নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওয়াসি আহমেদ

ওয়াসি আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিকৃতি

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২৪


“কবিরাজ দেওয়ানে চিশতীহ শাহ জালালুদ্দিন চিকিৎসালয়”

গ্যারান্টি সহকারে জন্ডিস, টাইফয়েড, কলেরা, যক্ষ্মা, ক্যান্সার সহ সকল
দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা (বাতেনি পদ্ধতিতে) করা হয়।
বিফলে মূল্য ফেরত।


গ্রামের রাস্তায় এরকম একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই অবাক হবায়র কথা। যতটকু অবাক হওয়ার কথা আমি তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হলাম। এমনিতে গ্রাম জিনিসটাই বিরক্তিকর, আর তার চেয়েও বেশি বিরক্তিকর এখানকার মানুষগুলো। বড় চাচা হঠাৎ মারা গেলেন বলে একরকম বাধ্য হয়েই আসতে হলো। কিছু করার না পেয়ে হাঁটাহাঁটি করতে বের হয়েছিলাম,এমন সময় চোখ আঁটকে গেল সাইনবোর্ডটায়।
ভাবলাম সর্ব রোগনাশা কবিরাজ সাহেবের চেহারাটা একবার দেখেই যাই। টিনের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম, “কবিরাজ সাহেব আছেন???” গম্ভীর ধাঁচের কোনো দাড়ি গোঁফওয়ালা লোকের দরজা খোলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দরজা খুলে দিল বাচ্চা একটা মেয়ে।
- কারে চান?
- ইয়ে..কবিরাজ সাহেব আছেন নাকি??
- বাজান তো ঘুমায়। চিকিৎসার কামে আসছেন?

লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই হ্যাঁ বলে দিলাম। ব্যবসার গন্ধ না পেলে হয়তো ঘুম থেকেই উঠবে না। টাকা ছাড়া এক পাও নড়ে না এসব ধান্ধাবাজেরা। বাড়ি ফিরে খুব একটা লাভ নেই, এই অজোপাড়া গাঁয়ে ইন্টারনেট কাজ করে না। বিদ্যুৎ সংযোগ নামেমাত্র আর কি, একবার কারেন্ট গেলে আর ফিরে আসার নাম নেই। তারচেয়ে বরং কবিরাজ সাহেবের ভণ্ডামির ধরণটা দেখে যাই, মূর্খতা দেখার মাঝেও বিনোদন আছে।
মেয়েটাকে ভালোই শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে। আমার থেকে বড়সড় দাও মারতে পারবে ধরে নিয়ে কেমন আহ্লাদী ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে! হাত পেতেই বসে নাকি, এদের আবার বিশ্বাস নেই। তেমন একটা পাত্তা দেয়া যাবে না। উল্টো ঘুরে তাকালাম আমি। ঘরের ভেতর থেকে একটা চেয়ার এনে মেয়েটা আমাকে উঠানে বসতে বলল।
চুপচাপ বসে থাকতে কেমন দমবন্ধ লাগছে। তারচেয়ে হালকা কথাবার্তা চালানো যাক।
- নাম কী তোমার?
- মরিয়ম।
- বাহ। ঈসা নবীর মায়ের নামে নাম। চেন নাকি ওনাকে?
- জে না, চিনি না।
- আচ্ছা তোমার বাবা কি বাসাতেই চিকিৎসা করেন? কে কে থাকেন এখানে?
- খালি আমি আর বাজান-ই থাকি । মা তো সেই কবে মইরা গেছে।

এরই মাঝে কখন যেন কবিরাজ সাহেব উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছেন। লোকটাকে আপাদমস্তক ভালোভাবে লক্ষ করলাম। বছর পঞ্চাশেক বয়স, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি আর মাথায় কদমছাট চুল। গায়ের ফতুয়াটা এককালে হয়তো মাথার চুলের মতোই বিশুদ্ধ সাদা ছিল। অযত্নে অথবা অনিচ্ছায় হলদে রঙে পাল্টেছে। এই লোকের সাথে প্রথম দেখায় মনে হওয়ার কোন কারণই নেই, যে ইনি সর্ব রোগনাশক কবিরাজ। ইশারায় মরিয়মকে ভেতরে যেতে বলে আমার দিকে তাকালেন তিনি। উঠানে পড়ে থাকা একটা কাঠের চেয়ারে বসলেন।

