নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আপনের রাফখাতা

পিছন ফিরে তাকানোর বদলে সামনে তাকানোই বেশি সহজ

ট্রিপল এ

নিজেকে জানার একটা মাধ্যম হচ্ছে লিখে যাওয়া।লেখালেখি করার অভ্যাস নেই বললেই চলে,মাঝে মাঝে "আউল ফাউল"লেখার চেষ্টা করি একটু.....

ট্রিপল এ › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্পেকুলেটিভ স্পেকুলেশন এবং অন্যান্য

০৩ রা জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:১১

ডিসক্লেইমারঃ আপনারা যা পড়তে যাচ্ছেন সেটা অসম্ভব বড়ো এবং বেশ অপ্রচলিত একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রচেষ্টা। ২০১৯ সালের শেষ দিকে এটি লিখা হয়েছিলো। মূলত পুরো লেখাটি জুড়ে কিছু স্পেকুলেটিভ উপন্যাস এবং সেই উপন্যাসগুলোর সৃষ্টির পিছনের চিন্তার সাথে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গী কি ধরনের হতে পারে, তার মধ্যে সামঞ্জস্য টানার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা এই ধরনের লেখা বা বিষয় নিয়ে পূর্বে পড়েছেন বা চর্চা করেছেন, তাদের কাছে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য বা অপরিপক্কতার জন্য। এবং অবশ্যই জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, পরিবর্তনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ কারন পরিবর্তনের সম্ভাব্যতা থাকুক বা না থাকুক, পরিবর্তনের সামগ্রিকতাই বেঁচে থাকার একটা ভালো অনুপ্রেরণা………………


কিছুদিন আগে ক্লান্তি বা অসুস্থতার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিতে হয়েছিলো। একজন নয়-পাঁচ অফিস করা মানুষ যখন ছুটিতে থাকে, সিরিজ বা মুভি ওয়াচিং করে খুব সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। সেই কারনেই নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার ঘুল (Ghoul) দেখে ফেলেছিলাম এর মধ্যে। মাত্র তিন এপিসোডের দেখে অল্প সময়েই শেষ হয়ে গিয়েছিলো সেটা। ঘুল যখন রিলিজ পেয়েছে, তখন সেটা দেখতে চাইনি কারন নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার আলু/হলুদ রাধিকা আপ্তের অভিনয় আমার কাছে স্বাভাবিক কেন জানি মনে হয় না। যাই হোক, ঘুল বেশ ইন্টারেস্টিং একটা ওয়েব সিরিজ, কারন তা একটা ডিস্টোপিয়ান ফিউচারের কথা বলে। ডিস্টোপিয়া কি, সেটা নিয়ে একটু পরে আসছি, আগে ঘুল নিয়ে একটু সামারাইজেশন করে ফেলি। আমি জানি অনেকেই হয়তো ঘুল দেখেছেন, কিন্তু আমি মনে করি আমরা আসলে পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে হলে গিয়ে সেটা খাতায় লিখে ভুলে যাওয়া জাতি। তাই আমাদের একটু রিভিশন সব কিছুতেই দরকার। তো কাজের কথায় আসি, ঘুল হচ্ছে ভবিষ্যৎ ভারতের একটা গল্প, যেখানে রাষ্ট্র খুবই কঠোরতার সাথে সব কিছু পরিচালনা করে। সেখানে সন্ত্রাসবাদ খুবই বেড়ে গেছে, এবং রাষ্ট্র ন্যাশনাল প্রটেকশন স্কোয়াড নামের একটা অর্গানাইজেশন তৈরি করে সেটার উপর দায়িত্ব ছেড়েছে সন্ত্রাসীদের দমন করা। তো এই এনপিসি সব কিছুই খুব কঠোরভাবে পরিচালনা করতে চায়, অনেকটা জার্মানির গেস্টাপোদের মতো করে। সেখানে মুসলমানদের লিঞ্চিং করা হয়, এন্টি রিলিজিয়াস বা এন্টি স্টেট কোন বই কারো কাছে পেলে তাদের “রিহ্যাবিলিটেড” করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পুরো সিরিজটার স্পয়লার দিবো না, শুরুর কিছু অংশ বলি। রাধিকা আপ্তে, সিরিজে যার নাম নিরা, সে এই এনপিসিতে ট্রেইনি ক্যাডার হিসেবে থাকে, তার বাবা একজন প্রফেসর এবং তিনি মুসলিম। তো একদিন নিরাকে তার বাবা ট্রেইনিং সেন্টারে নামিয়ে দেয়ার সময় গাড়িতে নিরা তার বাবার সাথে তর্ক করছিলো যে কেন তার প্রফেসর বাবা আইন অমান্য করে এখনো বই থেকে পড়াশোনা করায়। সেই সময় সিলেবাসের বাইরে কিছুই পড়ানো নিষেধ ছিলো। এমন সময় পুলিস গাড়ি থামায়, থামিয়ে তার বাবার কাছে পরিচয়পত্র চায়। পরিচয় চেক করে যখন জানতে পারে পুলিস যে নিরার বাবা মুসলমান, তখন তারা গাড়ি চেক করতে চায়। নিরার বাবা তখন রেগে গিয়ে বলে যে এইটা রেসিয়াল কাস্টিং হয়ে গেলো, রাষ্ট্র বা পুলিস এইটা ঠিক করছে না। তখন নিরা পুলিসের কাছে তার আইডি দেখায়। পুলিস যখন দেখে নিরা একজন এনপিসি ট্রেইনি, তখন তারা গাড়িটা ছেড়ে দেয়। যেতে যেতে নিরার মনে পড়ে তাকে ট্রেনিং করার সময় বলা হয়েছিলো পরিবার, আপনজনের চেয়ে দেশ বড়ো, দেশই সবচেয়ে বড়ো আপনজন। নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন বা যে কেউ যদি দেশের বিরুদ্ধে কোন মনোভাব ধারন করে, তার নামে রাষ্ট্রকে সাবধান করা উচিত। নিরা এইটা মনে করে তার বাবাকে পুলিসের হাতে তুলে দেয় রাষ্ট্রবিরোধী চিন্তার জন্য……


এখন ঘুল হলো গিয়ে এক ধরনের পিশাচ, এরাবিয়ান ফোকলোর থেকে এসেছে সেটা। সিরিজে পিশাচ কি করে বা কিভাবে কি হলো, আমি এতো গভীরে যাবো না, শুধু বলে রাখি এই পিশাচ আসলে ডিস্টোপিয়ান এই রাষ্ট্রের অনাচারের বিরুদ্ধে পৈশাচিক উপায়ে প্রতিবাদ জানায়, সেটার ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই গল্প এগিয়ে গেছে। আমার আগ্রহ সিরিজ বা সিরিজের আদিভৌতিক অংশ নিয়ে নয়, আমার আগ্রহ এই সিরিজে দেখানো রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে। ভবিষ্যৎ কেমন হবে বা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানচিত্র কি বলবে, সেটা ভাবতে গিয়ে অধিকাংশ লেখক বা ফিল্মমেকার সেটাকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করেছেন। অবশ্যই ভবিষ্যৎ জগত পরিচালিত হবে বিজ্ঞান দিয়ে, অবশ্যই ভবিষ্যতে মহাকাশ পাড়ি দেয়াটা সাধারন বিষয় হয়ে যাবে, কিন্তু এতো দূরের ভবিষ্যতের আগেও মাঝামাঝিতে একটা ভবিষ্যৎ আছে, যার রাষ্ট্রব্যাবস্থা কেমন হবে এবং নাগরিক আর রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে, সেটা নিয়ে হাতে গোনা কিছু লেখক/ ঔপন্যাসিক কাজ করে গেছেন। আমরা ভাগ্যবান, তাদের প্রায় সবাই অসম্ভব চমৎকার কিছু সৃষ্টি আমাদের উপহার দিয়েছেন………

