নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

.

ইতিহাসের পাতিহাঁস

ইতিহাসের পাতিহাঁস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডেস্টিনি ডিসরাপ্টেড- মুসলিমদের চোখে বিশ্বের ইতিহাস (০০৪)

০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৪০

মধ্য- পৃথিবী (১)


পারসেপলিস এ প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ (ছবি Byঃ Hansueli Krapf)

ইসলামের জন্মের অনেক আগেই আটলান্টিক মহাসাগর আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী বিস্তৃত এলাকাটিতে দুট আলাদা জগতের সৃষ্টি হয়। এদের প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন বাণিজ্য ও ভ্রমণ রুটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে- একটি ছিল প্রধানত সমুদ্র রুট আর অন্যটি স্থল রুট।

আপনি যদি প্রাচীন সমুদ্রপথের দিকে তাকান তাহলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলটি বিশ্বইতিহাসের সুস্পষ্ট কেন্দ্র হিসেবে আপনার সামনে উঠে আসবে। কারণ এটাই ছিল সেই জায়গা যেখানে মাইসিনিয়ান (Mycenaeans), ক্রীট, ফোনেসিয়ান (Phoenicians), লিডিয়ান (Lydians), গ্রীক, রোমান, এবং অন্যান্য অনেক শক্তিশালী আদি সভ্যতার মেলামেশা হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি যারা বাস করত তারা খুব সহজেই ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি বসবাস করে এমন অন্য মানুষদের ব্যাপারে জানতে পারত এবং পরস্পরের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পেত। তাই এই মহান সমুদ্র নিজেই একটি সাংগঠনিক শক্তি হয়ে উঠে যা বৈচিত্র্যময় সব জনগোষ্ঠীকে একে অপরের গল্পের অংশ করে তোলে আর তাদের ভাগ্যকে একসঙ্গে বেঁধে ফেলে, যা একটি বিশ্ব ইতিহাসের বীজাণু গঠন করে। এবং এর থেকেই পরবর্তীতে বিকশিত হয় আজকের পশ্চিমা সভ্যতা।


এবার আপনি যদি প্রাচীন স্থলপথের ট্রাফিকের দিকে তাকান, তবে জগতের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন ছিল সেইসব সড়ক ও রুটের জটলা যেগুলো ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া, ইরানিয়ান উচ্চভূমি, মেসোপটেমিয়া (ইরাক) এবং মিশরকে যুক্ত করেছিল। যেই এলাকার মধ্যে এই পথগুলো বিস্তৃত ছিল তা আবার চারদিকে নদী আর সাগর দ্বারা বেষ্টিত ছিল- পারস্য উপসাগর, সিন্ধু ও Oxus (আমু দরিয়া) নদী; আরল সাগর, কাস্পিয়ান সাগর, কৃষ্ণ সাগর, ভূমধ্য সাগর, নীলনদ এবং লোহিত সাগর। পরবর্তীতে এই এলাকাই রূপ নেয় ইসলামী বিশ্বে।


আমাদের দৈনন্দিন ভাষায় এই দ্বিতীয় যে এলাকাটি তার কোন একক নামকরণ করা হয়নি। এর একটা অংশকে আজকে বলা হয় ‘মধ্যপ্রাচ্য’। বড় একটা জিনিসের একটা অংশকে কোন একটা নাম দিলে তা পুরো জিনিসটার মধ্যে যে আন্তঃসংযোগ তাকে বুঝতে দেয় না। উপরন্তু আপনি যখন ‘মধ্যপ্রাচ্য’ শব্দটা ব্যাবহার করছেন, আপনি ধরে নিচ্ছেন যে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন পশ্চিম ইউরোপে। উদাহরনস্বরূপ, আপনি যদি পারস্যে গিয়ে দাঁড়ান, এই কথিত ‘মধ্য প্রাচ্য’ আপনার জন্য হয়ে যাবে মধ্য-পশ্চিম। সেজন্য আমি সিন্ধু নদ থেকে ইস্তানবুল পর্যন্ত এই পুরো জায়গাটাকে ‘মধ্য-পৃথিবী’ নামে ডাকবো, কারণ এটা ভূমধ্যসাগরীয় এবং চাইনিজ দুনিয়ার মাঝখানে অবস্থিত।

চীনা দুনিয়াটি অবশ্য ছিল এক স্বতন্ত্র মহাবিশ্ব এবং অন্য দুটি দুনিয়ার সঙ্গে তার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। ভূগোল এর দিকে একটু নজর দিলে আপনি সেটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নেবেন। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে চীন বিচ্ছিন্ন ছিল শুধুমাত্র বিশাল দূরত্বের কারণে, আর মধ্য দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল হিমালয় পর্বতমালা, গোবি মরুভূমি এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার ঘন জঙ্গলের দ্বারা- প্রায় দুর্ভেদ্য এক বাঁধের মতো। এজন্যই চীন এবং তার সঙ্গীসাথী এবং প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউই মধ্য-পৃথিবীতে কেন্দ্রিভূত যে বিশ্ব-ইতিহাস তাতে প্রায় ঢুকতেই পারেনি। একই কারণে এই বইয়েও তাদের ব্যাপারে খুব কমই উল্লেখ করা হবে। একই কথা প্রযোজ্য সাব-সাহারান আফ্রিকার ক্ষেত্রেও। বাকী দুনিয়া থেকে তারা বিচ্ছিন্ন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি দ্বারা। একই রকম কারণে আমেরিকা মহাদেশের স্বতন্ত্র একটি বিশ্ব ইতিহাস রয়েছে- ভৌগলিক কারণে যা আরও বেশী অাবশ্যম্ভাবী ছিল।

