নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইকবাল সুমন

"ঘোড়ার ডিমের খোঁজে নয়, ডিমওয়ালা-ঘোড়ার খোঁজে...

ইকবাল হোসাইন সুমন

আমি ইকবাল সুমন। মাঝে মাঝে টুকটাক লিখা লিখি করি। এছাড়া কোন কিছু করি না।

ইকবাল হোসাইন সুমন › বিস্তারিত পোস্টঃ

রম্য রচনা‬

৩০ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫২

আব্দুসসামাদ‬
‪‎৪র্থ খণ্ড‬
(নিচে অন্য পর্বগুলোর লিঙ্ক দেয়া আছে)

খাদিজা খালাকে হাসপাতালে নিয়ে ঢুকার পূর্ব মুহূর্তে প্রায় আঁতকে উঠার অবস্থা। দেখি ঋতু আমার সামনেই হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে। গত ২ বছর তার সাথে আমার একবারও দেখা হয়নি। আমি দেখা করার চেষ্টা করিনি, সেও না। ঋতুর সাথে যেদিন আমার লাস্ট দেখা হয়, সেদিন ও আমার মেসে প্রথম এবং শেষবারের মত এসেছিল। আমরা কলিগরা মিলে একটা ফ্ল্যাটে ৩ জন থাকতাম। অনেক মজা করছিলাম সেদিন। ঋতু যে এত মজার এতগুলো বছর আমি আগে কখনোই টের পাইনি। ঋতু সেদিন আমাদের ৩ জনের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। চা খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে সে সবার সামনে আমাকে বলে উঠে, “তোমার সাথে আজকে থেকে আমার সব সম্পর্ক শেষ, মৃত্যু ছাড়া তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না। আমি মরলে তুমি আমাকে দেখতে আসবে, তুমি মরলে আমি তোমাকে দেখতে যাব।“

আমি হাসিমুখে বলেছিলাম, “ঠিক আছে”
ঋতু বলেছিল, “আমি কি চা’টা খেয়ে যাব?”
আমি বলেছিলাম, “অবশ্যই খেয়ে যাবে। চা’টা অনেক ভাল হয়েছে”

সেই থেকে ২ বছর পরে ঋতুকে আজ আবার দেখলাম।

আমরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামতেই ঋতু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “খালা কি মারা গেছে?”
আমি বললাম, “না, এখনও মরেনি”
ঋতু বলল, “আমি আগেই ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিয়েছি। আগে জরুরী বিভাগে নিতে হবে। তারপর ক্যাবিনে”।

খাদিজা খালার হাসপাতালে ভর্তির যাবতীয় কাজগুলো ঋতু মোটামুটি আধাঘণ্টার মধ্যে করে নিলো। আমি শুধু চেয়েচেয়ে দেখলাম, কিছু বললাম না।
ডাক্তার বলল খাদিজা খালার তেমন কিছু হয়নি। ২/১ টা স্যালাইন দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। মোটামুটি ২ দিনের মত হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হবে।

হাসপাতালের ক্যাবিনে খাদিজা খালা তখন ঘুমচ্ছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঋতু আস্তে আস্তে হেঁটে আমার কাছে আসলো। এসেই বলল, “তারেক যখন আমাকে খবরটা দিল, আমি ভাবছিলাম তুমি মারা গেছ। শুনেই খুব পুলকিত অনুভব করছিলাম। ভাবলাম, আহ! কতদিন পরে তোমাকে দেখব। কিন্তু পরে শুনলাম উল্টা, শুনলাম তুমি মর নাই। তখন মনটাই খারাপ হয়ে গেল”।
আমি ঋতুকে বললাম, “মানুষের মৃত্যুর মধ্যে একটা দুঃখ দুঃখ ভাব থাকলেও, বেশ আনন্দও আছে। অনেক মানুষ তাদের শত্রুর মৃত্যুর পর হৃদয় কোমল হয়ে যায়, তখন সে তার শত্রুকেও দেখতে আসে। আমি তোমার শত্রু না হলেও, শত্রু থেকে কম না। তুমি আসছ ভালই হয়েছে। তুমি এদিকটা দেখ। আমার গ্রামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। গ্রামে এক ভয়ানক চোর ধরা পড়েছে। বিকেলে তার কঠিন বিচার করতে হবে”
- সে নিয়ে তোমাকে টেনশন করতে হবে না। খাদিজা খালা মরলে জানাজা পর্যন্ত আর বাঁচলে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমার। সে পর্যন্ত আমি হাসপাতালে থাকব। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, সাফ সাফ উত্তর দেবে। চোর কি সত্যি ধরা পড়েছে?
- ধরা পড়েনি মানে, একদম হাতেনাতে ধরা পড়েছে। এই এক ভয়ঙ্কর চোর। সাত গ্রামের মধ্যে এই ধরণের চোর দেখা যায় না।
"আমি আবার জিজ্ঞাসা করছি, চোর কি সত্যি সত্যি ধরা পড়েছে?" ঋতু এবার আমাকে কঠিনভাবে জিজ্ঞাসা করল।
আমি বললাম, "না, এখনও ধরা পড়েনি। তবে ধরা পড়বে। নির্ঘাত ধরা পড়বে"

