নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যাযাবর রাজা রিটার্নস

যাযাবর রাজা রিটার্নস › বিস্তারিত পোস্টঃ

গুরু, তোমায় সালাম

০৫ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৩:২৬



দূর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা আজম খান

ষাটের দশকে সদ্য কৈশোর পেরোনো এদেশের এক তরুণের দিন কাটছিল গানে গানে। তার গানগুলো ছিল গতানুগতিক গানগুলোর চেয়ে একটু আলাদা। সর্বদাই নতুনত্বের ছোঁয়া ভেসে বেড়াত তার গানে। রোগা লিকলিকে লম্বা গড়নের সেই যুবকটিও তার গানের মতোই ছিল আলাদা। সবার সাথে মিশতেন, স্বভাবে ছিল না কোনো রাশভারী আচরণের ছাপ। শিশুর মতো সহজ সরল এই যুবকটি একমাত্র গানের কাছেই নিজেকে সম্পূর্ণ খুলে দিতে ভালোবাসতেন। কিন্তু যুবকটির মনে যখন এমন সারল্যর আধার দেশের রাজনৈতিক অবস্থা তখন জটিল থেকে আরও জটিলতর। সময়টা ১৯৭১। প্রিয় মাতৃভূমির ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানি হায়নার দল। ওর জ্বালিয়ে দিচ্ছে সবুজ দেশটার শহর ও গ্রাম। বাবার সামনে মেয়ের সম্ভ্রম হানি করছে, ছেলের সামনে বাবাকে মেরে ফেলছে, মায়ের কোল থেকে দুধ পানরত শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে আছড়ে মারছে।

চারপাশের এমন দৃশ্য, পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর এমন নারকীয়তা দেখে ছেলেটি ওদের প্রতিহত করার দলে নাম লেখাতে মনঃস্থির করে। সরাসরি গিয়ে ছেলেটি একদিন তার বাবার সামনে দাড়িয়ে বললো, "বাবা, আমি যুদ্ধে যেতে চাই।" ছেলেটি ভেবেছিল বাবা তার এই সিদ্ধান্তে মত দিবেন না। কিন্তু ছেলেটিকে অবাক করে দিয়ে দৃড়তার সাথে বাবা বললেন, "যাবি যা, কিন্তু দেশ স্বাধীন না করে ফিরে আসিস না।" বাবার মুখে এমন উদ্দীপিত কথা যেন ছেলেটিকে আর সাহসী করে তোলে। কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ছেলেটি বেরিয়ে পড়ে মাতৃভূমিকে উদ্ধারের লক্ষ্য বুকে নিয়ে। গানপাগল ও দেশপ্রেমিল এই যে ছেলেটির কথা বলছি তিনি আর কেউ নন। তিনি এদেশের কিং অফ রক, এদেশের মানুষ ভালোবেসে যাকে উপাধি দিয়ছেন গুরু।

তিনি সেই আজম খান। মাতৃভূমির পাশে দাঁড়ানোর দৃড় প্রত্যয় বুকে নিয়ে আজম খান প্রথমে যান কুমিল্লা। কুমিল্লা থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছান আগরতলায়। তারপর সেখান থেকে মেঘালয়ে গিয়ে তিনি যোগ দেন খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ২ নং সেক্টরে। এখানে দুই মাস প্রশিক্ষণ শেষে স্বশস্ত্র যোদ্ধা আজম খান ঝাপিয়ে পড়েন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে। আজম খানের প্রথম অপারেশন ছিল কুমিল্লায়। কুমিল্লায় সলদায় কৃতিত্বের তিনি সাথে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করলে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ তাকে এক গুরু দ্বায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় পাঠান। গেরিলা অপারেশন পরিচালনার উদ্দেশ্যে সেকশন কমান্ডার নিযুক্ত হয়ে ঢাকায় এসেই আযম ঝাপিয়ে পড়েন পাকবাহিনী নির্মূল করতে। লক্ষ্য একটাই আপন শহরকে শত্রুমুক্ত করতে শত্রুবাহিনীকে ঝেটিয়ে বিদায় করা।

