নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

.

ইতিহাসের পাতিহাঁস

ইতিহাসের পাতিহাঁস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডেস্টিনি ডিসরাপ্টেড- মুসলিম বিশ্ব ইতিহাস (০১৪)

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৭

খিলাফত এর জন্ম (৬)
দ্বিতীয় খলিফা
১৪ – ২৪ হিজরি

ওমর (র) যখন মারা যান মুসলিম শাসনাধীনে তখন ২০ লক্ষ বর্গমাইলের ও বেশি এলাকা [তার মানে ৩৭ টা বাংলাদেশের সমান- বাংলাদেশের আয়তন ৫৫ হাজার বর্গমাইল হিসাবে]। এতো কম সময়ে এত বিশাল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? ধার্মিক মুসলিমরা হয়ত এটাকে শুধুই আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসাবে দেখবেন। তবে ইতিহাসের পন্ডিতরা এর একটি ব্যাখ্যা এভাবে দেন যে, তৎকালীন দুই পরাশক্তি বাইজান্টাইন এবং সাসানিদ সাম্রাজ্য সেই সময় একে অপরের সাথে মারাত্মক শক্তিক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ করেছিল। যদিও তাদেরকে বাইরে থেকে শক্তিশালী দেখাচ্ছিল, ভিতরে ভিতরে তাদের কাঠামো ফোকলা হয়ে গিয়েছিল এবং তারা পতনের মুখেই ছিল। কেউ কেউ [এরা কারা পাঠক নিশ্চয় চিনেন] বলার চেস্টা করেন যে মুসলিমরা অন্য সবার চেয়ে বেশি জোশ নিয়ে লড়াই করত কারন তারা বিশ্বাস করত যে মরলে তারা সরাসরি বেহেস্তে যাবে এবং হুরপরী পাবে ইত্যাদি। আমি এইসব 'যুক্তি'র উপর কমেন্ট করার দরকার মনে করছি না। বরং অন্য সম্ভাব্য কারণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব।

প্রথম দিকের সেই মুসলিমরা বিশ্বাস করতেন যে তারা এই সৃষ্টিজগতের ভাগ্য নির্ধারক (apocalyptic- এর জুতসই বাংলা কেউ কমেন্টে জানালে বাধিত হব) বিশাল কিছুর জন্য লড়াই করছেন। ইসলামের জন্য সংগ্রামের মাঝে তারা জীবনের মানে খুঁজে পান এবং তাদের বিশ্বাস ছিল এর ফলে মৃত্যু হলে তাও হবে অর্থবহ। প্রাণী হিসাবে মানুষ এটা বার বার প্রমাণ করেছে যে যখন তারা কোন কিছুর মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পায় তখন তারা অসম্ভব সব বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করার এবং অশেষ কষ্ট সহ্য করার শক্তি পেয়ে যায়। জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার জন্য মানুষের যে আকাঙ্খা তা খাদ্য এবং পানীয়ের মতোই একটি মৌলিক ক্ষুধা। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ এই ক্ষুধা নিবারণের সুযোগ খুব একটা পায় না। এ কারণেই যখন মানুষ একটি apocalyptic ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে নিজেকে দেখতে পায়, তারা এতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খলিফা ওমরের আমলে মুসলিম যোদ্ধারা নিজেদের এমন একটা অবস্থানেই দেখতে পেতেন।

আর মদিনার তৎকালীন বাস্তবতাও তাদের আদর্শবাদিতাকে জিইয়ে রেখেছিল- ওমর মুখে যা বলতেন, কাজে সেটাই করতেন। সবার জন্য যেটা নিয়ম করতেন, সেটা নিজে পালন করতেন। মুসলিমরা যেসকল গুণাবলী বাকি দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগ ওমরের মদিনাতে দেখা যেত। যেমন- ভাতৃত্ববোধ, সম্প্রীতি, ফেয়ারনেস, ভদ্রতা, সাম্য, সহমর্মিতা,সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহন ইত্যাদি। নিদেনপক্ষে অন্য যে কোন সাম্রাজ্যের তুলনায় প্রথম দিককার খিলাফতের সময় মুসলিম সমাজে এইসকল আদর্শের বাস্তবায়ন এত বেশি রকম দেখা যেত যে পরবর্তীকালের মুসলিমরা সেটাকে সামান্য ঘষামাজা করে সহজেই হারিয়ে যাওয়া এক আদর্শ সময়ের স্মৃতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল।

