নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

.

ইতিহাসের পাতিহাঁস

ইতিহাসের পাতিহাঁস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডেস্টিনি ডিসরাপ্টেড- মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব ইতিহাস (০১২)

২৬ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৪০

খিলাফত এর জন্ম (৪)
দ্বিতীয় খলিফা
১৪ – ২৪ হিজরি

খিলাফতের দ্বিতীয় বছরে অগাস্ট মাসের এক দিন আবু বকর (র) গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে বের হলেন, আর এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে তার গায়ে লাগল। রাত নামতেই তাঁর খুব জ্বর আসল। তিনি বুঝতে পারলেন যে মৃত্যু অত্যাসন্ন। সমাজের কয়েকজন অতি গণ্যমান্য ব্যাক্তিকে ডেকে তিনি বললেন যে তিনি ওমর (র) কে উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষনা করে যেতে চান, যাতে এটা নিয়ে পরবর্তিতে কোনো বিরোধ সৃষ্টি না হয়।

কিন্তু গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা বেঁকে বসলেন, কারন নম্র আর অমায়িক আবু বকরের তুলনায় ওমর ছিলেন একেবারেই ভিন্ন রকমের মানুষ। ওমর ছিলেন বিশালাকার, অন্য সবার থেকে আধা মানুষ বেশি লম্বা- ভিড়ের মধ্যে থাকলে মনে হত যেন বাকিরা মাটিতে দাঁড়িয়ে আর তিনি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার। তাঁর মুখমণ্ডল ছিল রক্তিমাভ আর তিনি দুই হাতেই সমানভাবে কাজ করতে পারতেন। আর বিখ্যাত ছিল তাঁর চড়া মেজাজ।

ইসলাম গ্রহনের পূর্বে ওমর এর মারামারি আর পান করার অভ্যাস ছিল বলে জানা যায়। সেই সময় তিনি ইসলাম এবং মোহাম্মদ (সঃ) কে ঘৃণা করতেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী মুসলিমদের মাঝে সুবিদিত। বলা হয়ে থাকে যে, একদিন তিনি ঘোষণা দিলেন তিনি মোহাম্মদ কে হত্যা করবেন আর মক্কার সব গণ্ডগোল মিটিয়ে দেবেন। এরপর তিনি তাঁর তলোয়ার নিয়ে শহরের মধ্য দিয়ে রওয়ানা দিলেন। পথিমধ্যে তিনি দেখলেন তার আদরের বোন একটি গাছের নিচে বসে একটা পাতার উপর লেখা কি যেন পড়ছে।

'তুমি কি করছ?' তিনি প্রশ্ন করলেন।
‘পড়ছি’।
‘কি পড়ছ?’
‘কোরান, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি’- ভয়ে ভয়ে বললেন তাঁর বোন।
‘কি?! এটা আমাকে দাও।‘ এই বলে তিনি সেটা ছিনিয়ে নিলেন।

সেই আয়াত ছিল সুরা তা’হার অংশ বিশেষ। ওমর অবাক হয়ে দেখলেন আয়াতগুলো যেনো ঠিক তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। সেই মুহূর্তেই ওমর এর ভিতরটা বদলে গেল। তিনি তাঁর তলোয়ার ফেলে দিলেন আর মক্কার রাস্তা দিয়ে দৌড়ে মোহাম্মদ এর দরজায় গিয়ে করাঘাত করলেন- ‘আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি। আপনিই আল্লাহর নবী'

{অনুবাদকের নোটঃ এই ঘটনা এত সংক্ষিপ্ত না। অন্যান্য সুত্রে দেখা যাচ্ছে, এর আগে থেকেই আরও কিছু ঘটনা ছিল ওমর আর মোহাম্মদ (সঃ) এর মধ্যে। তবে সেদিন তিনি নবীজিকে মারতেই বের হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বোনকে কোরআন পড়তে তিনি সম্ভবত কোনো গাছতলায় দেখেননি। পথে এক সাহাবীর (না’ইম ইবনে আব্দুল্লাহ (র)) সাথে দেখা হলে ঐ সাহাবী ওমরকে নাকি বলেছিলেন- মোহাম্মদ কে মারবেন তো বুঝলাম, আগে নিজের বোনের সাথে গিয়ে কথা বলেন (মানে, তোমার ঘরেই তো সমস্যা ঢুকে গেছে)। তখন ওমর তাঁর বোনের বাড়ি যান এবং কোরআন তেলাওয়াত শুনতে পান। ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে হচ্ছে লেখক এখানে শর্টকাট মেরে দিয়েছেন, তবে মূল থীম একই।}

