নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

i blog/therefore i exist

অচিন্ত্য

"জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ"

অচিন্ত্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রতিদ্বন্দ্বী

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১০:২১

প্রতিদ্বন্দ্বী
:::
বন্যা এবং অনিশ বাবু দু’জনকেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনন্য অস্থির হয়ে হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করছে। অপারেশন থিয়েটারটা ইমার্জেন্সির পাশেই। সেখানে কিছুক্ষণ পরপর বীভৎস সব কেস আসছে। কাছেই কোথায় যেন মারাত্মক একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আহতদের অনেকে চোখের সামনেই মারা যাচ্ছে। এসব দৃশ্য অনন্য সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এমন যদি হয় যে সহ্য করতেই হবে ? অনিশ বাবু যদি অপারেশন থিয়েটার থেকে আর না ফেরেন ? বাইরে অপার্থিব জ্যোৎস্না ফুটেছে।
সেদিনও এমন জ্যোৎস্না ছিল
তোমার কিছু কথা তোর বুকেও জমা ছিল
সন্ধ্যা নেমে এলে দূর সাগর কেঁদেছিল
পায়ের আলপনা সৈকতের বুক জুড়ে
ভাটার গাঙচিল দৃশ্য চোখে যায় উড়ে
জানা তো হয়নি পায়ের ছাপ জোয়ার মুছেছিল কিনা
শোনা তো হয় নি সাগর জল কী গান গায় মনে মনে
শুধু জেনেছিলাম সেই সন্ধ্যানীল পটভূমির প্রচ্ছদে
বৃষ্টি হবে বলে কোন সুদূর পরবাসে
মেঘের পরে মেঘ হায় কোথাও জমেছিল
না, জোয়ার পায়ের ছাপ মুছতে পারে নি। জমা মেঘ জলও হয়েছিল। তাই দুঃসাহসী শুরুটা সমাজ-লোকের চোখ-সবকিছু উপেক্ষা করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল। অনন্য’র দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অনীশ বাবু প্রথমে রিএ্যক্ট করলেও শেষতক মেনেই নেবেন।
:::
হিল টাউন। মহাসড়কের পাশেই শংখ নদীর কোল ঘেঁষে ছোট্ট জনপদ। হাইওয়ে থেকে একটিমাত্র এন্ট্রেন্স। এন্ট্রেন্সে লোহার গেট। পাশেই একটা সিকিউরিটি ক্যাম্প। গেটটা অনেক রাত অবধি খোলা থাকে। ভোরের আলোয় যখন টাউনটা জেগে ওঠে, গেটটাও রাতের আড়মোড়া ভেঙ্গে সরব হয়। ক্যাম্পের সামনের রাস্তাটায় ঝাড়ুর আঁচড় পড়ে। পেপারওয়ালা ছেলেটি পেপার নিয়ে ক্যাম্পের পাশে একটা বেঞ্চে এসে বসে। ব্যাংকের বারান্দায় শুয়ে থাকা কুকুরটি ঘুমো চোখে বার দু’এক এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার শরীরের ওমে মাথা ডুবিয়ে দেয়। বাংলা লিংকের অফিসের পাশের গলিতে গোটা ছয় বয়স্ক ব্যক্তি প্রাত ভ্রমণে বের হন। রোদ কিছুটা চড়লে কর্মজীবী মানুষেরা অফিসমুখো হয়। মহাসড়ক থেকে গেটের ভেতর দিয়ে তাকালে নানা শ্রেণীর মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য একই পথে দেখা যায়। অফিসমুখী, গার্মেন্টসমুখী মানুষ গেটটা পার হয়ে মহাসড়কের কিনারে এসে দাঁড়ায়। ছোট্ট জনপদটিতে শুরু হয় অবিরাম জীবন প্রবাহ।