-আসসালামু আলাইকুম, বিলম্ব করানোর জন্য শরমিন্দা। দুপুরের খানাদানার পর আমার আবার কিঞ্চিৎ নিদ্রাযোগের অভ্যাস আছে। স্বাস্থ্যের জন্য এই অভ্যাস বিশেষ উপকারী। তা ভাইজানরে দেইখা তো মনে হয় শহরের লোক। তয় আশ্চর্যের কিছু নাই, শাহ জালালুদ্দিনের সুনাম পুরা বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডে ছড়াইছে গো। কী রোগ হয়েছে বলেন দেখি। লজ্জা কইরেন না, লজ্জার অপর নাম মিরিত্যু।
কথা বেঁচে খায় এই কবিরাজ। প্রথম সাক্ষাতেই কথার মারপ্যাচে মানুষকে আকৃষ্ট করার গুণটা তার সহজাত। তবে “বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড”, “নিদ্রাযোগ”– অশিক্ষিতের মুখে এধরনের খটমটে বাংলা শব্দ শুনতে পাব বলে আশা করিনি।
- ওয়ালাইকুম আস সালাম। ক’দিন ধরে খুব কাশি হচ্ছে, কবিরাজ সাহেব। সারাতে পারবেন?
আমার কথা শুনে মুচকি হাসলেন লোকটা।
-হায়াতের মালিক পরওয়ারদিগার। একটা কথা মনে রাইখেন, জালালুদ্দিনের নাম হুনলে ওলাবিবি পর্যন্ত পালায়। সর্দি কাশি, এইসব মামুলি বিষয় গো। কিন্তু কথা হেইডা না। আপনার শরীরে কোনও অসুখ নাই ভাইজান, তয় মনে আছে। সেই অসুখের নাম হইতেছে অবিশ্বাস। ওই অসুখেই আমার কাছে আসছেন। ঠিক বলেছি না ভাইজান?
সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে অবাকই হলাম বলতে হয়। লোকটার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো। খুব সূক্ষ্মভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম আমি।
- কতদিন যাবত চিকিৎসা করছেন আপনি?
- তা প্রায় বারো বছর হইব। ঘাটের মড়ারে জিন্দা করছি, বুঝলেন? বেবাকের জানা আছে সেই ইতিহাস।
- সব রোগ সারাতে পারেন?
- কইলাম তো, রোগজীবাণু আমারে ডরায়। শাহ জালালুদ্দিন নির্দেশ দিলে রোগজীবাণু এই গেরামের ত্রিসীমানায় পা দিতো না। তবে আমার বিচার বিবেচনা আছে, ভাইজান। মাইনষের শরীরে বাসা না বানলে হেরা খাইব কি? আপনের আমার যেমন বাসাবাড়ি আছে, সন্তান-সন্ততি আছে, হেগরও তেমন। মায়া লাগে গো, মায়া। সেজন্যেই একবারে দুনিয়া থেইকা তাড়ায়া দেই না। বুঝাইয়া কই, যাতে ধীরেসুস্থে বাইর হয়া যায়, অন্য কারো শরীরে গিয়ে ভিটা গাঁড়ে! কবিরাজর সবার কথা স্মরণে রাখতে হয়।
- এই যাদুকরী চিকিৎসা শিখেছেন কোথায়?
- বাতেনি শিক্ষা, ভাইসাহেব। স্বপ্নে পাওয়া। দিন দুনিয়ার মাঝে এই শিক্ষা পাইবেন না। ধ্যানে মিলে জ্ঞান, অধিক চিন্তায় অজ্ঞান।
- স্বপ্নে? কীভাবে?
- বিষয়টা অত্যন্ত গোফন। আপনেরে ভাই বইল্যা ডাকছি যখন, বলি। মরিয়মের মায়ের মিততু’র পর একদিন স্বপ্ন দেখলাম। সে কী স্বপ্ন গো! ঘাইমা নাইয়া শ্যাষ হইয়া গ্যালাম, স্বপ্নের কোনও শ্যাষ নাই। লোকে কয়, তিনদিন তিনরাত অজ্ঞান আছিলাম আমি। আসল কথা আপনেরে কই, আমি এই জগতে ছিলাম না। মরিয়মের মা’র পিছে পিছে ওইপারে গেছিলাম। সেইখানেই এই শিক্ষা মিলছে গো, ভাইজান। অব্যর্থ চিকিৎসা । সর্ব রোগের নিরাময় করতে পারি।
মনে মনে না হেসে পারলাম না। বলে কি লোকটা! আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র যেখানে ক্যান্সার প্রতিষেধক আবিস্কারে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে সব দুরারোগ্য ব্যাধি সারানোর গ্যারান্টি দিচ্ছে পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত কবিরাজ? এ ব্যবসায় কিরকম অর্থ উপার্জন হয় জানতে চাইলাম কবিরাজ সাহেবের কাছে।