ডিস্টোপিয়া ব্যাপারটি এখনো খোলাসা করা হয় নি। ডিস্টোপিয়া হচ্ছে ইউটোপিয়ার বিপরীত শব্দ। আমরা কমবেশি অনেকেই ইউটোপিয়ার সাথে পরিচিত, ইউটোপিয়া হচ্ছে এমন একটা কল্পিত জগত যেখানে দুঃখ, জরা, অপরাধ, সীমাবদ্ধতা থাকবে না বললেই চলে, সে জগত খুশির জগত, সেখানে শুধু আনন্দ। এখন ডিস্টোপিয়া যদি তার বিপরীত হয়, তার মানে ধরে নিতে হবে ডিস্টোপিয়া হচ্ছে এমন একটা জগত যেখানে শুধুই দুঃখ, বেদনা, যন্ত্রনা, অবিচার, অনাচার, অপরাধ আর কষ্ট থাকবে। এখন এইখানে হয়তো ব্যাপারটা এইভাবে চিন্তা করা যেতে পারে যে ডিস্টোপিয়া মন্দ কিন্তু সেটা কার জন্য মন্দ? একজনের কাছে যা ভালো না, অন্যের কাছে সেটাই ভালো হতে পারে! স্তালিনের কাছে যে জগত চমৎকার ছিলো, রোনাল্ড রেগান কি সেই জগতে সুখী থাকতে পারতো? সে থিয়োরি মতে সামতে যেতে চাইলে আবার এটাও বলতে হয় যে ইউটোপিয়াও কি তাহলে সবার জন্য ইউটোপিয়া? কোন এক ইউটোপিয়ায় কোন দার্শনিক যদি দাঁড়িয়ে বলে ফেলে যে মানুষ যদি সারাক্ষন সুখেই থাকে, তাহলে অস্তিত্বের উদ্দেশ্যই বা কি রইলো? অবশ্য বলার সম্ভাবনা কম কারন এই পৃথিবীতে অসুখী মানুষ এতোই বেশি যে ইউটোপিয়া পেলে সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যে দরকার, সেটা বুঝতেই মানুষের অনেক সময় লেগে যাবে। সে যাই হোক……………


তো সুদূর ভবিষ্যতের পৃথিবী কি ইউটোপিয়ান না ডিস্টোপিয়ান, সেটা নিয়ে বেশ কিছু স্পেকুলেটিভ ফিকশন আছে। ঘুল দেখে উঠার পর আমার এই ডিস্টোপিয়া নিয়ে লেখা স্পেকুলেটিভ ফিকশন/নভেলগুলো একটু ঝালিয়ে নেয়াটা দরকার মনে হচ্ছিলো। কারন ঘুল এমন একটা সিরিজ যা কিন্তু একটু লজিক ল্যাডার ফলো করে চলা বিগিনার লেভেলের যেকোন মানুষকেই গভীরভাবে চিন্তা করতে আগ্রহী করে তুলবে। যারা একটু ব্রেইনস্টর্মিং করার মতো বইপত্র পড়েন, তাদের কাছে জর্জ অরওয়েল খুবই পরিচিত একটি নাম। এনিম্যাল ফার্ম তো ভালো মানের পড়ুয়াদের মুখে মুখে থাকে! কিন্তু আমি অন্য একটি উপন্যাস নিয়ে কথা বলবো, সেটা হলো গিয়ে নাইন্টিন এইট্টি ফোর। এই উপন্যাসটা ডিস্টোপিয়া নিয়ে আগ্রহী বিগিনারদের খুব ভালো একটা চিত্র দেখায় কারন সহজ সরল ডিস্টোপিয়া কেমন হতে পারে বা সেটার গঠন কেমন হবে, জর্জ অরওয়েল সেটা বেশ সাবলীলভাবেই দেখিয়েছেন। আমি বলছি না যে এইটা একটা মাস্টারপিস না, বরং ডিস্টোপিয়া শব্দটা আসলে নাইন্টিন এইটটি ফোর আসবেই। সে যাই হোক, আমরা একটু গল্পটার দিকে যাই। নাইন্টিন এইটটি ফোর ওশেনিয়া নামের এমন একটা রাষ্ট্রের কথা বলে যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিয়ন্ত্রন করে নজরদারীর মাধ্যমে। প্রশ্ন উঠতে পারে এটা তো বিশ্বের সব রাষ্ট্র এখনই করে! তো এ আর নতুন কি? নাইন্টিন এইটটি ফোরের নজরদারীটা একটু উঁচু লেভেলের। সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের বাসার প্রত্যেক ঘরের এক পাশের দেয়াল হলো গিয়ে একটা মনিটর বা স্ক্রিন। পুরো দেয়াল জুড়ে একটা স্ক্রিন যেখানে একটাই সরকারি চ্যানেল দেখানো হচ্ছে। শুধু ঘরে না, যেকোন চার দেয়ালের রুমে একটা দেয়াল হবে এইরকম স্ক্রিন। সেটা লিফট হোক বা অফিস, বাথরুম হোক বা কিচেন, সব জায়গায় একই নিয়ম। সেই স্ক্রিন একই সাথে একটা ভিডিও ক্যাপচারার অর্থাৎ সেখানে সারাক্ষন অডিও আর ভিডিও রেকর্ড হচ্ছে রুমের। সুতরাং মানুষ কি বলছে বা করছে বা চেহারায় কি চলছে বা তার মুখে হাসি নাকি কান্না- সব রেকর্ড করা হচ্ছে এবং সেটা মনিটর করা হচ্ছে। সেই সমাজে দুঃখ হচ্ছে বেআইনি একটা ব্যাপার। তাই থট মনিটরিং এর জন্য থট পুলিস আছে, যারা কিনা এই চেহারাগুলো দেখে চেহারার পিছনের অনুভূতিগুলো যাচাই করে। যদি মনে হয় কারো চেহারায় বা কথায় বা চিন্তায় কোন কারনে রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কিছু চলছে, তাকে এরেস্ট করে ফেলা হয়। সেই সমাজে বাচ্চাদের সেখানো হয় বাবা-মা, পরিবারের যেকোন সদস্য যদি কখনো রাষ্ট্রের নামে কিছু বলে, সেটা যেন রাষ্ট্রকে সাথে সাথে তারা জানিয়ে দেয়। এখন যদি আমরা গল্পটার প্লটের দিকে একটু মন দেই, তাহলে এই সব কিছু আরও পরিষ্কার হবে। আমি ধরেই নিচ্ছি যারা এই নাগাদ পড়েছেন, নাইন্টিন এইটটি ফোর তাদের পড়া। তারপরেও আমি একটু স্পয়লার সহ গল্পটা অল্প অল্প করে বলবো, যদি কেউ একটু ভুলে যান, তাদের যেন একটু হেল্প হয়। গল্পে নায়ক মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ নামে একটা ডিপার্টমেন্টে কাজ করে, যেই অর্গানাইজেশনের কাজ হচ্ছে মিথ্যা বা ফলস ফ্যাক্ট তৈরি করা। করে লাভ কি হবে? কারন রাষ্ট্র চায় না রাষ্ট্র পরিচালনাকারী পার্টি বা পার্টি হেড যার নাম হচ্ছে বিগ ব্রাদার, সে যেন কখনো জনগনের কাছে ছোট না হতে পারে। জনগন যেন তার বিরুদ্ধে কখনো ক্ষেপে না যায়। যেমন ধরে নেয়া যাক বিগ ব্রাদার কোন এক কালে কোন একটা মন্তব্য করেছিলেন যেটা বর্তমানে এসে একটু বেখাপ্পা লাগছে। তখন এই মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ সেই অতীতের সমস্ত কাগজে উল্লেখিত সেই মন্ত্রব্য মুছে ফেলবে এবং নতুন মন্তব্য লিখে দিবে যা গ্রহনযোগ্য। কারন অতীত থাকে কাগজে আর স্মৃতিতে। যদি কাগজের মিথ্যাকে স্মৃতির বিরুদ্ধে আনা যায়, স্মৃতি নিজেও বিভ্রান্ত হয়ে যায় যে তাহলে আমি কি ভুল জেনে আসছিলাম কিনা। এইভাবে পার্টির নামের সমস্ত তিক্ত সত্য মুছে সেখানে গুণগান লেখা এবং ঘটতে থাকা ঘটনা অতীতের নথিতে লিখে দেয়া যে পার্টি বলেছিলো ভবিষ্যতে এইটাই হবে। এতে করে জনগনও পার্টি আর বিগ ব্রাদারকে ঈশ্বরতূল্য মনে করা শুরু করে সহজেই। সেই সমাজে আরেকটা ব্যাপার হয়, সেটা হলো গিয়ে হেইট সেশন। দুই মিনিটের এই সেশনে হয়টা কি আসলে? যেখানেই যারা আছে, সবাই দল করে আলাদা আলাদা ভাবে একত্র হয়ে যায়, স্ক্রিনে তখন ইমানুয়েল গোল্ডস্টাইন নামের একজন মানুষের চেহারা ভেসে উঠে। শোনা যায়, একসময় এই লোকটা পার্টির হাই লেভেলে ছিলো, এতো টাই হাই লেভেলে যে সে বিগ ব্রাদারের মত একটা পজিশন হোল্ড করতো। কিন্তু কোন একটা কারনে পার্টির বিরুদ্ধে চলে যায় সেই লোক, পরে ওশেনিয়া ছেড়ে অন্য একটা দেশে পালায় সে। স্ক্রিনে দেখা যায় সে পার্টির নামে আর বিগ ব্রাদারের নামে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে। গোল্ডস্টাইন বলতে থাকে প্রেসের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সরকারের নামে সমালোচনার স্বাধীনতা। স্ক্রিনে দেখানো হয় গোল্ডস্টাইনের পিছনে ওশেনিয়ার প্রতিপক্ষে দেশের সৈনিকরা কুচকাওয়াজ করছে যে দেশটার সাথে অনেক বছর ধরে ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে। এইসব দেখে আর শুনে মানুষ রেগে উঠে গোল্ডস্টাইনের বিরুদ্ধে, তাকে গালাগালি শুরু করে দেয়। গল্পের নায়ক নিজেই বিগ ব্রাদারের মিথ্যাচার এবং রাষ্ট্রের এই ধরনের গেস্টাপো টাইপ পুলিসিং এর বিরুদ্ধে কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখে হেইট সেশনের এক মিনিটের মাথায় সে নিজেও তীব্র ঘৃণা নিয়ে গোল্ডস্টাইনকে গালি দিচ্ছে। সে আবিষ্কার করে রাষ্ট্র মানুষের ঘৃণা উগরে দেয়ার এক আদিম কামনাকে পুজি করে, ম্যানিপুলেট করে অনাচার বাড়িয়েই যাচ্ছে, নাগরিকদের কোন অধিকারই দিচ্ছে না শুধুমাত্র মনস্তাত্ত্বিক খেলায় এগিয়ে থেকে, নাগরিকদের কঠিন সমস্ত নিয়মের বেড়াজালে বন্দি করে………………..


