নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

brotoweb.wordpress.com/

ব্রতশুদ্ধ

ব্রতশুদ্ধ › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন \'কণা\'

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ২:৩১


কণার বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা নেই। শহরে যাদের গণিকাবৃত্তির অভ্যাস আছে তারা সবাই মোটামুটি ভাবে কণাকে চেনে।যাদের গণিকাবৃত্তির অভ্যাস নেই তারাও অনেকে কণাকে চেনে। কাস্টোমারদের হট কেক’এর নাম কণা । কণার কাস্টমার খুঁজতে হয় না, দৈহিক আকৃতি দেখে অনেক হোমরা-চোমরাও ওর প্রেমে পড়ে যায়, নেশায় পড়ে যায়,বিছানায় নিয়ে যাবার প্রেমে পড়ে যায়, স্বপ্ন দেখতে থাকে, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত তরুন যুবকরা কণাকে বাথরুমে নিয়ে যায় তার আগে আড্ডায় বসে ওরা মাগী কণা বলে ডাকে, কণাকে সমাজের জঞ্জাল বলে আলোচনা করে , এদের মত বারবনিতাদের সাথে কতটুকু খারাপ ব্যবহার করা উচিৎ তা নিয়েও আলোচনা করে । শহরের তরুণ যুবক গুলো একেকটা শাখামৃগের মত। এই মূহুর্তে একটা বলছে তো পরমূহুর্তেই তার বিপরীত কথাটা বলে আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছে নয়তো ক্ষুব্ধ হতে হতে একসময় রাগে কপালের বলীরেখা প্রকট হয়ে উঠছে তারপর আবার সে কথার বিপরীতটা বলে পালটি খাচ্ছে । তবে এরা কখনো কণার প্রশংসা করে না। অনেকে তো কণাকে না চেনার ভান করেই কণা বিষয়ক আলোচনা থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে । তারপর আবার কান খাড়া করে আলোচনাগুলো শোনে। কণার তাতে কিছু আসে যায় না। কণার বাঁ হাতের বুড়ো আংগুলটা নেই। কণার অবশ্য তাতেও কিছুটা আসে যায় না। শহরে তার দেহ মন্থন করা পুরুষের অভাব নেই। দেহের বর্তমান অবস্থায় বলছে আগামী কয়েক বছরে চাঙ্গা বাজার হারানোর সম্ভাবনাও তার নেই।
ত্রিশ কিংবা বত্রিশ বছর আগে একটা ছোট্ট গাঁয়ের ছোট্ট কুঁড়েঘরে জন্মেছিল কণা। কবিরাজ বাবাঁ আর তাঁতশ্রমিক মা। একটা মাতাল বড় ভাই। তারপর একটা চার দেয়াল। নিষিদ্ধ এলাকার চার দেয়াল।
ঝড় ঝঞ্ঝা হলে তার চৌকাঠ মাড়ানো কাস্টমারের চাপ কিছুটা কম থাকে। আজ তেমনই একটা রাত। কিন্তু ঝড়-ঝঞ্ঝা নয় আজ সন্ধ্যের দিকে ভূমিকম্প হয়েছে। ধর্মীয় প্রার্থনালয়ে আজ কণার কাস্টমারগুলোর বেশির ভাগ ভীড় জমিয়েছে । আগামী দু-তিন দিন এ মুখো হবে বলে মনে হয় না। তাই আজ শহরটা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কণা। নিষিদ্ধ এলাকার সীমা কেবল অতিক্রম করবে ঠিক এমন সময় কণার সবচেয়ে প্রিয় কাস্টমার সালামের সাথে দেখা।
-কিরে কণা? আজকে কি আমি ফণা তুলমু না?
- না রে আজকে শইল ভালা না । আইজ শহরডারে একটু ঘুইরা দেখুম। যাবি আমার লগে?
- বুক চাপড়ে সালাম চিৎকার করে গান ধরে “ও আমার উড়াল পঙ্খীরে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা।“ চল আমার পাখি ,আইজকা তরে শহর দেখামু। তার আগে একটু সোহাগ করবানা আমার লগে?
- আইজ মাফ কর আমারে। আইজ মন ডা সত্যিই উড়তে চাইতাসে।
- আইচ্ছা ঠিকই আসে। (কিছুটা মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো সালাম)