ঋতু আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ কিছু বলল না। এরপর বলল, “চোর ধরা পড়ুক আর না পড়ুক, বিকেলে আমার জন্য একটা রিক্সা ব্যবস্থা করে রাখবে। আমি তোমার গ্রামে যাব। আমি চোরের কঠিন বিচার দেখব।

আমি জানি, ঋতুকে নিষেধ করা আর না করা এক কথা। তাই কিছু বললাম না, চুপ মেরে থাকলাম।

ঋতু আমাকে হাসপাতালে থাকতে দিল না। বলল, “খালা এখানে মরে-বাঁচে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। তুমি চোরকে কঠিন শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা কর। একাধিক চোর হলে ভাল হয়। ওখান থেকে একটা চোর আমার হাতে ছেড়ে দেবে। খবরদার তার গায়ে যেন কেউ হাত না তুলে। চোর মারা আমি একদম পছন্দ করি না। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত খায়েস ছিল নিজ হাতে একটা চোর পেটাবো। তার পিঠের চামড়া উঠা পর্যন্ত পেটাবো। চিন্তা করেছ, কি সুন্দর দৃশ্য হবে! গ্রামের মানুষরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। ভাবতে পারো, ব্যাপারটা কি রকম অসাধারণ হবে! আমার তো চিন্তা করে এখনই নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে”

বিকেল ৩ টার দিকে আমি বাড়ি এসে পৌঁছলাম। দেখি, আগেই জালাল মিয়াঁ এসে বসে আছে। আমার তাকে দেখেই বিরক্ত লাগলো।
- আব্দুসসামাদ, তুমি আসছ! আমি তো চিন্তায় অস্থির! চোরের কি ব্যবস্থা করছ? স্কুল মাঠে তো ইতোমধ্যে মানুষ জড়ো হতে শুরু করেছে। সবাই আমার নামে গুণগান গাইতেছে। মিছিল পর্যন্ত করতেছে। কিন্তু যদি সময়মত ওরা চোর না পায়, তাহলে আমাকে ধরে এরা কি করবে, সেটা তোমার ধারণার বাইরে। একদম মেরেই ফেলবে।
“কিসের চোর?” আমি জালাল মিয়াঁকে জিজ্ঞাসা করলাম।
- কি বলছ এসব! আমি তো তোমার কথার উপরে আস্থা রেখেই মাইকে চোর ধরা পড়েছে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। তুমি শুনোনি?
- আমারে এসব কথা বলে লাভ নাই মিয়াঁ। আমি এসব কিছু জানি না। আপনার চোর আপনি কোথায় থেকে ধরে নিয়ে আসবেন সেটা আপনি জানেন! আমাকে শুধু শুধু ডিস্টার্ব করবেন না তো! খাদিজা খালারে নিয়া এমনিতেই অনেক চিন্তায় আছি। কখন বাঁচে-মরে ঠিক নেই। যান তো এখন এখান থেকে। আর একটা কথা শুনেন, “এই সব কথা যদি আবার বলতে আসেন, আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় আর আপনাকে ঘেঁষতে দেব না”।
এই বলে আমি ঘরের ভিতর ঢুকে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলাম।

স্কুল মাঠে আসতে আসতে আমার প্রায় বিকেল ৫ টাই বেজে গেল। দেখি গ্রামের আর কোন লোক বাদ নেই। লোকে একদম লোকারণ্য। মাঠের পাশে পাটি পেতে কিছু দোকানপাটও বসেছে। একদম উৎসব উৎসব আমেজ। চারদিকে খানাপিনারও অভাব নাই।
একটু দূরে দেখি ঋতুও এসে বসে আছে। তাকে ঘিরে উৎসুক জনতার বেশ ভিড়। স্কুল ঘর থেকে ভাল একটা চেয়ার নিয়ে আসা হয়েছে তার জন্য। সেখানেই ও বসে আছে। হেঁসে হেঁসে সবার সাথে কথা বলছে।
অনেকক্ষণ হল আসলাম। কেউ আমার দিকে ভুলেও তাকালো না। ঋতু একবার তাকিয়েছিল। কিন্তু মনে হয় না, তেমন পাত্তা-টাত্তা দিয়েছে। জালাল মিয়াঁ দূর থেকে বেশ অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই আছেন অনেকক্ষণ ধরে। আমার প্রতি তার ভয়ানক রাগ থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার চেহারায় অসহায়ত্বটাই বেশী দেখতে পেলাম। সে বুঝতে পারছে, সে ভয়ানক একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। আজ গ্রামের লোকজন যদি সময় মত চোরকে তাদের সামনে দেখতে না পায়, জালাল মিয়াঁ ভাল মতই জানে, তাহলে জালাল মিয়াঁর কপালে আজ শনি আছে।

