নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রায়আন৫৬৩

আবু রায়আন

ছাত্র

আবু রায়আন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঋণং কৃত্বা

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩৮

ঋণং কৃত্বা
শিবরাম চক্রবর্তী
অলংকরণ: তুলি।




কারও ধার ধারি না, এমন কথা আর যেই বলুক, আমি কখনই বলতে পারি না। আমার ধারণা, এক কাবুলিওয়ালা ছাড়া এ কথা এ জগতে কেউই বলতে পারে না। অমৃতের পথ 'ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা'; অকালে মৃতে হতে না হলে ধার করতেই হবে।
ধার হলেও কথা ছিলো বরং, কিন্তু তা-ও নয়। বাড়িভাড়া বাকি, পাঁচশ টাকা মাত্তর! কিন্তু তার জন্যই বাড়িওয়ালা করাল মূর্তি ধরে দেখা দিলেন একদিন-
'আপনাকে অনেক সময় দিয়েছি আর আমি দিতে পারবো না। কোনো অজুহাত শুনছি না আর-'
'ভেবে দেখুন একবার,' আমি তাকে বলতে যাই: 'সামান্য পাঁচ শ টাকার জন্য আপনি এমন করছেন! অথচ এক যুগ পরে একদিন-আমি মারা যাবার পরে অবিশ্যি- আপনার এই বাড়ির দিকে লোকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলবে, একদা এখানে বিখ্যাত লেখক শ্রীঅমুকচন্দ্র অমুক বাস করতেন।'
'বাস করতেন!বাস করতেন!বাস করে আমার মাথা কিনতেন!' জবাবে তাঁর দিক থেকে যেন একটা ঝপটা এল। 'শুনুন মশাই, আপনাকে সাফ কথা বলি, যদি আজ রাত্রি বারোটার ভিতর আমার টাকা না পাই, তাহলে এক যুগ পরে নয়, কালকেই লোকে এই কথা বলবে।'
বাড়িওয়ালাতো বলে খালাস, চলে গেলেন। কিন্তু এই একবেলার মধ্যে আমি এত টাকা পাই কোখায়? পাছে ধার দিতে হয়, সেই ভয়ে সহজে কেউ আমার মতো লেখকের ধার ঘেঁষে না।
লেখক মাত্রই ধারালো, আমি আবার তার ওপরে এক কাঠি-জানে সবাই।
হর্ষবর্ধনের কাছে যাবো? তাদের কাছে এই কটা টাকা কিছুই না। তাদের কীর্তিকাহিনি লিখে অনেক টাকা পিটেছি, এখন তাদের পিঠেই যদি চাপি গিয়ে? তাদরে পৃষ্ঠপোষকতায় যদি এই দায় থেকে উদ্ধার পাই?
কথাটা গিয়ে পড়তেই হর্ষবর্ধন বলে উঠলেন,'নিশ্চই নিশ্চই! আপনাকে দেব না তো কাকে দেব!'
চমকে গলাম আমি। কথাটা যেন কেমনতরো শোনলাম না?
'আপনি এমন কিছু আমাদের বন্ধু নন?' তিনি বলতে থাকেন।
'বন্ধুত্বের কথা যদি বলেন--' আমি বাধা দিয়ে বলতে যাই।
'হ্যাঁ, বন্ধুত্বের কথাই বলছি। আপনিতো আমাদের বন্ধু নন। বন্ধুকেই টাকা ধার দিতে নেই মানা আছে। কেননা, তাতে টাকাও যায়, বন্ধুত্বও যায়।' তিনি জানান, 'তবে হ্যাঁ, এমন যদি সে রন্ধু হয় যে বিদেয় হলেই বাঁচি, তার হাত খেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাকে ওই ধার দেওয়া। তাহলেই চিরো কালের মতো নিস্তার।'