উপন্যাসে দেখা যায় ওশেনিয়ার সাথে সারাক্ষন কোন না কোন দেশের যুদ্ধ চলছেই। হয় ওশেনিয়ার সাথে যুদ্ধ চলছে ইউরেশিয়ার, নাহলে ইস্ট এশিয়ার। এবং যুদ্ধের কারনে ওশেনিয়ায় সব সময় জরুরী অবস্থা থাকে, নাগরিকদের সব কিছুই রেশন করে চলতে হয়। একটা সামান্য পাউরুটি, সেটাও কিনতে হয় কালোবাজার থেকে কারন রাষ্ট্র সরকারিভাবে খাদ্য সরবরাহে মনযোগ দিতে পারছে না। যদি জিগ্যেস করা হয় কেন, উত্তর একটাই, এই যে! যুদ্ধ চলছে! আর বাকি সব হচ্ছে গোল্ডস্টাইনের চক্রান্ত। তার চক্রান্তের জন্যই তো নাগরিকদের এতো কষ্ট! এখন যুদ্ধ চললে সেটার ক্ষয়ক্ষতি তো হবেই। হয়ও সেটা। আকাশ থেকে মাঝে মাঝেই বোমা পড়ে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সবসময়ই সেটা সমাজের সবচেয়ে নিচু যারা, তাদের এলাকায় গিয়ে পড়ে। সেই নিচু জাতকে প্রোল বলা হয়। তাদের ঘরে নজরদারী রাখার স্ক্রিন নেই কারন রাষ্ট্র তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের কিছু সস্তাদরের পর্নোগ্রাফি দেয়া আছে, তারা জুয়া খেলে আর মদ খায়, আর একদম নিচু মানের কাজগুলো তাদের দিয়ে করানো হয়। তাদের নিয়ে কারোরই কোন মাথাব্যাথা নেই। তারা এক্সিস্ট করে এবং বোমার আঘাতে মারা যায়- সমাজে এই তাদের ভূমিকা…


নাইন্টিন এইটটি ফোর জুড়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে, তা হলো রাষ্ট্র নাগরিকদের বিভ্রান্ত করে নিজেদের অনুগত রাখার জন্য কিভাবে ফ্যাক্ট ম্যানিপুলেশন করে আর কি ধরনের থিয়োরি ফলো করে। একটা এক্সাম্পল দেয়া যাক, কোন এক হেইট সেশনে একজন পার্টি অফিশিয়াল হেইট জানাচ্ছেন ইমানুয়েল গোল্ডস্টাইন আর ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে। ইউরেশিয়া হচ্ছে সেই দেশ যার সাথে ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে। সেই পার্টি স্পোকসপারসন বলেই যাচ্ছেন যে গোল্ডস্টাইন খারাপ, সে কুচক্রী, ইউরেশিয়া একটি রেসিস্ট, সেক্সিস্ট দেশ যারা শুধু যুদ্ধ করে আর অত্যাচার করে সহ আরও নানা কিছু। বক্তৃতার মাঝখানে তাকে পিছন থেকে একটা ছোট কাগজ দেয়া হয় পার্টি থেকে, তিনি বক্তৃতা বন্ধ না করেই কাগজটায় চোখ বুলান এবং কথা বলতে থাকেন যে ইস্ট এশিয়ার সাথে এই চলমান যুদ্ধে নাগরিকদের উচিত রাষ্ট্রকে সহায়তা করা এবং রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা কারন ইস্ট এশিয়ার মতো জঘন্য রাষ্ট্রকে হারানোই হচ্ছে ওশেনিয়ার মতো ভালো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেশনে আসা নাগরিকরা বুঝতেই পারছে না যে কি হচ্ছে। ব্যানার আর ফেস্টুন তারা নিয়ে এসেছে ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে লিখে, মাঝে ইস্ট এশিয়া আসলো কোথা থেকে! পার্টি স্পোকসপারসন তখনও কথা থামায়নি, সে জনগনের চোখ পড়ে বুঝতে পারে এবং বলে আপনারা হয়তো অবাক হচ্ছেন যে ইস্ট এশিয়ার কথা কেন বলা হচ্ছে। আপনারা কি মনে করছেন ইস্ট এশিয়ার সাথে যুদ্ধটা এই মাত্র শুরু হয়েছে? ইতিহাস বলছে সৃষ্টির শুরু থেকেই আমাদের সাথে ইস্ট এশিয়ারই যুদ্ধ চলছে। এই যে আপনারা ব্যানারে ইউরেশিয়ার নাম লিখে এনেছেন, এর কারন কি জানেন? আপনাদের ভুল জানানো হচ্ছে, ইউরেশিয়ার মতো বন্ধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপনাদের ভুল বুঝানো হচ্ছে যে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। ভুলটা বুঝাচ্ছে কে? ওই যে, ইমানুয়েল গোল্ডস্টাইন! সব চক্রান্ত তো তারই………


