নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস । তবু , উড়েছিনু, এই মোর উল্লাস

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ

নিজ জীবনোপন্যাসের নায়ক

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

জুতা

২৮ শে জুন, ২০১৭ রাত ১২:২৪

পাজামার দড়ি আরেকটু টাইট করে বাঁধে সুরমা ।

খালাম্মার কাছ থেকে 'আন্ধাইর গিরো' শিখে নিলে ভাল হতো । খালাম্মা শিখাতে চেয়েছিল । পাত্তা দেয়নি । এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে । আবার মনে হচ্ছে, আব্বার পায়জামা না পরে নিজেরগুলা পরলেও হতো ।
সমস্যা হল তার দুটো পায়জামাই রঙিন । একটা লাল,আরেকটা সবুজ । বছর তিন আগের ঈদে লাল পায়জামা পেয়ে ত্রিশটা রোজা না রাখতে পারার কষ্ট ভুলে গিয়েছিল । সেই লাল পায়জামা পরলেই চলত । অন্ধকারে কেউ বুঝতেই পারত না পায়জামা লাল নাকি কালো ।

একটু টাইট করে বেঁধে শক্ত হাতে মনার আঙ্গুল ধরে । জিজ্ঞেস করে, "কিরে মনা, ভালা লাগতেছে না ভাই? "
মনা উত্তর না দিয়ে মাথা দুলায় । দুজনে সাবধানে হাঁটে ।

সুরমা নিজের দিকে মনোযোগ দেয় । আরেকটু হাঁটলেই বড় মসজিদ । সারা শহরের মানুষ আজ বড় মসজিদে । তারার মত বাতি চারদিকে । ঝিকমিক । আকাশের তারার চেয়েও বেশি মানুষ আজ এইখানে । মানুষের চেয়েও বেশি ফকির । গিজগিজ করছে এলাকা । সুরমা শক্ত করে পায়জামা ধরে রাখে, হাত উপরে নিয়ে চেক করে একবার ------ টুপি ঠিকমত মাথায় আছে তো?

ফকির দেখে সুরমার বিরক্তি লাগে । কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরক্তি ভুলে কয়েক কদম এগিয়ে যায়, তারপর ভীত চোখে কানাকানি মনাকে জিজ্ঞেস করে, 'ভাই । ও ভাই । আমি যে ছেড়ি এইটা বুঝা যায়? '
মনা একবার তাকায় । তারপর সদ্য পড়ে যাওয়া দাঁত বের করে বলে, 'নারে । সুরমিবু , তুই তো ভাই হয়া গেলিরে !'

সুরমা নিশ্চিত হয় । কম কায়দা কানুন করতে হয়নি তাকে ! আব্বার পুরান পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে নিজেকে ছেলে বানিয়েছে । তারপর না সে মসজিদে আসার সাহসটুকু করতে পারল । আম্মা প্রথম থেকেই গাইগুই করছিল : 'মেয়ে মানুষ , তায় আবার ঋতুমতী । মসজিদে যাইবি আবার কী ? ধেমড়ি ছেরির শখ দেখো ! '

অনেক কান্নাকাটি করে কোনমতে রাজি করিয়েছে । শরীর একটু বাড়ন্ত । কয়েকদিন আগে কী - না - কী হয়েছে তাই বলে সে মসজিদে যেতে পারবে না ? গতবারও তো গেলো ! আব্বা ছিল তখন । আব্বা থাকার সময় মেয়ে থেকে ছেলেও সাজতে হয়নি । আব্বা এইবার থাকলে কোন চিন্তাই ছিল না । কিন্তু...কিন্তু আব্বা আম্মাকে ছেড়ে অন্য একজনের ঘরে চলে গেল বলে মেয়ে থেকে ছেলে সাজতে হচ্ছে কিনা সুরমা ভাবে । ভাবতে ভাবতে দিশা না পেয়ে কান্নাকাটি করে ।

তারপর কাঁদতে কাঁদতে কোনমতে রাজি করালেও হাজার হাজার শর্ত দিয়ে তারপর ছেড়েছেন সুফিয়া বেগম । নামাজের সময় মসজিদের ভেতর যাওয়া যাবেনা,পুরুষ মানুষের শরীরে শরীর লাগানো যাবেনা । রাতের খাবার খিচুড়ির লাইনে খেয়ে আসবে । খিচুড়ি খেয়েই বাসায় আসতে হবে । আসার সময় ভিক্ষা করে কিছু টাকা আনতে পারলে ভাল... । এইরকম আরও হাজার হাজার উপদেশ ।

সুরমা শুনেও শুনেনি । ভিক্ষা তো সে করবেই না । মরে গেলেও না ।
মেয়ে হয়ে এতরাতে ঘুরাঘুরি করবে কার সাথে ? তাই কোনরকম আব্বার পাঞ্জাবি বের করিয়েছে , তারপর টুপি আর পায়জামা পরে ছেলে হয়েছে । তারপর আবার গার্জিয়ান হিসেবে মনাকে আনতে হয়েছে ! তবেই না বের হয়েছে ।

ঢোলাঢালা পায়জামা পাঞ্জাবি । তাও আবার পুরাতন । সুরমার বেখাপ্পা লাগছিল । কিন্তু বের হতে পারবে সেই আনন্দেই ভুলে গেছে সব । ঘর থেকে বের হওয়ার পর আনন্দ কমে গেছে । এত এত মানুষ ! সেই পুরাতন লাল - নীল -সবুজ বাতি । খিচুড়ি খাওয়ার লাইন । সবকিছু গতবছরের মত । গতবারের সাথে এবারের তফাত ----- গতবার আব্বা ছিল সাথে, এবার মনা । গতবার মনে কোন ভয় ছিল না, কোন গ্লানি ছিল না । এবার মেয়ে হওয়ার গ্লানির সাথে আছে ভয় ----- কারও কাছে ধরা পড়ে যাবেনা তো?

