নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

.

ইতিহাসের পাতিহাঁস

ইতিহাসের পাতিহাঁস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডেস্টিনি ডিসরাপ্টেড- ০১৫: ওমর (র)।। নারী ক্ষমতায়ন, দাসপ্রথা, মাদক এবং ব্যাভিচারের শাস্তি, তৃতীয় খলিফা নির্বাচন

০৩ রা এপ্রিল, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১৯

খিলাফত এর জন্ম (৭)
দ্বিতীয় খলিফা
১৪ – ২৪ হিজরি

প্রথম খলিফা আবু বকরের (র) খিলাফতের সময়েই (ওমর (র) এর পরামর্শে) কুরআনের সবগুলো আয়াতকে একসাথে গ্রন্থনা করা হয়। শুরুর দিকে মুসলিমদের কাছে কুরআন ছিল একটা অগোছালো সংগ্রহ। আয়াতগুলো মহানবীর (সঃ) জীবনকালে অনেক বছর জুড়ে নাজিল হয়েছিল। যখন যে আয়াতগুলো নাজিল হচ্ছিল, মুসলিমরা হাতের কাছে যা পেয়েছিলেন (পার্চমেন্ট কাগজ, চামড়া, পাথর, হাড্ডি ইত্যাদি) তাতেই সেগুলো লিখে বা খোদাই করে রাখছিলেন। ওমর (র) খলিফা হওয়ার পর তাঁর উপস্থিতিতে প্রতিটি লিখিত আয়াত মানুষের মুখস্থ ভার্সনের সাথে মিলিয়ে দেখা হলো, বিশেষত পেশাদার আবৃত্তিকারদের সাথে। এঁদেরকে তখনকার সমাজে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার হিসাবে গণ্য করা হতো। এরপর সাক্ষীদের উপস্থিতিতে পেশাদার লেখকেরা প্রতিটি আয়াতের অনুমোদিত কপি লিপিবদ্ধ করেন। সেগুলোকে একত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহে পরিনত করা হয়।

যখনি কোন কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতেন, ওমর কুরআনের মধ্যে সমাধান খুঁজতেন। কুরআনে যদি উত্তর খুঁজে না পেতেন তবে তিনি কম্যুনিটির মানুষদের সাথে আলোচনা করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন যে একইরকম পরিস্থিতিতে মহানবী (সঃ) কি করেছেন বা বলেছেন। এখানে কম্যুনিটি বলতে বোঝানো হচ্ছে নবীজির সাহাবীদেরকে, যাদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়ই ছিলেন। এভাবে যখনই কম্যুনিটি কোনও একটি বিষয়ের উপর রায় দিতেন, ওমর দলিল লেখকদের দিয়ে সেটি লিখিয়ে সব প্রাদেশিক গভর্নরদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এটা অনুসরণ করতে পারেন।

ওমর ফুল-টাইম স্কলারদের কিছু পদ তৈরি করেন যাদের চাকরি-ই ছিল কোরআন, হাদিস এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করা, যাতে যখনই কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের দরকার হয়, তিনি যেন এঁদের কাছে তা পেতে পারেন। এখান থেকেই উৎপত্তি হয় মুসলিমদের অন্যতম প্রধান সামাজিক প্রতিস্ঠান ‘উলামা’র। উলামা শব্দের ইংরেজি হচ্ছে স্কলার।

মুসলিম আইনের কাঠামো মজবুত করার পাশাপাশি ওমর মদিনার সমাজে এর বাস্তবায়নেও ব্যাস্ত ছিলেন। আর এক্ষেত্রে আমরা তাঁর চরিত্রের কঠোর দিকটির দেখা পাই। ধানাইপানাই করা লোকজন তিনি একদম সহ্য করতেন না। যেমন- একটা দল তর্ক করার চেষ্টা করল যে, কুরআনের প্রথম দিকের আয়াতগুলোতে নেশাকে না বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু মদ জিনিসটাই যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ সেটি পরিষ্কার করা হয়নি (যদিও পরের দিকের আয়াতগুলোতে ঠিকই মদকে পরিষ্কারভাবেই নিষিদ্ধ বলা হয়েছে)। ওমর মদের উপর নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর করলেন।