একটা গোলাপী ফ্যালফেলে শাড়ী আর লোকাট ব্লাউজ পড়ে শহর প্রদক্ষিণে বের হল কণা। কিন্তু চলন ভঙ্গিটা একেবারেই অজানা লাগলো সালামের। বেশ একজন মহীয়সী নারী সুলভ পদাঙ্কে মত্ত সে । এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে আবার একইভাবে শহরের তরুণ যুব বৃদ্ধগুলোও কণার দিকে তাকাচ্ছে । এভাবেই চলছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। কনার বাঁ হাত দিয়ে পেটে চেপে ধরা সোনালী পার্সে টাকা আছে অনেক। তাতে একটা লাল লিপ্সটিকও আছে। একটু পর পর সেটা পার্স থেকে বের করে ঠোঁটে লাগায় আর লিপস্টিকটা পার্সে পুরেই মোবাইলটা গুতিয়ে কি যেন দেখে।। তারপর মোবাইলটা পার্সে ভরে রাখে। সালাম কণার কারসাজি বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে। কিন্তু সালাম কোন কথা বলছে না। সালাম শুধু কণাকে দেখছে। মাথা থেকে পা অব্দি দেখছে তারপর থেকে থেকে থুতু ফেলে ডানহাতের তর্জনি আর মধ্যমার ভেতর রাখা সিগারেটের ডগার ছাইটুকু তুড়ি মেরে ফেলে কষে টান দিচ্ছে। সে ধোঁয়া নাক মুখ দিয়ে অনর্গল বেরিয়ে যাচ্ছে। চলতে চলতে বেশ কিছু পথ পাড়ি দিয়েছে ওরা।
- ঐ সালাম চলনা নদীর পাড়ে ব্রিজটায় পা ঝুলায়া বইগিয়া।
- ধুর ঐহানে যাওন যাইব না। এর চেয়ে চল পাড়ায় যাইগা।
- ধুর , আইজ আর আমি পাড়ায় যাইতাসিনা।
- কি??
- হ। আইজ আমি সারারাইত ঘুরমু। আমি আইজ শহর দেখুম। ব্রিজের উপরের থেইক্যা নদীর জলে চান্দের আলোর সিনেমা দেখুম। মাঝির নৌকা চালানী দেখুম নৌকার বৈঠা দিয়া হেলেঞ্চার পাতায় ধাক্কা দেওন দেখুম।
- হ আরো কিছু দেখো । ঐ আমার ভালা লাগতাসেনা ।। চল তো পাড়ায়।
- তুই যা। তোমার তো আর তর সইতাসে না। চুন্নি মমতাজ আইজ কাজ করতাসে। যা তুই হেই চুন্নির কাছে যা।
- আমি কইসি না তুই আমারে কোনদিন অন্যরে দেহায়া দিবি না। পাড়ায় আই একমাত্র তর লেইগ্যা। এইডা তুই ভালো কইরাই জানস।
- আমি না থাকলে কি করবি? (হাঁসি দিয়ে বলে কণা)
- আর পাড়ায় যামু না।
কণা সালামের কথার ভেংচি কাটে তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে। সালাম এবার বুঝে গেছে কণা আজ সত্যিই খুব সহজে কাজে ফিরবে না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই সাথে চলতে শুরু করলো সালাম।

- আইচ্ছা কণা তর এই বুইড়া আঙ্গুল ডা জানি কেমনে কাডা পড়সে?

এই একটা প্রশ্ন কনা বহুবার শুনেছে। বেশ বিরক্তবোধ করে কণা এই প্রশ্নে । নব্য কাস্টোমারের কাছ থেকে এ ধরনের প্রশ্ন পেলে বেশ কোমল সুরেই মাথা ঠান্ডা করে উত্তর দেয় কণা। কিন্তু পুরনো কোন কাস্টোমার এ ধরণের প্রশ্ন জুড়ে দিলে মেজাজটা বেশ গরমই হয়ে যায় তার।

