নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মধ্য-পৃথিবী (৪)
মধ্য-পৃথিবীতে আলেকজান্ডার যে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন তাও একসময় হালকা হয়ে এলো এবং এশিয়ায় তাঁর ১১ বছরের শাসনকালের প্রভাব ম্লান হয়ে আসলো। ব্যাবিলনে এক রাতে তিনি হঠাৎ করেই মারা যান- ফ্লু, নাকি ম্যালেরিয়া, নাকি অত্যধিক মদ্যপান বা বিষক্রিয়াজনিত কারণে- কেউ তা ঠিক জানেনা। (মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩২ বছর, তিনি নাকি কোনও যুদ্ধে কখনও পরাজিত হননি।) তাঁর দখল করা অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন অংশে একেকজন সেনাপতিকে তিনি নিয়োগ দিয়ে রেখেছিলে। যেই মুহূর্তে তিনি মারা যান, সাথে সাথে তাদের যার যেমন শক্তিতে কুলালো ওইসব এলাকা তারা নিজের নামে দাবি করে বসলো। এভাবে এই এলাকাজুড়ে গ্রীক রাজত্বের আদলে কতগুলো ছোট রাজ্যের সৃষ্টি হলো যা কয়েকশ বছর ধরে টিকে ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ব্যাকট্রিয়া নামক রাজ্য (বর্তমানের উত্তর আফগানিস্তান)। সেখানে শিল্পীরা গ্রীক স্টাইলে ভাস্কর্য বানিয়েছিল। পরে, যখন বৌদ্ধ প্রভাব ভারত থেকে উত্তরে চুইয়ে এলো, এই দুই শিল্প শৈলীর মিশ্রণ ঘটলো, আর এ থেকেই উদ্ভব হল আজকে আমরা যাকে গ্রীক-বৌদ্ধ (grekko-buddhist art) শিল্প হিসাবে চিনি।
চিত্রঃ গ্রীক-বৌদ্ধ শিল্পকলার নমুনা।। এটি বর্তমান পাকিস্তানের গান্ধারা নামক জায়গায় পাওয়া। লক্ষ্য করুন বুদ্ধের গায়ের পোশাকের যে স্টাইল, তাঁর কোকড়া চুল এবং মোটের উপর যে দাঁড়ানোর ভঙ্গি, এগুলো এসেছে গ্রীক ভাস্কর্যের স্টাইল থেকে, ভারতীয় অঞ্চলের নিজস্ব স্টাইল এরকম নয়।
এক সময় এই রাজ্যগুলো দুর্বল হয়ে পড়ল, গ্রীক প্রভাব ম্লান হয়ে গেলো আর গ্রীক ভাষা এখানে অপ্রচলিত হয়ে গেলো। চাপা পড়ে থাকা ফার্সি আবার উপরে উঠে আসলো। আরেকটি সাম্রাজ্যের জন্ম হল যেটা প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য যেই এলাকা নিয়ে ছিল এর অনেকটা অংশ নিয়েই বিস্তৃত হল (যদিও ঠিক ততটা বড় হয়নি)। নতুন এই শাসকরা নিজেদেরকে পার্থীয়ান নামে ডাকতো। এরা ছিল ভয়ংকর যোদ্ধা। রোমের সাথে যুদ্ধ করে এরা পূর্বদিকে রোমের সম্প্রসারণ ঠেকিয়ে দিল। তাদের সৈন্যবাহিনীতেই প্রথমবারের মতো কাটাফ্রাক্ট (cataphract)-এর প্রচলন হয়। এরা ছিল সম্পূর্ণ ধাতব বর্মে আবৃত নাইট (খুব কাবিল যোদ্ধা) যারা বিশাল সাঁজোয়া ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করত। পরবর্তীকালে মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক দিনগুলোতে আমরা যেমনটা দেখি অনেকটা সেরকম।
চিত্রঃ কাটাফ্রাক্ট যোদ্ধা
এই পার্থীয়ান নাইটরা ছিল মোবাইল দুর্গের মতো। কিন্তু মোবাইল দুর্গ অনেক জবরজং। তাই পার্থীয়দের আরেক ধরনের সেনাদলও ছিল- হালকা অস্ত্রধারী সৈন্য যারা বর্ম ছাড়া ঘোড়ায় চড়ে লড়াই করত। এদের একটি যুদ্ধ কৌশল ছিল এরকম যেখানে এই হালকা অশ্বারোহী বাহিনী কখনো কখনো পরাজয়ের ভান করত। যুদ্ধের গরম মুহূর্তে তারা হঠাৎ লেজ গুটিয়ে দৌড় দিত। বিপক্ষের সেনাবাহিনী (এইতো পাইছি তোরে মনে করে) সারি ভেঙ্গে তাদেরকে ধাওয়া দিত, তাদের সব শৃঙ্খলা ধ্বসে পড়ত। আর পার্থীয়ানরা ঠিক তখনই হটাত করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ধাওয়াকারী বাহিনীকে কয়েক মিনিটের মাঝেই কচুকাটা করে ফেলত। এই কৌশল ‘পার্থীয়ান শট (Parthian shot)’ নামে পরিচিত ছিল। আধুনিক ইংরেজিতে ‘parting শট’ (ওস্তাদের মাইর টাইপ কিছু) বলে যে শব্দগুচ্ছটি আছে তা আসলে এই ‘Parthian shot’ এরই এক অপভ্রংশ।