পেপারওয়ালা ছেলেটির খোঁজে ক্যাম্পের সামনে থামে অনন্য। ছেলেটিকে দেখা যাচ্ছে না। আজ মঙ্গলবার। প্রথম আলোর নকশার দিন। একটা পেপার নিতে হবে। গিন্নীর সাপ্তাহিক বায়না। সাধারণত পেপার কেনা হয় না। নেটেই পড়া হয়। এক মাস ধরে নেট কানেকশন নেই। অফিস থেকে টেলিটকের মোডেম দেওয়া হয়েছে। এখানে টেলিটকের নেটওয়ার্ক অত্যন্ত দুর্বল। কানেকশন চেঞ্জ করার জন্য অ্যাপ্লাই করেছে অনন্য। অ্যাপ্লিকেশন একমাস ধরে প্রক্রিয়াধীন। একেই বলে সরকারি জায়গা। পরক্ষণেই ভাবনার মোড় ঘুরে যায়। বিচিত্র মানুষের মন ! কিছুদিন আগেও জীবন জীবিকা ছিল অনিশ্চিত। আর এখন চাকরির এক্সট্রা ফ্যাসিলিটির খুঁতগুলোও চোখে লাগছে। ভাবনার রেশ কাটতে না কাটতেই অফিসের গাড়ি এসে দাঁড়ায়। অনন্য দৌড়ে গাড়িতে উঠে যায়। পেপার কেনা হয় না।
:::
ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। কাঁথার ভেতর অনন্যর আলসেমী জমে উঠেছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে অনন্য ক্যান্টিনমুখো হবে কিনা ভাবছে। সকালের নাস্তার সময়টা আজকাল দশটার কাছাকাছি এসে ঠেকেছে। কিন্তু এখন কয়টা বাজে ? অনন্য ঘড়ি ব্যবহার করে না। ফোনের স্ক্রিনটাও হাত থেকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এটা অনন্য’র তৃতীয় ফোন। দেখতে দেখতে হাতে হাতে ফোন চলে আসছে সবার। দারুণ ব্যাপার ! ধীরে ধীরে পোস্টাল সার্ভিসের একেবারে আকাল পড়ে যাচ্ছে। পোস্ট অফিস ! রাইট। বাবা মানি অর্ডার করেছে। খোঁজ নিতে হবে। পোস্ট অফিস আসলে এখন একটা নস্টালজিক ব্যাপার। যেমন নস্টালজিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে ক্যাসেট প্লেয়ার জিনিসটা। সেই লাল রঙের টু ইন ওয়ানটা। কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আয় খুকু আয়-দ্যা ফাদার। দারুণ ফিল্ম। ফাদার-পিতা-বাবা। ছোটবেলা। একটা ছোট্ট উঠান। মা চুলায় ভাত রান্না করছে। সন্ধ্যায় বাবা গীতা থেকে ব্যাখ্যা করছে। নিষ্কাম কর্ম। রামকৃষ্ণ - যত মত তত পথ।
আড়মোড়াটা যে আবার একটা ঘুমের আকার নেবে এটা আশা করেনি অনন্য। সকালের নাস্তাটা এখন আর পাওয়া যাবে না। কয়টা বাজে জানতে না পারলেও এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে যে দুপুরের খাবার সময় হয়ে এসেছে। নাহ, আর নয়। মহুয়াতলায় যেতে হবে। লোকজন এসে পড়েছে মনে হয়।
বিকেলে বন্যার সাথে টিএসসি’র দিকে ঘোরাঘুরির প্ল্যান ছিল। কিন্তু এদিকে আবার মুশকিল হয়েছে। ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামে নাটকের প্রপস কেনার জন্য যার যাওয়ার কথা ছিল সে যেতে পারছেনা। তার জায়গায় অনন্যকে যেতে হচ্ছে। বিকেলের ঘোরাঘুরির প্ল্যানটা শেষ পর্যন্ত ক্যানসেল করে দিতে হল। ভালই হল। মনটা খুব একটা ভাল নেই অনন্য’র। প্রোগ্রামের আর তিন দিন আছে। এখনো ছেলেপেলে রিহার্সালে সিনসিয়ারলি প্রেজেন্টই হচ্ছে না। যে কয়জন এসেছিল তাদের নিয়েই প্র্যাকটিস করছিল অনন্য। প্র্যাকটিস এর মাঝখানে অনীশ বাবুর ফোন। অনন্য ফোনটা ধরেই বলতে যাচ্ছিল যে পরে কথা হবে। অনীশ বাবু তাকে শেষ করতে দিলেন না। তিনি কীভাবে যেন জানতে পেরেছেন তার ছেলে বিফ খেয়েছে। অনন্য অনেক চেষ্টা করল তাকে বোঝাতে যে এ বিষয়ে পরে সে নিজেই কথা বলত। এখন প্রোগ্রামের রিহার্সাল চলছে। অনীশ বাবু সে কথায় কান দিলেন না। অনন্যকে বাধ্য হয়ে রিহার্সালটা সেখানেই শেষ করে দিতে হল।
রিহার্সাল মাঝপথে শেষ করার জন্য নয়, অনন্য’র মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল আরেকটা কারণে। বিফ খাওয়া যে নিষিদ্ধ কিছু নয় একথা সে বাবার কাছ থেকেই শিখেছে। অথচ এই বিষয়টা নিয়ে বাবা আজ এতটা সিরিয়াস ! অনন্য ঠিক মেলাতে পারে না।
:::
