যিকার যোদ্ধা । এরাই বীর । মরণের চেয়েও কঠিন কিছু এদের হারাতে পারেনি । এরা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকা কাকে বলে এদের দেখে শিখো । "

তেমন সমাজের দেখা কবে পাবো, বাঙ্গালী ? করুণা নয়,সহানুভূতি নয়,একটু সম্মান চাই । আমাদের অনেকেরই যে অনেক কথা, অনেক গল্প বলা বাকি আছে !

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:২৭

নতুন বলেছেন: নারীদের মানুষ ভাবা শেখাতে হবে স্কুলে...কলেজে... পরিবারে... নতুন করে শেখাতে হবে...

২| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:৪০

অ রণ্য বলেছেন: সুন্দর লেখা !!!!! ধন্যবাদ ভায়া আপনাকে শেয়ার করার জন্য।

৩| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:৫৫

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: যে মানুষটা ধর্ষণের মতন এত বড় দুর্ঘটনারর পরও বেঁচে আছে,সারভাইব করেছে,তাকে শ্রদ্ধা ছাড়া কিছু দেওয়ার নেই আমাদের । আমাদের বাচ্চাদের দেখিয়ে বলতাম, "এরা সত্যিকার যোদ্ধা । এরাই বীর । মরণের চেয়েও কঠিন কিছু এদের হারাতে পারেনি । এরা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকা কাকে বলে এদের দেখে শিখো ।
পুরোপুরি একমত

৪| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:২২

আউলা বলেছেন: আপনার লেখাটা ভাল লাগলো।

৫| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:৩৮

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ বলেছেন: পড়ার জন্য এবং মতামত জানানোর জন্য ধন্যবাদ

৬| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:৩৮

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ বলেছেন: পড়ার জন্য এবং মতামত জানানোর জন্য ধন্যবাদ

৭| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:৪০

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ বলেছেন: লেখাটা 'বিশেষ' করে একচেটিয়াভাবে নারীদের জন্য নয় । আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ষণ এবং ভিকটিম

৮| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:৪০

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ বলেছেন: লেখাটা 'বিশেষ' করে একচেটিয়াভাবে নারীদের জন্য নয় । আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ষণ এবং ভিকটিম

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.