এই যে পুরো ব্যাপারটা হলো, নাগরিকরা হয়তো বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। তাই রাষ্ট্র তখন ঠিক করলো প্যারারাল থিঙ্কিং নামের একটা থিয়োরি চালু করতে হবে। সেটা কি? প্যারারাল থিংকিং হচ্ছে একই সাথে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুইটা ধারনা বিশ্বাস করা এবং দুইটাকেই ধারন করে কাজ করে যাওয়া। একই সাথে আমরা বিশ্বাস করছি ইউরেশিয়ার সাথে যুদ্ধ চলছে আর ইস্ট এশিয়া ভালো, একই সাথে আমরা সেটাও মেনে নিচ্ছি যে ইস্ট এশিয়ার সাথেই আসলে যুদ্ধ চলছে এবং বাকি সব গোল্ডস্টাইনের চক্রান্ত। মজার ব্যাপার হচ্ছে যুদ্ধটা ইউরেশিয়ার সাথে হলে সেটাও গোল্ডস্টাইনের চক্রান্তই হবে। প্রশ্ন আসতে পারে যে এই ধরনের প্যারারাল থিংকিং তো শুধু উপন্যাসেই সম্ভব, বাস্তবে কি মানুষকে এইভাবে বোকা বানানো যাবে? জর্জ অরওয়েল কি শুধু একটা ফিকশনই লিখেছেন তাহলে? ব্যাপারটা তেমন না। নাইন্টিন এইটটি ফোরের চেয়ে বড়ো এবং ভয়ানক মাপের প্যারারাল থিংকিং আমরা এখন নিজেরাই করি। কিছু এক্সাম্পল দেই সহজ থেকে কঠিন হিসেব করে। কেউ যদি জিগ্যেস করে ছেলেটা রিলেশনের জন্য কেমন, কোন এক বন্ধু হুট করে বলে ফেললো ‘আরে শালা তো একটা ক্যারেক্টারলেস, সারাক্ষন মেয়ে লাগিয়ে বেড়ায়। তবে যাই হোক না কেন, রিলেশনে প্রচুর টাকা আর সময় খরচ করে সে’- আরে যে ছেলে ক্যারেক্টারলেস, সে রিলেশনের জন্য ভালো হয় কি করে? আর রিলেশনে সময় আর টাকা ইনভেস্ট করাই যদি ক্রাইটেরিয়া হয়, তাহলে ক্যারেক্টারের প্রশ্নই বা আসবে কেন? যদি কাউকে জিগ্যেস করা হয় মেয়ে বিয়ে দিতে চাই, অমুকের ফ্যামিলিটা কেমন? উত্তর আসবে ‘ বলবেন না ভাই, পুরাই উচ্ছন্নে যাওয়া ফ্যামিলি, সব হারাম পয়সা। তবে ছেলের চাচা কিন্তু সচিব, ছেলেকে কানাডা পাঠাবে’- আরে বাবা ফ্যামিলি ঘুষখোর হলে বা ইলিগ্যাল কাজে টাকা কামালে সেটা ভালো ফ্যামিলি হয় কি করে? আর ছেলের চাচা বড়ো অফিসার হলেই যদি সব হয়ে যায় তাহলে ফ্যামিলির কথা জিগ্যেস করে লাভ কি? আবার যদি প্রশ্ন করা হয় দেশে লিকার লাইসেন্স প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় না কেন? উত্তর আসবে ‘ আরে ভাই এই হারাম জিনিশের অনুমতি দিয়ে দেশটাকে জাহান্নাম বানাবো নাকি? আর সিলেক্টিভ সেক্টর থেকে আমদানি আর স্টক হয়, সবাইকে দিয়ে দিলে সেক্টর কিভাবে বাঁচবে?’ তো ব্যাপারটা হচ্ছে হারামই যদি হয়, তাহলে অল্প স্বল্প বারেরই বা লাইসেন্স আছে কেন? আর যদি কিছু বিশেষ ক্লাস বা ইকোনমিক্যাল লিমিটেই মদকে ধরে রাখা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে হারাম হালাল দিয়ে কি করবো? এই সমস্ত ব্যাপার বা তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপারগুলো অহরহ প্রতিনিয়ত আমরা নিজেরাই করছি। প্যারারাল থিংকিং নিয়ে জর্জ অরওয়েল একটা সাদামাটা এক্সাম্পল দিয়েছিলো কিন্তু তার ঐশ্বরিক মাত্রার সৃজনশীলতা আমরা প্রায়ই দেখাচ্ছি সমাজে……………..


নাইন্টিন এইটটি ফোর নিয়ে বলি আবার। বেশি বলবো না, আমি জানি এইটা অনেকেই পড়েন নাই এবং এইটার স্পয়লার দেয়া ঠিক হবে না। নাইন্টিন এইটটি ফোরের ওশেনিয়া রাষ্ট্রের দর্শন হচ্ছে সারাক্ষন নাগরিকদের নজরদারিতে রাখা, তাদের মধ্যে একটা প্রোপাগান্ডা ঢুকিয়ে দেয়া, তাদের চোখে পার্টি আর বিগ ব্রাদারকে ঈশ্বরতুল্য দেখানো, এবং সারাক্ষন আরেক দেশের সাথে যুদ্ধ জিইয়ে রাখা যেন নাগরিকরা দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজেদের প্রতি যে রাষ্ট্রের উদাসীনতা, সেটা নিয়ে কিছু না বলে। ঠিকই তো, আপনি সুইটজারল্যান্ডে যদি থাকেন, আপনার বাসার সামনের রাস্তাটা ভেঙ্গে গেলে অথবা একদিন বিদ্যুৎ সরকারের গাফিলতিতে না থাকলে সরকারের বিরুদ্ধে বিশাল বড়ো অভিযোগ দিবেন, পুরো দেশে সরকারের বিরুদ্ধে ছিঃ ছিঃ পড়ে যাবে। আপনিই ভেবে দেখুন তো, গতো চার বছরে সিরিয়ান সরকারের কাছে কি একটা আবেদনপত্রও জমা হয়েছে যে কোন একজন নাগরিক বলছেন যে তার বাসার সামনের রাস্তাটায় খানাখন্দ আছে? যেখানে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে খুশি হতে হয় যে বোমার আঘাতে মরিনি এখনো, সেখানে রাস্তা একটু ভাঙ্গা হলে কি এমন হয়ে যাবে? আপনারা কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন আরে তাই তো! এই ওশেনিয়ার সাথে তো এখনকার নর্থ কোরিয়ার মিল আছে অনেক! সেখানের নাগরিকেরা তো এইভাবেই সাফার করে! আপনারা হয়তো ভুল যাচ্ছেন, রাষ্ট্রের উদাসীনতা আর প্যারারাল থিংকিং আপনার নিজেরই রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে বসে আছে। রাষ্ট্র কি সারাক্ষন আপনাকে মনিটর করছে না? চারদিকে সিসিটিভির জালে আবদ্ধ আপনি, মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে সারাক্ষন আপনার আচরন মনিটর করা হচ্ছে, মাইক্রোফোন দিয়ে আপনার কথা শুনে নেয়া হচ্ছে- আপনি কি নাইন্টিন এইটটি ফোরের মতো নজরদারীতে নেই? রাষ্ট্রের নামে কোন কথা আপনারা বলতে পারেন? রাষ্ট্র আপনাকে আপনার বেসিক সুবিধাটুকু দিচ্ছে? নাগরিক অধিকার বলে রাষ্ট্রের কাছে যখনই আপনি যৌক্তিক কিছু দাবী করেন, তখন কি কোনকালেই আপনার শুনতে হয় নাই দেশের মানুষ না খেয়ে মরে আর উনি আছেন বিলাসিতা নিয়ে? আপনি যখন রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে যাবেন এমাজন বা আলিএক্সপ্রেস থেকে সরাসরি একজন নাগরিক কেন কোন বৈধ কিছু কিনতে পারে না, তখন কি রাষ্ট্র আপনাকে আরেকটা তূলনামূলক বড়ো সমস্যা শুনিয়ে দিবে না? আপনারও কি মনে হবে না সমাজের এই বড়ো সমস্যার কাছে আমার নিজের সমস্যা কিছুই না? একটু স্যাক্রিফাইস কি করা যায় না? মোটাদাগে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নটি হচ্ছে তাহলে কি আমরাও কি একটি ডিস্টোপিয়ান রাষ্ট্র বা সমাজের পথে চলছি? শুধু আমরাই না, বিশ্বের সব দেশই কি ধীরে ধীরে ডিস্টোপিয়ান হয়ে যাচ্ছে? তাহলে জর্জ অরওয়েল কি তাহলে যে স্পেকুলেটিভ ফিকশনটি লিখেছিলো, তা ধীরে ধীরে সত্যে রূপান্তরিত হচ্ছে?