হঠাৎ করে পূর্ব দিক থেকে তারেককে দৌড়ে আসতে দেখলাম। তারেক চিৎকার করে বলছে, “চোর ধরা পড়েছে রে... চোর ধরা পড়েছে...”
তারেক কাউকে কিছু না বলে আমাকে এসে জড়ায়ে ধরল। আমি তারেককে জোর করে ছাড়িয়ে নিলাম, বললাম, “দূর মিয়াঁ, আর লোক পাওনাই! জালাল মিয়াঁরে জড়িয়ে ধর। জালাল মিয়াঁর গরুচোর ধরা পড়েছে। আমার গরুচোর ধরা পড়েনি!!!”

দেখলাম, জালাল মিয়াঁ আমার দিকে এখনও বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কিছু বলছে না। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে জালাল মিয়াঁর কাছে গেলাম। যাইয়া কানে কানে বললাম, “আপনি তো আপনার চুরি না হওয়া বাকি ২ টা গরু নিয়া খুব চিন্তায় ছিলেন। আমারে বলছিলেন, এই ২ টা গরু দেখলেই আপনার খুবই খারাপ লাগে, দুঃখ বেড়ে যায়। তাই আমি আপনার মনের দিকে তাকিয়ে আপনার বাকি গরু ২ টা চুরি যাওয়ারও ব্যবস্থা করেছিলাম। দেখলেন না, আপনাকে মাইকিং করতে বলে গ্রামের সব মানুষকে এই দিকে নিয়া আসছি। যাতে, চোর ঐদিকে আপনার বাকি ২ টা গরু চুরি করে নিয়ে যেতে সহজ হয়। কিন্তু এই তারেকরাই তো গরু ২ টি চুরি হতে দেয়নি। একদম হাতে নাতে চোর ধরে ফেলেছে। উল্টো এখন চোর ধরে নিয়ে আসতেছে। দেখলেন, পোলাপান কি বজ্জাতের হাড়ি!!! দেখুন, আমার কোন দোষ নাই, জালাল মিয়াঁ”

জালাল মিয়াঁ হঠাৎ করে আমাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “সামাদ, তুমি আমারে বাঁচাইলা!!!”।
আমি খুবই বিরক্ত হলাম। বললাম, “ছাড়েন মিয়াঁ, আপনারে বাঁচানোর আমার ঠেকা পড়ছে! সারাদিন এদিকওদিক ছুটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে আছি। এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে, ঘুমবো”।
জালাল মিয়াঁ খুবই অবাক হল, বলল, “তুমি সব কিছুর ব্যবস্থা করেছ। তুমি চলে গেলে আমরা একা একা কি করব!”
আমি জালাল মিয়াঁকে ঋতুকে দেখিয়ে বললাম, “ওই যে মেয়েটা দেখছেন তাকে চিনেন?”
- না।
- ঢাকায় তার সাথে আমার পরিচয়। তার সাথে আমার বিয়ের কথা ছিল। কিন্তু সে আমাকে বিয়ে করেনি। কেন করেনি জানি না। জিজ্ঞাসাও করিনি। কিন্তু সে খুবই ভাল মেয়ে। সে আপনার গরুচোরের বিচার হওয়া পর্যন্ত থাকবে। এই নিয়ে আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। সে একাই সব কিছু করবে। ও যেভাবে চায় সেভাবে করবেন। সাবধান তার কোন কথায় ‘না’ করবেন না। আমার প্রতি বিশ্বাস না রাখতে পারেন, কিন্তু তার প্রতি ১০০% বিশ্বাস রাখবেন”।

আমি চলে আসার সময় বেশ কয়েকবার ঋতুর দিকে তাকালাম। কিন্তু ঋতু ভুলেও আমার দিকে একবারের জন্যও তাকাল না। মনে হল, ও অনেক ব্যস্ত। চিন্তা করলাম, তাকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না।

সাড়ে ৫ টার দিকে বাসায় এসেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রাতে খাওয়ার তেমন চিন্তা নাই। কারণ বাসায় খাবার মত কিছুই নাই। অন্য ব্যাপারগুলো নিয়েও আমি চিন্তা করছি না। জানি, খাদিজা খালা বেশ ভাল থাকবে। জালাল মিয়াঁর চোরেরও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ঋতু থাকতে এই দিয়ে আমার টেনশন নাই। সকাল পর্যন্ত ঘুমানোর প্লান আছে। এটাও জানি, আমাকে ডিস্টার্ব করতে ঋতু কাউকে দেবে না।

(চলবে)

এখান থেকে পড়ুন
১ম খণ্ড
২য় খণ্ড
৩য় খণ্ড
৫ম খণ্ড

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.