-বাপ মাইয়ার দিন চইলা যায়। কুনু কুনুদিন রোগী আসে, ফুঁ দিয়া দেই। চাল কিনার টাকা যোগাড় হইয়া যায়। আবার মাঝে মাঝে রোগ-জীবানুর দুঃখের কথা হুইনা আমার মনডা উদাস হয়। তখন ভাবি, আর কয়ডা দিন শইলের ভেতর সংসার করুক। হেগো খাওইয়াতে গিয়া নিজে না খাইয়া থাকি। আমি সবই পারি গো, কিন্তু মাইয়াডা আমার খিদা সহ্য করতে পারেনা। তার মধ্যে মাইয়ার উপরে আছে এক দুষ্ট জ্বিনের আছর ।
নড়েচড়ে বসলাম। জ্বিনের কাহিনী ও চলে এসেছে। আর কি কি শুনতে হবে কে জানে !

- তা জ্বিনটা কি হঠাৎ হঠাৎ ভর করে? নাকি সবসময় আশেপাশেই থাকে?
- মাইয়ার রক্তে বাস করে ভাইজান। দুষ্ট জ্বিন, নাম শাহ শরাফত। মানুষের মধ্যে যেমন ভালমন্দ আছে তেমনই আছে জ্বিনের মধ্যেও,বুঝলেন? মাঝেমধ্যে জ্বিনডা বাইর হয়া আসতে চায়। তখন মাইয়াডা আবোল তাবোল বকে। অজ্ঞান হয়া যায়।
- কোনও রোগও তো হতে পারে?
- আরে ধুর, ধুর! শাহ জালালুদ্দিনের মেয়ের কাছে রোগ আইব কোন সাহসে? একবার খুব বাড়াবাড়ি রকম দুব্বল হয়া গেছিল মাইয়াডা। মরিয়মের চাচা আমারে না জানায়া নিছিল সদরের এক ডাক্তারের কাছে ! কি নাকি টেস্ট ফেসট করাইছে। মাইয়ার বলেক “লিউক্যামি” রোগ । এরা তো আর আসল ঘটনা জানে না। তয় চিন্তার কিছু নাই আমি রোগ সারানোর ব্যবস্থা নিছি। আপনাগো দোয়ায় মরিয়ম এর অসুখ শিঘ্রি সারায়া তুলব।