আহা! আমি যদি ওর দ্বিতীয় শ্রেণীর বন্ধু হতাম- মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি।
'কিন্তু আপনিতো বন্ধু নন, লেখক মানুষ। লেখকেরাতো কখনও কারো বন্ধু হন না।'
'লেখকদেরও কেউ বোধ হয় বন্ধু হয় না।' সখেদে বলি।
বিলকুল নির্ঝঞ্ঝটা! এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে বলুন?' তিনি বললেন,'আপনি যখন আমাদের আত্নীয়-বন্ধু কেউ নন, নিতান্তই একজন লেখক, তখন আপনাকে টাকা দিতে বাধা কি আর? কত টাকা দিতে হবেক বলুন?'
'বেশি নয় শ পাঁচেক। আর একেবারে দিয়ে দিতেও আমি বলছি না।' আমি বলি,'আজ তো বুধবার। শনিবার দিন টাকাটা আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেব।'
কথা দিলাম। এ ছাড়া আজ বাড়িওয়ালার হাত থেকে বাঁচার আর কি উপায় ছিলো? কিন্তু কথাতো দিলাম। না ভেবেই দিয়েছিলাম কথাটা- শনিবারের সকাল হতেই ওটা ভাবনার কথা হয়ে দাড়াঁলো।
ভাবতে ভাবতে চলছি, এমন সময় গোবর্ধনের সঙ্গে মোলাকাত-অকূলপাথারে। চৌরাস্তার মোড়ে।
গোবর্ধণ ভায়া, একটা কথা রাখবে? রাখো তো বলি'
'কী কথা বলুন?'
'যদি কথা দাও যে তোমার দাদাকে বলবে না, তাহলেই বলি তোমায়।'
'দাদাকে কেন বলতে যাব? দাদাকে কি আমি সব কথা বলি?'
আর কিছু কথা নয়। কথাটা হচ্ছে এই যে আমাকে শ পাঁচেক টাকা ধার দিতে পারো- দিন কয়েকের জন্য? আজ তো শনিবার? এই বুধবার সন্ধ্যের মধ্যে- টাকাটা আমি তোমায় ফিরিয়ে দেব!'
'এই কথা?' এই বলে আর দ্বিরুক্তি না করে শ্রমান গোবরা তার পকেট থেকে পাচঁ খানা একশ টাকার নোট বার করে দিল।
টাকা নিয়ে আমি সটান শ্রীহর্ষবর্ধনের কাছে। 'দেখুন আমার কথা রেখেছি কি না? লেখক হতে পারি, দরিদ্র লেখক হতে পারি, কিন্তু কথা কখনও খেলাপ করি না।'
হর্ষবর্ধন নিরবে টাকাটা নিলেন।
'আপনিতো ভাছেন যে টাকাটা বুঝি আপনার মারাই গেল। আমি আর এ জন্মেও এ মুখো হব না। ভাবছিলেন যে-'
তিনি বিকল হয়ে বলবেন, না না সেসব কথা আমি আদৌ ভাবি নি। ভাবছি যে এত তাড়াতাড়ি আপনি টাকাটা ফিরিয়ে দিলেন! আর এত তাড়াতাড়ি আপনার প্রয়োজন কি করে মিটতে পারে? বেশ, ফের আবার দরকার পড়লে চাইতে কোনো কুন্ঠ করবেন না।'
বলাই বাহুল্য!মনে মনে আমি ঘাড় নাড়ালাম। লেখকেরা বৈকুন্ঠের লোক, কোনো কিছুতেই ওদের কুন্ঠা হয় না।
শনিবার দিই দরাকার পড়ল আবার। হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে গোর্বধনকে দিতে হলো।
'কেমন গোবর্ধন ভায়া! দেখলে তো, কথা রেখেছি কি না। এই নাও তোমার টাকা- প্রচুর ধন্যবাদের সহিত প্রত্যর্পিত।'
... বুধবার আবার গোবরার কাছে যেতে হলো। পাড়তে হল কথা- 'গোবর্ধন ভায়া, শনিবার টাকাটা ফেরত দিব বলেছিলাম, শনিবারেরই দিয়েচি, দিইনি কি? এক দিনের জন্যও কি আমার কথার নড়চড় হয়েছে?...