পার্থীয়ানরা মূলত ছিল পারস্যের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলের এক যাযাবর পশুপালক সম্প্রদায়। কিন্তু একবার যখন তারা পুরাতন পারস্য সাম্রাজ্যের মঞ্চে উঠে বসে গেলো, তারা সবদিক থেকে বস্ত্তত ফার্সিতেই রুপান্তরিত হয়ে গেলো। (তাদের পার্থীয়ান নামটিও সম্ভবত ‘পার্সিয়ান’ এরই বিবর্তন)। যদিও এই সাম্রাজ্য কয়েক শতাব্দী ধরে টিকে ছিল, এটির তেমন কোনও চিহ্ন আর আজকে খুঁজে পাওয়া যায়না। খুব সম্ভবত এই জন্য যে শিল্প ও সংস্কৃতিতে তাদের তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। আর তাদের সেই মোবাইল দুর্গেরও কোনও হদিস পাওয়া যায় না, কারণ ভিতরের যোদ্ধা মারা গেলে ওই বর্ম স্ক্র্যাপ হিসাবে অন্য কাজে চলে যেত।
পার্থীয়ানরা বাণিজ্যের সুরক্ষা দিয়েছিল এবং উন্নতিসাধনও করেছিল। তাদের সীমানার মধ্যে কাফেলার চলাফেরা ছিল অবাধ। পার্থীয়ানদের রাজধানী Hecatompylos নামে পরিচিত ছিল গ্রীকদের কাছে। এই শব্দের অর্থ হল ‘শতদুয়ারী’- কারণ এত বেশী সংখ্যক রাস্তা এসে ওই শহরে মিলিত হয়েছিল। পার্থীয়ানদের হাট-বাজারগুলোতে সম্ভবত সাম্রাজ্যের সব অঞ্চলের এবং সীমান্তবর্তী অন্যান্য সমাজের গল্প শোনা যেতঃ যেমন পূর্বাঞ্চলে গ্রেকো-বৌদ্ধ রাজ্যসমূহ, আরও দক্ষিণে হিন্দুরা, পূর্বে চীনারা, পশ্চিমে ক্ষীয়মাণ গ্রিক (Seleucid) রাজ্যসমুহ, আর উত্তর আর্মেনীয়রা। রোমানদের সাথে অবশ্য যুদ্ধ করা ছাড়া পার্থীয়ানদের অন্য আর তেমন সামাজিক মেলামেশা ছিল না। পার্থীয়ানরা পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হলেও, এদের সভ্যতার প্রভাব নিজেদের সীমান্তের বাইরে ছড়ায়নি। তাই ভূমধ্যসাগরীয় পৃথিবী আর মধ্য-পৃথিবী আবারও পৃথক পৃথক পথে চলে গেলো।
পার্থীয়ানদের উত্থানের শুরুটা যে সময়ে ঠিক তখনই এইদিকে চীন প্রথমবারের একীভূত হয়। বস্তুত, চীনের বিখ্যাত হান রাজবংশের গৌরবের দিনগুলো পার্থীয়ানদের রাজত্বকালের হুবহু একই সময়ে ছিল। পাশ্চাত্যে রোমানদের বিশাল রাজ্য সম্প্রসারনও শুরু হয় পার্থীয়ানদের উত্থানের সমসাময়িক কালে। ওইদিকে রোম যখন প্রথমবারের মতো কার্থেজ জয় করছিল, পার্থীয়ানরা এদিকে তখন ব্যাবিলন দখল করছিল। ওদিকে জুলিয়াস সিজার যখন গল (ফ্রেঞ্চ এলাকা) তছনছ করে দিচ্ছিলেন, এদিকে মধ্য-পৃথিবীতে তখন পার্থীয়ানদের ক্ষমতা তুঙ্গে ওঠেছিল। ৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পার্থীয়ানরা এক যুদ্ধে রোমানদের তুলোধুনো করে, তারা চৌত্রিশ হাজার রোমান সৈন্য বন্দি করে আর Crassusকে হত্যা করে। জুলিয়াস সিজার, পম্পেই দ্য গ্রেট এবং Crassus তখন রোমের শাসনক্ষমতার তিন অংশীদার ছিলেন। এর ত্রিশ বছর পরে পার্থীয়ানরা রোমের শাসক মার্ক অ্যান্টনিকে একটি যন্ত্রণাদায়ক পরাজয় উপহার দেয় এবং ফোরাত নদীকে এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে স্থায়ী সীমান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। যীশু খ্রীষ্টের জন্ম যেই সময়, পার্থীয়ানরা তখনো পূর্বদিকে রাজ্যসীমানা বাড়িয়ে যাচ্ছিলো। খ্রিষ্টান ধর্মের বিস্তার পার্থীয়ানরা তেমন একটা আমলেই নেয়নি। তারা