তবে কুরআনে মদ্যপানের শাস্তি স্থির করে দেয়া হয়নি। ওমর ডিডাক্টিভ যুক্তির (deductive reasoning) মাধ্যমে সেটা নির্ধারণ করে দিলেন, আর সেটা হল চাবুকের আঘাত। কারন কুরআনে slander (অপবাদ দেয়া) এর শাস্তি চাবুক, আর নেশা মানুষকে আজেবাজে কথা বলায়। সুতরাং মদ্যপানের শাস্তি একই। এধরনের যুক্তি বা উদাহরণ ব্যাবহার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকে 'কিয়াস' বলা হয়, পরবর্তিতে ইসলামী আইন বিশারদরা যেটির বহুল ব্যাবহার করেছেন।

অবৈধ যৌন সম্পর্কের সমাজ-ধ্বংসকারী ক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে ওমর ব্যাভিচারের জন্য কঠোরতম শাস্তির মত দেন। তিনি ব্যভিচারের জন্য পাথর মারার শাস্তি প্রচলন করেন, যেটা কিনা কুরআনে উল্লেখ নেই। বরং এটার উল্লেখ পাওয়া যায় খৃস্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্টে, যেটা একই সাথে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ 'তোরাহ' হিসাবেও পরিচিত। [অনুবাদকের নোটঃ ইহুদি বাইবেল এর প্রথম পাঁচ অধ্যায়কে একত্রে বলা হয় Law of Moses (মুসা’র আইন), হিব্রু ভাষায় ‘তোরাত মোশে’। তারা বিশ্বাস করত এগুলা মুসা নবীর লিখা। তবে আজকালকার পণ্ডিতরা মনে করেন এগুলা অনেক ব্যাক্তির মিলিত লেখালেখি। তো এই Law of Moses এর মধ্যে আছে deuteronomy 22:21 (আমাদের যেরকম সুরা, আয়াত ইত্যাদি), যেখানে বলছেঃ “she shall be brought to the door of her father’s house and there the men of her town shall stone her to death. She has done an outrageous thing in Israel by being promiscuous while still in her father’s house.” গুগল করলে পাঠক নিজেই দেখতে পাবেন। সতিদাহ আর বর্ণপ্রথার ঐতিহ্যে গর্বিত, গোমূত্রব্যাটারি চালিত বঙ্গদেশী বিজ্ঞানমনস্ক চিড়িয়ারা ভুলেও মুখে আনবেনা যে খৃস্টান এবং বিশেষত ইহুদি ধর্ম এসব তথাকথিত ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতার’ আঁতুড়ঘর। ইহুদি বিদ্বেষের (anti Semitism) অভিযোগ একবার উঠলে ফান্ডিং তো চিরতরে বন্ধ হবেই, যেগুলো বিদেশে আশ্রয় নিয়েছে সেগুলোকে ওদের 5th ক্লাস বিজ্ঞান, ব্যাবসায় আর কলা (science, commerce, arts)- সবকিছু পশ্চাৎদেশে ভরে দিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে।]
আরবদের একটি প্রাচীন প্রথা ছিল কয়েক দিনের জন্য অস্থায়ী বিবাহ। এটা যে বিয়ের মোড়কে পতিতাবৃত্তি, সেটা বুঝতে না পারার মতো লোক খলিফা ওমর ছিলেন না। তিনি এটাকেও নিষিদ্ধ করেন। (শিয়া ধর্মগুরুরা পরবর্তিতে এই প্রথাটিকে আবার বৈধতা দান করেন। ইরানে নাকি এখনো এটা চালু আছে, সেখানে এই জিনিসের নাম ‘সিগেহ’/sigeh।)