অন্যদিকে দূর দুরান্তের মানুষ কাহিনীর পর কাহিনী শুনতে পাচ্ছিল যে মুসলিমরা কিভাবে অসম্ভব সব বাধার বরুদ্ধে লড়াই করে সামরিক বিজয় ছিনিয়ে আনছিল। এমন এক শক্তিকে বাধা দেয়ার চেস্টা করাটা অর্থহীন মনে হতে লাগল। তার উপর সাধারণ মানুষের কোনো কারণও ছিলনা মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করার। কারণ বিজিত হলেও তাদের জীবনে খুব একটা কোন পরিবর্তন আসার আশংকা ছিল না। তাদের যারা শাসক ছিল তারা হয়ত সব ধনদৌলত হারাবে, কিন্তু সাধারন জনগণের সম্পত্তি যেমন ছিল তেমনই থাকবে। [অনুবাদকের নোটঃ আমাদের মনে রাখতে হবে 'নেশন স্টেট' জিনিসটা মাত্র তিন চারশ বছরের পুরানো একটা কনসেপ্ট, এর আগে শাসন ক্ষমতায় জনগণের তেমন কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। আজকে আমরা যেরকম পরিচয়ে চিনি সেরকমভাবে রাষ্ট্র ছিল না, ছিল সাম্রাজ্য। সম্রাট গেলে অন্য সম্রাট আসবে, সেই সম্রাট হতে পারে বর্তমানের শাসকগোষ্ঠীর কেউ, হতে পারে অন্য কোনো জাতির, তার গায়ের রঙ বা ভাষাও হতে পারে ভিন্ন- সে বেশি অত্যাচারী না হলেই পাবলিক খুশি। রোমান সাম্রাজ্য বা খিলাফতের মতো বড় বড় কিছু শাসন ব্যাবস্থা 'কিছুটা' সার্বজনীন রাষ্ট্রের আদল নিতে পেরেছিল এবং সে কারনেই তারা এতটা সফলতা পেয়েছিল। অন্যদিকে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের সাম্রাজ্য তার মৃত্যুর সাথে সাথেই টুকরা টুকরা হয়ে যায়। বলে রাখি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়াশুনা নাই, এটা আমার বুদ্ধিতে যেটা বুঝলাম বললাম] আরবদের যুদ্ধ যদি বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে হত, যারা কিনা নিজেদের ঘরবাড়ি বাঁচানোর জন্য লড়ছে, তাহলে সে লড়াই হত অনেক বেশী কঠিন এবং ফলশ্রুতিতে তারা ধীরে ধীরে তাদের লড়াইয়ের আদর্শিক দিকটি হারিয়ে ফেলত। কিন্তু দূর দূরান্তের এলাকাতেও তাদের প্রতিপক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই ছিল ভাড়াটে সৈনিক বা চাপে পড়ে লড়তে আসা যোদ্ধা (draftee)।

জীবনের মিনিং খুজে পাওয়ার সাথে সাথে আর একটি ফ্যাক্টর ছিল যা না বললেই নয়- যুদ্ধ মুসলিমদেরকে গণিমতের সম্পদ প্রাপ্তির সুযোগ করে দিত। সাধারণ নাগরিকদের সম্পত্তি গণিমত হিসাবে নেয়ার অনুমতি ওমর মুসলিম যোদ্ধাদেরকে দেননি। যুদ্ধের ময়দানে যা পাওয়া যেত সেটা, আর যে রাজাদেরকে পরাজিত করা হত তাদের কোষাগার- এগুলো নেয়া বৈধ ছিল এবং সেগুলোই পরিমাণে অনেক ছিল। এভাবে যা পাওয়া যেত তার পাঁচ ভাগের চার ভাগ যোদ্ধাদের মাঝে সমান ভাবে ভাগ হত, সেখানে সৈনিক আর জেনারেলের কোনও পার্থক্য ছিল না, সবার ভাগই সমান।