হালকাভাবে জরথুষ্ট্র ধর্মের অনুসারী ছিল। যখন খ্রিষ্টান মিশনারিরা একে একে পূর্বদিকে আসতে শুরু করল, তখন পার্থীয়ানরা তাদেরকে আসতে দিয়েছিল। ধর্মের ব্যাপারে তারা খুব একটা মাথা ঘামাতো না। (পাঠক লক্ষ্য করুন, লেখক এখানে খ্রিস্টীয় সনের শুরুর দিকের কথা বলছেন। সেই সময় মধ্য-পৃথিবীতে পার্থীয়ানরা কি করছিল সেটা বলার ফাঁকে খুব সংক্ষেপে যীশুর, বা মুসলিমরা যাকে ঈসা আঃ বলে তার জন্মের কথা উল্লেখ করলেন। কারন এই বইটি হল মুসলিম এলাকার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলা ইতিহাস। এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু যদি পাশ্চাত্য/ খ্রিষ্টান ইতিহাস হতো, তবে এই সময়ের ইতিহাসে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, যীশুর জন্ম এবং তাঁর কার্যকলাপ, রোমান সাম্রাজ্যের গল্প এগুলো বেশী গুরুত্বসহকারে উঠে আসতো, মধ্য-পৃথিবীতে পার্থীয়ানরা কি করছিল সেই ইতিহাস আমাদেরকে বলা হতো না। বইয়ের ভুমিকায় বলা কথাগুলো আমাদেরকে তাই মনে রাখতে হবে। ইতিহাস জিনিসটা কেমন তা নির্ভর করে সেই ইতিহাসটা কে বর্ণনা করছে, তার লক্ষ্যবিন্দু এবং দৃষ্টিভঙ্গি কি তার উপর। )
পার্থীয়ানদের শাসনব্যবস্থাটি ছিল সামন্ততান্ত্রিক। স্তরে স্তরে রাজা, তস্য-রাজা, আর জমিদারদের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ করা হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে সাম্রাজ্যের সার্বভৌম ক্ষমতা এইসব ছোট ছোট সামন্তদের কাছে চলে যেতে লাগল। তৃতীয় (খৃস্টীয়) শতাব্দীতে এক প্রাদেশিক বিদ্রোহীদল শেষ পার্থীয়ান শাসককে উৎখাত করে সাসানীয় নামে রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে। খুব দ্রুতই সাসানীয়রা পার্থীয়ানদের প্রাক্তন সাম্রাজ্যের পুরো এলাকাটিই নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসে এবং তার বাইরে আরও একটু নতুন জায়গাও দখল করে। সাসানীয়রা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে কোন কিছু পরিবর্তন করেনি, তারা শুধুমাত্র সাম্রাজ্যটিকে আরো কার্যকরভাবে সংগঠিত করে। গ্রীকদের যে সামান্য ছাপ তখনো এই অঞ্চলে রয়ে গিয়েছিল তা তারা সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলে, এবং ফার্সি সংস্কৃতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করে। তারা বিশাল বিশাল ভাস্কর্য, ভবন এবং মনোরম শহর নির্মাণ করে। তাদের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে জরথুষ্ট্র ধর্ম আবার জোরেশোরে ফিরে আসে- সেই আগুন আর ছাই, সূর্যালোক এবং অন্ধকার, আহুরা-মাজদা এবং আহিরমান ইত্যাদি। তখনকার দিনে মিশনারি সন্ন্যাসীরা আফগানিস্তান থেকে পশ্চিম দিকে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে আসতো। কিন্তু তারা দেখল তাদের ছড়ানো বীজের জন্য জরথুষ্ট্র ধর্মের ঘাঁটি পারস্য ছিল পাথরের মতো, কোন চারাই গজাল না। ব্যার্থ হয়ে তারা উল্টা ঘুরে পূর্ব দিকে রওয়ানা দিল, আর এ কারনেই বৌদ্ধ ধর্ম চীনে বিস্তার লাভ করল, ইউরোপে নয়। পরবর্তীকালের অগণিত ফার্সি গল্প এবং কিংবদন্তীতে এই সাসানীয় যুগের কথা উঠে এসেছে। সাসানীয়দের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট Khusrow Anushervan কে ফার্সিভাষীরা ‘ন্যায়পরায়ণ সম্রাট’ এর প্রতীক হিসাবে চেনে, হয়তবা তাঁর নামটি ইরানের পৌরাণিক প্রথম রাজবংশের তৃতীয় রাজা kay Khosrow এর নামের মতো একই রকম শুনায় বলেও। (বাংলাদেশেও নিকট অতীতে এই খসরু নামের প্রচলন ছিল)