নিন্দুকেরা বলে ওমর নারীদের অধিকার খর্ব করেছিলেন। এটা ঠিক যে যৌনতার ডিসরাপ্টিভ প্রভাব কমাতে ওমর নারী ও পুরুষের পৃথক ভূমিকা নির্ধারন করে দেন। যেমন তিনি নারী ও পুরুষের আলাদা আলাদা প্রার্থনা করার নিয়ম করেন। সম্ভবত এই কারণে যে নামাজীদের মাথায় যেন যৌন চিন্তা জাগ্রত না হয়। তবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন স্থানে মুসলিম সমাজে নারী পুরুষের পৃথকীকরণের যে চরম রূপ দেখা যায় এবং নারীদেরকে ব্যাপকভাবে ক্ষমতাহীন করে ফেলা হয়, ওমরের সময়কাল তার থেকে বহু দূরে ছিল। ওমরের আমলে মুসলিম ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্যই শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। নারীরা পুরুষের সাথেই কাজে এবং নাগরিক জীবনে অংশ নিতেন, লেকচার শুনতেন, বক্তৃতা দিতেন, কবিতা লিখতেন, ত্রাণকর্মী হিসাবে যুদ্ধে যেতেন এবং অনেক সময় সম্মুখযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। ওমরের সময় সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নিয়ে উন্মুক্ত মিটিংয়ে আলোচনা হতো। একজন সাধারণ নাগরিকের সমান মর্যাদায় ওমর সেসব মিটিং এ অংশ নিতেন এবং পুরুষের সাথে সাথে অনেক নারীও তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে চরম বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন কোনও ভয়ভীতি ছাড়া। মদিনার বাজারের পরিচালক হিসাবে ওমর একজন মহিলাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে সেটা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ, যেটার আওতায় ছিল নির্মাণকাজের নিয়ন্ত্রণ, ব্যাবসার পারমিট ইস্যু করা, ওজনে কারচুপি হচ্ছে কিনা সেটার তদারকি ইত্যাদি।

সেই সময়কার (খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে) পৃথিবীর সব সমাজেই দাস প্রথা অনুমোদিত ছিল, আরব সমাজ এর ব্যতিক্রম ছিলনা। ইসলাম এই প্রথাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেনি, তবে দাসের উপর মালিকের ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছিল। ওমর এই নিয়মকানুনগুলো খুব কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন। কোনো মুসলিমকে দাস হিসাবে রাখা যাবে না। মালিকের দ্বারা দাসীর গর্ভে সন্তান আসলে তাকে বিয়ে করতে হবে। এর মানে হলো বাচ্চাটি মুসলিম হয়ে জন্ম নিবে এবং ফলতঃ দাস হবে না। দাসত্বের ফলে কোনো পরিবার ভাঙা যাবে না। তার মানে মালিক সহজে দাস কেনাবেচা করতে পারবে না, বিক্রি করতে বা কিনতে চাইলে পুরো একটি দাস পরিবার কিনতে বা বেচতে হতো। দাসদেরকে অত্যাচার বা শোষণ করা নিষিদ্ধ ছিল, তাদের মানবাধিকার অন্য যে কোনো স্বাধীন মানুষের সমান বলে স্বীকৃত ছিল। এই ধারণাটি কোরানে জোরালোভাবে বলা হয়েছে এবং মহানবীর বিদায় হজ্বের ভাষণেও সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। ওমর আইন করলেন যে মালিক নিজে যা খাবে ঠিক সেই খাবারই দাসদেরকে দিতে হবে এবং দাসদেরকে মালিকের পরিবারের সাথে একত্রে আহার করতে দিতে হবে। ওমরের আইন যদি এভাবে এগিয়ে যেতে থাকতো তাহলে মুসলিম সমাজে দাসপ্রথার অবসান খিলাফত এর প্রথম দিকেই হয়ে যেতে পারতো । কিন্তু মুসলিম সমাজ পরবর্তীতে এই ব্যাপারে আবার পিছনদিকে হেঁটেছে।

