নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রুপালী সিংহ

রুপালী সিংহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অতিপ্রাকৃত গল্পঃ নিষেধাজ্ঞা

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:১০

"গল্পটা আমার বাবার " বেশ হালকা গলায় বললেন মাসুদ ভাই, আমার সহযাত্রী।

রাতের বুক চীরে ট্রেন পদ্মা এক্সপ্রেস ছুটছে রাজশাহীর দিকে। আগামীকাল রাজশাহী ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা, বগিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তারপরও কেমনে যেন প্রায় সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কয়েকজন ছাত্র অবশ্য এখনো জেগে, তাদের সামনে বই খোলা। তবে আমার সীট, এবং সামনের সীটের সবাই সজাগ, মাসুদ ভাইয়ের গল্প শোনার ধান্দায়।

মাসুদ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ট্রেনে ওঠার পর। বগির অধিকাংশ যাত্রীর (আমি সহ) মত তিনি ভর্তি পরীক্ষার্থী নন, গত বছর ঢাকা ভার্সিটি থেকে অনার্স পাশ করে বের হয়েছেন। রাজশাহীতে মামাবাড়ি যাচ্ছেন।

জীবনে প্রথম বার রাজশাহী যাচ্ছে এমন কয়েকজনের আগ্রহী বিভিন্ন প্রশ্নেই হঠাৎই উঠে এল রাজশাহীর কুখ্যাত নরবলি দেয়া জমিদার সহ অন্য অসংখ্য আলাপ। তারই সূত্রধরে মাসুদ ভাইয়ের গল্পের সূচনা।

"অন্যভাবে বললে এ ঘটনার নায়ক আমার বাবা " কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন মাসুদ ভাই, "অবশ্য যদি কাউকে নায়ক বলা যায়।

বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার, বদলির চাকরি। সেই সূত্রে দেশের অনেক প্রত্যন্ত জায়গায় ঘোরা হয়েছিল তার। সম্ভবত নানা জায়গায় ঘোরাঘুরির ফলেই তার একটা অদ্ভুত শখ হয়েছিল, ভূত দেখার শখ। "

ভূত শব্দটা শুনে আমরা একটু নড়েচড়ে জুৎ হয়ে বসলাম। বগিতে কর্মক্ষম লাইট মাত্র একটা, বাইরে ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্না। এমন পরিবেশে ভূতের গল্পই তো চাই!

" বাবা সবসময়ই খুব ব্যাস্ত থাকতেন। আর ছুটি পেলেই চলে যেতেন আগে থেকে প্ল্যান করে রাখা বিভিন্ন জায়গায়, ভূত দেখার জন্য। বাবার এই আগ্রহের কথা সর্বজন বিদীত ছিল। লোকজন বাড়িতে এসে বিভিন্ন ভূতের আছর লাগা গাছ, বাড়ি, পুকুর এইসবের খোঁজ দিয়ে যেত। আর এসবের জন্য তিনি পরিবারে একদমই সময় দিতে পারতেন না। সাধারণত ঈদের সময় ছাড়া আমরা তাকে কাছেই পেতাম না।

ঈদগুলো আমরা সবসময় দাদীবাড়িতে করতাম। কিন্তু এক কোরবানীর ঈদে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমরা এই ঈদটা মামাবাড়িতে করব। মামাদের সাথে ভাগে গরুও কেনা হয়ে গেল।

আমার বয়স তখন আট, ছোট বোনটার ছয়।

ব্যাপারটা ছিল খুবই আশ্চর্যের। কারণ বাবা শ্বশুরবাড়িতে যেতে পছন্দ করতেন না। আমার নানার সাথে তার কিছু একটা ঝামেলা ছিল। মায়ের সাথে বিয়ের নয় বছরেও তার শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সংখ্যা ছিল হাতে গোণা।

আমার মনে আছে মা খুব খুশি হয়েছিলেন, তার ধারণা ছিল এতদিনের মনোমালিন্য মেটানোর জন্য বাবা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

কিন্তু পরে জানা গেল আসল ঘটনা। বাবার অফিসে নতুন হাবিলদার রাজশাহীর। সে বাবাকে একটা ভূতের বাড়ির সন্ধান দিয়েছে, বাবার প্রধান উদ্দেশ্য ঈদের ছুটিতে সেই বাড়িটা দেখে আসা। এর মাধ্যমে মনোমালিন্য কমলেও মন্দ না।