What’s on your mind?
সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে শ্রাবণের এক মেঘলা সকালে ২০ মাস পর আবার অফিস অভিমুখে বাসা থেকে বের হলাম। দিনটা ছিল অসম্ভব সুন্দর। মেঘে মেঘে আকাশের গ্যালারি ভরে উঠেছিল। মাঝ মাঠে আমি। আমি আর একা নই। পথে বেরিয়েছি। কিছুক্ষণ পরেই নতুন মানুষ, নতুন মুখগুলোর সাথে দেখা হবে।
:::
ক’দিন ধরে বন্যার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। আসলে এই পরিবেশটা তাকে স্যুট করেনি। ছোটবেলা থেকে সতেজ সবুজ পরিবেশে বড় হয়েছে। কিন্তু এখন এই অন্ধ গলির বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এমাসে অলরেডি তিনবার ডাক্তার দেখানো হয়ে গেছে। অনন্য’র খুব অসহায় লাগছে। আবার যদি ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে কারো না কারো কাছে ধার করতে হবে। কার কাছে ধার করবে অনন্য ? বন্ধু বান্ধব কেউ তো বাকি নেই। চাইলে অবশ্যই না করবে না। কিন্তু কত চাওয়া যায় ? নিজের কাছে খুব খারাপ লাগে। এখনো অর্ধেকটা মাস পড়ে আছে। হাতে টাকা পয়সা যা আছে তা দিয়ে কীভাবে যে মাসের বাকি দিনগুলো গুজরান হবে উপরওয়ালাই জানেন। অনন্য’র দুশ্চিন্তা হয়, আর বন্যা মনে মনে বলে- আল্লাহ, এ মাসে যেন আর অসুস্থ না হই।
উপরওয়ালাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তিনি সব সময় তা শোনেন না। তাই বন্যার প্রার্থনা বিফল করে দিয়ে আবারো প্রচণ্ড জ্বর এসে সারা গা কাঁপিয়ে দিল। এবারের জ্বরটা সত্যিই ভয়াবহ। একশ চার। সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি। এখন রাত সাড়ে দশটা। বন্যা অস্থির হয়ে উঠেছে। কোন প্রবোধই মানছে না। জ্বরের ঘোরে অসংলগ্ন কথা বলছে। অনন্য’র জীবনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নিয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে নিতান্ত কাঁচা। অনন্য ঠিক করতে পারল না এই মুহূর্তে বন্যাকে সম্পূর্ণ একা রেখে কোন একটা রিক্সার খোঁজে বের হবে, নাকি বৃষ্টি থামার আশায় আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। অবশেষে এক প্রতিবেশীর সহায়তায় কোনরকমে কাছেই একটা ফার্মেসিতে পৌঁছা গেল। কিন্তু হায় ডাক্তার সাহেব ততক্ষণে চলে গেছেন। বন্যার অসংলগ্ন কথা চলছেই। ফার্মেসির রোগীর বেডে ওকে শুইয়ে রেখে অনন্য বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে পড়ল। তাকে একজন ডাক্তার খুঁজে বের করতে হবে।
:::
সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অনন্য পিসিতে একটা কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। এমন সময় বাড়ি থেকে ফোন। অনীশ বাবু ভীষণ অসুস্থ। অনন্যকে বাড়ি আসতে হবে। অনন্য বাড়ি ছুটে গেল। বাসায় বন্যা একা। কিন্তু কী-ই বা করার আছে। বাড়ি গিয়ে দেখা গেল অনীশ বাবুর অবস্থা সত্যিই নাজুক। কোন খাবারই খেতে পারছেন না। শরীর খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। উপজেলা সদর হাসপাতালে পাঁচ দিন চিকিৎসার পরও অবস্থার উন্নতি না হওয়াতে অনন্য বাবাকে নিয়ে ঢাকা চলে এল। অনীশ বাবু অনন্য’র বাসায় উঠতে রাজি হলেন না। তাকে নিয়ে আসা হল অনন্য’র বোনের বাসায়। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন টাইফয়েড, জন্ডিস এবং লাংস কনসলিডশন একসাথে এটাক করেছে। অনীশ বাবুকে ভর্তি করা হল ক্লিনিকে। অনন্য দিনের বেলায় অফিস করে, রাতে ক্লিনিকে।