বাকি এক পঞ্চমাংশ মদিনাতে পাঠানোর নিয়ম ছিল। মহানবীর সময়ে চল ছিল যে এই অংশটা সাথে সাথেই গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হত [মানে, কোষাগারে জমা রাখা হত না]। ওমরের সময়ও এই নীতি মোটামুটিভাবে বজায় থাকে। উপরের সবগুলো ফ্যাক্টর একসাথে বিবেচনায় নিলে মুসলিম খিলাফতের [সেই সাথে ইসলামেরও] এরকম দ্রুত বিস্তারকে আর ব্যাখ্যাতিত মনে হয়না।

এই লিঙ্ক এ ক্লিক করলে দেখতে পাবেন ৬৩২ থেকে ৬৫৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝে (১০- ৩৩ হিজরী) ধাপে ধাপে কিভাবে ইসলামিক রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

মুসলিমদের কাছে সামরিক বিজয় আর বিজিত মানুষদের ইসলাম গ্রহণ, এই দুটো ছিল ভিন্ন জিনিস। ‘তরবারির মাধ্যমে ধর্ম বিস্তার’ বলে কিছু ছিলনা। মুসলিমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনে সচেষ্ট ছিল ঠিক, কিন্তু তাদের প্রজারা সবাই মুসলিম হতে হবে এরকম কোন চাহিদা ছিলনা। বরং মুসলিম সেনাদল যেখানেই গিয়েছে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন তাদের পিছে পিছেই গিয়েছে। মুসলিমদের সামাজিক প্রজেক্টের খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে যায়। কারণ যে অঞ্চলে এটা ঘটছিল তা ছিল মধ্য পৃথিবীর সেই ঐতিহাসিক এলাকায় যা প্রধান প্রধান স্থল ও জল পথের সংযোগস্থলে অবস্থিত। প্রথম ৫০ বছরে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্ত , ভূমধ্যসাগরের পূর্ব প্রান্ত, নীল নদ, কাস্পিয়ান সাগর এবং পারস্য উপসাগরের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায়। এই এলাকার পারস্পরিক যোগাযোগ সমৃদ্ধ জনপদগুলোতে মুসলিমদের কাহিনী বিদ্যুৎ গতিতে [মনে হয় না মানুষ সেই সময় বিদ্যুৎ কি জিনিস সেটা জানত, কিন্তু বিদ্যুতের গতিতো সেইম ই ছিল। বিজ্ঞানীরা কি বলেন?] মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল- আড্ডা, গল্পগুজব আর পন্ডিতদের তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে। এভাবে ছড়িয়ে যাওয়াটা খুব সহজেই ঘটেছিল কারণ মুসলিম আইডিয়াগুলো একেবারে নতুন/ অপরিচিত কিছু ছিলনা। সেসময় একদিকে জরথুষ্ট্র দুনিয়া একেশ্বরবাদের খুব ধারে কাছেই ঘোরাঘুরি করছিল, আরেকদিকে বাইজান্টাইনদের পরিচয় ছিল খৃষ্টধর্মের সাথে। আরও বহু আগেই ইহুদি ধর্ম খুব কড়া রকমের একেশ্বরবাদের সাথে পরিচয় করিয়েছিল লেভান্ট [ইরাক থেকে মিশর পর্যন্ত এলাকা] অঞ্চলের মানুষকে।

