নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখতে ভালো লাগে তাই লিখি।

সুদীপ কুমার

মন যা চায়।

সুদীপ কুমার › বিস্তারিত পোস্টঃ

সমান্তরাল

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:১৭



দীপা চুপচাপ বসে আছে। ICU এর বেডে মায়ের শীর্ণ দেহ । রুপা কাঁচের এপাশ হতে অপলকভাবে তাই দেখছে। দীপা রুপাকে ডাক দেয়।
-অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছিস। এবার একটু বস।
রুপা দিদির দিকে তাকায় ।কিছু বলেনা। দাঁড়িয়েই থাকে।
ICU তে এসে মোহন সাহেব রুপার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রুপা বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
-নীচে ড্রাইভার আছে,তোরা বাড়ী চলে যা।আমি পরে আসছি।

রুপা বায়না ধরে মায়ের কাছে,ওকে খাইয়ে দিতে হবে। লোপা ফ্যাকাশে মুখে হাসে ছোট মেয়ের আবদার শুনে।
-মাকে বিরক্ত করিসনা রুপা।
দিদির কথা শুনে রুপা গাল ফুলিয়ে রাখে।
-দীপা, তুই ভাত মেখে নিয়ে আয়। আমি ওকে খাইয়ে দিচ্ছি।
দীপা ভাত মেখে নিয়ে আসে।
-মা,তোমার শরীর আজ বেশী খারাপ। আমি ওকে খাইয়ে দিচ্ছি।
রুপা বোনকে খাইয়ে দিতে থাকে। লোপা বসে বসে তাই দেখে। ভাবে আর কয়দিন এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হবে তার। মরণ ব্যাধি যেভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মোহন দীপাকে নিয়ে সমস্যায় পড়বেনা। কিন্তু রুপাকে নিয়েই ওর যত দুঃচিন্তা। ক্লাস নাইনে পড়ে, এখনও আচরণ বাচ্চাদের মত।
-আমি যখন থাকবোনা,তখনও ছোটবোনকে এভাবেই দেখে রাখিস মা।
দুইবোন মায়ের দিকে তাকায়। উঠে গিয়ে মায়ের পাশে বসে। দু’বোনই মাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে থাকে।

লোপা মারা যাওয়ার পর,মোহন সাহেব প্রথম যে সমস্যায় পড়েন তা হলো রান্না আর ছোট মেয়েকে নিয়ে। একটি কাজের মেয়েও ঠিক মত থাকছিল না। আর রুপা একা একা বাসায় থাকতে চাইছিল না। বড় মেয়ে রাজশাহী মেডিকেলে পড়ে। ও রাজশাহী চলে গিয়েছে। আর উনি ব্যবসায় ব্যস্ত। পাশের ফ্লাটের ভাবি এ সময় মাতৃস্নেহে এগিয়ে আসেন। তার ছোট মেয়ে লিজা আর রুপা একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। পরশীর এমন সহযোগীতায় মোহন সাহেব কিছুটা আশস্ত হন।

মা মারা যাওয়ার পর রুপার চেনা জগত ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। রুপাও বদলে যেতে থাকে । একদম চুপচাপ ধরণের হয়ে যায়। আর রুপার এমন পরিবর্তনে মোহন সাহেব খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। উনি যতদূর সম্ভব মেয়েকে উচ্ছল রাখার চেষ্টা করে যান। বড় মেয়ের পরামর্শ মত উনি গৃহ শিক্ষক বদলিয়ে ফেলেন। বয়স্ক একজন শিক্ষক রাখেন বাসায়। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করে দেন। গ্রাম হতে বৃদ্ধ মাকে বাড়িতে এনে রাখেন।

মোহন সাহেব বেশ আয়েশ করে ডিসকভারি চ্যানেল দেখছিলেন। কত না জানা ব্যাপার-স্যাপার যে আছে পৃথিবীতে উনার জানাই ছিলনা। কচ্ছপের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার সাথে সাথে সব বাচ্চা সমুদ্রের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু সব বাচ্চা সমুদ্রে পৌছায়না। শিয়াল আর পাখি কত বাচ্চা খেয়ে ফেলে।
-বাবা ,খেতে এসো ভাত বেড়েছি।
-আসি মা।
খাওয়া-দাওয়া শেষে রুপা বাবার জন্যে ঔষধ নিয়ে আসে। মোহন সাহেব ঔষধ খেয়ে আবার টিভির সামনে বসেন। রুপা মোহন সাহেবের পাশে এসে বসে।মোহন সাহেব লক্ষ্য করে মেয়ে বেশ উসখুস করছে।
-কিছু কি বলবি মা?
-না,কিছু না।
-আমার মনে হচ্ছে,তোর জরুরী কোন কথা আছে।
রুপা চুপ করে থাকে।
-দেখ মা,তোর মা বেঁচে থাকলে মাকে তো বলতিস। ধরেনে আমিই তোর মা,আমিই তোর বাবা।
-বাবা,পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষ বাবার মত হয়না কেন?
মোহন সাহেব মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে দেখে। সমস্যাটা কোথায় বুঝবার চেষ্টা করে।
-কেউ কি কিছু বলেছে?
রুপা মাথা নাড়ায়।
-একটা কথা সত্যি করে বলবি মা ? তোর শরীরে কি কেউ হাত দিয়েছে?
-জানো বাবা, দিদা আশে পাশে না থাকলে স্যার শুধু আদর করার চেষ্টা করে। আমার একদম ভাল লাগেনা।
-মারে পৃথিবীতে অনেক পুরুষ আছে সত্যি, তবে মানুষ আছে খুব কম। তোর আর এই স্যারের কাছে পড়তে হবেনা।