- বুইড়া আঙ্গুল চিবায়া খাইছি। একদিন রাইতে খিদা লাগসিল। বুচ্ছস??
- ধুর জানপাখি চেত ক্যা? আমি কি তুমার দুরের কেউ? আইচ্ছা বাদ দেও।
তারপর কণা নিম্নস্বরে তিন চারটে খিস্তি কেটে হাঁটার তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ সালাম বলে ওঠে
- ঐ চুন্নি কই যাস? বিরিজ তো আইয়া পড়সি।
কণা আশপাশ চেয়ে দেখে সত্যিই সে ব্রিজের ওপর হাঁটছে। একটা কচি খুকির মত হাঁসি দিয়ে ওঠে কণা।
‘ হে হে । হ আইয়াই তো পড়সি দেখি। নে আমার লেইগ্যা ২০ টাকার বাদাম কিন। তারপরে ঐ কুনায় গিয়া বই চল।’
সালামের কণার কথাটা শুনতে যতটুকু না দেরী হল তারচেয়ে কমসময় লাগলো বাদাম কিনে আনতে। দেখে মনে হল হয় ব্যাটার খুব খিদে পেয়েছিল নয়তো এমন কোন একটা সময়ের জন্য সে অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিল।তারপর তারা দুজন মিলে ব্রিজের এক পাশে ভাঙ্গা মাইলফলকের গা ঘেঁষে বসে। চারটে পা শুন্যে ঝুলছে তাদের। তারা বাদাম খাচ্ছে আর থেকে থেকে হাসছে। মাঝে মধ্যে সালাম কণার চিবুকে হাত বোলাচ্ছে আর কণা জোড়ে মাথাটা ঝেকে হাতটা সরিয়ে দিচ্ছে। তারপর আবার নিম্নস্বরে কণা খিস্তি খাচ্ছে আর বাদাম চিবুচ্ছে।
একটা দশ বার বছরের হাফপ্যান্ট পড়া বাচ্চা হঠাতই এসে দুজনের মাথার মাঝ বরারব হাতটা ঠেলে দেয়।
“ আম্মা কয়ডা টেকা দে না” বলেই কণার মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে। কণাও ঘার ঘুড়িয়ে ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মধ্যে হঠাৎ সালাম চেচিয়ে ওঠে বাচ্চাটার উপর। “ ঐ যা এইহান থেইক্যা’। কণা সালামের দিকে হাত বাড়িয়ে তাকে চুপ থাকতে বলে। তারপর সোনালী পার্সটা থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে বাচ্চাটার হাঁতে ধরিয়ে দেয়। বাচ্চাটা আরো বড় বড় চোখ করে কণার দিকে ফ্যালফেলিয়ে চায়। কণা বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলায় তারপর বলে ‘ বাপজান তোর পেটটা তো খালি পইড়া আসে যা কিছু খাইয়া ল।‘ বাচ্চাটাও ‘ আইচ্ছা’ বলে দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়। কণা তারপর কিছু সময় চুপ থাকে । সালাম এবার ফ্যালফেলিয়ে কণার দিকে চেয়ে থাকে। কণা ঘাড়ঘুরিয়ে সালামের দিকে তাকায়। চোখে কণার অশ্রু, সালামের মনে একটু অনুশোচনার ভিড় জমে । সালাম ডান হাত কণার কাধে রেখে বাঁ হাঁতে কণার চিবুকটায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ‘ জানপাখি?? কি হইসে?? কান্দো ক্যান?”
কণার অশ্রুশিক্ত নয়ন জোড়া এ কথা শুনে যেন জলে আরো ভিজে ওঠে । তারপর সালামের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে কণা।
‘ জানস সালাম, আমারও না এমন একটা বাচ্চা আসিলো। আমারো না একবার বিয়া হইসিল।;
সালাম এ কিচ্ছা শুনেছে আরো বেশ কয়েকবার। তবুও আবার শুনতে তার ভালো লাগে। কণা কথা বলেই যাচ্ছে। যেন আজ এই নদীর পানি তার সমগ্র দুঃখগাঁথায় লবণাক্ত করবে সে। তারপর আরো বলে কণা।
