নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

.

ইতিহাসের পাতিহাঁস

ইতিহাসের পাতিহাঁস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডেস্টিনি ডিসরাপ্টেড- মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব ইতিহাস (০১১)

২০ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩০

খিলাফত এর জন্ম (৩)
১১-২৪ হিঃ (৬৩২-৬৪৪ খৃস্টাব্দ)

যারা আবু বকর (র) কে খলিফা হিসাবে দেখতে চাইছিলেন তাদের যুক্তি ছিল যে সেই সময়ে উম্মাহ-র প্রয়োজন ছিল স্থির বিবেচনাবোধ, তারুণ্যের আবেগ নয়। সে সময় আলীর বয়স ছিল ৩০ এর একটু উপরে আর আবু বকর ছিলেন প্রায় ৬০। সেই সময়ের আরব সমাজে একজন ৩০ বছরের মানুষকে ৬০ বছরের একজনের উপরে মুরব্বী হিসাবে মেনে নেয়াটা খুব সম্ভবত অচিন্তনীয় ছিল। কারণ, আরবীতে গোত্রপতিদের উপাধি ‘শেখ’ শব্দটার আক্ষরিক অর্থই হল ‘বয়স্ক (পুরুষ) মানুষ’

অনেকে বলেন এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে আলীর (র) দীর্ঘ ছয় মাস সময় লেগেছিল। অন্যরা আবার বলেন যে আবু বকর এর খলিফা হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই আলী তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এরকম একটা মতভেদ এতদিন পরে আর শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে মীমাংসা করা যাবে না। উত্তরাধিকারের এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই পরবর্তিতে ইসলাম এর মাঝে শিয়া ও সুন্নী নামে দুটি ধারার উৎপত্তি হয়। আপনি শিয়া না সুন্নী তার উপর নির্ভর করবে কাহিনীর কোন ভার্শনটি আপনি গ্রহণ করবেন {অনুবাদকের নোটঃ তবে মনে রাখতে হবে যে চার খলিফার যে কোনও একজনের চরিত্র হনন করা, তাঁদের কাউকে ক্ষমতালোভী, জবরদস্তীকারি হিসাবে উপস্থাপিত করা এসব ইসলামের শত্রুদেরই কাজ। আমি মনে করি এই চার খলিফার জীবনকাল মুসলিমদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত, সত্যিকার মুসলিম কেমন হবে এঁদের মধ্য দিয়েই তিনি তা আমাদেরকে দেখিয়েছেন}। এরকম অনেক ঘটনা নিয়েই শিয়া এবং সুন্নীদের আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা আছে। আলীর সমর্থকদের থেকে পরবর্তিতে শিয়া মতবাদ জন্ম হয়, যারা আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করে মহানবীর পরে নেতৃত্ব একমাত্র আলী (র) এরই প্রাপ্য ছিল।

যাই হোক, আলী এবং আবু বকর এর মাঝে যদি কোনো সমস্যা থেকেও থাকে সেটি মিটে যেতে কোনো বর্ণনা মতেই ছয় মাসের বেশি লাগেনি। আর সেটা একেবারে সময় মতই হয়েছিল। কারন ইসলামের অস্তিত্ব তখন নতুন এক সংকটের মুখোমুখি হয়। সমগ্র আরব জুড়ে গোত্রগুলো মোহাম্মদ (সঃ) এর সাথে করা তাদের সন্ধিচুক্তি গুলো ভাংতে শুরু করল। বেশির ভাগই বলল যে তাদের আনুগত্য ছিল ব্যাক্তি মোহাম্মদ এর প্রতি। আবু বকরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ কিংবা ‘মুসলিম উম্মাহ’ এর সাথে কোনও চুক্তি তো তারা করেনি। মোহাম্মদ এর মৃত্যুর ফলে আগের বোঝাপড়া তাই এখন শেষ। এইসব গোত্রের লোকেরা এতদিনে অবশ্য সবাই নামেমাত্র হলেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাদের অনেকে বলল যে তারা এখনও মুসলমানই আছে। এখনও আল্লাহ যে এক সেটা বিশ্বাস করে, মোহাম্মদ কে নবী মানে, তারা নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, মদ্যপান এবং ব্যভিচার বেশি না করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যাকাত, যেটা মদিনার কোষাগারে জমা দেয়ার কথা? না সেটা আর সহ্য করা সম্ভব হবে না, যাকাত আর তারা দেবে না।

কোন কোন গোত্রের নেতারা জিনিসটাকে আরেক স্তর উপরে নিয়ে গেল। তারা নিজেদেরকে নবী বলে দাবি করতে শুরু করল, এটাও দাবি করল যে তাদের কাছে নাকি সরাসরি অহি নাজিল হয় আর ধর্মীয় বিধিবিধান জারি করার ক্ষমতাও তাদের আছে। তারা ধর্মকে ব্যাবসার এক উর্বর মাধ্যম হিসাবে দেখল। এই ‘নবীন উদ্যোক্তা’রা (startup?) চাইলো মোহাম্মদ (সঃ) এর অনুকরনে নিজের নিজের সার্বভৌম উম্মাহ গড়ে তুলতে।