ওদিকে তখন রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ছিল। ২৯৩ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ডাইওক্লেশিয়ান প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য রোমান সাম্রাজ্যকে চারটি অংশে বিভক্ত করেন। এই রাজ্য এতই বড় হয়ে গিয়েছিল যে একটিমাত্র কেন্দ্র থেকে একে পরিচালনা করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ডাইওক্লেশিয়ানের সংস্কারের পরিনতিতে রোমান সাম্রাজ্য দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। দেখা গেলো ধনসম্পদ সব ছিল পূর্বাঞ্চলে। আর তাই রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল পুরোই ভেঙ্গে পড়ল। যাযাবর জার্মান উপজাতিরা সেখানে ঢুকে পড়ল আর সরকারি পরিসেবা সংকুচিত হয়ে এলো, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ল, ব্যাবসা বাণিজ্যে ধ্বস নামলো। বিদ্যালয়গুলো থমকে গেলো আর পশ্চিম ইউরোপীয়দের পড়াশুনা আর লেখালেখি প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। এভাবেই ইউরোপে শুরু হল তথাকথিত ‘অন্ধকার যুগের’। আজকের জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মতো এলাকায় যেসব রোমান শহর ছিল সেগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। সমাজকাঠামো সরল হয়ে মোটাদাগে তিন শ্রেণীর মানুষে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো- ভূমিদাস, যোদ্ধা এবং পুরোহিত। একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান ওই অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষদেরকে আলগাভাবে এক সুতায় ধরে রাখতে পারল, তা হল খ্রিস্টান ধর্ম, যার খুঁটি ছিলেন রোমের বিশপ, শীঘ্রই যাকে ‘পোপ’ নামে ডাকা শুরু হলো।
রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশটি, যার সদর দফতর ছিল কনস্টান্টিনোপল (আজকের তুরস্কের ইস্তানবুল), টিকে থাকলো। স্থানীয় লোকেরা তখন একেই রোম (রোমান সাম্রাজ্য বোঝাতে) বলে ডাকতো। কিন্তু পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকদের কাছে মনে হলো আগের যে বড় রোমান সাম্রাজ্য ছিল তা থেকে এটার পরিচয় আলাদা করতে হবে- তাই তারা এই সাম্রাজ্যের একটা নতুন নাম দিলেন: বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য।
অর্থোডক্স খ্রিস্টানধর্মের কেন্দ্র ছিল এই কনস্টান্টিনোপল। পাশ্চাত্যের যে খ্রিস্টান ধর্ম তা থেকে এই অর্থোডক্স খ্রিস্টিয়ানিটির রূপ ছিল আলাদা- এদের পোপের মতো কোন কেন্দ্রীয় ধর্মগুরু ছিলনা। খৃস্টান অধ্যুষিত প্রতিটি শহরের ছিল নিজের একজন করে হেড-বিশপ, যাকে বলা হতো ‘metropolitan’। (আজকে আমরা ‘মেট্রোপলিটন’ দিয়ে বুঝাই একটি বড় শহর। মনে হচ্ছে এ শব্দের দ্বারা হয়তবা বোঝানো হতো সেইসব শহর যেগুলো এতটুকু বড় ছিল যে তার নিজস্ব একজন হেড-বিশপ বা মেট্রোপলিটন ছিলেন)। ধরে নেয়া হতো যে সব মেট্রোপলিটনরা ছিলেন সমান মর্যাদার অধিকারী, তবে আসলে কনস্টান্টিনোপলের হেড-বিশপ সবার চেয়ে উপরে ছিলেন। আর তাঁদের সবারও উপরে ক্ষমতা ছিল সম্রাটের। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের যে শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপ ছিল তা বাইজান্টাইনে এসে জড়ো হল। এখানে লেখক ও শিল্পীদের বই, পেইন্টিং, এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম তৈরি অব্যাহত থাকলো। কিন্তু ‘পূর্বের রোম’ যখন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে পরিনত হল তাঁর পর থেকে এই সাম্রাজ্যের কাহিনী পশ্চিমা ইতিহাসে মোটামুটি উহ্যই থাকে।