চিকিৎসা চলছে। কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। এমন এক দিনে অনীশ বাবু অনন্যকে ডেকে বললেন- আমার অসুস্থতা শরীরে নয়, মনে। তুইই পারিস আমাকে সুস্থ করে তুলতে। অনন্য জানে এর মানে কী। অনন্য বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, আগে তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন, তারপর দেখা যাবে। একথায় অনীশ বাবু অধৈর্য হয়ে ওঠেন। তিনি বারবার তাকে বলেন যেদিন তাদের সেপারেশন হয়ে যাবে সেদিনই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। অনন্য বোঝানোর চেষ্টা করে, ব্যাপারটা শুধুমাত্র একপক্ষের চাওয়াতেই হবে না। এর একটি আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। সে বাবাকে বলে যে বন্যাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। বন্যা রাজি হলেই সেপারেশনের প্রক্রিয়ে শুরু করবে। কিন্তু এসব কথায় অনীশ বাবু আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি অনন্য’র চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে তার কাছে পিতা নয় স্ত্রীই বড়। অনন্য অসহায় বোধ করে। সে একবার তার বাবাকে বোঝায় তিনি যেন আর কিছুদিন ধৈর্য ধরেন, আরেকবার বন্যাকে বোঝায় বাবা মা’র দিকে তাকিয়ে তাদের সেপারেশনটা দরকার। কেউ তার কথা শোনে না।
দিনে দিনে অনীশ বাবুর আচরণ অতি মাত্রায় অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। তিনি প্রায় প্রতিদিন বন্যাকে ফোন করে খুন করার হুমকি দিতে লাগলেন। অনন্য বাবকে বোঝায় – তুমি এখন মানসিকভাবে অস্থির হয়ে আছ। তাই তোমার কথা আমি এখন না, পরে শুনব। জবাবে অনীশ বাবু বলেন- তুই আমাকে মানসিক রোগী প্রমাণ করতে চাস যেন আদালতে আমার সাক্ষ্য না নেয়। অনন্য এর মাঝে একদিন বাসায় যেতে চাইলে অনীশ বাবু তীব্রভাবে নিষেধ করেন। তিনি তাকে বলেন এই মুহূর্তে অনন্যকে চাকরিতে ইস্তফা দিতে হবে, না হলে তার মরা মুখ দেখতে হবে। অনন্য তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনা পরম্পরার কোন কার্য-কারণ খুঁজে পায় না।
:::
ডিয়ার মারুফ
তোর মেইল পেয়েছি বেশ কয়েক দিন আগে। বিলম্বে উত্তর দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমরা এক রকম আছি। চাকরি ছাড়ার পর আয় সংকোচনের কারণে আমরা বাসা বদল করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু এই বাসাও ছেড়ে দেওয়া দরকার। কারণ বাসায় ওঠার চার মাস পর মালিক পাঁচশ টাকা, আট মাস পর আরো পাঁচশ টাকা বাড়িয়েছে। এবং এই জানুয়ারিতে আরো পাঁচশ টাকা বাড়ানোর কথা বলেছিল। অনুরোধ করে এখনো পর্যন্ত থামিয়ে রেখেছি। নতুন বাসা খুঁজে চলেছি। নতুন বাসা খুঁজতে গিয়ে যে সমস্যাটির মুখোমুখি হচ্ছি তা হল এই, মালিক প্রথমেই জানতে চায় আমি কী করি। প্রথম প্রথম আগের চাকরির কথা বলতাম। কতদিন বলা যায়। ছোট্ট কমিউনিটি। সবাই দেখে আমি সারাদিন বাসায়ই থাকি। আমি বেকার শুনে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। জানিনা এভাবে কতদিন চলবে। ইন্টারভিউ এর রেজাল্ট এখনো দেয়নি। একটা পজিটিভ রেজাল্ট আমার খুব দরকার।