স্পেকুলেটিভ ফিকশন বা ডিস্টোপিয়া নিয়ে লেখার কথা বললেই যে নামগুলো চলে আসে সেগুলো হচ্ছে জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটটি ফোর আর অল্ডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড। এই দুটো উপন্যাসই মূলত ডিস্টোপিয়াকে সবচেয়ে চমৎকার উপায়ে সামনে আনতে পেরেছে। রে ব্র্যাডবেরি নামের একজন লেখক আছেন, তার ফারেনহাইট ৪৫১ নামের একটা ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসও খুবই ভালো একটা রেফারেন্স। আর্থার কোশারের ডার্কনেস এট দ্যা নুনও বেশ চমৎকার একটা উপন্যাস কিন্তু সেটা স্পেসিফিক্যালি সোভিয়েত ইউনিয়নকে মাথায় রেখে লেখা বিধায় আমি সেটাতে আমার আদর্শ ডিস্টোপিয়া খুঁজে পাই নি, সেই ডিস্টোপিয়া ছিলো পলিটিক্যাল ডিস্টোপিয়া। হালের হাঙ্গার গেমস বা ডাইভারজেন্টও ডিস্টোপিয়া নিয়ে লেখা স্পেকুলেটিভ উপন্যাস তবে সেগুলো নিয়ে বলবো না, কারন হাঙ্গার গেমস বা ডাইভারজেন্টের মুভি আছে, যাদের পছন্দ, তারা দেখে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে পারেন। আমি ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড নিয়ে বলবো। ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড হচ্ছে নাইন্টিন এইটটি ফোরের পুরো উল্টো, যারাই বইটা পড়েছেন, তারা শুরুর অর্ধেক হয়তো ধরতেই পারবেন না যে এইটা আসলে ইউটোপিয়া না ডিস্টোপিয়া। এই উপন্যাস এমন একটা ভবিষ্যৎ সমাজের কথা বলে যেখানে জেনেটিক্যালি পপুলেশন প্রোডাকশনকে কন্ট্রোল করা হয়। সেখানে কেউ প্রাকৃতিকভাবে বাচ্চা জন্ম দেয় না, বরং সেখানে সমস্ত শিশু ল্যাবরেটরিতে কৃত্তিমভাবে তৈরি করা হয়। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে যদি সবাইকে এক ফ্যাক্টরি/ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়, তাহলে কাস্ট সিস্টেম থাকে কিভাবে? মুচির ছেলে কোন না কোন কারনে হয়তো মুচিই হয়, রাজার ছেলে রাজা হয়, এমনটাই তো দেখে আসছি আমরা, তাই নয় কি? তো কারো ছেলে মেয়ে না হলে শিশু তার পূর্বপুরুষের সম্মান পাবে কিভাবে? আমরা আজ অবধি যতো স্পেকুলেটিভ ফিকশন পড়েছি বা ডিস্টোপিয়ান সমাজ দেখেছি, প্রত্যেকটাতেই কাস্ট ছিলো, ইকুয়ালিটি কোথাও ছিলো না। রাইটাররাও সত্যটা বুঝে গিয়েছিলো যে ইকুয়ালিটি শুধু মুখের কথা, ইকুয়ালিটি থাকলে সমাজ চলে না।

সে কথা বাদ দেই, ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ডে কাস্ট সিস্টেম তৈরি করার জন্য পাঁচ ধরনের বাচ্চা বানানো হতো। সেগুলো হচ্ছে আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা আর এপ্সাইলন। আলফারা হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে উঁচু স্তর, ক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা থাকে। তাদের হাতেই সমাজ চালানোর অধিকার আছে। বিটারাও বেশ উঁচু লেভেলের ক্লাস, আলফার চেয়ে একটু কম বাট তারাও শুধু মানসিক কাজ করে যেমন চিন্তা করা, কথা বলা বা ডিসিশন নেয়া। গামা আর ডেল্টারা করে শারীরিক পরিশ্রম, এর মধ্যে গামারা একটু ভালো মানের কাজ করে যেমন মেকানিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান, ট্রাক ড্রাইভার, ফুড সাপ্লাই সুপারভাইজার টাইপের। আর ডেল্টারা এক্কেবারে নিচু শারীরিক কাজ করে যেমন শ্রমিক, সুইপার, ক্লিনার, মুচি এইটাইপের। এপ্সাইলনরা হচ্ছে সমাজের এক্কেবারে বাইরের, আমরা আসলে বর্তমানে হরিজন বা অচ্ছুৎ বলতে যা বুঝি, তারই একটা আরও বাজে অবস্থায় থাকা গোত্র হচ্ছে এপ্সাইলন। তারা সোসাইটিতে থাকেও না, বাইরের দিকে কোনরকমে বেঁচে থাকে। এখন এই সমাজে বিয়ে, পরিবার, বাবা-মা-ভাই-বোন এইগুলো এক্কেবারে জঘন্য গালির মতো শব্দ। যেখানে সবই ল্যাবরেটরিতে হচ্ছে, সেখানে ছয় সাতশো বছর আগের কিছু মধ্যযুগীয় ব্যাপারকে গালি হিসেবেই মানুষ ধরে নেয়। তো পরিবারহীন এইসব বাচ্চাকে দেখভাল করা হয় কিভাবে? সেটাও অনেকটা ইন্টারেস্টিং। ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ডে আমরা দেখতে পাই তাদের স্লিপ হিপনোসিসের মাধ্যমে বড়ো করে তোলা হয়। তাদের বিছানায় বালিশের নিচে একটা স্পিকার থাকে যেটা হালকা আওয়াজে ঘুমের মধ্যে ইন্সট্রাকশন দেয়। যেমন আলফা বাচ্চাদের স্পিকারে বলা হতে থাকে ‘আমি আলফা, আমি সবচেয়ে উঁচু, আমি গামা ডেল্টা বাচ্চাদের সাথে মিশবো না, কখনো আমি আমার ক্লাস ভুলে যাবো না, আমি বিটাদের সাথে মিশবো বাট তাদের সাথে সেক্স করবো না অতিরিক্ত প্রয়োজন না পড়লে। আমি শুধু আলফাদের সাথেই সেক্স করবো।’ সেই সমাজে ইন্টারকোর্সকে সরাসরি শোয়া বা সেক্সই বলা হতো, সে বিষয়ে পরে আসছি। বিটা বাচ্চাদের শোনানো হতো ‘ আমি বিটা, আমি অনেক উচি একটা ক্লাসে আছি, আলফারা আমার চেয়ে উঁচু, কিন্তু আমি হিংসা করবো না আলফাদের বরং আমার খুশি হওয়া উচিত আমি বিটা, কারন আলফাদের মানসিক কাজ কঠিন, আমারটা একটু সহজ, আমি গামা বা ডেল্টা বাচ্চাদের সাথে মিশবো না’। গামা আর ডেল্টাদেরও কি ধরনের কথা শোনানো হতো, সেটা তো বুঝতেই পারছেন। সেখানে আরও একটা ভাবে বাচ্চাদের কন্ডিশনিং করানো হতো যেটা মানসিকের বদলে অনেক বেশি শারীরিক। যেমন একদল ডেল্টা বাচ্চাকে একটা রুমে এনে রেখে তাদের সামনে খাবার আর বই রাখা হলো। এখন ছোট বাচ্চাতো যা দেখবে সেটাই ধরতে চাইবে। যারা খাবার বা চকলেট ধরছে, তাদের কোন সমস্যা নেই। কিন্তু কোন বাচ্চা যদি ভুল করেও বই ধরে ফেলে বা উল্টেপাল্টে দেখার চেষতা করে, তাহলেই আশেপাশে বোমা বিষ্ফোরন হয়, তীব্র শব্দে সাইরেন বাজে, ধোয়া ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং বইয়ের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রিক শক দেয়া শয়। তখন রুমে থাকা প্রায় সব বাচ্চাই কান্না শুরু করে, তাদের তখন আরেকটা রুমে নিয়ে শান্ত করা হয় দশ পনেরো মিনিটের জন্য। এরপর তাদের সামনে আবার খাবার আর বই রাখা হয়। এইবার অনেক বাচ্চাই কিন্তু আর বই ধরতে চায় না। এইরকম প্রসেস একশো বা হাজারবার চালানোর পর ডেল্টা বাচ্চাদের মনে ঢুকে যায় যে বই একটা খারাপ জিনিশ, চিন্তা খারাপ জিনিশ। আমি খাবো আর কাজ করবো, বই পড়ে বা চিন্তা করে কাজ কি? শিশুকালের সেই শারীরিক যন্ত্রনা অবচেতন মনে বই, চিন্তার উপর ডেল্টাদের একোটা ঘৃণা জন্মিয়ে দেয়। এইরকম অনেক প্রসেস দিয়ে প্রত্যেক ক্লাসের বাচ্চাদের নিজের সিলেক্টিভ রোলের জন্য তৈরি করা হয়……………………