লোকটা কি লিউকেমিয়ার কথা বলছে? সে তো এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার! বাচ্চা মেয়েটার এত ভয়াবহ মরণব্যাধির শিকার! মেয়েটাকে আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করল। কবিরাজ কে বললাম, “আপনার মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেটা কি সম্ভব?”
আমার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এক মুহূর্ত কি যেন ভেবে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। আর আমি তার পিছু পিছু ঘরের ভেতর ঢুকলাম। নোংরা একটা ঘর, স্যাঁতসেঁতে মেঝে। আসবাব বলতে একটা কাপড়ের আলনা আর এক কোনায় ছোট্ট একটা চৌকি। সেই চৌকিতে শুয়ে আছে মরিয়ম। ঘরের এক কোণে কে যেন যত্ন করে রঙ্গিন কাগজের ফুল বানিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। মরিয়ম এর কাজ হবে হয়তো। অসুস্থ শরীরে বাগানের ফুল তুলতে পারে না বলে কাগজের ফুলে স্বপ্ন ঢেলে দেয়। নির্মম বাস্তবতার সাথে খুব একটা পরিচয় নেই আমার, বুকের ভেতর কেমন যেন লাগল।
মরিয়মের মাথার কাছে একটা লোক বসে ছিল। কবিরাজের চেহারার সাথে মিল দেখে মনে হল ইনিই মরিয়মের চাচা। এমন সময় বাইরে কার যেন কণ্ঠ শোনা গেল, কবিরাজের নাম ধরে ডাকছে। জালালুদ্দিন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমার দিকে তাকালেন মরিয়মের চাচা। আমি কিছু বলার আগে নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন।
- মাইয়াডার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে ভাইজান। ওর মা মইরা যাওয়ার পর বাপটা পাগল হইয়া গেল। খালি কয় সে সব রোগ সারাইতে পারে, মরিয়মের মা শিখায়া গেছে। গ্রামের গরিব লোকেরাও অসুখ সারাইতে আসা শুরু করল। গরিব মানুষ তো এরও, বোঝেন না? ডাক্তার দেখানের ভিজিট পাইব কই? ভাইজানের কাছে আনলে পাঁচ-দশ টাকা দিলেই ফুঁ দিয়া দেয়। এতেই খুশি হয়া চইলা যায় ওরা। রোগ সারলে বলে জালাল কবিরাজের ক্ষেমতায় সারছে, আর না সারলে বলে আল্লাহর মাল আল্লাহ্ নিয়া গেছে, মানুষের কি করার আছে?
সরাসরি সবকিছু বলে দিল লোকটা। অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর একসাথে পেয়ে গেলাম।
- তাহলে আপনিও জানেন যে আপনার ভাইয়ের কোন ক্ষমতা নেই !
- তা তো জানিই, ভাই। কিন্তু এই মাইয়াডারে বড় আদর করি আমি। ওরে ভালা ডাক্তর দেখায়া চিকিৎসা করাইতে চাই। ভাইয়ে কয় এই রোগ হে ছাড়া কেউ সারাইতে পারবনা। কি করুম কন, গোপনে চিকিৎসা করাইতে চাই। কিন্তু সে তো অনেক ট্যাকার মামলা! এত ট্যাকা পামু কই? তাও এর ওর থাইকা চায়্যা চায়্যা কিছু জমাইছি। আপনে কিছু দিয়া যান ভাই।

তামাশা দেখতে এসে এরকম বিপদে পড়ব কে জানত ! কিছু টাকা দিতে ইচ্ছা করছে। টাকা যে আমার কাছে নেই, তাও না। তবে সামনের মাসে তানিয়ার জন্মদিন। ওকে একটা ডায়মন্ড রিঙ কিনে দেব ভেবেছিলাম। সেমিস্টার ফি আর বইপত্র কেনার টাকার কথা বলে আব্বার থেকে একটা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সে পরিমান টাকা জমিয়েও ফেলেছি আমার প্যান্টের পেছন পকেটে মানিব্যাগটা এখনো সেই টাকায় গর্ভবতী হয়ে আছে। সত্যি সত্যি যদি সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়ে দেই, তাহলে তো আর তানিয়াকে দামি আংটিটা কিনে দিতে পারবনা। আর দামি আংটিটা কিনে না দিতে পারলে তানিয়া ওর বান্ধবিদের কাছে বলতেও পারবেনা, “দেখ,আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে কততো ভালবাসে!”
আড়চোখে মরিয়মের দিকে তাকালাম। গাল দুটো ভাঙা, অপুষ্ট হাড় জিরজিরে শরীর। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন নিস্তেজ, অনেক অভিমান অভিযোগ লুকিয়ে আছে সেখানে। বিছানার এক পাশে একটা টিনের গ্লাসে ভাতের মাড় রাখা! হয়তো এটা খেয়েই আজ সারাদিন পার করে দেবে।
হঠাৎ মনে হলো, ওর সাথে আমার ছোট বোন ইরিনার কেমন যেন একটা মিল আছে! এক্ষুনি ছুটে এশে ভাইয়া বলে গলা জড়িয়ে ধরবে, ওর কপালে একটা চুমু খাব আমি। পকেট থেকে বের করে দেব চকলেট বার!
পরক্ষনেই আমার ঘোর কেটে গেল। কী ভাবছি এসব! অজো পাড়াগাঁয়ের একটা ফকিন্নি বাচ্চার সাথে নিজের বোনের মিল খুজছি! ছি ! ছি ছি!
মরিয়মের চাচা দুঃখী দুঃখী মুখ করে আশার দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু না বলে বেরিয়ে আসাটা খারাপ দেখায়। তাকে বললাম আমি এখন টাকা নিয়ে আসিনি, তবে সন্ধ্যায় এসে অবশ্যই কিছু টাকা দিয়ে যাব। ঢাকায় ফিরে মরিয়মের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলাম। এরপর কোনোদিকে না তাকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে।
আজ রাতে ঢাকায় রওয়ানা হব। এখন কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিতে হবে। অবশ্য তার আগে একটা জরুরি কাজ সারা বাকি। ফেসবুকে জালাল কবিরাজ আর তার মেয়ের বিষয়ে একটা বড়সড় স্ট্যাটাস দিতে হবে। একবার ভাবলাম বাসায় ফিরে ল্যাপটপ থেকে লগইন করব। কিন্তু আমার নতুন কেনা আইফোন সিক্স-প্লাস থেকে স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়াটাই ভালো। তাতে করে আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসের সাথে সাথে নিজের স্ট্যাটাসটাও প্রকাশ পাবে, হাজার হোক, আই ফোন থেকে দেওয়া স্ট্যাটাস! হাঁটতে হাঁটতেই হালনাগাদ করলাম –