চাকরি ছাড়ার বিড়ম্বনা শুধু এটুকুই নয়। টাকা এবং পজিশন দিয়েই মানুষ মানুষকে বিচার করে। আমার বেকার জীবন শুরুর পর আমার প্রতি বাড়িওয়ালার আচরণে পরিবর্তন এসেছে। বাড়িওয়ালা এখানে থাকেনা। মাসে একবার করে খবর নিয়ে যায় আর বাসা ভাড়াটা নিয়ে যায়। কয়েকদিন আগে এসে বলল যে সে একটু দৌড় এর উপর আছে, আজ রাতেই তাকে আবার চলে যেতে হবে। আমি যেহেতু বাসাতেই আছি আমি যদি একটু কষ্ট করে এ মাসের বিদ্যুৎ বিলটা কোন এক সময় দিয়ে আসি তার খুব উপকার হয়। এমন ভদ্র ভাষায় বললে না-ও করা যায় না। কিন্তু বিষয়টা কী দাঁড়াল ? বাড়িওয়ালা আমাকে দিয়ে তার কাজ করাচ্ছে। পাশের ফ্ল্যাট খালি হয়েছে। টুলেট টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়িওয়ালা আমাকে অনুরোধ করে বলল সেই ফ্ল্যাটের চাবিটা যেন নিয়ে রাখি আর কেউ বাসা দেখতে এলে যেন তাকে বাসাটা দেখাই। বিদ্যুৎ বিল দিয়ে এলাম। কয়েকদিন ধরে আমাকে বাড়ি ভাড়া নিতে আসা লোকজনকে বাসাটা দেখাতে হচ্ছে আর তার আপডেট বাড়িওয়ালাকে জানাতে হচ্ছে। প্রতিবারই বাড়িওয়ালা অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আর আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে এই কথা বলে। কিন্তু কী এসে গেল। আমারও না করার উপায় নেই। কারণ, আমি আসলেই বাসাতেই থাকি, তাই তার অনুরোধ উপেক্ষা করাটা তার সাথে সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে। আর তা হলে অনুরোধ করে যে ভাড়া বৃদ্ধিটা আটকে রেখেছি সেটাও দুর্বল হয়ে পড়বে। শুধু তাই না। মাঝে সাঝেই পানির সমস্যা হয় বলে বাড়িওয়ালা একটা অতিরিক্ত মোটর লাগিয়ে দিয়েছে। সেদিন আমাকে নতুন মোটরের সুইচটা দেখিয়ে দিয়ে বলল পানির সমস্যা হলে যেন সেটা অন করে দেই। এই কাজটাও আমাকে কয়েকদিন করতে হয়েছে। চাকরি থেকে ইস্তফা শেষ পর্যন্ত আমাকে বাসার কেয়ারটেকারে পরিণত করল ! অপেক্ষা কবে শেষ হবে জানি না।
অনন্য
:::
সবার খুব মেজাজ খারাপ। বাস আসার কথা সন্ধ্যা সাতটায়। এখন বাজে সাড়ে আটটা। এখনও নাকি আরো আধা ঘণ্টা লাগবে। প্রিপারেশন কমপ্লিট। কমপ্লিট না হয়ে উপায় নেই। অনন্য তার বন্ধুদের নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে শপিং করেছে। সি বিচে পরার জন্য আলাদা পোষাক, ছেঁড়া দ্বীপের জন্য আলাদা পোষাক, ব্যাক প্যাক, ট্রাভেল ব্যাগ, চুরুট থেকে শুরু করে হেন কিছু আর বাদ নেই। অপেক্ষার পালা সাঙ্গ করে বাস আসে। সারারাত ধরে সমুদ্রের দিকে ছুটতে থাকে। সমুদ্র ভ্রমণ শেষে অনন্য’র ডায়েরিতে শব্দ ভর করেঃ
তখন শেষ রাতে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। সাগরের কাছে আকুল হয়ে জানতে চেয়েছিলাম বাঁচতে চাওয়ার মানে। মাথার উপর ‘অবকাশ’ এর ছাউনি। পেছনে ফেলে আসা বিগত অধ্যায়। সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত কাব্য- সমুদ্র সংশয়।
সময় গেছে স্থির হয়ে। মনে পড়ছে বিস্মৃতির অতল গহীনে তলিয়ে যাবার আগের সর্বশেষ অসমাপ্ত কবিতা; সবুজ গন্ধের দিন, অচেনার গাম্ভীর্যে চেনা মুখ, সংশয়ের সমুদ্রস্নান। ভেতরের অধীর নির্লিপ্তি আর বাইরের সাগরের গর্জনে আমি হই দ্বিখণ্ডিত। এই নিবিড় তমিস্রায় ডুবে যেতে থাকে অনুভবের ভগ্নাংশ।
