নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

.

ইতিহাসের পাতিহাঁস

ইতিহাসের পাতিহাঁস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডেস্টিনি ডিসরাপ্টেড- মুসলিমদের চোখে বিশ্বের ইতিহাস (২)

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৫

ভূমিকা- ২
ইসলামে আমার ব্যক্তিগত অংশিদারিত্ব থাকায় আমি স্বীকার করে নিতেই পারতাম যে আমি হয়ত বিশ্ব ইতিহাসে ইসলামের গুরুত্ব আসলে যতটুকু তার থেকে বেশী ভাবছিলাম। কিন্তু তারপরও একটা খুঁতখুতে সন্দেহ থেকেই গেলো... আমার মূল্যায়ন কি পুরোটাই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট ছিল? এই ছয়টি মানচিত্র একটু দেখুন। ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে (ইংরেজি সন হিসাবে) ইসলামি বিশ্বের স্ন্যাপশট:

মানচিত্র- ইসলামের ক্রমবিস্তার

আমি যখন বলি ‘ইসলামি বিশ্ব’, আমি বোঝাতে চাই সেইসব সমাজ যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে এবং/অথবা যেখানে শাসক মুসলমান। এর বাইরে অবশ্যই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিশ্বের অন্য প্রায় প্রতিটি অংশেই মুসলিম আছে, কিন্তু সেই ভিত্তিতে লন্ডন, প্যারিস অথবা নিউ ইয়র্ক-কে ইসলামী বিশ্বের একটি অংশ বলে দাবি করলে তা অসত্য হবে। এমনকি আমার এই সীমিত সংজ্ঞা মেনেও, ‘ইসলামি বিশ্ব’ কি তার অনেক শতাব্দীর অস্তিত্ব জুড়ে একটি গোণায় ধরার মত ভৌগলিক বাস্তবতা নয়? এটি কি আজকের দিনেও তাই নয়- এশিয়ান-আফ্রিকান ভূখণ্ড জুড়ে বিস্তৃত এবং ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি বিরাট বাফার জোন হিসাবে? কলেবর এর দিক দিয়ে এটা ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত আয়তন থেকেও বড়। অতীতে, এটি সম্পূর্ণটিই ছিল একটি একক রাজনৈতিক সত্তা, এবং তার অবিভক্ততা এবং রাজনৈতিক ঐক্যের ধারণা আজও কিছু মুসলমানদের মধ্যে অনুরণিত হয়। এই ছয় মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে, আমি এখনও ভাবি কেউ কিভাবে ৯/১১ এর ঠিক আগে ইসলামকে বিশ্ব ইতিহাসের টেবিলে এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হতে পারে!

৯/১১ এর পর ধারনা বদলে গেলো। পশ্চিমা অমুসলিমরা জিজ্ঞাসা করতে শুরু করল ইসলাম ব্যাপারটা কি, এই লোকগুলো কারা, আর ঐ এলাকায় হচ্ছেটাই বা কি। ঠিক একই প্রশ্নমালা আমার জন্যও নতুন করে জরুরী হয়ে গেলো। সেই বছর, আটত্রিশ বছরের মধ্যে প্রথমবারের জন্য পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সফরে যাওয়ার সময় আমি একটি বই সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম যেটা লন্ডনের এক পুরনো বইয়ের দোকানে পেয়েছিলাম। বইটা ছিল প্রয়াত উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ (ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড এ ধর্মবিদ্যার অধ্যাপক)-এর লিখা ‘ইসলাম ইন মডার্ণ হিস্টোরি’ (আধুনিককালের ইতিহাসে ইসলাম)। স্মিথ ১৯৫৭ সালে বইটি প্রকাশ করেছিলেন, তাই যাকে তিনি ‘মডার্ণ হিস্টোরি’ বলছিলেন তা ততদিনে চল্লিশ বছরেরও আগের কথা। অথচ তাঁর বিশ্লেষণ আমাকে নাড়া দিল এই জন্য যে তা আশ্চর্যজনকভাবে এবং অস্বস্তিকরভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হল সেই ইতিহাসের সাথে যা ২০০২ সালে উন্মোচিত হচ্ছিল।