অনেকে এটা নিয়ে বিতর্ক করবেন- কিন্তু আমার মতে "বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য’ খ্রিস্টান ধর্মের সাম্রাজ্যই ছিল। এখানে প্রজাদের ভাষা ছিল গ্রিক। সেখানকার দার্শনিকদের ব্যাপারে বলতে গেলে..... থাক তাদের দার্শনিকদের ব্যাপারে আর না বলি। যেকোনো সুশিক্ষিত পশ্চিমাকে ধরুন- তারা সক্রেটিস, প্লেটো, ও এরিষ্টটলের কথা জানে, সোফোক্লেস, ভার্জিল, ট্যাসিটাস, পেরিক্লিস, ম্যাসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাস এবং অন্য অনেকের কথা জানে (অর্থাৎ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ববর্তী গ্রীক এবং রোমান সাম্রাজ্যের চরিত্রগুলোর কথা জানে)। কিন্তু বাইজান্টাইনদের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন এমন শিক্ষাবিদদের বাদ দিলে আর কেউই এমনকি তিনজন বাইজান্টাইন দার্শনিকের নাম অথবা দুইজন বাইজান্টাইন কবির নাম, বা সম্রাট জাষ্টিনিয়ান এর পর থেকে একজন বাইজান্টাইন সম্রাটের নামও বলতে পারবে না। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য প্রায় এক হাজারটি বছর ধরে টিকে ছিল, কিন্তু খুব কম লোকই ওই হাজার বছরে ঘটা যে কোনও পাঁচটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলতে পারবে।
প্রাচীন রোমের সাথে তুলনা করলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ততোটা কৌলীন্য ছিল না। কিন্তু তার নিজের অঞ্চলে এটি একটি সুপারপাওয়ার ছিল। মূল কারণ হল তাদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলনা, আর কারণ হল দেয়াল দিয়ে ঘেরা তাদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল ছিল বিশ্বইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে দুর্ভেদ্য শহর। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি (যখন মোহাম্মদ (সঃ) এর জন্ম হয়) বাইজেন্টাইনরা শাসন করত এশিয়া মাইনরের (তুরস্ক) অধিকাংশ আর আজকের পূর্ব ইউরোপের কিছু এলাকা। তাদের ঠোকাঠুকি চলত তখনকার দিনের ওই অঞ্চলের আরেক সুপারপাওয়ার সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে। সাসানীয়দের সুবিশাল সাম্রাজ্য তখন পুবে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই দুটি সাম্রাজ্যের মাঝখানে ছিল বিতর্কিত একফালি এলাকা- ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলবর্তী অঞ্চলসমুহ, যেখানে এই দুটি বিশ্ব ইতিহাস ওভারল্যাপ করেছিল। এবং যেখানে বিরোধ লেগেই থাকত। আর দক্ষিণে, উভয় বড় সাম্রাজ্যের ছায়ার নিচে, ছিল আরব উপদ্বীপ যা ছিল অনেকগুলো স্বায়ত্তশাসিত উপজাতি অধ্যুষিত। তো ইসলামের জন্মের আগে এই ছিল মধ্য-পৃথিবীর রাজনৈতিক ছক।
মানচিত্র- ইসলামের জন্ম মুহূর্তেঃ বাইজান্টাইন এবং সাসানিয় সাম্রাজ্যদ্বয়
অধ্যায় সমাপ্ত///
শুরুর পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগের পর্ব এখানে
পরের পর্ব এখানে
[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com এ প্রিভিউ এবং রিভিউ দেখতে।]