এরপর তিনি মোহাম্মদ (স) এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের একজন হয়ে ওঠেন। কিন্তু কঠোর মানুষদের জন্য তিনি কঠোর ই থেকে গেলেন। তাঁর ভয়ংকর রাগ মাঝে মাঝে প্রকাশ পেয়ে যেত। এসবের আড়ালে তাঁর অন্তর যে ভাল ছিল তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু অনেকেই ভাবলেন এমন একজনকে খলিফার দায়িত্ব দেয়াটা ঠিক হবে কি না। এই গুরূত্বপূর্ন সময়ে আলী (র) এগিয়ে এসে ওমর এর প্রতি তাঁর সমর্থন জানালেন। আলীর কথায় পাল্লা ওমর এর দিকে ভারি হয়ে গেল। আর এভাবেই মুসলিমরা পেলো তাদের দ্বিতীয় খলিফা।

দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ওমর সমাজের লোকদেরকে বললেন যে তিনি জানেন তাকে মানুষ ভালবাসার তুলনায় ভয়ই বেশি পায়। কিন্তু এর কারণ হলো এতদিন তারা তাঁর চরিত্রের একটি দিক ই শুধু দেখতে পেয়েছে। মোহাম্মদ এবং আবু বকর দুজনই ছিলেন দয়ালু হৃদয়ের মানুষ। কিন্তু নেতৃত্ব দিতে গেলে কখনো কখনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আর এরকম অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ওমর ই ছিলেন তাঁদের পছন্দ। এখন যখন তিনি খলিফা, তিনি অন্যরকম হবেন। কারণ তিনি জানেন একজন নেতাকে মাঝে মাঝে নম্রও হতে হয়। তাই এখন থেকে জনগণ তার চরিত্রের উভয় দিকই দেখতে পাবে। যারা খারাপ কাজ করবে, দূর্বলের উপর অত্যাচার করবে, তারা পুরনো ওমরকেই দেখতে পাবে। অপরদিকে দরিদ্র, অনাথ, বিধবা এবং অন্য যারাই ভাল পথে থাকবে এবং যাদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে তারা দয়ালু ওমরকে পাবে।

উম্মাহ খুব শিঘ্রই বুঝতে পারল ওমর কিরকম সুউচ্চ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। ওমর উম্মাহর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দশ বছর। এই দশ বছরেই তিনি ইসলামের ধর্মতত্বের গতিপথ নির্ধারণ করে দেন এবং ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনকে রূপ দান করেন। তিনি মুসলিম সভ্যতাকে এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রদান করেন এবং এমন একটি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন যা কিনা রোমান সাম্রাজ্য থেকেও বড় এক সাম্রাজ্যে পরিনত হয়।

এতগুলো অর্জনের যে কোন একটাই যথেষ্ট ছিল তাঁকে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্রদের তালিকায় একজন হিসেবে জায়গা করে দিতে। আর সবগুলো অর্জন একসাথে ধরলে তো সেটা সেন্ট পল, কার্ল মার্ক্স, লরেঞ্জো ডি মেডিচি এবং নেপোলিয়ন- এদের সবার মিলিত অর্জনের মতো কিছু একটা ছিল। অথচ ইসলামের বাইরের অধিকাংশ লোকই তাকে শুধুই একটি নাম হিসাবে জানে। খুব বেশি হলে জানে মাত্র দুই লাইনের একটা পরিচয়- 'ওমর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন, মোহাম্মদ এর একজন উত্তরসূরী', ব্যাস এতটুকুই।