“গ্রামের একটা অসুস্থ বাচ্চা মেয়েকে দেখে মনটা খুব খারাপ হল। নিজের অজান্তেই পানি এল চোখে। মেয়েটার ব্লাড ক্যানসার, চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন । অথচ মেয়েটার বাবা সম্পূর্ণ বিকৃত মস্তিষ্কের একজন মানুষ, যে নিজেকে সর্ব রোগ নাশা কবিরাজ বলে দাবি করে। মেয়েটার চিকিৎসার জন্য টাকা যোগাড় করতে হবে। ভাবছি একটা পেইজ খুলব। আশা করি আমার ফেসবুক বন্ধুরাও মেয়েটার মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতে আমার পাশে এসে দাঁড়াবেন।”

রাতে দেখলাম স্ট্যাটাসে অনেকগুলো লাইক পড়েছে। সবাই আমার মানবিকতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তানিয়াও দেখলাম লিখেছে, দেখতে হবেনা বয়ফ্রেণ্ডটা কার! শুধু একটা কমেন্ট দেখে মেজাজটা খারাপ হল। জাহিদ লিখেছে, “তোমাকে যতটুকু চিনি তাতে আমার মনে হয়না একটা টাকাও তুমি মেয়েটার চিকিৎসার জন্য দিয়ে! মেয়েটার বাবা হয়তো বিকৃত মস্তিস্কের লোক,কিন্তু একবার নিজের কথা চিন্তা করে দেখ। লোক দেখানো স্ট্যাটাস আপডেট করছ অথচ কাজের কাজ কিছুই করছ না! এটাও কি কম বিকৃত আচরণ?”
প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম। সব জায়গায় আতলামি না করলে চলে না? হারামজাদাকে এখনই ব্লক করতে হবে ......


পরিশিষ্ট

তানিয়ার জন্মদিনটা সেবার বেশ ভালভাবেই পালন করেছিলাম। হীরার আংটিটা পরিয়ে দেবার পর ওর চোখে পানি চলে এসেছিল। হীরার চেয়ে সেই অশ্রুতে আমি বেশী চাকচিক্য খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রেমিক হিসেবে আমি অসাধারন।
এর কিছুদিন পরই অবশ্য তানিয়া আমাকে ছেড়ে চলে যায়! তাতে কি? মিতুকে নিয়েও আমি বেশ সুখেই আছি। এক বছর পর কি যেন কাজে আবার গ্রামেগিয়েছিলাম। কৌতূহলের বশে জালাল কবিরাজের বাড়ির দিকে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে সাইনবোর্ডটা নেই। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম, মারা গিয়েছে মরিয়ম। সেই সাথে জালাল কবিরাজ কবিরাজি ছেড়ে বেদের দলে ভিড়েছে। মরা মানুষ বাঁচিয়ে তোলার আশ্চর্য বিদ্যা শিখে পাড়ি জমিয়েছে চর অঞ্চলে।
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম তখন, পৃথিবীতে আসলেই মস্তিস্কবিকৃত মানুষের অভাব নেই!






মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:৩৯

মারুফ হোসেন বলেছেন: মনটা উদাস হয়ে গেল! মানুষের ভণ্ডামি আর ভালোবাসার কন্ট্রাডিকশনটাও চমৎকারভাবে এসেছে। এগিয়ে চলুক লেখালেখি।

২| ১২ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:৪২

ওয়াসি আহমেদ বলেছেন: অনেক আগের লেখার এটা। অনুপ্রেরণার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.