আমি শৈশবে এবং পরবর্তীকালে পড়াশুনা করে যা জেনেছিলাম স্মিথের লেখা তার উপর নতুন করে আলোকসম্পাত করলো। উদাহরণস্বরূপ, কাবুলে আমার স্কুলের দিনগুলিতে আমি সৈয়দ জামালউদ্দীন-ই-আফগানী নামে একজন লোকের ব্যাপারে বেশ অবগত ছিলাম। আমি জানতাম তিনি আধুনিক ইসলামের ইতিহাসে এক সুউচ্চ চরিত্র ছিলেন। কিন্তু সত্যি বলতে আমি কখনই বুঝে উঠতে পারিনি তিনি কিভাবে তাঁর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, শুধু এই তথ্যটুকু ছাড়া যে তিনি প্যান-ইসলামিজম নামে একটি মতবাদ প্রচার করেছিলেন, যা আমার কাছে এক নিছক ফ্যাকাশে মুসলিম উগ্র জাতীয়তাবাদ বলে মনে হয়েছিল। এখন স্মিথ এর লেখা পড়ে আমি বুঝতে পারলাম যে, ‘ইসলামিজম’, যেই রাজনৈতিক মতাদর্শ আমাদের চারদিকে এত হুলুস্থুল শুরু করেছে ২০০১ সালে, এর মৌলিক মতবাদটি একশত বছরের ও বেশী আগে এই বুদ্ধিবৃত্তিক ‘ইসলামিক কার্ল মার্ক্স’ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাহলে কিভাবে এই লোকের নামটা পর্যন্ত বেশিরভাগ অমুসলিমদের কাছে অজানা হতে পারে?

আমি ইসলামের ইতিহাস চষে ফেলতে শুরু করলাম, এখন আর শুধু আমার ব্যক্তিগত পরিচয় খোঁজার জন্য নয়, বরং আমার নিজের সময়ের মুসলিমদের মাঝে যেই উদ্বেগজনক কাণ্ডকারখানা বিস্তার লাভ করছিল তাকে বোঝার চেষ্টায়- আফগানিস্তানের ভয়াবহ গল্প, ইরানে গোলমাল, আলজেরিয়া, ফিলিপাইন এবং অন্যত্র বিদ্রোহী তৎপরতা, মিডিল ইস্টে হাইজ্যাকিং এবং আত্মঘাতী বোমা হামলা, রাজনৈতিক ইসলামের চরমপন্থা কঠিন রূপ নেয়া- এবং ঠিক ওই সময়টাতেই, তালেবানদের উত্থান। ইতিহাসের দিকে একটি নিবিড় চাউনি নিশ্চয়ই প্রকাশ করবে কিভাবে (how on earth) ঘটনা ঠিক এইখান পর্যন্ত আসলো।

এবং ধীরে ধীরে, আমি বুঝতে পারি এটা কিভাবে এই পর্যন্ত আসলো। আমার ধারনা হলো (পশ্চিমাদের কাছে যেটা) ‘ওই দূরের ইসলামিক এলাকা’, তার ইতিহাসটি ঠিক ফ্রান্স বা মাল্টা বা দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসের মতো সর্বজনস্বীকৃত (পশ্চিমা ধ্যান ধারণায়) যেই ইতিহাস তার একটা অংশমাত্র (সাবসেট) নয়। এটা অনেকটা নিজেই একটা বিকল্প বিশ্ব-ইতিহাসের মত, টেক্সাসের ওই প্রকাশকের জন্য আমি যেই ইতিহাস লিখতে চেষ্টা করেছিলাম তার পরিপূরক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী। অথবা সেই ইতিহাসের পরিপূরক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী যা McDougall-Littell কর্তৃক প্রকাশিত, যার জন্য আমি ‘ইসলাম বিষয়ক’ অধ্যায়গুলো লিখেছিলাম।

এই দুই ইতিহাস একই জায়গায় শুরু হয়েছিল- প্রাচীন ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস (দজলা ও ফোরাত) নদীর মাঝখানের জায়গাটায়, এবং তারা একই জায়গায় এসে আবার মিলিত হয়েছে- আজকের এই বৈশ্বিক লড়াই যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসলামিক বিশ্বকেই মনে হচ্ছে প্রধান খেলোয়াড়। মাঝের সময়টুকুতে তারা গিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন- কিন্তু অদ্ভুতভাবে সমান্তরাল পথের উপর দিয়ে।