এই উদ্দেশ্য নিয়েই গুলশান যাত্রাবাড়ী অঞ্চলে নিজের বাহিনী নিয়ে পাকবাহিনীর কোমর ভেঙে দিতে বেশ কয়েকটি প্রলয়ংকারী অভিযান চালিয়ে শত্রুবাহিনীকে দিশেহারা করে দেন সেকশন কমান্ডার আযম খান। দুঃসাহসী এই গেরিলার তান্ডবে ঘুম হারাম হয়ে যায় পাকবাহিনীর। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কমান্ডার আযম খানের সবচেয়ে মারত্মক আঘাতটির নাম ছিল অপারেশন তিতাস। ঢাকা শহরের গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার এই অভিযানে দূর্ধর্ষ যোদ্ধা আযম খানের হুংকার এলোমেলো করে দেয় শত্রুপক্ষকে। আর এভাবেই দাপটের সাথে যুদ্ধ করে ডিসেম্বরে দলবল নিয়ে বীরের বেশে ঢাকায় প্রবেশ করেন এই দাপুটে গেরিলা যোদ্ধা।



রকস্টার আজম খান


বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনের এক অবিস্মরণীয় নাম আজম খান। তাকে বলা হয় পপ সম্রাট তাকে বলা হয় রক আইকন। লোকজন ভালোবেসে তাকে গুরু বলে ডাকে। গানের সাথে সখ্যতা তার সেই ছোট থেকেই। তবে স্বাধীনতা পূরবর্তী সময় থেকেই গান পাগল আজম খান গান বাজনা নিয়ে থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রণাঙ্গন থেকে ঘরে ফিরে বন্ধু বান্ধব নিয়ে তিনি গঠন করেন উচ্চারণ নামের ব্যান্ডদলটি। শুরু করেন বাংলা গানের এক নতুন অধ্যায়। লোকসংগীত, পল্লীগীতি সহ এদেশের মাটির গানকে পশ্চাত্য রকের আদলে এনে এদেশের এক নতুন ধারার সূচনা করেন এই সংগীত শিল্পী। উচ্চারণ ব্যান্ড গঠনের পর আজম খান নিয়মিত গান করে গেলেও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠান তাকে ও তার গানের দলকে পৌছে দেয় সারাদেশের মানুষের কাছে। সেটিই ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে আজম খানের প্রথম গানের অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে আজম খানের কন্ঠে এত সুন্দর দুনিয়া কিছুই রবে না রে এবং চার কালেমা সাক্ষী দেবে গান দুটি প্রচারের পরপরই গানগুলো যেমন প্রশংসিত হয় তেমনই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরপরের গল্পতো ইতিহাস! সারাদেশের আকাশে বাতাসে আর তরুণদের হৃদয়ে তখন একটাই নাম আজম খান। আর এর অন্যতম কারণ ছিল আজম খানের গানের সুর ও কথার বৈচিত্র্যতা এবং কাধ ছোঁয়া চুল দাড়ি গোফের এক বেপরোয়া বেশভূষা। বাংলাদেশের মানুষ যেন তার গানে নতুন কথা শুনতে পায় যে কথায় প্রেম ভালোবাসার তুলনায় আধিক্য ছিল দ্রোহ, অবক্ষয় ও আধ্যাত্মবাদের। এসময় বাংলা গানের এই নতুন ধারায় আজম খানের সংগী ছিলে ফিরোজ সাই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ প্রমুখ।


যুদ্ধপরবর্তী সময়ে অস্ত্র ছেড়ে আজম খান যখন কন্ঠে গান তুলে নেন এদেশ সার্বিক পরিস্থিতি তখন বড়ই টালমাটাল। একদিকে দূর্ভিক্ষ, অভাব অনটন ছিনতাই রাহাজানি এবং যুব সমাজের বিপথগামীতা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে তুলেছিল। যে মাতৃভূমিকে রক্ষার উদ্দেশ্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন সেই প্রিয় মাতৃভূমির এমন বেহাল দশা আজম খানকে পীড়িত করে তোলে। এমন সব অনুভূতি নিয়ে আজম খান প্রকাশ করেন তার নতুন গান 'রেল লাইনের ঐ বস্তিতে/ জন্মেছিল একটি ছেলে/ মা তার কাদে/ ছেলেটি মরে গেছে/ হায় রে হায় বাংলাদেশ….। গানটি প্রকাশের সাথে সাথে দেশজুড়ে তুমুল আলোড়ন তৈরি হয়। মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে গানটি। এই গানটি যেমন তৎকালীন ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছিল তেমনই আজম খানের অন্যান্য গানগুলো যেন এক একটি গল্প বলে যেত। তার পাপড়ি কেন বোঝে না গানটিতে ভেসে উঠেছে প্রেমিকাকে ভালোবাসার কথা না বলতে পারা এক প্রেমিক হৃদয়ের তৃষ্ণার্ত হাহাকার। আবার আলাল দুলাল গানটিতে তিনি তুলে এনেছেন দুরন্ত পুত্রদের সামলাতে না পারা বাবার নাস্তানাবুদ অবস্থা।