এটা পরিহাসের মতো শুনাতে পারে যে, ওমরের নিজের জীবনাবসান হয়েছিল এক মানসিক ভারসাম্যহীন পার্সীয় দাসের হাতে, যে কিনা মসজিদে ওমরের পেটে ছুরি চালিয়ে দিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুশয্যায় সম্প্রদায়ের মান্যগণ্যরা অনুরোধ করলেন ঝামেলাবিহীন ক্ষমতার পালাবদলের স্বার্থে তিনি যেন নিজের উত্তরসূরি নির্বাচন করে রেখে যান, আবু বকর যেমনটা করেছিলেন । কেউ কেউ বললেন, “আপনার ছেলে পরবর্তী খলিফা হলে কেমন হয়?”

একথা শুনে ওমর তাঁর জীবনে শেষবারের মতো ক্রোধে ফেটে পড়লেন, “তোমরা কি মনে করো আমি নিজের আর পরিবারের সুযোগ সুবিধার জন্য খলিফার দায়িত্ব নিয়েছি?” সেইদিন মারা যাওয়ার আগে তিনি আরেকটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। তিনি ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি পরামর্শক কমিটি (শুরা) গঠন করে দিয়ে গেলেন, যাদের কাজ হবে উম্মাহ-র মতামত যাচাই করে পরবর্তী খলিফা নিয়োগ করা। পরবর্তীকালের অনেক ইসলামী চিন্তাবিদরা এই শুরা কেই ইসলামের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি বলে বিবেচনা করেন। শুরা দেখতে পেলেন যে অধিকাংশ লোকের প্রথম আর দ্বিতীয় পছন্দ হলেন আলী (র) আর ওসমান (র)। কারও কাছে আলী এগিয়ে আর কারও কাছে ওসমান।

শুরার প্রধান সমবেত জনতার সামনে আলী এবং ওসমান দুজনেরই ইন্টারভিউ নিলেন। দুজনের কাছেই তার প্রধান প্রশ্ন ছিল, “খলিফা হলে আপনি কি কুরআন, সুন্নাহ অনুযায়ী চলবেন এবং প্রথম দুই খলিফা আবু বকর এবং ওমর (র) এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন?” আলী জানালেন তিনি কুরআন, সুন্নাহ অনুযায়ী চলবেন ঠিকই, কিন্তু আবু বকর এবং ওমর এর সবকিছুই যে তাঁকে ফলো করতে হবে তা তিনি মনে করেন না, তাঁর নিজের বিবেচনায় অন্যকিছু ভাল মনে হলে তিনি সেভাবেই করবেন। অন্যদিকে ওসমান বললেন যে, কুরআন সুন্নাহর পাশাপাশি তিনি আগের দুই খলিফার রেখে যাওয়া সিদ্ধান্তগুলো মেনেই কাজ চালাবেন। শুরা তাই ওসমান (র) কেই পরবর্তী খলিফা ঘোষণা করলেন, উপস্থিত জনগণও তাতে সায় দিলেন। আর ঝামেলা সৃষ্টি না করতে আলী (র) ও তা মেনে নিয়ে ওসমান (র) এর প্রতি আনুগত্যের শপথ নিলেন।

শুরুর পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগের পর্ব এখানে
০৪/০৪/২০২১ এডিটঃ দেখতে পাচ্ছি বইটি ২০১৮ সালে কেউ একজন বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন। আমি পড়ে দেখিনি কেমন অনুবাদ হয়েছে, আগ্রহী হলে জোগাড় করে পড়ে নিতে পারেন। রকমারি'র লিঙ্ক এখানে

[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com এ প্রিভিউ এবং রিভিউ দেখতে।]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.