সাগর তুমি কি জান আত্মপ্রবঞ্চনার নাম প্রতারণা কি না? তুমি বলে দাও কোথায় লুকিয়ে থাকে এত আর্তনাদ। কোন মরুতে উধাও হয় বর্ষার সহস্র জলধার? তুমি দেখেছ কি শুকিয়ে যাওয়া তিন ভাগ জল? তুমি কি জান কতটা দূর গেলে দূরত্ব ঘোচে? চোখ দু’টো খুব পোড়ায়। তোমার জলে ধুয়ে দেবে? তোমার বিশাল বুকে আমায় একটু জায়গা দেবে? তুমি বলে দাও বাঁচতে চাওয়ার মানে।
বসন্তের প্রথম দিন, প্রথম অনুভব, প্রথম দীর্ঘশ্বাস- প্রবোধ না প্রবঞ্চনা? সাগর কোন প্রবোধ দেয়নি। জানতাম দেবে না। আমি জানতাম ক্রমশ একলা হলে লুকোচুরি ঘুচবে। আমি জানতাম সাগর আমাকে একাকীত্বের অসীম অনুভবের ভেতর আবার টেনে নিয়ে যাবে। যাবেই তো। তোমার কথা কিছু তোর বুকেও তো জমা ছিল।বসন্তের রাত কতই বা দীর্ঘ হয়। চাঁদ ঝাপসা হয়। আমার থেকে আমি হই অন্তরীন। সেট সাজতে থাকে। আমি মে’ক আপ নেই পরের দৃশ্যে শট দেয়ার জন্য।
“কি খুঁজি মানুষের বিষাদের চোখে
কোথায় আলোর উৎসবে স্বপ্নের প্রতিবিম্ব ভাঙ্গে
একা একা আমি থাকি দাঁড়ায়ে
স্মৃতির ঝড়ো বাতাসে দু’জনার শরীর মেশাই”
:::
অনন্য বাসার কলিং বেল বাজায়। ভেতর থেকে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা ভেসে আসে- কে ? আমি অনন্য। বন্যা দরজা খুলে দেয়। বন্যার দিকে তাকিয়ে অনন্য’র খুব কষ্ট হয়। এরকম একটা ভুতুড়ে বাসায় একা একা মাসের ওপর হল থাকছে। এই ক’দিনে তার স্বাস্থ্য ভেঙে চোয়াল বেরিয়ে এসেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। দৃষ্টি উদভ্রান্তের মত হয়ে গেছ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কারো কাছে তার কোন চাওয়া নেই। কোন অভিমান নেই। নেই কোন অভিযোগ।
অনন্য দ্রুত হাতে এফিডেভিট এর কাগজ বের করে। এই কাগজে অনন্যা সাইন করে দিলেই তাদের সেপারেশন হয়ে যাবে। অনীশ বাবু বলেছেন সাইন না নিয়ে এলে তার মরা মুখ দেখতে হবে। সাইন করার পর অনন্যা কোথায় যাবে ? বাবার বাড়ি থেকে তো তাকে অনেক আগেই ত্যাগ করা হয়েছে। সে কি এই বাড়িতেই একা একা থাকবে ? কত দিন থাকবে ? না, সে রাস্তাও তো বন্ধ। বাড়িওয়ালাকে অনন্য জানিয়ে দিয়েছে বাসা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছ। অনীশ বাবু বলেছেন বাসা ছাড়ার কথা না বললে তিনি গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবেন।
বন্যার সাইন এর জন্য অনন্য কলম বের করে। বন্যা উঠে কিচেনে চলে যায়। অনন্য ঠিক বুঝতে পারে না এই মুহূর্তে কিচেনে কী কাজ থাকতে পারে। এই ফাঁকে ডাইনিং টেবিলে একটু নজর বুলিয়ে নেয় অনন্য। এক নজর বুলিয়েই বোঝা যাচ্ছে বন্যা কোন রকমে পাউরুটি, কলা, চানাচুর এসব খেয়ে দিন পার করছে। অনন্য’র বুক ব্যথা করে ওঠে। বন্যা কিছুক্ষণ পর একটা কেক হাতে ফিরে আসে। কিছুটা অংশ হাতে করে অনন্য’র মুখে তুলে দিয়ে বলে- হ্যাপি বারড্ডে। বলতে বলতে কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।
:::
হাসপাতালের কোলাহল, করিডোরে ডাক্তার নার্সদের ছোটাছুটি, বাইরের অপার্থিব জ্যোৎস্না, - সব একটু একটু করে উধাও হয়ে যায়। অনন্য’র দৃষ্টি অপারেশন থিয়েটারের দরজা ভেদ করে ভেতরে চলে যায়। পাশাপাশি দু’টো অপারেটিং বেড ধীরে ধীরে দু’টো রেসিং ট্র্যাকে পরিণত হয়; একটা পৌঁছে গেছে পৃথিবীর এন্ট্রেন্সে, আরেকটা এক্সিটে। দুইজন দৌড়াচ্ছে। প্রবল বেগে দৌড়াচ্ছে; একজন আরেকজনের আগে প্রান্তে পৌঁছে যাবে বলে।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১১:৩৯

গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: অনেক দিন পরে এলেন ! আগমনী বার্তাটাও দিলেন চমৎার লেখনিতে ।
ভালো লাগলো ।

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১০:৪৭

অচিন্ত্য বলেছেন: ধন্যবাদ

২| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ২:১৭

স্নিগ্ধ শোভন বলেছেন:

অনেক দিন পর। কেমন আছেন?
পোষ্টের কথা পরে এসে বলছি।

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১০:৪৭

অচিন্ত্য বলেছেন: বেশ আছি। আপনি?

৩| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৪

কলমের কালি শেষ বলেছেন: চমৎকার গল্প ।

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১০:৪৮

অচিন্ত্য বলেছেন: ধন্যবাদ

৪| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৮

হাসান মাহবুব বলেছেন: লেখার ভঙ্গি অবশ্যই পাঠককে সতর্ক করে দেয় বাড়তি মনোযোগের সাথে পাঠের। শুরুর শেষ আর শেষের শুরুর মাঝে ঝুলে থাকে মনুষ্য রক্তপিন্ড। ধরিত্রী মায়ের দৃষ্টিতে দুটোই তার সন্তান, জাত-কুলের ভেদাভেদ নেই। ভালো লাগলো গল্পটা। প্লাস। এত দেরীতে পড়ার জন্যে আমাকে মাইনাস।

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:২৩

অচিন্ত্য বলেছেন: প্লাসে মাইনাসে কাটা :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.