লিজার মা রুপার খুব যত্ম নেওয়া শুরু করে। উনি মোহন সাহেবকে এই বলে আশস্ত করেন, আজ হতে উনার তিন সন্তান। উনার এখন দুই মেয়ে আর এক ছেলে।

রুপাকে দেখলেই পাপ্পুর মেজাজ খুব চড়ে যায় । কয়েকদিন আগেও রুপার এতো কর্কশ ব্যবহার ছিল যে মারতে ইচ্ছে হতো ওর। আর কি নেকু নেকুভাবে কথা বলতো। মনে হতো ও যেন পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। এখন অবশ্য কমেছে।আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। তারপরেও ও হিন্দুদের খুব একটা পচ্ছন্দ করেনা। রুপাও বুঝতে পারে পাপ্পু ওকে পচ্ছন্দ করেনা। তাই সেও পাপ্পুকে এড়িয়ে চলে।
স্কুল হতে ফিরে পাপ্পু জামা-কাপড় ছেড়েই ডাইনিং টেবিলে বসে যায়। চিৎকার করে মায়ের কাছে খাবার চায়।
-তুই তোর ঘরে গিয়ে বস। আমি তোর ঘরেই খাবার দিয়ে আসছি।
-কেন ঘরে খাবো কেন? আমি এখানেই খাবো।
লিজা আর রুপা টেবিলে এসে বসে। পাপ্পু টেবিল বাজাতে শুরু করে।
-ভাইয়া,তুমি ঘরে যাওতো। তুমি তো গরুর মাংস দিয়া খাইবা। রুপা আছেনা?
-কেন? গরুর মাংস কি খাওয়নের জিনিস না নাকি? কত হিন্দুইতো খায়।
লিজার মা রান্না ঘর হতে বেরিয়ে আসে।
-পাপ্পু তুমি দিন দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছো দেখি।শোন শুধু পড়াশুনায় ভাল করলেই ভাল মানুষ হওয়া যায়না।
মায়ের কথা শুনে পাপ্পু রাগ দেখিয়ে ঘরে চলে যায়।

রাতে শোবার সময় পাপ্পুর আব্বাকে ছেলের আচরণ নিয়ে অভিযোগ করে পাপ্পুর মা।
-কেন সমস্যা কোথায়? পাপ্পু কিছু ভুল বলেনি।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি আবার বলেন-তোমার মনে অন্য কোন ভাবনা আছে নাকি? অবশ্য মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর।

রুপা চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি কেমন নির্জন। দিদা কয়েকদিনের জন্য বাড়ি গিয়েছে। ঠিকা কাজের মেয়েটাও আজ আসেনি। কিছুক্ষণ রাস্তায় মানুষ চলাচল দেখে। এরপর টিভি ছেড়ে দেয়। টিভিও দেখতে ভাল লাগেনা। সেলফ হতে ব্ল্যাক এড়ো বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বহুবার ও এ বইটি পড়েছে। ভালই লাগে পড়তে। বিশেষ করে নায়িকার পুরুষ সেজে থাকাটা ও বেশ এনজয় করে। বইটি পড়ার পরে ও ভেবে পায়না ও কি করবে। রুপা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সবাই ওকে সুন্দরী বলে। ও ভেবে পায়না, কেন সবাই ওকে সুন্দরী বলে।তবে কিছুদিন যাবৎ রুপা যা করছে , কেউ ওর দিকে চাইলে ও সরাসরি তাদের চোখের দিকে তাকায়। খেয়াল করে দেখেছে , তারা অনেকেই তার মুখের দিকে নয় তার শরীরের অন্য অংশে চেয়ে রয়েছে। ব্যাপারটা ওর বিশ্রী লাগে। রুপার কাছে তাদেরকে চোর মনে হয় ।

-বাবা, আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলে?
-প্রেসারটা বেড়েছে মা।
-ডাক্তার আংকেলকে দেখিয়েছো?
-হ্যাঁ মা।