প্রশ্ন জাগতে পারে মনে, শুরুতে যে বলা হলো এইটা অনেকটা ইউটোপিয়ান সমাজ, তাহলে শুধু খাবার খাওয়া আর কাজ করার মধ্যে আনন্দ কই? আসছি সেটা নিয়ে। রাষ্ট্র সেখানে সোমা নামে একটা ট্যাবলেট সরবরাহ করে নাগরিকদের, ট্যাবলেটটা অনেকটা ভায়াগ্রা, গাঁজা, এফ্রোডিজিয়াক, এলএসডির সম্মিলিত এফেক্ট যেমন হবে, তেমন একটা মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা তৈরি করে। এই ট্যাবলেট আলফা বিটারা যতো খুশি দরকার, খেতে পারে, গামা আর ডেল্টাদের একটু রেশন করে দেয়া হয় যেমন দিনে প্রত্যেককে একটা কি দুইটা। কাজ ভালো করলে বেশি করে সোমা পুরষ্কার দেয়া হয়। সোমা খেলেই যেহেতু অন্য একটা জগতে হারিয়ে যাওয়া যায়, সেহেতু এই সমাজে সবাই সোমার ভুখা। সেক্সের ব্যাপারটায় এখন আসি, ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ডে এমন একটা সমাজের কথা বলা হয়েছে যেখানে সবাই সবার সাথে সারাক্ষন শুচ্ছে( নিজ নিজ ক্লাসে)। যে যার সাথে খুশি তার সাথে শুচ্ছে, বাচ্চাদের ছোট থেকেই সেক্স গেম শেখানো হচ্ছে। এমনকি টিচাররা সেই সব বাচ্চার উপর জোর দিচ্ছে যারা সেক্স গেম তেমন একটা খেলতে চায় না। তাদের হোমওয়ার্ক দেয়া হয় বেশি করে সেক্সুয়াল এক্টিভিটিজে লিপ্ত হতে। এমনকি এই গেমের ক্যারেক্টারও হতে হবে র‍্যান্ডম, স্পেসিফিকেশন আনা হচ্ছে অপরাধ। কেউ যদি কার সাথে টানা এক সপ্তাহের বেশি শুয়ে ফেলে, রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে পারে। সবাই সবাইকে বলছে যে একজনে মজে থেকে লাভ কি, আরও ত্রিশ চল্লিশ জনের সাথে শুয়েই দেখো, ভ্যারিয়েশন আনো! সরকার প্রতি পনেরোদিন অন্তর অন্তর একটা সরকারী খরচে অর্জি(গ্রুপ সেক্স) এরেঞ্জ করে, সেখানে লাগামহীন সোমার সাপ্লাই দেয়া হয়, যে যার সাথে যতক্ষন খুশি যতোবার খুশি তখন শুতে পারে, কয়জনের সাথে একবারে কে শুচ্ছে, কেউ সেটা জাজ করে না। এখন আমরা তো অভাবী মানুষ, তাই না? এইটুকু পড়েই হয়তো ভাবছি যে এইটাকে ডিস্টোপিয়া কোন পাগলে বলে? এইটা তো সোজা ভাষায় ইউটোপিয়ার বাপ, হ্যাভেন! সরকার আমাকে সেক্স করতে জোর করছে, সরকার নিজের খরচে গ্রুপ সেক্স এরেঞ্জ করে দিচ্ছে, সোমার মত চমৎকার একটা ট্যাবলেট দিচ্ছে, জীবনে আর কি চাই? এই রকম ‘ডিস্টোপিয়া’ কোথায় আছে কেউ একবার বলো, সেখানেই চলে গিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেই! আচ্ছা সে স্বপ্ন পরে দেখি, ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ডে ফিরি। রাষ্ট্র সেখানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রায় সবার জন্যই ওপেন করে দিয়েছে, যার ক্লাস যতো উপরে, তার ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কোয়ালিটি ততোই ভালো। সেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে আবার চোখের সামনে চলা চিত্রের নায়ক নায়িকা কি বোধ করছেন, অনুভব করা যায়। বেশিরভাগ সময়েই ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে সফটকোর পর্ন দেখানো হয়। আর বারবার বলা হয় মন খারাপ লাগলেই বা আনন্দ কম হলেই সোমা খান। চিন্তা করে কি হবে, এর চেয়ে সোমা খেয়ে আনন্দ করাই ভালো……………