আজম খানের গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো ওরে সালেকা ওরে মালেকা, পাপড়ি, অভিমানী, বাংলাদেশ, আমি যারে চাই রে, এত সুন্দর দুনিয়া প্রভৃতি। আজম খানের প্রকাশিত গানের অ্যালবামগুলোও ছিল বেশ ব্যবসা সফল। ১৭ টিরও বেশি ব্যবসফল অ্যালবাম রয়েছে বাংলাদেশের এই রক আইকনের। এই রক লিজেন্ডের জনপ্রিয়তা শুধু নিজের দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল। তার জনপ্রিয়তা তাকে নিজের দেশের সীমানা ছাড়িয়ে উপমহাদেশের এক আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত করেছিল। আজ যে কলকাতার ব্যান্ড শিল্পীরা রয়েছেন তাদের অনেকেরই অনুপ্রেরণার নাম আজম খান।


একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক আজম খান বাংলাদেশের সংগীতে এক নতুন দিগন্তের শুধু সূচনা করেই থেমে যাননি বরং সংগীতের এই নতুন ধারাকে মানুষের মাঝে জনপ্রিয়ও করে গিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের আজ যে রকস্টারগণ কিংবা যে সুপ্রতিষ্ঠিত রকগান তার ভিত রচনা করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সফল রকস্টার আজম খান। বাংলাদেশের সংগীতে একজন আজম খানের অবদানের জন্য বাংলা সংগীত চিরঋনী হয়ে থাকবে এই গুণী গায়কের নিকট। আজম খানের এই অবদান কোনো পুরষ্কারের মাধ্যমেই শোধ করার মতো না। তারপরও একজীবনে আজম খানের ঝুলিতে যাওয়া পুরষ্কারগুলোর মধ্যে বেস্ট পপ সিংগার অ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন দর্শক পুরষ্কার, কোকাকলা গোল্ড বটল পুরষ্কার এবং মরণোত্তর একুশে পদক উল্লেখযোগ্য।


বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকরী নন্দিত এই গায়ক গানের বাইরে নাটক সিনেমাতেও অভিনয় করে প্রশংসা পেয়েছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি কালা বাউল নামক এক নাটকে নাম ভূমিকায় এবং পরবর্তীতে গডফাদার নামক একটি চলচ্চিত্রে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এছাড়া তিনি ক্রাউন এনার্জি ড্রিংক নামক একটি কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপনেও গায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।


২০১১ সালের ৫ জুন বাংলাদেশের এই রক সম্রাটের জীবনাবসান ঘটে। আজন্ম এই যোদ্ধা মৃত্যুপূর্ব এক বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। সাদামাটা জীবনের অধিকারী খ্যাতিমান এই গায়কের না থাকার প্রায় এক দশক হতে চলেছে। অথচ আজও তিনি বেঁচে আছেন তার গানে, শ্রোতাদের হৃদয়ে। যতদিন বাংলা সংগীত থাকবে ততদিন এই রক রাজপুত্র বেঁচে থাকবেন তার উত্তরসূরিদের মাঝে, বেঁচে থাকবেন লাল সবুজের ঐ পতাকায়।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৪:৩১

রাজীব নুর বলেছেন: উনি একজন অতি সাধারণ মানুষ। তাঁর মধ্যে কোনো লোভ ছিলো না।

২| ০৫ ই জুন, ২০২১ রাত ৮:০১

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: উনি আসলেই সালাম পাওয়ার মত একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং পপ সম্রাট ছিলেন। উনি যা সম্মান পেয়েছেন তার চেয়েও বেশী প্রাপ্য ওনার ছিল। উনি সম্ভবত ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। উনি ভালো ক্রিকেট খেলতেন। জাতীয় টুর্নামেন্টেও দুই একবার খেলেছেন মনে হয়।

৩| ০৫ ই জুন, ২০২১ রাত ৯:১৩

স্বামী বিশুদ্ধানন্দ বলেছেন: আমি নটরডেম কলেজে পড়ার সময় একবার তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল - একদম মাটির মানুষ। একজন সেলিব্রিটি হিসাবে তার মধ্যে অহংকার বা দম্ভ ছিলোনা, ছিল না কোনো হিপোক্রেসি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.