বাবা আর মেয়ে খেতে বসে। খাওয়া শেষ করে মোহন সাহেব টিভির সামনে বসেন। রুপা ঔষধ নিয়ে আসে।
-আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড় বাবা।
-মারে, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেই কি তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে ? তার চেয়ে আয় গল্প করি।
রুপা খাবারের টেবিল পরিস্কার করে রেখে আসে।
-বাবা, আমরা তো মাংস খাই ,তবে কেন গরুর মাংস খাইনা?
মোহন সাহেব হেসে ফেলেন হো হো করে।
-আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে এই জন্যে কি বাবা ?
-শোন ,তোর দিদার সামনে এমন কথা বলিস না। মা কিন্তু খুব খেপে যাবে।
-বাবা, বলোনা।
-শোন মা ,ধর্ম আসলে কি ? ধর্ম হলো সংস্কৃতি। তুই ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবি , যে ধর্মের উৎপত্তিস্থল যে অঞ্চলে , ওই অঞ্চলের ভাষাতেই সেই ধর্ম গ্রন্থ রচিত। অতীতে কোন এক সময় সমাজপতীরা বাধ্য হয়েছিল গরু খাওয়া নিষিদ্ধ করতে । আর নিষিদ্ধকরণ যেন সবাই মেনে চলে তাই এতে ধর্মের রঙ লাগিয়ে দেওয়া হয়। বুঝলি ?
রুপা চুপ করে থাকে। কিছু বলেনা।
-শোন মা ,আমি চাইবো কয়েকটি জিনিস তুই সারা জীবন মেনে চলবি। যেমন ধর, কোনদিন গরুর মাংস খাবিনা। ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে ঘৃণা করবি না। আর বিয়ের আগে কুমারিত্ব হারাবি না।
রুপা বুঝতে পারে ওর কান গরম হয়ে উঠছে।


স্কুল হতে ফেরার পথে রুপা লিজাকে জানায় , প্রতীক , সংকেত ,যোজনীতে ওর সমস্যা হচ্ছে।
-শোন, ভাইয়া এই বিষয়গুলি খুব ভালভাবে বোঝাতে পারে। সন্ধ্যায় আসিছ।
সন্ধ্যায় রুপা লিজাদের বাসায় যায়। লিজা ওকে নিয়ে পাপ্পুর ঘরে ঢুকে।
-পড়ার সময় আমার ঘরে কেন তোরা ? যা ভাগ।
-ভাইয়া , একটা পড়া বুঝিয়ে দে।
-কি পড়া ?
রুপা খুব সহজেই সবকিছু বুঝতে পারে। আর মনে মনে স্বীকার করে , পাপ্পু শিক্ষক হিসেবে খুব ভাল। পড়া শেষ হলে রুপারা চলে আসে। পাপ্পু আর পড়ায় মন বসাতে পারেনা। একটা জিনিস পাপ্পু খেয়াল করে , রুপার শরীরে অদ্ভুদ এক ঘ্রাণ আছে। কেমন ঘোর লেগে যায়।

দীপা এবার বাড়িতে এসে ছোট বোনের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করে। কিন্তু বুঝতে পারেনা পরিবর্তনটা ঠিক কোথায় ঘটেছে। দীপা বাবাকে বিষয়টা জানায়। মোহন সাহেব হেসে উড়িয়ে দেন। জানান , রুপা সারাদিন একা একা থাকে ,তাই এমন লাগছে হয়তো। কিছুদিন দুইবোন চুটিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ায়। ছুটি শেষে দীপা রাজশাহী চলে যায়।

কলিং বেলের শব্দ পেয়ে পাপ্পু দরজা খুলে দেয় । দেখে রুপা দাঁড়িয়ে। পাপ্পু দরজা হতে সরে দাঁড়ায় । লিজা ভেতরে আসে।
-খালাম্মা নেই ?
- আম্মা নিউ মার্কেটে গিয়েছেন।
-লিজা গ্রাম থেকে কবে আসবে ?
-আগামী শুক্রবার।
-আমি লিজার ঘরে গেলাম।
-যাও।
রুপা লিজার ঘরে আসে। এটা ওটা নাড়ে। ওর মন চাইছে পাপ্পুর কাছে যেতে কিন্তু লজ্জা লাগছে। কিছুক্ষণ পর পাপ্পুর আম্মা বাড়িতে ফেরেন।
-রুপা মা , কতক্ষণ?
-এই একটু আগেই।
-খেয়ে যাবে তুমি।
-ঠিক আছে।
ওই দিন রাতে পাপ্পু অন্যরকম এক স্বপ্ন দেখে। ধু ধু এক বালুচরে ও দাঁড়িয়ে আছে। একটি শাড়ি পড়া মেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছেনা। পাপ্পুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। আলো জ্বেলে পানি খেয়ে শুয়ে পড়ে। আর ঘুম আসেনা ওর।ও টের পায় ঘরময় একটা সুন্দর গন্ধ। কিছুক্ষণ পর ফযরের আযান পড়ে। পাপ্পু উঠে নিজেকে তৈরি করে। আব্বাকে সাথে নিয়ে নামায পড়তে যায়।

১৬/০২/২০১৭

ময়মনসিংহ







মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.