হ্যাঁ, অদ্ভুত সমান্তরাল! উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা বিশ্বের ঐতিহাসিক কাঠামোর মধ্যে থেকে পেছন ফিরে তাকালে, আপনি দেখবেন প্রাচীনকালে একটি একক বড় সাম্রাজ্য সেখানে অন্য সবার উপরে অত্যুচ্চ আসনে আসীন ছিল- সেটা হলো রোম, যেখানে সার্বজনীন রাজনৈতিক রাষ্ট্রের স্বপ্নটি জন্ম নিয়েছিল।

ইসলামিক বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে পিছন ফিরে তাকালেও যে কেউ একটি একক নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যকে সেখানে প্রবলভাবে উপস্থিত দেখতে পাবেন- সার্বজনীন রাষ্ট্রের দর্শনকে যা ধারন করেছিল। কিন্তু এটা রোম নয়, এটা ইসলামের প্রাথমিক দিকের খিলাফত।

উভয় ইতিহাসেই সেই বিশাল প্রথম সাম্রাজ্যগুলো ভেঙ্গে টুকরা হয়ে যায়, কারণ এরা খুব বেশী বড় হয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যগুলোকে তখন ‘উত্তরের যাযাবর বর্বর’রা (nomadic barbarians from the north) আক্রমণ করে। কিন্তু ইসলামিক বিশ্বে, ‘উত্তর’ বলতে বোঝায় মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ সমতলভুমি (steppes), আর এই বিশ্বের যাযাবর বর্বর-রা জাতিতে জার্মান নয়, তারা হলো তুর্কী (এই তুর্কী সেই তুর্কী নয়)। দুই ক্ষেত্রেই আগ্রাসনকারীরা সেই বিশাল সাম্রাজ্যগুলোকে কেটেকুটে জোড়াতালি দেয়া ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত করে, যেগুলো আবার বাঁধা ছিল একটি করে সার্বজনীন, ইউনিফাইং ধর্মীয় মতাদর্শের ছায়ায়: পশ্চিমে ক্যাথলিক খ্রিষ্টিয়ানিটি, পূর্বে সুন্নি ইসলাম।

বিশ্ব ইতিহাস সবসময়ই একটি গল্প- কিভাবে ‘আমরা’ আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছালাম। তাই ইতিহাসের বর্ণনা অবধারিতভাবে নির্ভর করে এই ‘আমরা’ টা কে এবং ‘আজকের অবস্থান’ বলতে তারা কি বুঝায় তার উপর। পশ্চিমা বিশ্ব-ইতিহাস ঐতিহ্যগতভাবে ধরে নেয় যে ‘আজকের অবস্থান’ হল গণতান্ত্রিক শিল্প এবং শিল্প-উত্তর (post-industrial) সভ্যতা। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আরও যা ধরে নেয়া হয় তা হলো বিশ্বের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা তাদেরকে নিয়ে আসে সেই আঁতুড়ঘরে যেখানে তাদের জাতির জন্মের আদর্শগুলোর উদ্ভব হয়েছিল- স্বাধীনতা এবং সাম্যের ধারনার। এর ধারাবাহিকতায় তাদের উত্থান ঘটে এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎযাত্রার নেতৃত্ব দেয়া সুপারপাওয়ার হিসাবে। এই ধারনাগুলো ইতিহাসের একটি ডাইরেকশন তৈরি করে দেয় এবং আমাদেরকে বলে দেয় যে আমরা যে পথে চলছি সেই পথের আরও সামনে আমাদের জন্য একটি লক্ষ্য স্থির করা আছে। কিন্তু এর একটা সমস্যা হচ্ছে আমরা ভাবতে শিখি যে দুনিয়ার সব মানুষের গন্তব্য বুঝি একটাই- যদিও কিছু মানুষ একটু পিছিয়ে আছে, কারণ হয় তারা শুরু করেছে দেরিতে অথবা তাদের চলার গতি কম। এই কারণে সেই পিছিয়ে থাকা জাতিগুলিকে আমরা বলি- “উন্নয়নশীল জাতি”। (অর্থাৎ উন্নয়ন এর সংজ্ঞা বা লক্ষ্য সবার জন্যই সমান বলে ধরে নেই)

[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com/Destiny-Disrupted-History-Through-Islamic/dp/1586488139]

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরের পর্ব এখানে

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.