'এমন কথা কেন বলছেন?' গোবর্ধন আমার ভণিতা ঠিক ধরতে পারে না।'
'টাকাটা আমার দরকার পড়েছে আবার। ওই পাঁচ শ টাকাই। সেজন্যই তোমার কাছে এলাম ভাই! শনিবারই তোমায় আবার ফিরিয়ে দেব টাকাটা।নির্ঘাত।'
এভাবে হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন, গোবর্ধন আর হর্ষবর্ধন-- শনিবার আর বুধবারের দুধারের টানাপোড়ানে আমার ধারি ওয়ালা কম্বল বুনে চলেছ, এমন কালে একদিন পথে দু জনের সঙ্গেই দেখা। এককালে মোলাকাত।
দুই ভাই পাশাপাশি আসছিল। আমাকে দেখে দাঁড়ালো। দুজনের চোখেই কেমন যেন একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি।
হয়তো দৃষ্টিটা কুশল জিজ্ঞাসা হতে পারে, কোথায় যাচ্ছি, কেমন আছি- এই ধরনের সাধারণ কোনো কৌতূহলই হয়তো বা, কিন্তু আমার তো পাপ-মন! মনে হল দুজনের চোখেই যেন এক তাগাদা।
'হর্ষর্ধনবাবু, ভাই গোবর্ধন, একটা কথা আমি বলব, কিছু মনে করো না-' বরে আমি শুরু করি: 'ভাই গোবর্ধন, তুমি প্রতিবুধবার হর্ষবর্ধন বাবুকে পাঁচ শ টাকা দেবে। আর হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি প্রতি শনিবার পাঁচ শত টাকা আপনার ভাই গোবর্ধনকে দেবেন। হর্ষবর্ধনবাবু, আপনাকে দিতে হবে শনিবার আর গোবর্ধন ভায়া, তোমাকে দিতে হবে বুধবার... ... হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি শনিবার আর গোবর্ধন, তুমি বুধবার মনে থকবে তো?- গোবর্ধনকে শনিবার আর হর্ষবর্ধনবাবুকে বুধবার। হর্ষবর্ধনবাবু বুধবার.... গোবর্ধন শনিবার...আপনি বুধবার... তুমি শনিবার ... আপনি শনিবার... তুমি বুধবার... শনিবার বুধবার... বুধবার শনিবার... বুধবার বুধবার... শনিবার শনিবার.... ...
'ব্যাপর কি? হর্ষবর্ধনতো হতভম্ব।-'কিছু্ই বুঝতে পারছি না।'
'ব্যাপার এই যে ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।'

শিবরাম চক্রবর্তী(ডিসেম্বর ১৩, ১৯০৩-আগষ্ট ২৮, ১৯৮০): রম্যলেখক। তাঁর পুরো জীবন কেটেছে কলকাতায়।
(সংগ্রহকৃতঃ প্রথম আলো, ম্যাগাজিন: গোল্লাছুট; শুক্রবার, ৮ জানুয়ারি ২০১৬)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৩

চাঁদগাজী বলেছেন:


অনেক দরকারী কথা বলে মনে করেছিলাম; মোটামুটি বিরক্তিকর

২| ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৯

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: বলে গেছেন উপনিষদ
আরাম নাহি অল্পে|
বাড়িসুদ্ধ সবার আমোদ
শিবরামের গল্পে||
শিবরাম নিজেই বলেছিলেন এই কথা| তার বই পড়েই মানুষ হয়েছি| এটা আমার অন্যতম প্রিয় গল্প|
প্রত্যেক কিশোরের শিবরাম চক্রবর্তীর বই পড়া অত্যাবশ্যক

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.