.

কাতারে কাতারে মানুষ 'আল্লাহু আকবর' বলে সেজদায় যায় । বাইরের বিচিত্র লাইটিং তাদের উপর বিচিত্র নকশা তৈরি করে । বাইরে ফকিরদের আহাজারি কোলাহল থেমে গেছে ।
চারদিক কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় । আবার 'আল্লাহু আকবার' বলে সরব হয়ে উঠে ।

ইমামের সুরেলা তেলওয়াতে সুরমার কেমন ঘোর লাগে । তারও ইচ্ছা হয় সবার সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতে । সেজদায় যেতে । তারপর হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহ কে বলত, 'আল্লাহ, আব্বারে ফিরায়ে আনাও । আর মনারে এই সামনের ঈদে নতুন এক জোড় জুতা দিয়া দিও...'

সুরমা কাতারে দাঁড়ায় না । জুতার স্তুপের একটা জুতায় তার চোখ আটকে যায় । আবছা অন্ধকারেও চকচক করছে । একবার, দুইবার, কয়েকবার দেখে । মনে মনে মাপ নেয় । মনার পায়ে লাগবে । ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে যায় । মসজিদ থেকে জুতা চুরি করে নিবে ? আল্লাহর ঘরে সে চোর হবে ?

অজানা আকর্ষণে এগিয়েই যায় । মসজিদে সবাই ঝিম মেরে বসে আছে । এতক্ষণ যে বাচ্চারা লাফালাফি করছিল তারাও চুপচাপ বসে গেছে । সুরমা জানে, এটা 'আত্বাহিয়্যাতু' পড়ার সময় । কিছু করতে হলে এই সময়ে করে নেওয়াই ভাল ।
সুরমার ভেতর চলতে থাকে হাতুড়ি পেটার শব্দ । ধুপধুপ । ধুকপুক । ধুপধুপ ।
নামাজের লাইনে বসে থাকা মনার হাত ধরে শক্ত করে । মনা একবার তাকায় । উঠতে চায়না সে । আঙুল দিয়ে চুপ থাকার নির্দেশ দেখায় সুরমাকে ।
মনার মুখ দেখে সুরমার মন মায়ায় ভরে যায় আবার । নতুন জুতাগুলো পেলে এই ছোট মুখটা ভরে উঠবে কিন্তু আবার ভাবে সুরমাঃ সে চুরি করবে ? চুরি ? মসজিদে ? আল্লাহর ঘরে ?
ঘামে জবজবে হয়ে যায় তার শরীর ।

নামাজের শেষ বৈঠক ।
সুরমা চকচকে নতুন জুতাগুলোর দিকে এগিয়ে যায় । গুনাহ - নেকীর বিচার অনেকক্ষণ ধরে করছে সে । বিচারে ক্লান্ত হয়ে এগিয়ে যায় জুতাগুলোর দিকে । যে জুতার জন্য এত লোভ, এত পাপ, এত দ্বিধা সেটা ভাল করে দেখতে হবে ।
কাছে থেকে দেখেও আঁশ মিটে না । একটু ছুঁয়ে দেখে । তারপর চারপাশে তাকায় । সবাই একমনে বসে আছে হাঁটুতে হাত দিয়ে । ধ্যানমগ্ন পুরো এক মসজিদ মানুষ ।
এত এত নেকীর কাজে একলা সে গুনাহগার হবে?

.

আরেক ঝলক দেখে নেয় চারপাশ । তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ায় । কী করেছে এতক্ষণ সে ভুলে যায় । দম আটকে রাখে কিছুক্ষণ । তারপর আস্তে আস্তে অল্প অল্প করে শ্বাস নেয় ।

মনার হাত ধরে শেষ সিঁড়ি পার হয় । সিঁড়ি থেকে নেমে লম্বা দম নেয় সুরমা । মনাকে তাড়া দেয় 'তাত্তাড়ি হাট শয়তান' ।

মসজিদের গেইট পার হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে । কপালের ঘাম কমে আসছে । সারামুখে হাসি ছড়ায় পেটে চাপ দিয়ে ধরে । পাজামার ভেতর পেটের সাথে লাগানো একজোড়া নতুন জুতা ।
সুরমা অন্ধকারে গিয়ে জুতা বের করে । মনাকে দেখায় । অন্ধকার ভেদ করে মনার কলকল হাসি ভেসে আসে । সুরমার ভেতর থেকে পাপ-পুণ্যের গ্লানি মুছে যায় ।

মসজিদের ভেতর থেকেও এবার শব্দ আসে , এতক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ইমাম সাহেব বলেন "আসসালামু আলাইকুম ইয়া রহমতুল্লাহ..."

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৭

মক্ষীরাজা বলেছেন: ভাইয়ুমণিতা!!!!!!!!!

বাহ!!!!!!!!

মুগ্ধ মুগ্ধ মুগ্ধ!!!!!!!!

ঠিক পরীর দেশের রাজণ্যদের লেখা !!!!!!!!

উলে জাদুরে। উম্মা :>

২৯ শে জুন, ২০১৭ দুপুর ১২:০১

ফরহাদ বিন হাফিজ পরাগ বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.