যথাসময়ে আমরা নানাবাড়ি চলে এলাম,ডিউটির জন্য বাবা এলেন কয়েকদিন পর।

ঈদের দিনকয়েক পর সকালবেলা বাবার কাছে কয়েকজন লোক এল। বাবা তাদের কাচারি ঘরে নিয়ে গেলেন কথাবার্তা বলার জন্য, আমি বাবার কোলে গিয়ে বসলাম।

সত্যি বলতে, ভয় পেলেও আমারও ভূত বিষয়টার ওপর বেশ আগ্রহ ছিল।

কথাবার্তা শুনে যা বুঝলাম তাহল কোন বাড়ি নয়, আসলে মন্দির। আজই বাবা সেই মন্দির দেখতে যাবেন। জায়গাটা রাজশাহী শহর থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার ভেতরে একদম গ্রামের ভেতর। আমার ছোট মামাও যাবেন। "

"জায়গাটার নাম কি ভাই? " সামনের সীট থেকে জিজ্ঞেস করল হাবিব।

"জায়গার নাম দিয়ে কি করবা? " মৃদু হেসে জবাব দিলেন মাসুদ ভাই।

"যাই হোক, এই প্রথম আমি একটা সুযোগ দেখতে পেলাম। বাবাকে বলতেই তিনি এক বাক্যে না করে দিলেন, আমি মামার গলা ধরে কান্নাকাটি শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত মামা বাবাকে রাজি করালেন।

আমরা যখন ওইগ্রামে পৌছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ওই এলাকার ও.সি. র বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা চললাম সেই মন্দিরের দিকে। সাথে ওসি ছাড়াও চলল ওই এলাকার মাতবর আর কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ।

মাতবরের কাছ থেকে জানা গেল মন্দিরটা খুবই পুরানো, জমিদারি আমলের চেয়েও পুরনো। জায়গাটা সবাই মন্দির হিসেবে জানলেও সেখানে কখনো কোন পূজা অর্চনা হয়নি, ভেতরে কোন প্রতিমাও নেই। এলাকার জমিদাররা নাকি প্রতি নতুন চাঁদে ওই মন্দিরে পাঁঠা বলি দিতেন দেবতা শিবের উদ্দেশ্যে। "



"মন্দিরটার সার্বিক আকৃতি ছিল চতুর্ভুজাকৃতি, মন্দিরের ভেতরে উঠান। মানে মন্দির টাই ছিল ভেতরের উঠান ঘিরে। মন্দিরের সমস্ত দেয়ালে ছিল খোদাই করা অসংখ্য স্বস্তিকা চিহ্ন। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি কেন শিবের উদ্দেশ্যে বলি চড়ানো হত।

মন্দিরের ভেতরের উঠানের জমিতেও কোন অদ্ভুত উপায়ে পোড়ামাটির একটা বিশাল স্বস্তিকা আঁকা। বাবাকে এই স্বস্তিকাটাই বেশি আগ্রহী করল। পরে বুঝেছিলাম ভূতের ওপর আগ্রহ ছাড়াও বাবা শখের আর্কিওলজিস্ট ছিলেন। তার আর্কিওলজির বিভিন্ন বই এখনো আমার বাসায় আছে।

ওইখানে বেশ খানিকটা সময় কাটানোর পর মাতবর জানালেন, বাবা এখনো 'ভৌতিক ' রুমটা দেখেনই নি।

আমাদের গোটা জটলাটা চললাম 'ভৌতিক ' রুম দেখতে।

মন্দিরের এক কিনারে একটা গর্ত মতোন জায়গায় গেলাম আমরা, স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের মানুষ ঢোকার জন্য একটু ছোট গর্ত। মাতবর জানালেন প্রচলিত আছে অনেক আগে এই গর্ত নাকি স্বর্ণের ঢাকনি দিয়ে আটকানো ছিল। তবে বলার ধরনে মনে হল তিনি নিজেই এই গল্প বিশ্বাস করেন না। মাটির

নিচের রুমে নামার জন্য কোন সিঁড়ি নেই, লাফ দিয়ে নামতে হল। মেঝে থেকে গর্তের উচ্চতা ছয় ফুটের কম হবেনা। আমাকে হাতে হাতে নামানো হল।

ঘরটা সম্পূর্ণ দেয়াল, মেঝে ভারি কাঠ দিয়ে মোড়ানো। কি কাঠ তা জানি না,তবে বয়সের সাথে সাথে কাল হয়ে গেছে।