‘জানস আমার জামাই কাঠের কাম করতো। কি সুন্দর যে কাম করতো । ঐযে ঘরে যে আমার গয়নার বাক্সডা আসে না? হেইডা তো হেই বানাইসে রে। আমার জামাই যে আমারে কি সোহাগ করতো রে। আমার লেইগ্যা কত্ত কিছু আনতো রে। আমারে কত ভালাবাসতো রে।‘ এসব বলতে বলতে কণার কান্নার মাত্রা বাড়তে থাকে। সালামের এসব কথা শুনতে শুনতে কণার মাথায় হাত বুলিয়ে যেতে ভালোই লাগছে। কণা বলে ‘আমার স্বামীর নাম আসিলো কেরামত। কি যে ভালা মানুষ আসিলো । তারপরে একবার কাঠের গুদামে হারামী জয়নাল আগুন দিলো। সব পুইড়া গেল। সোয়ামী আমার রেল লাইনে মাথা দিলো। আমি আমার বাপের ঘরে ফিরা গেলাম। কয়দিন বাদে বাপও পেডের ব্যাথায় মইরা গেল। জয়নাল আমার মদখোর ভাইডার লগে মিশ্যা শয়তানী আটলো, বাইচ্চাডারে বেইচা দিলো। মা এর চোক্ষে ছানি পড়লো মা-ও অন্ধ হইয়া গেল। জয়নাল আর ভাইডা মিল্লা আমারে পিডাইতে শুরু করলো। পতিদিন পিডাইতো। একদিন তো মদ খাইয়া আইয়া বডি দিয়া আমার আঙ্গুলডাই কাইট্টা দিলো ভাইয়ে আমার ।তারপরে হাসনাহেনার কাসে বেইচ্চা দিলো।‘ এসব বলতে বলতে একসময় কণা চুপ হয়ে যায়। আর যেন কান্না বের হচ্ছে না কণার চোখ দিয়ে।
এসব কথা অনেকবার শুনেছে সালাম। কণার বুকটা ফেটে গেলেও সালাম একটু বিরক্তই হচ্ছে এখন। তাও সালাম কণার মাথায় হাত বুলিয়েই যাচ্ছে। হঠাতই গাঁ টা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে যায় কণা। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতে থাকে ‘ সবই আমার ভাগ্য রে। হয়তো এইডাই আসিলো আমার কপালে’।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাকি বাদাম গুলো শেষ করে কণা। মাঝে মধ্যে কণা দু-তিনটে বাদাম ছুলে দিচ্ছে সালামকে। সালাম বাদামের কোয়া গুলো কণার হাত থেকে নিয়ে টূস করে পুরে দিচ্ছে মুখের ভেতর। একটা দমকা হাওয়ায় কণার বুকের শাড়িটা সরে যায়। সালামের চোখ পড়ে কণার ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা স্তনের অংশে। কিছুক্ষনের জন্য চুপসে যাওয়া কামনা পুনরুজ্জিবিত হয় সালামের। সালাম কিছু বলবে এমন সময় একটা পুলিশের জিপ পেছনে এসে স্বশব্দে ব্রেক মারে। তারা দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে জিপের দিকে তাকায়। কন্সটেবল গুলো কণাকে বেশ ভালো করেই চেনে। সবচেয়ে মোটা আর কুৎসিত কস্টেবলটা পানের পিক ফেলে কণাকে বলে ঊঠে ‘ কিরে কণা নাকি?? এইখানে কি করস?”
কনাও জবাব দেয় একটা হাঁসি দিয়ে । তারপর কন্সটেবলটা কণাকে গাড়িতে ঊঠার ইশারা করে। কনাও পা টিপে টিপে গাড়ির দিয়ে এগিয়ে যায়। সালাম ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে। কণা গাড়িতে গিয়ে বসে। গাড়িটা সালামের চোখের সামনে দিয়ে কণাকে নিয়ে ছুটে যায়। সালাম হতাশ হয়ে থুতু ফেলে তারপর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তর্জনী আর মধ্যমার ভেতর রেখে কষে একটা টান দেয়। সেই ধোঁয়া নাক আর মুখ দিয়ে অনর্গল বের হতে থাকে তারপর সালাম হাঁটতে হাঁটতে গান ধরে “ ও আমার উড়াল পঙ্খীরে যা যা উড়াল দিয়া যা।‘

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.