এর কিছুটা সম্ভবত এই কারণে যে ওমরের অন্যতম মূলনীতি ছিল কোনরকম ভাব না দেখানো। এই গুণটি তার কিংবদন্তির এতটাই বড় অংশ যে মুসলিমদের কাছে ওমর হয়ে ওঠেন একটি আদর্শ, যেখানে শাসকের কথামাত্রই কোনো আইন নয়, শাসকের ইচ্ছাই শাসন নয়, বরং সকল কর্তৃত্ব ছিল আল্লাহর। তিনি ইসলামকে দেখতেন একটি নিরংকুশ ন্যায় এবং সাম্যের সম্প্রদায় হিসাবে এবং তিনি তার এই দর্শনকে বাস্তবে রূপ দিতে সচেষ্ট ছিলেন। মুসলিম সম্প্রদায়ে কারো কখনোই কোনও মানুষের খেয়াল খুশিকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ এই সম্প্রদায়ের আইন হল কুরআন, আর নবীজির (সঃ) জীবন হলো এর গাইড। আর এই দুইয়ের বাইরে অন্য কিছুরই প্রয়োজন নেই। ওমর ঘোষনা করলেন যে তাঁর কাজ শুধু উম্মাহকে একত্রে রাখা আর কোরানের প্রদর্শিত পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলা নিশ্চিত করা।

ওমর কখনোই ধনী ব্যাক্তি ছিলেন না। আলী এবং আরও কয়েকজন মিলে তাকে বুঝালেন যে খলিফা হিসাবে তাঁর এখন উচিত একটি উপযুক্ত বেতন গ্রহণ করা। মুসলিম সাম্রাজ্য যেহেতু এখন অনেক বড়, সম্পূর্ণ আরব জুড়েই বিস্তৃত, আমাদের এখন পার্ট টাইম খলিফা দিয়ে চলবে না, যাকে কিনা অর্থ উপার্জনের জন্য প্রতিবেশীর গরুর দুধ দোয়াতে হবে। ওমর তাদের কথা মানলেন এবং একটি কমিশন গঠন করে দিলেন যাদের কাজ হলো এটা বের করা যে একজন গড়পড়তা নাগরিকের জীবনযাত্রার ব্যায় কত। তিনি ঠিক সেই পরিমানটাই নিজের বেতন হিসাবে নির্ধারন করলেন, বেশিও না কমও না।

মহানবীর অনুসরণে ওমর ও সবসময় নিজের কাপড় নিজেই সেলাই/মেরামত করতেন, অনেক সময় রাষ্ট্রের জরুরী কাজ করতে করতেই। তাঁর সম্পর্কে এটাও বলা হয় যে রাতের বেলা তিনি নিজের পিঠে এক বস্তা শস্য নিয়ে মদীনার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অভাবী মানুষের মাঝে বিলি করতেন। একবার কেউ একজন তাঁকে চিনতে পেরে ওই বস্তাটা বহন করতে চাইল। ওমর (র) বললেন তুমি দুনিয়াতে আমার বোঝা বহন করতে পারবে কিন্তু আখেরাতে আমার বোঝা কি অন্য কাউকে বহন করার অনুমতি দেয়া হবে?

আপনি এইসব ঘটনাকে শুধুমাত্র কিংবদন্তি বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। হয়ত আপনি এটাও বলতে পারেন যে কাহিনীগুলো সত্য হলেও এগুলো একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে জনগনের প্রতি ওমর (র) এর মায়া দেখানোর প্রচেষ্টা মাত্র। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি যে তিনি আসলেই স্ট্রাইকিংলি ধার্মিক, ভণিতাহীন, নিবেদিত এবং জোরালো চরিত্র ছিলেন, ঠিক যেরকমটা এই কাহিনিগুলো আমাদেরকে ধারণা দেয়। তাঁর সম্পর্কে যেসব কাহিনী চলে এসেছে সেগুলো এত বেশি রকম সামঞ্জস্যপূর্ণ যে এগুলোকে ফেলে দেয়া যায়না। আর এই মানুষটি তার সমসাময়িক মানুষদের উপর যে বিশাল প্রভাব রেখে গেছেন সেটা আপনি আর কি দিয়েই বা ব্যাখ্যা করবেন? বাস্তবতা যাই থেকে থাকুক না কেন, মুসলিম মানসে ওমর যে কিংবদন্তি রেখে গেছেন সেটাই হয়ে দাঁড়ায় একজন আদর্শ শাসকের আচরণ কিরকম হবে তার মানদন্ড।

শুরুর পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগের পর্ব এখানে
পরের পর্ব এখানে

[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com এ প্রিভিউ এবং রিভিউ দেখতে।]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.