ভূমধ্যসাগরীয় দুনিয়া এবং মধ্য-পৃথিবী পরস্পরের সাথে লাগোয়া হলেও তাদের মাঝে যে স্বাতন্ত্র্য তার কারণ ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতাটা ততোটা ছিলনা, যতটা ছিল চীন বা আমেরিকা মহাদেশের বেলায়। বরং এই দুই অঞ্চলে আলাদা আলাদা বিশ্বব্যাবস্থা গড়ে উঠার কারণ হচ্ছে এরা প্রত্যেকে ছিল, ইতিহাসবিদ ফিলিপ ডি কারটিন-এর ভাষায়, এক একটি intercommunicating zone (আন্তঃ-যোগাযোগের অঞ্চল)। এদের একে অপরের সাথে যে যোগাযোগ ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী ছিল যার যার অভ্যন্তরীণ মিথস্ক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের কাছাকাছি যে কোনও জায়গা থেকে পারসেপোলিস-এ (একদম উপরে ছবি দেখুন। এটি ছিল প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের একটি শহর, যার ধংশাবশেস আজো বিদ্যমান ইরানের শিরাজ শহর থেকে ৬০ কিমি উত্তর-পূর্বে, আমাদের সুন্দরবনের মতই এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট) বা সিন্ধু নদের অববাহিকায় কোথাও যাওয়ার চেয়ে অনেক সোজা ছিল ভূমধ্যসাগরেরই উপকূলবর্তী অন্য যেকোনো জায়গায় যাওয়া।

একইভাবে, প্রাচীন কালে মধ্য-পৃথিবী’র বুক জুড়ে ছড়ানো স্থলরুটগুলোতে যেসব কাফেলা চলাচল করত তারা যে কোন একটা চৌরাস্তায় এসেই অন্য যে কোনও দিকে চলে যেতে পারত- আর এমন অনেক বড় বড় চৌরাস্তা-ই তখন ছিল। কিন্তু তারা যখন পশ্চিমে ভ্রমন করত, এশিয়া মাইনর (আজকে যাকে আমরা তুরস্ক নামে চিনি)-এর দিকে, তখন ভূমির আকৃতিটাই এমন ছিল যে তা ধীরে ধীরে তাদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সরু বটলনেক এ এনে ফেলত- যার নাম বসফরাস প্রণালী। এর ফলে ঐ এলাকায় এসে স্থলপথের ট্রাফিক দম হারিয়ে ফেলত এবং ফিরতি পথে কেন্দ্রের দিকে রওয়ানা দিতো অথবা দক্ষিণে ঘুরে ভূমধ্যসাগরের উপকূল ধরে চলতে থাকতো।

গল্প, গসিপ, জোকস, গুজব, ঐতিহাসিক কাহিনী, ধর্মীয় পুরাণ, পণ্য, এবং সংস্কৃতির অন্যান্য খুচরা অংশাদি ব্যবসায়ী, ভ্রমণকারী এবং যুদ্ধজয়ীদের সাথে সাথে এক জায়গা থেকে অন্য জয়গায় প্রবাহিত হয়। বাণিজ্য ও ভ্রমণ রুট তাই সভ্যতার বাহন- শিরা উপশিরা যেরকম রক্ত বহন করে। এরকম নেটওয়ার্ক দ্বারা পরিবেষ্টিত সমাজগুলো তাই একে অন্যের আখ্যানের চরিত্র হয়ে উঠে, যদিও কে ভালো আর কে খারাপ সেই ব্যাপারে তাদের মতদ্বৈততা থেকেও থাকে।

আর এভাবেই ভূমধ্যসাগরীয় এবং মধ্য-পৃথিবী অঞ্চলদুটি বিশ্ব-ইতিহাসের কিছুটা স্বতন্ত্র আখ্যান তৈরি করে নেয়। ভূমধ্যসাগরের চারপাশে বসবাসরতরা নিজেদেরকে মানব ইতিহাসের কেন্দ্র হিসাবে ভাবার যথেষ্ট ভালো কারণ ছিল। একইভাবে মধ্য-পৃথিবীর লোকদেরও একই রকম ভালো যুক্তি ছিল এটা মনে করার যে তারাই দুনিয়ার মাঝখানে বসে আছে।

এই দুই বিশ্ব ইতিহাসেরই কমন জায়গা ছিল (যেখানে তারা overlap করেছিল) সেই ভূখণ্ড যেখানে আপনি দেখতে পান আজকের ইসরায়েল, আজকের লেবানন, আজকের সিরিয়া ও জর্ডান- সংক্ষেপে বললে, যে এলাকাটি আজকে এত সমস্যাসংকুল। এই অঞ্চলটি ছিল সমুদ্র-রুট কেন্দ্রিক দুনিয়ার পূবের সীমানা আর স্থল-রুট কেন্দ্রিক যে দুনিয়া তার পশ্চিম সীমানা। ভূমধ্যসাগরীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, এই এলাকাটি সবসময়ই সেই বিশ্ব-ইতিহাসের অংশ ছিল যার কেন্দ্রে রয়েছে ভূমধ্যসাগর। আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, এটা সবসময়ই মধ্য-পৃথিবীর অংশ ছিল, যার কেন্দ্রে ছিল মেসোপটেমিয়া ও পারস্য। এটা তো ঠিক যে আজকের দিনে যেমন, তেমনি আগেও সবসময়ই এই জমিটুকু নিয়ে অনেক অবাধ্য যুক্তির ফোয়ারা বয়েছেঃ এই অঞ্চলটা আসলে কার ইতিহাসের অংশ?

শুরুর পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগের পর্ব এখানে

[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com/Destiny-Disrupted-History-Through-Islamic/dp/1586488139]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.