সবচেয়ে বড় কথা, পুরো ঘরে আঁচড়ের দাগ। হালকা - গভীর, নতুন - পুরনো অসংখ্য আঁচড়ের দাগ। কোন কোন আঁচড় মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ওঠে গেছে। কোন কোন আঁচড় এত গভীর যে প্রায় দুই ইঞ্চি পুরু কাঠের আস্তর ভেদ করে পাথরের দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কিছু আঁচড় দেখে মনে হয় গতকাল কাটা হয়েছে।

অনেকক্ষণ বাবা আঁচড় গুলো পরীক্ষা করলেন, তারপর বললেন মনে হয় কোন জন্তুর নখের দাগ।

মাতবর বললেন ' এরকম আঁচড় দেয়ার জন্তু আশেপাশের সাত গ্রামে নাই '। বাবা বললেন

'হয়তো কুকুর '।

মাতবর সর্বজান্তার ভংগীতে হাসলেন। প্রশ্ন করলেন 'বের হয়ে যায় কোথা দিয়ে? '

ছয় ফুট লাফিয়ে কুকুরের বের হয়ে যাওয়া আমার শিশু মস্তিস্কেও অস্বাভাবিক লাগলো।

'এখানে রাতে কেউ কখনো থাকে না? '

'এখানে রাতে থাকা নিষেধ '

'নিষেধ মানে? '

'নিষেধ মানে নিষেধ '।

পুরো মন্দির ঘুরে আমরা যখন বেড়িয়ে আসছি তখন সূর্য ডুবি ডুবি করছে।

মন্দিরে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বাবা হঠাৎ বললেন তিনি মন্দিরে আজ রাতে থাকবেন।

মাতবর একবাক্যে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে বাবা কোন প্রস্তাব দিচ্ছেন না, জানাচ্ছেন শুধু।

কিন্তু মাতবর কোনভাবেই রাজি হলেন না। তিনি বারবার বলতে থাকলেন মন্দিরে থাকা নিষেধ।

তবে কোন পুলিশের ওসিকে আটকানোর ক্ষমতা তার ছিল না। তিনি রাগে গজগজ করতে করতে আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন।

রাতে খেয়ে বাবা আরও কয়েকজন লোকসহ বেড়িয়ে গেলেন, তারা বাবাকে রেখে আসবেন। "

এটুকু বলে মাসুদ ভাই চুপ করে গেলেন।

"তারপর? আংকেল কিছু দেখছিলেন? " আমি সাসপেন্সের চূড়ান্ত থেকে বললাম।

"এরপরের ঘটনা খুব বেশি কিছু না। লোকজন ফজরের ওয়াক্তে বাবাকে আনতে যান, আমি ঘুমিয়েছিলাম তাই যেতে পারি নাই।

বাবা নাকি উঠানের স্বস্তিকাটার মাঝখানে বসে নিজের মুখে খামচি দিচ্ছিলেন । তিনি নাকি তার চোখ খুলে আনার চেষ্টা করছিলেন । এরপর বাবা পুরো পাগল হয়ে যান। "

"তিনি কি, মানে, পরে আর ভাল হন নি? " নিচু সহানুভূতির স্বরে জানতে চাইল শ্রাবণ, সামনের সীট থেকে।

"নাহ। এই ঘটনার আট মাস পর একদিন বাবা গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে খালি হাতেই নিজের চোখ উপড়ে ফেলেন ও মারা যান।

আমরা তাকে বেঁধে রাখতাম, কিন্তু কোনভাবে ওই রাতে তিনি বাঁধন খুলে ফেলেছিলেন। "

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:৪০

নীল জোসনা বলেছেন: ভয় ধরিয়ে দিলেন । :-& :-& :-& :-&

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:০৮

রুপালী সিংহ বলেছেন: কসট করে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রারথী।

২| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ ভোর ৬:০১

ইভান রুদ্র বলেছেন: ভয়ংকর

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:০৮

রুপালী সিংহ বলেছেন: কসট করে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রারথী।

৩| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৭:০১

সাধারন এক মেয়ে বলেছেন: আসলেই ভয়ঙ্কর ও নির্মম!

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:০৮

রুপালী সিংহ বলেছেন: কসট করে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রারথী।

৪| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৮:৫৪

আজীব ০০৭ বলেছেন: ভয়ংকর

৫| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৪:২৬

এনামুল রেজা বলেছেন: দারুণ তো! আপনাকে এ দিলাম ভয়ের গল্পটির জন্য!

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:০৯

রুপালী সিংহ বলেছেন: কসট করে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রারথী।

৬| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১:০৫

মামুন রশিদ বলেছেন: ভালোই ।

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:০৯

রুপালী সিংহ বলেছেন: কসট করে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রারথী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.