একদিকে যখন একজন বিজেতা হিসাবে ওমর ইসলামের ভৌগলিক বিস্তৃতির নির্দেশনা প্রদান করছিলেন, অন্যদিকে একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে তিনি ইসলামের ধর্মীয় দর্শনের কনসলিডেশনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এবং মুসলিম জীবনধারা বলতে কি বোঝায় তা পরিস্ফুট করছিলেন। আবু বকর (র) এটা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে ইসলাম শুধুমাত্র একটা 'সম্প্রদায়' এর এব্সট্রাক্ট ধারণা ছিলনা, বরং এটা একটা 'বিশেষ' সম্প্রদায় ছিল যাদের কাজ হল পৃথিবীতে পরিবর্তন নিয়ে আসা। ওমর একটি নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করে এই ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিলেন। তিনিই হিজরী ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেন, যার শুরুটা মোহাম্মদ (স) এর জন্মদিন থেকে নয়, প্রথম কোরান নাজিলের দিন থেকেও নয়, বরং মক্কা থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মদিনাতে হিজরতের দিন থেকে গণনা করা হয়। ওমরের ক্যালেন্ডার এই বিশ্বাসকেই জোরালো করল যে ইসলাম শুধু মাত্র ব্যাক্তিগত মুক্তির একটা পথ নয় বরং পৃথিবীটা কিভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত তার একটা প্ল্যান। যেমন, অনেক ধর্ম তাদের অনুসারীদেরকে বলে– ‘পৃথিবীটা ভেজাল, কিন্তু তুমি এর থেকে দূরে/বেঁচে থাকতে পার’। কিন্তু ইসলাম তার অনুসারীদেরকে বলে- ‘পৃথিবীটা ভেজাল, কিন্তু তুমি একে বদলাতে পার’। এটা সম্ভবত মোহাম্মদ (সঃ) এর বাণীর মধ্যে শুরু থেকেই অন্তর্নিহিত ছিল, কিন্তু ওমর (র) তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে একে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

শুরুর পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগের পর্ব এখানে
পরের পর্ব এখানে

[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com এ প্রিভিউ এবং রিভিউ দেখতে।]

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৮

রাজীব নুর বলেছেন: সব মানূষই এক অসমাপ্ত কাহিনী । কোনো মানূষই তার জীবনের সব ঘটনা, সব কাজ শেষ করে যেতে পারে না । জীবনের অনেকটা বাকি থাকতে থাকতেই অনেকে খেলার মাঠ ছেড়ে চলে যায় । দেনা-পাওয়ার হিসেব মিলবে না । এই খেলার একজন খেলুড়ে তো আপনিও ।

২| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৩৮

কাজী আবু ইউসুফ (রিফাত) বলেছেন: হযরত ওমর (রা:) সময়ে নাকি দুর্ভিক্ষ /প্লেগ/মহৃমারি হয়েছিল ; এবং তিনি নবী পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন করেছেন--এই কথাগুলো ব্লগে পূর্বে গাজীসহ দুয়েকজন বলেছে -সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। তবে আপনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত একটৃনা গোগ্রাসে পরলাম। সব পর্ব পড়েই ক্ষান্ত হবো দোয়া করবেন-আপনার লেখনিতে মনে হয় যেন সেলুলয়েড ফিতায় ইতিহাস দেখতে পাই। যাযাকাল্লাহ খাইরান।

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১:৪৪

ইতিহাসের পাতিহাঁস বলেছেন: রিফাত ভাই, দেখতে পাচ্ছি বইটি ২০১৮ সালে কেউ একজন বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন। আমি পড়ে দেখিনি কেমন অনুবাদ হয়েছে। যদি এর মধ্যে না পড়ে থাকেন, জোগাড় করে পড়ে নিতে পারেন। রকমারি'র লিঙ্কঃ Click This Link আপাতত প্রিন্ট এ নাই বলছে অবশ্য। ধন্যবাদ।

৩| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩১

প্রশ্নবোধক (?) বলেছেন: আপনি ইসলামের দাম দিলেন মূল্য নয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.