আমি এইটাও জানি ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড অনেকেই পড়েন নি তাই আমি স্পয়লার দিবো না , আমি শুধু সেই সমাজটা কিরকম হবে সেটা বর্ণনা করলাম। যাদের আগ্রহ আছে, তারা পড়ে নিতে পারেন, কাহিনীটা খুব চমৎকার। তো ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ডের রাষ্ট্রের দর্শন হচ্ছে নাগরিকদের আনন্দে রাখো, তাদের সুখে ডুবিয়ে দাও, আদের আদিম প্রবৃত্তি জাগিয়ে সেটাকে অনুভূতির চূড়ায় নিয়ে যাও। নাগরিকরা রাষ্ট্র নিয়ে বা রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ে তখন আর কোন প্রশ্ন করার আগ্রহই পাবে না। এখন অনেকেই হয়তো বলতে পারেন যে ধুর ছাই, এমনটা হবে নাকি? রাষ্ট্র তো পারে খালি নাগরিকদের শোষণ করে খেতে। আনন্দ দেয়া তো দূরের কথা। আচ্ছা, এতোক্ষন যা লিখলাম, সেটা পড়ে কি কোনভাবেই আপনাদের মুসোলিনি বা হিটলারের শাসন মনে পড়ে নাই? পৃথিবীতে একটাই উঁচু জাত থাকবে যারা জেনেটিক্যালি আলাদা হবে, বাকিরা সবাই সেই উঁচু জাতের কথাতেই চলবে- ক্লাসিক্যাল ফ্যাসিজমের জন্য কোন শক্ত এক্সাম্পল তো দেয়ার দরকার নেই, এইটাই তো সেটা। হ্যা রাষ্ট্র আমাদের সোমা বা গ্রুপ সেক্স হয়তো এখনো করতে দিচ্ছে না, কিন্তু আমরা যেন সচেতনতা ভুলে থাকি, তার জন্য রাষ্ট্র বা সমাজ এমন কি নেই যা করেনি? আমাদের প্রায় প্রত্যেকের বাসায় দেড়শো দুইশো চ্যানেল আছে, ইউটিউব আছে, কাউণ্টলেস মুভি আছে, প্রত্যেক মোমেন্টে নতুন গান, মিউজিক ভিডিও, ভাইরাল নিউজ, স্কুপ, এন্টারটেইনিং টপিক আসছে, আমরা এতোটা প্রাচুর্যে আছি যে আমরা আক্ষরিক অর্থেই জানি না যে আমরা কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরবো। সহজ থেকে আবার কঠিনে যাই। এই যে ডেইলি এতো মিম শেয়ার করি, একদিন পর পর নতুন ধরনের মিমের টেমপ্লেট আসে, সেফুদা থেকে রিপন খান আসে, হিরো আলম থেকে চাঁদ উঠেছিলো আসে, সাকিব খানের ফালতু মুভি দেখে সালমান খানের গৎবাঁধা মুভি আসে, একটা সপ্তাহ কি শুধু আমরা একটা বিষয় বা একটা ট্রেন্ড নিয়ে টিকে থাকতে পারি? এই যে আমাদের দেশে একটার পর একটা সমস্যা আসছে, আজকে বুলবুল তো কালকে ট্রেন তো পরশু পেয়াজ তো তরশু টেস্ট হার- কোনটা রেখে কোনটা নিয়ে হা হুতাশ করবো একটু নিশ্চিত হতে পারিছি? ছিয়াত্তুরের দুর্ভিক্ষ বা আটাশি আটানব্বইয়ের বন্যা বয়ষ্করা এখনো মনে রেখেছে কারন সেই বছরে বা সেই সময়ে এইটাই ছিলো সবচেয়ে ভয়াবহ খবর। নভেম্বর প্রায় শেষ, এগারো মাসের হিসেব টানি। গুগল বাদ দিয়ে বলুন, এই বছরে দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ তিনটা খবরের নাম, বা দেশের ক্ষতি হয়েছে, এমন পাঁচটা ঘটনার নাম। পারবেন না। এতো ইস্যু, এতো তথ্য, যে আমরা কিসে সচেতন হবো, আমরা গুলিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা আরও একটা ইস্যু দেই। হুট করে কল্লাকাটা গুজবে একজন মা কে গণপিটুনি দিয়ে পিষে ফেলা হলো, নাইন্টিন এইটটি ফোরের হেইট সেশনের মতো শয়ে শয়ে মানুষ ঘৃণার আদিম বিষ ঢেলে দিলো একজন নিরীহ অবলা মানুষের উপর। তার বীভৎসতা দেখে প্রতিবাদমুখর আমরা যেদিন হয়েছি, সেদিন কয়টা মিমে হাহা রিয়েক্ট দিয়েছি? কয়টা জোকস পড়েছি? কয়টা নতুন গান শুনেছি? নতুন কি সিরিজ এসেছে নেটফ্লিক্সে, সেগুলো নিয়ে কয়বার কথা বলেছি? বেতন কবে হবে, সেটা নিয়ে কয়বার ভেবেছি? প্রেমি-প্রেমিকার সাথে ভিডিওচ্যাট বা স্বশরীরে কতোক্ষন উষ্ণ মুহূর্ত বিনিময় করেছি? আজ থেকে ত্রিশ বা চল্লিশ বছর আগে এমন কিছু হলে বিক্ষোভে রাষ্ট্রের সমস্ত নাগরিক ফেটে যেতো, প্রত্যেকটা গনধলাই দেয়া মানুষের বিচার বা ফাঁসি না হওয়া নাগাদ কেউ বিক্ষভ থামাতো না। এই যে কুর্মিটোলার এক্সিডেন্টের পর ছাত্র আন্দোলন করেছে কারা? স্কুলের বাচ্চারা কারন তাদের কাছে এতো কিছুর এক্সেস নেই যেটা বিশ বছরের বেশি কারো কাছে আছে। তাই তারা বিক্ষোভ করতে পেরেছে। কয়জন বাবা-মা রাস্তায় বসে পড়েছিলো? কয়জন? কারন তাদের সামনে ঘটে যাওয়া ইস্যুর শেষ নেই। কোনটা রেখে কোনটায় মন দিবো? অলডাস হাক্সলির ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড এই মানসিক ট্রেন্ড নিয়েই। নাগরিককে নিয়ন্ত্রন করার উপায় হচ্ছে আনন্দ, ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ডের রাষ্ট্রযন্ত্র তাই মনে করতো। একটা ম্যাচিউর রাষ্ট্র নাগরিকদের শোসন করে আনন্দ আর প্রাচুর্য দিয়ে। জর্জ অরওয়েলের সাথে অলডাস হাক্সলির বিরোধ এইখানেই। অরওয়েল ভাবতো ডিস্টোপিয়ান রাষ্ট্র নাগরিকদের সুবিধা দিবে না, বাকস্বাধীনতা দিবে না, আনন্দ দিবে না। হাক্সলি বলছে উল্টো, রাষ্ট্র এতো দিবে যে নাগরিক আর প্রশ্নই করতে পারবে না আনন্দের ঠেলায়। অরওয়েল বলছে নাগরিকদের কথা বলার অধিকার কেড়ে নাও। হাক্সলি বলছে নাগরিকদের কথা বলতে দাও। আমরা সবাইকে এতো আনন্দ দিব যে একজন নাগরিকের কথা শোনার কারো সময় বা ইচ্ছাই থাকবে না। সঠিক কে তাহলে? আমি মনে করি অরওয়েল এবং হাক্সলি দুইজনেই সঠিক। অরওয়েল একটা ইম্যাচিউর রাষ্ট্র কিভাবে ডিস্টোপিয়া চালাবে, সেটার কল্পনা করেছেন আর হাক্সলি একটা ম্যাচিউর বা বুদ্ধিমান রাষ্ট্র কিভাবে ডিস্টোপিয়া চালাবে, সেটার কল্পনা করছেন। আমরা এই কারনে এই পৃথিবীতে দুইটার মাঝামাঝি একটা সেমি ডিস্টোপিয়ান সিচুয়েশন অনুভব করি………..


আচ্ছা, আমরা আবার উপন্যাসের আলোচনায় ফিরে যাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় দুইটা স্পেকুলেটিভ ফিকশন নিয়ে আলোচনা করা হলেও যেই লেখক বা যেই লেখাটার কারনে আজকে সবাই পৃথিবীতে ডিস্টোপিয়া বা স্পেকুলেটিভ ফিকশন নিয়ে এতো কিছু করেছে, আমি এখনো সেটা নিয়ে কিছু বলি নাই। ইয়েভিগিনি জামিয়াতিন নামের একজন রাশিয়ান লেখক ছিলেন, যিনি উই নামের একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। স্পেকুলেটিভ ফিকশনের এক্কেবারে প্রথম দিকের সৃষ্টি বলা হয় একে। এমনকি অরওয়েল, হাক্সলি ,ব্র্যাডবেরি বা কোশারের উপন্যাস যে এই উই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেয়া, তেমনটাও সন্দেহ করা হয়। এমনকি এরা একে অপরের বিরুদ্ধে ঠিক এই অভিযোগটি আনলেও নিজেরা কখনো এটি মেনে নেন নি। সে যাই হোক, উই আমাদের দেখায় একটি ভবিষ্যতের কথা যেখানে একটা সমাজ চলে গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে। রাষ্ট্র যারা চালায়, তারা ধরেই নেয় গণিতই একটা সমাজকে উন্নতির শিখরে পৌছাতে পারে। সেখানে সবাই কাচের বাড়িতে থাকে, যাতে প্রত্যেক মুহূর্ত কি হচ্ছে বা না হচ্ছে, সেটা পুলিস দেখতে পারে। উই যখন লেখা হয়েছিলো, টেলিভিশন বা মনিটরের ধারনা তখনো আবিষ্কার করা হয় নি, তাই ইয়েভগিনি জামিয়াতিন অরওয়েলের মতো দেয়ালের একপাশে স্ক্রিন বসানোর ব্যাপারটা ভাবেননি। সেখানে অসুখী মানুষ দেখলেই তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে, সবাইকে আইন করে বলে দেয়া আছে হাসিখুশি থাকতে। সেখানে আবার কিছুটা কবিতাচর্চা হয়, তাও সেগুলোতে সমাজ আর রাষ্ট্রের গুণগান থাকে। সেখানে পলিটিক্স আছে, ভোটের স্টাইল হচ্ছে মৌখিক। লিডার সবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করেন গতবারের পর এইবারও আমি লিডার হতে চাই, কারা আমাকে লিডার হিসেবে চাও, হাত তুলো। সবাই হাত তুলে কারন এইরকম ক্ষেত্রে হাত তোলা আইন এবং নাগরিকরা আইন অমান্য করতে ভয় পায়। এই পুরো সমাজটা একটা বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা। সেটা প্রায় এক দেড় কিলোমিটার উঁচু। কেউ জানে না তার উল্টোপাশে কি আছে। আমি জানি যে উই উপন্যাসটা অনেকেই পড়েন নাই এবং এইটার প্রিন্ট পাওয়া এত কষ্ট যে পুরো নীলক্ষেত, বাতিঘর বা দীপনপুর খুজলে হয়তো একটা কপি পাওয়া যেতেও পারে বাট না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই অল্প করে কাহিনীটা বলে দিচ্ছি, নায়ক নিজেও মিনিস্ট্রিতে কাজ করেন এবং গণিত নিয়ে আগ্রহী, সে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে যে তাকে দেয়ালের বাইরে নিয়ে যায়। দেয়ালের বাইরের আলাদা জগত দেখে নায়ক হতবাক হয়ে যান এবং লিডারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এর মধ্যে সেই দেয়াল অনেক জায়গায় ভেঙ্গে যায়। লিডার তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে এবং নাগরিকদের বলে বিনা খরচে একটা অপারেশন করে ইমাজিনেশন করার ক্যাপাবিলিটি ফেলে দিতে, যাতে তারা হিউম্যান মেশিন হতে পারে, নিখুত হওয়ার দর্শন শুধু মেশিনের আছে, তাই হিউম্যান মেশিন হওয়ার সার্থকতা আছে। কোন একটা কারনে নায়ক নিজেও কনভিন্স হয়ে এই অপারেশনটা করায় এবং সে তার ডাইরিতে লিখতে থাকে যে সে আর লিডার মিলে বিদ্রোহ থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু এই ভেঙ্গে পড়া দেয়াল সহ সমাজ কি আদৌ ঠিক হবে কিনা, সে বুঝতে পারছে না কারন ইমাজিনেশন তার মধ্যে নেই……………