আবু বকর যদি এসব অনিয়মকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিতেন তাহলে ইসলাম নিশ্চিত ভাবেই অন্য কোন দিকে মোড় নিত। এটা হয়ত পরিণত হত কিছু বিশ্বাস আর চর্চার একটি প্যাকেজে যা মানুষ শুধুমাত্র তাদের ব্যাক্তিগত পরিমণ্ডলে ধারণ করতো। কিন্তু এই সংকটের মোকাবেলায় আবু বকর কঠোর পথ নিলেন। নব্যুয়ত দাবি করা কিংবা মুসলিম দাবি করেও যাকাত এর বিধান অস্বীকার করা- এইসব ভণ্ড মুসলিমদেরকে রাষ্ট্রদোহীতার অপরাধীদের মতো করে তিনি ট্রিট করলেন। নবীজি বলেছেন ধর্মের ব্যপারে জোরাজুরি করা যাবে না। আবু বকর এটা মানলেন যে ইসলাম গ্রহণ বা বর্জন করার সম্পুর্ণ স্বাধীনতা মানুষের আছে। কিন্তু মুসলিম দাবী করলে এর পর আর ধানাই পানাই চলবে না। এর থেকে যে ধর্মীয় কনসেপ্ট উদ্ভুত হয় তা হলো- আল্লাহ যে রকম এক/অবিভাজ্য, মুসলিম উম্মাহকেও এক এবং অবিভাজ্য হতে হবে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আবু বকর ইসলামকে শুধুমাত্র একটি ধর্ম বিশ্বাসই নয় বরং একটি সামাজিক প্রজেক্ট হিসাবে আরো জোরদারভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন।

নতুন খলিফা একজন তুখোড় পরিকল্পনাবিদ হিসাবেও পরিচিতি পেলেন। মাত্র এক বছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যেই তিনি সব বিদ্রোহ দমন করে আরবকে একত্রিত করলেন।

অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে, মদিনার মানুষের সঙ্গে তাঁর আচরণে ছিল শুধুই বিনয়, স্নেহ এবং দয়াশীলতা- যে সকল গুনাবলির জন্য মানুষ সব সময়ই তাঁকে জানত এবং ভালোবাসত। ন্যুব্জ কাঁধ আর গভীর চোখের মানুষ আবু বকরের পোশাক ও বসবাস ছিল খুব সাদাসিধা এবং তাঁর কোন সম্পদ বা সঞ্চয় ছিল না। তাঁর একটা শখ ছিল তিনি চুল এবং দাড়ি মেহেদি দিয়ে রঙ্গিন করতেন। কোনও বিরোধ মিমাংসার ব্যাপার হলে তিনি শুধুমাত্র আইনের চোখ দিয়ে বিচার করতেন। তাঁর সব সিদ্ধান্তে প্রবীণদের একটি কাউন্সিলকে সাথে রাখতেন যেখানে সকলের কথারই সমান গুরুত্ব ছিল। তাঁর কর্তৃত্ত্বের ভিত্তি এটা ছিল না যে অন্য কারও চেয়ে তিনি বেশি ধার্মিক বা তিনি সবার চেয়ে বড়/গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম। তার কর্তৃত্বের উৎস ছিল শুধুমাত্র তাঁর প্রজ্ঞা এবং কোরআনের প্রতি তার নিষ্ঠা। তাঁর বিধি-বিধান বা বিচার সঠিক না হলে তা মানতে কেউ বাধ্য ছিলেন না। কিন্তু ঘটনা হল, তাঁকে বেঠিক বলার মতো পরিস্থিতি প্রায় কখনোই হয়নি।

হিজরতের আগে, মক্কার দিনগুলোতে আবু বকর একজন সমৃদ্ধশালী বণিক ছিলেন। তবে তাঁর সম্পদের অনেকটাই তিনি ব্যয় করে ফেলেছিলেন সেবামুলক কাজে, বিশেষত যেসকল ক্রীতদাসরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের স্বাধীনতা কিনে দিতে। আর হিজরতের সময় তাঁর বাকী সম্পদও তিনি মক্কায় ফেলে আসেন। খলিফা হিসাবে তিনি সামান্য কিছু বেতন নিতেন আর পাশাপাশি অল্প পরিসরে তাঁর আগের ব্যাবসাও চালু রাখেন। তিনি কোনোমতে দিন গুজরান করতেন। এমনকি তিনি মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের গরুর দুধ দুইয়ে দিয়ে কিছু উপার্জন করতেন। ইসলামিক কাহিনীগুলোতে আমরা পাই যে মদিনার রাস্তায় তিনি যখন হেঁটে যেতেন তখন তখন শিশুরা তাঁর দিকে ছুটে আসতো আর তিনি তাদেরকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন এবং ক্যান্ডি (তখনকার দিনে সুইট/ চকলেট টাইপ যা ছিল তাই) বিতরণ করতেন।

শুরুর পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগের পর্ব এখানে
পরের পর্ব এখানে

[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com এ প্রিভিউ এবং রিভিউ দেখতে।]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.