ইউটোপিয়া বা ডিস্টোপিয়া কি, অথবা সেখানে মানুষের সুখ বা স্বাধীনতাকে কি চোখে দেখা উচিত, সেগুলো নিয়ে বলার আগে একটা উক্তি তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। The freedom to make my own mistake is all I ever wanted- Mance Rayder, The King beyond the wall……


আসলে ডিস্টোপিয়া বা ইউটোপিয়ার কথা আসলেই স্বাধীনতা আর আরামের ব্যাপারটা চলে আসে। আমি সুখ লিখতে গিয়েও লিখলাম না কারন মানুষের মস্তিষ্ক সুখ অনুভব করতে পারে না, পারে আরাম অনুভব করতে। স্বাধীন থাকলে আর যা কিছুই অনুভব করা যায় না কেন, আরাম অনুভব করা যায় না। স্বাধীনতার মূল্য আরাম দিয়ে পরিশোধ করতে হয়। এই যে নাইন্টিন এইট্টি ফোর, ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড, উই, ফারেনহাইট ৪৫১- সবখানেই নাগরিকেরা আরামে আছে। রাষ্ট্রের কথা শুনবে, কাজ করবে, রাষ্ট্র সুবিধা দিবে বা সোমা দিবে, এবং দিনশেষে উদ্দাম আনন্দ হবে। আমি খাঁচায় বন্দি কি বন্দি না- সেটা ভেবে লাভ আছে? আনন্দ তো হচ্ছে? কিন্তু যারা এই নিয়মের মধ্যে নেই? যাদের রাষ্ট্রের সুবিধা নেই, সোমা নেই? তারা? যারা চাইলেই সাইবেরিয়ার কোন এক বরফঢাকা বনে রাতে কোটি কোটি তারার নিচে কাঁপতে কাঁপতে মহাকাশ দেখে, তার শরীর আরাম পাচ্ছে? তার স্বাধীনতা তাকে মুক্তি দিয়েছে, আরাম কি দিয়েছে?
লেখাটার নাম স্পেকুলেটিভ স্পেকুলেশন এই কারনেই যে আমি আসলে কিছু না, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, কিছু না কিছু স্পেকুলেট করার চেষ্টা করেছি। আমরা যে সায়েন্স ফিকশন, ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখা উপন্যাস, ইউটোপিয়া-ডিস্টোপিয়া তুলে আনা উপন্যাস নিয়ে এত লাফাই, সেটা আসলে কেন? আমি নিজেই উপরে প্রমান করার চেষ্টা করেছি আমাদের আশেপাশে কি হচ্ছে বা না হচ্ছে, সেটা দিয়ে অরওয়েল আর হাক্সলির কল্পনা কতোটা সত্যি কি সত্যি না। আমি নিজেই ইয়েভগিনি জামিয়াতিন যেভাবে ভবিষ্যৎ এর পৃথিবীর কথা ভেবে আতংকিত হয়েছেন, সেই পৃথিবীর কথা চিন্তা করে দুঃখ পাচ্ছি। কিন্তু অনেকেই বোধহয় জানে না, যে এই সমস্ত স্পেকুলেটিভ ফিকশন বা ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস আসলে একটা রিডিকিউল, একটা স্যাটায়ার। এইটা মানুষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যে এত যে অন্যায় অবিচার মানুষ করে, সেটার ধারাবাহিকতা যদি মানুষ বজায় রাখে, তাহলে ভবিষ্যতে এমন ভয়াবহ অবস্থাই হবে। আমরা হয়তো ভবিষ্যতে কন্সট্যান্ট নজরদারীতে থাকবো, হয়তো ভবিষ্যতে আমরা সেক্স ক্রেইভড রোবটে পরিনত হবো, হয়তো ভবিষ্যতে স্বাধীনতা আর সৃজনশীলতা বাদ দিয়ে আমরা রাষ্ট্র বা সমাজের প্রতি আনুগত্যকে বেশি জোর দিবো। অরওয়েল, হাক্সলি, ব্র্যাডবেরি, কুশার, জামিয়াতিন- সবাই এই উপহাসটা বোঝানোর জন্যই ডিস্টোপিয়া নিয়ে লিখেছেন, আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন যে আমরা যে পথে এগিয়ে যাচ্ছি, তার ফলাফল খুব ভয়াবহ হবে। প্রলয় ছাড়া ডিস্টোপিয়া সম্ভব না, এবং সেই প্রলয় শুধু একটা পারমানবিক যুদ্ধ বা ভয়াবহ কোন সুনামি থেকেই আসবে, তেমনটা না। আমাদের যান্ত্রিক জীবনের সাথে আদিম প্রবৃত্তি মিলিয়ে ফেলার যে অশ্লীল কামনা, তা আমাদেরকে এখন প্রাচুর্যে ডুবিয়ে রাখলেও একসময় আমরা হতাশ হয়ে যাবো, সোমার মতো কৃত্তিম ড্রাগ ছাড়া আমরা সুখে থাকতে পারবো না। এমন অনেক কিছুই হতে পারে, আবার আমরা না চাইলে হয়তো নাও হতে পারে। হওয়াটা শুরু হয়ে গেছে, সেটা খুব কম মানুষই ধরতে পারছে, সেটাই আসলে সমস্যা………


লেখাটির জন্য বেশ কয়েকটি ডিস্টোপিয়া নিয়ে লেখা উপন্যাস পড়তে হয়েছে, মেনশন করা উপন্যাসগুলো আসলেই চমৎকার এবং অনুরোধ থাকবে সুযোগ পেলে কিনে পড়ে ফেলার। বেশ কয়েকজন বক্তা স্পেকুলেটিভ উপন্যাসকে সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাদের রিভিউগুলোও লেখাটায় কাজে লেগেছে, চাইলে রেফারেন্স দিয়ে দেয়া যাবে। যারাই পড়েছেন, তাদেরকে জানাচ্ছি ধন্যবাদ…………..

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:১৭

সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: ভাই এতো বড় লেখা!

০৩ রা জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:২৯

ট্রিপল এ বলেছেন: আগের লেখা তো, এই কারনে বড়ো। পাঁচ ছয় বছর পর সামুতে ঢুকলাম, এখনকার ব্লগগুলো কেমন সাইজের, চেক করতে হবে আগে! মনে হচ্ছে টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যতে চলে এসেছি, সব নতুন লাগছে!

২| ০৩ রা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৫

আধুনিক চিন্তাবিদ বলেছেন: ব্যাপারটা আমার কাছে কঠিন লেগেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.